_'ভেতরে আসতে পারি'? মিষ্টি গলার মেয়েলি কন্ঠস্বর। সৌমিত্র দেখল অল্প বয়সি একটি কাপল। ফিটফাট পোষাক। দুজনেই দেখতে সুন্দর।
ছেলেটি বলল, স্যার আপনি আমাকে চিনতে পারবেন না। আমার নাম মিহির সেন। হরিপুরের সৌদামিনী হাই স্কুলের অঙ্কের মাষ্টারমশাই দশরথ সেনের ছেলে।
দশরথ সেন। নামটা উচ্চারণ হতেই সৌমিত্রর বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। ফর্সা পাটভাঙ্গা ধুতি পাঞ্জাবি পরা ক্লান্ত একটা মুখ। ততোধিক ক্লান্ত তার কন্ঠস্বর।
চৌদ্দ পনেরো বছর আগের কথা।
কোন একটা শুক্রবারে প্রায় বিকেল পাঁচটার সময় ওরা এসেছিলেন। দশরথ সেন আর তার সহধর্মিণী অনুরাধা সেন।
–'স্যার আমাদের দয়া করতে হবে। আমাদের একমাত্র ছেলে মিহির, বিদেশে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। ওর টাকা পয়সা জমা দেবার শেষ তারিখ আগামী কাল। ভদ্রমহিলার দিকে হাত তুলে বলেছিলেন, ওর দাদা বলেছিল টাকাটা জোগাড় করে দেবেন। কিন্তু পারেননি। এখন কী হবে স্যার, আমার ছেলের এতবড় সুযোগটা নষ্ট হয়ে যাবে?
চমকে উঠেছিল সৌমিত্র।
ব্যাংকের ম্যানেজার যখন, তখন এধরনের আবেদন নিবেদন মাঝেমধ্যেই শুনতে হয়।সৌমিত্র কিছু বলার আগেই মাষ্টারমশাই বললেন, আমাদের একটা এডুকেশনাল লোন করে দিতেই হবে স্যার।
–'বলছেন কী'! যেন আকাশ থেকে পড়লো সৌমিত্র। 'এডুকেশনাল লোন! সে তো অনেক কাগজপত্র, অনেক অনুসন্ধান। অনেক আইনি জটিলতা। কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকলেও দু তিন দিন সময় তো লাগেই?
'তবুও করে দিতে হবে স্যার। কাল বেলা বারোটার মধ্যে। অনুরাধা সেন বললেন, আপনি আমার ছেলের মতো। মায়ের জন্য এ কাজটা করতে পারবেন না?
সৌমিত্র তাকিয়ে দেখল ভদ্রমহিলার চোখে জল। ভদ্রলোকের চোখে নিরাশার অন্ধকার।
সৌমিত্রর মনে হলো সঙ্গের কাগজপত্র যদি ঠিক থাকে তা হলে সারারাত জেগে কাজটা করে দেওয়া অসম্ভব নয়। একটু কষ্ট হবে এই যা। অন্যান্য অনুসন্ধান পরে করলেই হবে।
সেদিন প্রায় সারা রাত জেগে দু'জন সহকারী নিয়ে লোনের সমস্ত ডকুমেন্টস তৈরী করে রেখেছিল সৌমিত্র, যাতে পরের দিন এগারটার মধ্যে টাকাটা পাঠানো যায়।..........
..... তার পর দিন, মাস, বছর গড়িয়ে গেছে।
সৌমিত্র তখন বহরমপুরে।
একদিন অঙ্কের মাষ্টারমশাই আর তাঁর স্ত্রী অনুরাধা ব্যাঙ্কে এসেছিলেন। কাঁধে ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগ থেকে একটা এ্যালুমিনিয়ামের বাটি বের করে বললেন, আপনার জন্য একটু পায়েস করে এনেছি। অনুরাধা খাইয়ে দেবে। আপনি খাবেন তো স্যার?
সৌমিত্র না করতে পারেনি। ওর তখন মার কথা মনে পড়েছিল। মাষ্টারমশাই বললেন, ছেলে এখন বিলেতি কম্পানিতে কাজ করছে। মাসিক মাইনে ত্রিশ লাখ। আমার সারা জীবনের রোজগার। সব আপনার জন্য সম্ভব হয়েছে। শ্রীমান নিজে পছন্দ কিরে বিয়েও করেছে। ওদেরই কম্পানির একজন বাঙ্গালি আফিসারের মেয়ে। খুব ভাল আছে ওরা। সুখে আছে।আমরাও সামনের মাসে লন্ডন যাচ্ছি। এখন ওখানেই থাকবো। বুড়ো বয়সে নাতি নাতনিদের নিয়ে থাকার সুখই আলাদা। গত মাসে রিটায়ার করেছি। কাজেই কোন পিছুটান নেই। দুজনের চোখে মুখেই একটা আগামী সুখের ইঙ্গিত খুঁজে পেল সৌমিত্র।
সৌমিত্র হেসে বলল, এর চাইতে ভাল খবর আর কী হতে পারে মাষ্টারমশাই, ভাল থাকবেন।এখানে আসলে অবশ্যই দেখা করবেন।
........দু'বছর পরের ঘটনা।
সৌমিত্র তখন আসানসোলে। অফিসে এসে মাষ্টারমশাই আর অনুরাধা দুজনেই খুব কাঁদলেন। অঝোরে অবিরাম সেই কান্না।
মাষ্টারমশাই বললেন, হলনা স্যার। সুখ জিনিসটা বড় চঞ্চল। কখন, কীভাবে আসবে কেউ জানে না।আমরাও তাকে খুঁজে পেলাম না।ওরা আমাদের ফেরৎ পাঠাল। মুখ বুজে শান্তি রক্ষার তাগিদে ফিরে এলাম।
অনেকক্ষণ অতীত হাতড়ালো সৌমিত্র। রুমাল দিয়ে মুখ মুছলো। জল খেল। কেন জানি নিজেকে পরাজিত মনে হল। তারপর মিহিরকে বলল। তা এত বছর বাদে আমার এখানে কেন? লোন তো শোধ হয়ে গেছে। মিহির বলল, স্যার, লোন শোধ হয়ে গেছে। কিন্তু, ঋণ শোধ হয়নি। বাবার মুখে শুনেছি, আমার জন্য আপনি যা করেছেন, কেউ তা করেনা।
বাবা মারা যাবার এক বছরের মধ্যে মা ও মারা গেলেন। বাড়িটা খালি পরে আছে। ভাবছি বিক্রি করে পাকাপাকি ওখানেই থাকবো।
সৌমিত্র একরাশ বিরক্তি মুখে এনে বলল, বেশ তো চলে যাও। তা আমার কাছে এসেছো কেন?
মিহির বলল, আপনার খোঁজে হেড অফিস গিয়ে শুনলাম সামনের মাসে আপনার রিটায়ারমেন্ট। তাই প্রণামী হিসেবে একটা উপহার এনেছি। এতক্ষণ চুপ করে থেকে মেয়েটি বলল, আপনি না করবেন না কাকু। মা, বাবারও খুব ইচ্ছে ছিল।
এবার কেন জানি চোখ দুটো জ্বালা করে উঠল সৌমিত্রর।
–কিন্তু উপহার তো আমি আগেই পেয়ে গেছি মিহির।
বিস্মিত হয়ে মিহির বলল, সে কি! কে দিয়ে গেছে উপহার?
সৌমিত্র বলল, তোমার মা আর বাবা দুজনেই।
–কী দিয়ে গেছে স্যার?
সৌমিত্র বলল, তাঁদের জমিয়ে রাখা দু'ফোঁটা করে চার ফোঁটা চোখের জল।.......