সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon

আশ্রয়

আশ্রয়
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^

ব্যালকনির দরজাটা খুলতেই গাছগাছালি আর ফুলে ভরা টবগুলো সুবিমলবাবুর দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল। প্রতিদিন সকালের ঠিক এই মুহূর্তটির জন্য আরও কিছু বছর বেঁচে থাকবার সাধ জাগে। মনে হয়, পৃথিবীটা কত সুন্দর। ফ্ল্যাটের ছোট পরিসরে স্ত্রী সুরমার হাত ধরেই এগুলোর শুরু। সুরমার চলে যাওয়ার পাঁচ বছরে এদের সঙ্গে আরও গভীরে জড়িয়েছেন, আনন্দ খুঁজে নিয়েছেন এদের যত্নে, পরিচর্যায়। সুরমা না থেকেও থেকে গেছে এদের মধ্যে। জল দিয়ে টবগুলোর মাটি ভিজিয়ে রোদ চড়া হওয়ার আগেই বাইরের দিকে পা বাড়ালেন সুবিমলবাবু।
প্রতিদিন নিয়ম করে এই জায়গাটিতে আসেন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। আগে যাদের সঙ্গে সময় কাটাতেন তাদের কাউকেই আজকাল আর বিশেষ পছন্দ হয় না। দেখা হলেই বড় বেশি কথা বলে সবাই। সংসারের কথা, পাওয়া না পাওয়া নিয়ে অনুতাপ, শারীরিক সমস্যা, রাজনীতি, ছেলের বৌয়ের নিন্দে, জামাইয়ের প্রশংসা এমনকি টিভি সিরিয়ালের এপিসোড - কিছুই বাদ যায় না সেই তালিকা থেকে। এদের একপ্রকার এড়িয়েই চলেন সুবিমলবাবু। নিজের মতো থাকতেই ভালো লাগে।
এই বন্ধুদের কাছে এসে শিখেছেন, মৌনতাও কথা বলে। উনি নিজের মনের সব কথা এখানে এসে উজাড় করে দেন। এখানে এলে মনের কথাগুলো, কষ্টগুলো সব মনে মনেই কেমন বলা হয়ে যায়। খুব হালকা লাগে। কোথাও একটা সংযোগ করতে পারেন এদের সঙ্গে। আশ্চর্য এক শান্তি আছে এখানে। এরাও বলে, এদের শেকড়ের কথা, বেড়ে ওঠার গল্প, কিছু মানুষের অমানবিকতার কাহিনী। এই বন্ধুরা তাঁর মন কেমনের আশ্রয়, তাঁর বিষন্নতার শীতল ছায়া।
আগে দাদুভাইও আসত মাঝেসাঝে এখানে। কিছুদিন যাবৎ তার সবকিছুই বন্ধ করে দিয়েছে বৌমা। অন্যমনস্কতার জন্য ছোট ছোট ভুল করে পর পর কতগুলো পরীক্ষায় ওর নম্বর কমে যাওয়া কিছুতেই মানতে পারছে না সে। দাদুভাই এখন ক্লাস ফোর। বৌমার ইচ্ছে ওকে নামকরা স্কুলে ভর্তি করবে এরপর। রেজাল্টের ধারাবাহিকতায় ক্রমাগত দাদুভাইয়ের এই পিছিয়ে পড়া নিয়ে আশাহত বৌমার সঙ্গে বাবুর মতবিরোধ, বচসা, অশান্তি, রাগারাগি চলছে বেশ অনেকগুলো দিন ধরে। অফিস থেকে ফিরতে আজকাল অনেকটাই দেরি হয় বাবুর। বৌমার অভিযোগ কানে আসে। ওকে, দাদুভাইকে সঙ্গ না দেওয়া নিয়ে। বাবুর কল্পনাপ্রবণ, আবেগপ্রবণ মনটা দাদুভাইও পেয়েছে সেটা ওর সঙ্গে কথা বললে টের পাওয়া যায়। বাবুর তেমন উচ্চাশা ছিল না কোন কালেই। বৌমা সে নিয়েও বলে মাঝেসাঝে, 'উচ্চাশা ছিল না বলেই এমন দুর্ধর্ষ রেজাল্ট আর ট্যালেন্ট নিয়ে কলকাতাতেই পড়ে থাকলে।' বৌমাও বরাবর ভালো রেজাল্ট করা মেয়ে। বেশ ভালো একটা চাকরিও করত সে। দাদুভাই হবার পর ওর একমাত্র ধ্যান জ্ঞান সবই ওই ছেলে।
নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে বন্ধুদের কাছে গিয়ে বেঞ্চটায় বসলেন সুবিমলবাবু। তাদের দিকে তাকিয়ে যেন স্বগতোক্তি করছিলেন তিনি। বাবু খুব ক্লান্ত থাকে আজকাল। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে অফিসে অনেক কিছুর সঙ্গে সমঝোতা, বাড়িতে চাপ, সেই অনুভূতিপ্রবণ মনটা হারিয়ে গিয়েও কোথাও আশ্রয় খোঁজে। এত কাজের ভিড়েও তাই একাকীত্ব গ্রাস করে ওকে।
মেঘনাও খুব একলা আসলে। সুরমার ছায়া সরে গেছে মাথার ওপর থেকে, এত ভালো একটা ক্যারিয়ার নিয়ে কিছু না করে বসে থাকবার অবসাদ সবকিছু মিলে সে আশ্রয় করে ঋভুকে। ওর চাওয়া পাওয়া সবটা চাপিয়ে দেয় ছোট্ট ছেলেটির ওপর। ঋভুর মনমরা মুখের দিকে তো আজকাল কষ্ট হয় তাকাতে। সবকিছু থেকে সরে গিয়ে আরও অমনোযোগী হয়ে পড়ছে সে। চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এল সুবিমলবাবুর।
কয়েকদিন পর....
আজ ছেলেকে অফিস ছুটি নিতে বলেছেন সুবিমলবাবু। অভিলাষের যে এ নিয়ে কতবার প্রশ্ন করা হয়ে গেল, বাবার শরীর খারাপ লাগছে কিনা। এর আগে এমন আবদার কখনো করেননি বাবা। দাদুভাইকেও আজ স্কুলে যেতে দেননি। সকাল সকাল ওদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন সুবিমলবাবু।
'আমরা কোথায় যাচ্ছি দাদু?' হাত ধরে থেকে প্রশ্ন করে ঋভু। 'আমার বন্ধুদের কাছে নিয়ে যাচ্ছি তোমাদের। চাইলে তোমরাও ওদের বন্ধু হতে পারো।'
সবুজ গাছপালায় ঘেরা খোলামেলা জায়গাটিতে এসে ওরা সকলেই প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নিল। বিয়ের পর পর কয়েকবার অভিলাষের সঙ্গে মেঘনা এসেছে এখানে। ঋভুও দাদুর সঙ্গে এসেছে আগে কয়েকবার। কিন্তু আজকের এই সবাই মিলে আসাটা কেমন অন্যরকম ভালোলাগার। বড় বড় গাছগুলো ছায়া নিয়ে, চোখের সবুজ আরাম হয়ে ডালপালা ছড়িয়ে সত্যিকারের বন্ধু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
হাতের ব্যাগটি ঋভুকে দেখিয়ে সুবিমলবাবু বললেন, 'এর ভেতর তোমার বন্ধুরা আছে।' ব্যাগ থেকে ক্রমশ ছেলে, বৌমা ও ওনার হাত ধরে অনেকগুলো চারাগাছ বেরিয়ে পড়লো। সবাই মিলে গাছগুলোকে জায়গা মতো লাগিয়ে দেওয়া হল। সুবিমলবাবু বলছিলেন, 'জানো দাদুভাই, আজ বসুন্ধরা দিবস। আজ আমাদের এই পৃথিবীর দিন। পৃথিবী আমাদের কতকিছু দিয়েছে। যে দেওয়াতে কোনো শর্ত নেই, কোনো স্বার্থ নেই। কিন্তু আমরা কী দিয়েছি পৃথিবীকে? কেউ কী ভেবে দেখি কখনো? পরিবেশের সবচাইতে উপকারী বন্ধু হল গাছপালা। আমরা মাঝেমাঝে যদি কিছু গাছ লাগাতে পারি, তাহলে প্রাণের স্পন্দন জাগবে পৃথিবীতে। প্রকৃতির এই বন্ধুরা তাদের সবটুকু দিয়ে শুধু ভালোবাসতে জানে। এদের কাছে এলে শান্তির যে আশ্রয় মেলে তার সঙ্গে কোনোকিছুর তুলনা চলে না।'
অভিলাষ আর মেঘনাও ভাবছিল, বাড়ির কত কাছে এমন সুন্দর একটি জায়গা আছে যেখানে এলে নিমেষে মন ভালো হয়ে যেতে পারে। কিন্তু জীবনের ছোট ছোট চাওয়া পাওয়া নিয়ে ব্যস্ততায়, সম্পর্কের টানাপোড়েনে নিজেদের বাইরেও যে একটা পৃথিবী আছে, সে কথা ওরা প্রায় ভুলতে বসেছিল।
সুবিমলবাবু বলে চলেছিলেন, 'তোমরাও এখন থেকে সময় বের করে এখানে আসবে। দেখবে চারাগাছগুলো কত বড় হল, কীভাবে ডালপালা ছড়ালো, পাতায় পাতায় বাতাসের শব্দ তুলে কী কী কথা বলল। একটা সময় আসবে যখন আমি এই পৃথিবীতে আর থাকব না। ব্যালকনির গাছগুলোর মধ্যে যেমন ঠাম্মি বেঁচে আছেন, এরাও আমার কথা মনে করাবে তোমাদের। বাড়ির বারান্দার বন্ধুদের যদি একটু সময় দাও দেখবে তারা তোমাকে মুক্ত বাতাস দেবে, সবুজ পাতা দেবে, রংবেরঙের ফুল দেবে কত। এরা কখনো একা হতে দেবে না তোমাদের।'
ছোট ছোট চারাগাছগুলো তখন মাটির সঙ্গে তাদের শেকড়কে গেঁথে নিচ্ছিল নিবিড় করে। বৈশাখী বাতাসের দোলা নিয়ে ওদের ছোট ছোট প্রাণ বলছিল, 'আমাদের নিজেদের মতো করে বড় হতে দাও। আমাদের স্বপ্নগুলোকে ডালপালা মেলতে দাও স্বাধীন ভাবে। তারপর.... তারপর আমরাই তোমাদের ভরসা হব.. আশ্রয় হব.....।'

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri