আর পাঁচটা দিনের মতো মোবাইলের সেট করা অ্যালার্মে সকাল ছটায় ঘুম থেকে উঠে পড়েছে মিলি। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকিয়ে মাথায় হাত ! সারা রাতের বৃষ্টিতে হাউজিংয়ে প্রায় এক হাঁটু জল জমে গেছে। কি করে ডিউটি যাবে ও? তাড়াতাড়ি মোবাইলটা নিয়ে ড্রাইভার দাদাকে ফোন করে।
“দাদা আসছেন তো?“
তপন দা সহাস্যে উত্তর দেয় “হ্যাঁ ম্যাডাম জানি, আপনাকে তো যেতেই হবে। তাই সাঁতার কেটে হলেও যাব।“
তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নেয় মিলি। গাড়িতে উঠতে গিয়ে প্রায় কোমর অব্দি ভিজেই যায়।
“যেদিকে একটু কম জল জমে আছে সে দিক দিয়ে চলুন দাদা।“
“গোটা কলকাতাই তো প্রায় জলের তলায় ম্যাডাম।“
“সে হোক, আপনি সাবধানে চলুন, বেরিয়েছি যখন ঠিক পৌঁছে যাব।“
আর কথা বাড়ায় না মিলি। গাড়ির স্পিকারে পছন্দের রবীন্দ্র সঙ্গীত চালিয়ে পেছনের সিটে একটু গা এলিয়ে বসে। গোটা রাজ্যে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছে। মিলি বেশ কয়েক বছর হল এক সরকারি নার্সিংকলেজে পড়ায় । সরাসরি পেশেন্ট কেয়ার নর্মালি দেয় না। কিন্তু এই অতিমারীর সময়ে প্রায় সমস্ত স্বাস্থ্যকর্মীদেরই ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছে। প্রথম প্রথম একটু ভয় ভয় করলেও এখন বেশ ভালই লাগছে নতুন রোলে কাজ করতে। সুপার ভাইজার হিসেবে প্রতিটি ওয়ার্ডে রাউন্ড দিয়ে দেখা। বেশিরভাগ সময় অবশ্য সিসিইউতেই থাকতো মিলি। ওখানেই তো আসল ক্রাইসিস। স্টাফেদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাজও করে রুগীদের অবস্থার একটু উন্নতির জন্য। সে এক অন্যরকম ভালোলাগা।
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে এখনও। রাস্তা ঘাট বেশ ফাঁকা। চাকাডোবা জলে সশব্দে গাড়ি এগিয়ে চলে মাঝারি গতিতে। মিলির মনটা আজ বেশ খুশি। বেড নাম্বার ফোরের ছেলেটার মুখটা ভেসে উঠছে বারবার। সমরেশ মন্ডল। মাঝারি বর্ণ। গোলগাল চেহারা। মাথাভর্তি কোকড়ানো চুল। চোখ দুটো দেখলেই বোঝা যায় বুদ্ধিদীপ্ত। বয়স আঠাশ। এই কয়েক দিনের আলাপে ও ছেলেটির ব্যবহারে ওকে ভাইই মনে হয় মিলির। বেশ কিছুদিন ভর্তি আছে সিসিইউ ওয়ানের বেড নাম্বার ফোরে। কাঁচের দরজা খুলেই ঠিক বাঁহাতে পড়ে বেডটা। অবস্থার উন্নতি হয়েছে আগের চেয়ে অনেকটা। প্রথম দিন ডিউটি অন হয়েই মিলি দেখেছিল ছেলেটির কি ধৈর্য ও সহনশীলতা! ডাক্তারবাবু দু-তিনবার ডানহাতে চ্যানেল করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলে অনায়াসে বাঁহাতটি এগিয়ে দিয়ে বলেছিল আপনি এই হাতে চেষ্টা করে দেখুন। বড় মায়া জড়ানো চোখ দুটো। সারা ঘরে মনিটরের পিপ পিপ শব্দের মাঝে ঐ একটি সদাহাস্যময় মুখ যেন বাকি রুগীদেরও মনে সাহস যোগাতো। প্রথমদিকে সব সময় সিপ্যাপ মেশিনে থাকা ছেলেটি একটু এদিক-ওদিক পাশ ফিরলেই বা দুঢোক জল খেতে গেলেও তরতর করে স্যাচুরেশন নেমে যেত। এখন অনেকটাই ভালো। গতকালের কোভিড রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে তাই আজ ওকে কোভিড হসপিটাল থেকে সরিয়ে নর্মাল হসপিটালের নর্মাল ওয়ার্ডে পাঠানোর কথা। ওখানে কিছুদিন অবজারভেশনে রেখে ছুটি দেবে হয়তো। এতগুলো দিন বাড়ির লোকজন থেকে আলাদা রয়েছে। নর্মাল ওয়ার্ডে গেলে সবার সাথে দেখা হবে, তাই স্যার রাউন্ডে এসে যখন বলেন “কাল তোকে নর্মাল বেডে দেবো।“ বেজায় খুশি হয়েছিল সে। সদাহাস্যময় মুখের হাসি আরো চওড়া হয়েছিল। একদিন মিলিকে ডেকে বলেছিল “জানেন তো আপনাদের দেখলে মনে সাহস হয় আর একটা অদ্ভুত কথা মনে হয়। আপনারা যখন সাদা পিপিই পড়ে চারপাশে ঘুরে বেড়ান মনে হয় আমরা বুঝি পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন অন্য কোনো গ্রহে আছি আর এলিয়েনরা আমাদের চিকিৎসা করছে।মিলি পিপিই র আড়ালে সশব্দে হেসেছিল “হা হা.....” বলেছিল, “তোমার মনটা বড্ড সরল, দেখবে খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে তুমি।“
“সুস্থ্য তো হতেই হবে দিদি। নতুন চাকরী জয়েন করেছি সল্টলেকে। বাবা-মায়ের অনেক আশা আমাকে নিয়ে। একমাত্র ছেলে তো।“ মাথাটা নামিয়ে লাজুক হেসে বলেছিল “বিয়েও সামনে, মহামারীর প্রকোপ কমে গেলেই বিয়ে। জেনারেল ওয়ার্ডে গেলে ওর সাথে দেখা হবে।“ “নিশ্চই দেখা হবে । খুব ভালো খবর।খুব সুখী হবে তোমরা।“ তারপর আরো নানা কথায় বড় আপন হয়ে গিয়েছিল ছেলেটি। শুধু মিলি নয় গোটা ওয়ার্ডের মেডিকেল নন-মেডিকেল সব স্টাফেদেরই খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিল সমরেশ এই কয়েকদিনেই। আজ ছেলেটা অন্য হসপিটালে চলে যাবে ওয়ার্ডটা পুরো ফাঁকা হয়ে যাবে। তবু তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে বাড়ি ফিরে যাক মনে মনে বলতে বলতে কোনও অদৃশ্য শক্তির কাছে হাতজোড় করে মিলি।
হঠাৎ হালকা ঝাকুনিতে সম্বিৎ ফেরে। “ম্যাডাম এখানেই নামতে হবে। একটু জল কম আছে এদিকে আর বৃষ্টিটাও একটু কমেছে। “
“আটটা দশ! ইসস দেরী হয়ে গেল।“ চুরিদারের পা গুটিয়ে গোড়ালি ডোবা জলে পা চালিয়ে দ্রুতগতিতে ভেতরে যায় মিলি। নার্সিং সুপারিনটেনডেন্টের অফিসে সই করে সোজা ডনিং রুমে পিপিই পরে চলে আসে সিসিইউর সামনে। দরজা ঠেলেই বাঁ দিকে তাকায় মিলি। ওমা! আজকে ছুটি হওয়ার কথা ছিল যে ! কাল ইভিনিংয়েই কি তাহলে সিফট করে দিল! নার্সিং সেন্টারে গিয়ে বলে “সমরেশকে কখন সিফট করলো সিস্টার?”
সিস্টার এক অদ্ভুত চাহনিতে তাকিয়ে বললেন “গুডমর্নিং ম্যাডাম।“
“গুডমর্নিং।বলছি, সমরেশকে কখন সিফট করা হল?” কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে সে উত্তর দিল “সমরেশ নেই। “
“নেই মানে?”
“কাল সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ এক্সপায়ার করে যায়। বিকেল পাঁচটা থেকে হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হয় ওর। তারপর অনেক চেষ্টা করেও.....”
আর কোনো কথা কানে আসে না মিলির। ফেসশিল্ড আর গগলসের ভেতরে চোখ দুটো ঝাঁপসা হয়ে আসে। মনে হয় গোটা সিসিইউটা যেন দুলছে।গলাটা কেমন যেন বুজে আসে। কোনোরকমে পাশের চেয়ারে বসে পরে। গোটা সিসিইউ আজ থমথমে। মনে মনে বলে “যেখানেই থাক ভালো থাক ভাই........ ভালো থাক।“
মিনিট পাঁচেক মনটা শান্ত করে আবার কাজে ফেরে। বেড নাম্বার ওয়ানের ঠাকুমার সাচুরেশন আজ একটু ভালো। আটের ভদ্রলোক ভেন্টিলেশন থেকে বেড়িয়ে সিপ্যাপে এসেছে। ভাইটালস এর চার্ট, ইনটেক আউটপুট চার্ট মেলাতে থাকে মিলি। একটু বেশিই ব্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করে মিলি। এই অসম লড়াইয়ে আর যেন কোনো ভাই না হারায়, কোনো বাবা মা তাদের একমাত্র সন্তান না হারায়।