সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
24-November,2022 - Thursday ✍️ By- সৌগত ভট্টাচার্য 212

আলোর বেণু

আলোর বেণু
সৌগত ভট্টাচার্য
-----------------------

"অনেক দিনের টার্গেট আজ ধরতে পেরেছি!"
"কোথায় কোথায়?"

মাটি থেকে ছয় ইঞ্চির মত শাটারটা উঁচু করা, সেই ফাঁক দিয়ে রাস্তার আলো ঢুকছিল অন্ধকার চৌকো ছোট্ট দোকান ঘরটায়। সেই আলোই যথেষ্ট কাজের জন্য। কাজ প্রায় শেষের দিকে। বাইরে থেকে কে যেন ঝপ করে শাটারটা নামিয়ে দেয়। নিমেষে রক্ত হিম হয়ে গলা শুকিয়ে যায়, কাঠ হয়ে থমকে যায় চিকু। বাইরে বাজির শব্দ আর পিকনিকের মাইকের আওয়াজ। রাত শেষে মহালয়া। বন্ধ অন্ধকার দোকানের ভেতর বাজির শব্দ যেন বুকে এসে ধাক্কা দিচ্ছে। চিকুর সঙ্গে মোবাইল নেই, কাজে আসার সময় ফোন নিয়ে আসে না। কতবার মোবাইল জুয়ার বোর্ডে হেরেছে আবার নতুন ফোন তুলেছে। রাত দুটো আড়াইটে বাজে বোধহয়। চিকু বড় বড় চোখে অন্ধকারের মধ্যে বন্ধ শাটারটার দিকে তাকায়। মাঝে মাঝে বাজির আলো শাটারের নীচে দিয়ে এসে অন্ধকার দোকান ঘরটা আলো করে আবার নিমেষে অন্ধকার করে দিচ্ছে। মশা কামড়ালেও মশা মারতে পারছে না সে। সমানে পা নাড়িয়ে মশা তাড়াচ্ছে। একসঙ্গে পাঁচ রকম গান আর বাজি পোড়া বারুদের গন্ধ চিকুর কানে নাকে আসছে। 

"কখন ঢুকেছে?"
"জানি না, শুয়রের বাচ্চাটা কখন ঢুকেছে! তবে মনে হয় না খুব বেশিক্ষণ ... "

চিকুর ডাগর চোখটা অসম্ভব মায়া জড়ানো। যেদিন প্রথম কাজের জন্য চিকু পল্টনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, একটা বারমুডা পড়া পাটপাট করে চুল আঁচড়ানো। ওকে দেখে পল্টনের মত অভিজ্ঞ চোখও বিশ্বাস করতে পারেনি যে ছোকরা এই লাইনের মাল। বাপ-মা মরা ছেলেটার প্রতি পল্টনের বারবার একটা বাড়তি স্নেহ আছে। চিকু মাথা নিচু করে পল্টনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর বয়েস তখন পনেরো হবে। এই পল্টনের দলেই ওর দশ বছরের বেশি কেটে গেল। রাতের শিফটে কাজ করতে চাইত না সে, ঘুম আসত শুধু। দিনের বেলায় কাজ করত সে পল্টনের দলের হয়ে। সারাদিন শুকনা টানলে রাতে তো মরার মত ঘুম হবেই। ইদানীং দিনের বেলায় অন্য ধান্দা করে রাতের শিফটে পল্টনের কাজ করে চিকু। দাদা বউদির সংসারে একফালি চৌকিতে কাজ করে এসে পঁচিশ বছরের কাকলাশ শরীরটি মরার মত পরে থাকে। বাড়ির লোক জানে, চিকু পল্টন নামের কারো গোডাউনে মাল সাপ্লাইয়ের কাজ করে। মাল ঢুকলে নাইট শিফটে কাজ।

"পুলিশে খবর দিয়েছ?"
"না না পুলিশ-টুলিশ পরে হবে! আজ শালা হাতের সুখ করব মাইরি!"

এমন তো আর এই প্রথম না। স্টেশন বাজার থেকে সাইকেল চুরি করতে গিয়ে বাজারের মধ্যে প্রথম ধরা পড়ে চিকু। পকেট কাটতে গিয়ে অনেকবার ধরা পড়েছে। রাস্তায় ফেলে পিটানোর সময় কে না লাথ মেরেছে, নখ তুলেছে, গরম জল ঢেলেছে, পেটে লাথ খেয়েছে। লোকে ক্যালানোর সময় বলে, চিকুদের গায়ে নাকি মন্ত্র পড়া তাবিজ ঢোকানো থাকে ব্যথা লাগে না। তখন আবার বাঁশ দিয়ে বুট জুতা দিয়ে মাথায় মারে, মেরে মুখ ফাটিয়ে দেয়। অনেক পরে পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। হাসপাতালে গিয়ে সেলাই করতে হয়। পল্টন তখন থানা পুলিশ উকিল সমালায়। এই লাইনে গুরু ছাড়া একা কাজ করা যায় না, থানা পুলিশ উকিলের বহুত লাফরা। ধরা পড়লে চিকু বাড়িতে ফোন করে বলে ওভার টাইম চলছে। দুই তিনদিন বাদে বাড়ি ফিরবে সে। যদিও বাড়ি ফেরা না ফেরার ফোনের কেউ অপেক্ষা করে না। দুই চার দিনে মারের দাগগুলো একটু হলেও শুকিয়ে আসে। বাড়ির লোক ভাবে নেশা করে পড়ে থাকার বা মারামারি করার দাগ।

"অনেকদিন ধরে এই গ্যাংটাই এই এরিয়ায় চুরি করেছে!"
"পঞ্চাশ টাকার পেট্রোল নিয়ে আয়..."

শাটার নামানো দোকানের বাইরে কৌতূহলী গলার আওয়াজ বাড়ে, চোর ধরা পড়েছে শুনে। সকাল হলে চোর পেটানোর লোক জড়ো হবে। শাটার নামানো অন্ধকার দোকানের ভেতর থেকে বাইরের পৃথিবীর সব গান হাসি উল্লাস শুনতে পায় চিকু। কয়েকটি মাতাল বাইক নিয়ে বাওয়াল করছিল একটু আগে নিজেদের মধ্যে। পিকনিকের আধ সেদ্ধ মাংসের গন্ধ ভেসে আসে চিকুর নাকে। শুকনো গলায় থুতুও গিলতে পারছে না সে। যেটুকু নেশা সন্ধ্যায় করেছিল সেটা অনেক আগেই কেটে গেছে। খিদে তেষ্টায় শরীর অসার হয়ে আসছে, হাড়মাস যেন এক হয়ে যাচ্ছে পঁচিশ বছরের শরীরে। জ্বলজ্বল করছে শুধু দুটো চোখ। আজ নদীর চরে  খাসির মাংস আর দারুর পিকনিক ছিল চিকুর। 

"....পুলিশকে দিয়ে কোনো লাভ হবে না!"
"এগুলো মালকে নিজেদের সাইজ করতে হবে!"
"শুয়োরের বাচ্চার সাহস কম না"
"সেই নাইলে মহালয়ার রাতে চুরি করতে ঢোকে!"
"আজ মালটা জিন্দা ফিরবে না!"

শাটারে পিঠ ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে বসে চিকু বড় বড় চোখ নিয়ে অন্ধকার দোকান ঘরটার সিলিংয়ের দিকে তাকায়। আরেকটু পরে ভোর হলেই চিকুদের বাড়ির সামনে নদীতে আলো ফুটবে। নদীর চরে চারদিক কাশে ভরে আছে। মহালয়ার ভোরে আলো ফোটার আগেই শহরের লোকজন চিকুর বাড়ির সামনে নদীর চরে চলে আসে। পল্টন একদিন বলছিল, এই শহর ছাড়া আর কোথাও নাকি বাজি পুড়িয়ে সকাল বেলায় মহালয়া হয়না। এত বয়েস হয়ে গেলেও চিকু যদিও এই শহরের বাইরে কোথাও কখনো যায়নি। জেল খাটতে গিয়ে অন্য অনেক কয়েদীদের থেকে নানা জায়গার গল্প শুনেছে।  নদীর পারে ভোর রাত থেকে বাজি পোড়ে আকাশ আলো করে। অনেকে নদীর জলে নেমে কী যেন একটা পূজা করে। মরা বাপ ঠাকুরদাকে জল দেয় নাকি। চিকুর বাবার কথা মনে পড়ে না। ও বেশ কয়েক বছর টেবিল পেতে মহালয়ার সকালে নদীর পারে দোকান দিয়েছিল নদীর পারে চা বিস্কুট সিগারেট। ভালোই বিক্রি হয়েছিল। 

"কেউ যেন পুলিশকে আগে ফোন না করে!"
"আজ এমন দেব যে হোল লাইফ মনে রাখবে!"
"শালা কোন এলাকায় চুরি করতে এসেছিস আজ তোর মালুম হবে…"

আলোহীন দমবন্ধ এক চৌকো পৃথিবীতে আটকে পড়েছে চিকু। কোনো ভাবেই এই অন্ধকার থেকে পালানোর পথ খুঁজে পায় না সে। বাইরে বাজির আলো আকাশের আলো থাকলেও সেই আলোর মধ্যে অনেকখানি ভয় অপেক্ষা করে আছে। তবুও দরজা খোলার অপেক্ষা করে শাটারের দিকে তাকায় সে। ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমে ক্লাবের মাইকের চোঙ থেকে ফুল ভলিউমে কী সব গান বাজে, 

"বাজল তোমার আলোর বেণু, মাতল রে ভুবন….."

গানের শব্দগুলোর অর্থ চিকু বোঝে না। ওর খিদে পাওয়া ক্লান্ত শরীরের ঘুমটা বারবার এই গানের আওয়াজে চটকে যায়! এইসব গানগুলো শুনলে হেব্বি ঝাঁট জ্বলে চিকুর। সে ঘুমে ঢুলতে থাকে…. শাটারে মাথা ঠেকায়...
আলোর অপেক্ষায় চিকুর অনেক অনেক বছর ধরে জমে থাকা ঘুম পায়…

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri