আমার ভাষা - বাংলা ভাষা
আমার ভাষা - বাংলা ভাষা
সঙ্গীতা মোহান্ত
~~~~~~~~~~~~~~~
বহু শতাব্দী ধরে স্তরে - স্তরে বিবর্তিত হয়ে, গ্রহণে - সৃজনে ঋদ্ধ হয়ে, নিজের বুনিয়াদ তৈরী করে একটি ভাষা জন্ম নেয়। বিস্তৃত হয়। একটি জাতির অস্তিত্ব উল্লেখ করে। চলুন, আজ একবার চলে যাই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া এমনিই একটি ভাষার অতীতের পৃষ্ঠায়। স্মরণ করি, তাঁর জন্মবৃত্তান্তের কিছু ইতিহাস।
আমাদের "বাংলা ভাষার ইতিহাস''।
আনুমানিক ২৫০০ খ্রীষ্ট-পূর্বাব্দের কথা ।
রাশিয়ার ইউরাল পর্বতের পাদদেশে বসবাসকারী আদি ইন্দো - ইউরোপীয় ভাষাবংশের জনগোষ্ঠী একসময় নানা কারণে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ায় তাদের ভাষায় আঞ্চলিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়েছিল। ফলস্বরূপ, ইন্দো - ইউরোপীয় ভাষাবংশ থেকে প্রথম পাঁচটি প্রাচীন ভাষাগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে। এরমধ্যে একটি হলো ইন্দো- ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠী। এই ইন্দো - ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠীর লোকেরা যখন ভারতে এলো, তারা নিজেদের আর্য বলে দাবী করত এবং অঞ্চল অনুযায়ী এই আর্যগোষ্ঠীর হাত ধরেই সৃষ্টি হয়েছিল ভারতের বিভিন্ন ভাষা। বাংলা তার মধ্যে অন্যতম।
খুব সংক্ষিপ্ত ভাবে সে প্রসঙ্গ আলোচনা করলে বলা যায়; অষ্ট্রিক ও দ্রাবিড় হল ভারতের সর্বপ্রথম প্রাচীন বসবাসকারী জনগোষ্ঠী। এদের মধ্যে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মূল ভুখন্ড ইন্দোচীন উপদ্বীপের আদিবাসী, "অষ্ট্রিক'' জাতির কিছু অংশ পূর্ব ভারতে তাদের বাসস্থান করেছিল। তাদের ভাষা ছিল প্রচলিত ভাষা। এরপর এই অখন্ডিত ভারতে প্রবেশ করে আর্য জনগোষ্ঠী। সনাতন ধর্মাবলম্বী আর্যদের ধর্মগ্রন্থ ছিল "বেদ''। তারা কথা বলত প্রাকৃত ভাষায়। "প্রাকৃত ভাষা'' হল প্রাচীন আর্য ভাষা অর্থাৎ সংস্কৃত ভাষারই রূপান্তরিত রূপ। তবে প্রাকৃত ভাষায় বিবর্তিত হওয়ার পূর্বে তাদের কথ্যরূপটির চারটি উপভাষা ছিল। প্রাচ্য, উদীচ্য, মধ্যদেশীয় ও দাক্ষিণাত্য। "সংস্কৃত'' ছিল আর্যদের সাহিত্যের ভাষা। এরপর কালক্রমে, প্রাচীন ভারতীয় আর্যদের আঞ্চলিক প্রাকৃত ভাষাগুলো থেকে স্বাভাবিক ভাবে লোকমুখে বিবর্তিত হয়ে এক - একটি উপভাষার জন্ম হয়। সেরকম ভাবেই প্রাচ্য উপভাষা থেকে প্রাচ্যা প্রাকৃত এবং প্রাচ্যা থেকে জন্ম হয় "মাগধী প্রাকৃত"।
এরপর স্থানীয় - ভিত্তিক কথ্যরূপগুলো বিবর্তিত হয়ে এক - একটি অপভ্রংশ ভাষায় পরিণত হয়। "মাগধী প্রাকৃত", অপভ্রংশ হয়ে নাম হলো "মাগধী অপভ্রংশ'' ।
এই মাগধী অপভ্রংশের দুটো ভাগের মধ্যে পূর্বী ভাগ থেকে জন্ম হল -- বাংলা ভাষার। এই বিবর্তন প্রক্রিয়া চলেছিল হাজার বছর ধরে ।
কিন্তু বাংলা ভাষার জন্ম গাণিতিক ভাবে ঠিক কবে হয়েছিল, সে প্রশ্নের উত্তর আজও অনাবিষ্কৃত। অভিজ্ঞ গবেষণায় কেউ বলেন ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শতাব্দীর মধ্যে, কেউ বলেন দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর ভেতর।
শিকড় যেহেতু সংস্কৃত -র সাথে গাঁথা, স্বভাব সুলভ ভাবে নতুন শব্দ তৈরীতে পারদর্শী হয়েই জন্মেছিল বাংলা ভাষা । অনুরূপভাবে, ইংরেজ সহ বিভিন্ন বৈদেশিক জাতির সংস্রবে থাকার দরুণ বহু বৈদেশিক শব্দকে দক্ষতার সাথে আত্তীকরণ দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছে সে ।
অভিজ্ঞ ভাষাবিদগণ বাংলা ভাষাকে মোট তিনটি স্তরে ভাগ করেছেন। প্রাচীন বাংলা, মধ্য বাংলা এবং আধুনিক বাংলা ।
'চর্যাপদ' এই প্রাচীন বাংলার নিদর্শন। খ্রিষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে রচিত, "চর্যাপদ'' হল বৌদ্ধ - দোহা পদ সংকলন। বাংলা সাহিত্যে এই প্রাচীন যুগ চলে দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ।
এরপর ১২০১ থেকে ১৮০০ খ্রীঃ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের "মধ্য যুগ''। মধ্যযুগ ছিল কাব্যপ্রধান ও ধর্মকেন্দ্রিক। মধ্যযুগের উল্লেখযোগ্য মৌলিক রচনা হল - শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বৈষ্ণব পদাবলী ও মঙ্গলকাব্য।
অনুবাদ সাহিত্যকর্মে উল্লেখযোগ্য - রামায়ণ, মহাভারত, ভগবত প্রভৃতি।
এরপরেই বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে পদার্পণ ঘটে আধুনিক যুগের। ১৮০১ খ্রীঃ থেকে বর্তমান কাল। ১৮০১ খ্রীষ্টাব্দে কোলকাতা ফোর্ট উইলিয়ামে প্রথম সুত্রপাত হয় গদ্যের। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার নবজাগরণের যুগে সাহিত্য প্রাঙ্গণে আধুনিকতার এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন হয়। কবি, গল্পকার, নাট্যকার, ঔপন্যাসিকদের কলম দিয়ে নিঃসৃত হয় কালজয়ী সব লেখা। বাংলা সাহিত্যের ভান্ডার পূর্ণতা পেতে থাকে ।
বর্তমানে মাতৃভাষা হিসেবে বিশ্বের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলা ভাষা পঞ্চম স্থানে। প্রায় বাইশ কোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলা।
ব্যবহারিক দিক থেকে এই ভাষার স্থান সপ্তমে। আনুমানিক ছাব্বিশ কোটি মানুষের ব্যবহারিক ভাষা, বাংলা ভাষা।
বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বে বাংলা সাহিত্য নিয়ে চর্চার অন্যতম স্থান হল ইউরোপ ও আমেরিকা। যুক্তরাষ্ট্রে বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য প্রভৃতি নিয়ে, গবেষণা কেন্দ্রে বিস্তর গবেষণা চলে আসছে দীর্ঘকাল। এছাড়াও বিশ্বের বহু নগরীতে বাংলা ও বাঙালির সাংস্কৃতিক চর্চা বহমান এবং সমাদৃত। সেখানে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিদিন আলাদা করে প্রকাশিত হচ্ছে বাংলা পত্র - পত্রিকা বা খবরাখবর। সুতরাং আশা করা যায়, "বাংলা'' ভাষার কোনো দুরবস্থা ঘটেনি। সে তার নিজের জায়গায় যথেষ্ট সমৃদ্ধশালী।
তবে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, ২১শে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের পরিপ্রেক্ষিতে এই ফেব্রুয়ারি মাস এলেই কিছু - কিছু বাঙালির মধ্যে একটি গেল - গেল রব উঠে যায়।
বাংলা ভাষাকে নিয়ে তাঁদের "আশঙ্কা'' কাজ করে। বাঙালির কাছে বুঝি বাংলা ভাষা অনাদৃত হচ্ছে। পরিবর্তে, তার ইংরেজির প্রতি ক্রমশঃ স্পৃহা জন্মাচ্ছে।
হ্যাঁ, কিছুটা তো জন্মাচ্ছে অবশ্যই। তবে এই স্পৃহা তৈরীর কারণ বা রাস্তা করে দেওয়ার মূল কান্ডারী না বললেও, কিছুটা দায়ী আমাদের বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়গুলো।
এই বিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজির মান যদি আরেকটু বাড়ানো যেত, অভিভাবকদের তাহলে এতখানি আতঙ্কিত হয়ে, সন্তানকে যুগপোযোগী করে তুলতে ইংরেজি মাধ্যমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ার এতখানি প্রবণতা বোধহয় দেখা যেত না। রাতারাতি এত ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়গুলোও তৈরী হত না বা রমরমিয়ে চলত না।
বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়গুলো ইংরেজির সাথে এমন বৈমাত্রেয় আচরণ না করে যদি বাংলার সাথে ইংরেজিকে সমান্তরাল ভাবে রাখত, তবে বাংলার মধ্যে এমন দ্বিমুখী মনোভাব তৈরী হত না হয়ত। দ্বিভাষী হওয়াতে তো কোনো দোষ নেই । বাংলার ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হবে, বিশ্বজুড়ে তাদের যাতায়াত হবে ; এ তো খুব সুখের কথা ! ইংরেজি সেখানে সহায়কের কাজ করবে। তবে, আভিজাত্যের কারণেও অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করান।
বর্তমান দিনকাল অনুযায়ী মধ্যবিত্ত থেকে ধনী ; কিছু অভিভাবকদের মাথায় একটা জিনিসই কাজ করে, তাদের সন্তান বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করবে। তাই ছোটো থেকেই তাদের ভিত তৈরীতে মা - বাবা সচেষ্ট থাকেন। কাজেই বলা যায়, বাংলা ভাষাকে কিছুটা শিথিল করে দেখার পেছনে বর্তমান যুগে বাংলার ছেলেমেয়েরা কারণ নয় । ফলাফল মাত্র।
অপরদিকে, ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়গুলোতে যদি রাজ্যের মাতৃভাষাকে বাধ্যতামূলক ভাবে কিছুটা স্থান দেওয়া হত তবে, "আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসেনা'' --- বলা, হতভাগ্য অভিভাবকদের সংখ্যাটা কিছুটা হলেও হ্রাস পেত। মাতৃভাষায় নিরক্ষরতা দূরীকরণ হত। নিরক্ষরের দুরবস্থা দূর হত।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴