জানুয়ারি মাসের এক সন্ধ্যা, ঢাকের আওয়াজ কাঁপিয়ে দিচ্ছিল মেয়েটিকে, বাড়িতে ভর্তি আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী। রটন্তি কালীপূজো। মেয়েটি; যে এ বাড়ির বড় বউ, নিজেকে বন্ধ করে রেখেছে একটা ঘরে। এ অশুচি অবস্থায় মাকে স্পর্শ করার অধিকার নেই ওর। চোখের জলে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে সব। এ কান্না মাকে স্পর্শ করতে না পারার চাইতেও বেশি যেন মাতৃত্বকে স্পর্শ না করতে পারা্য। প্রতি মাসে ও অপেক্ষায় থাকে একটি নতুন প্রাণের কিন্তু না
আসে না সে। একটা একটা করে পেরিয়ে যাচ্ছে বছর। পেরোচ্ছে যন্ত্রনাময় চিকিৎসার ধাপ কিন্তু ফুরোচ্ছে না অপেক্ষা। কাছে দূরের মানুষ দের কৌতুহলের জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত ও।
_”বাড়িতে পূজো তুমি ওষুধ খেলে না কেন?”
-“ এবার ও পিরিয়ড হয়ে গেল? যাঃ”
কিভাবে জনে জনে বোঝাবে ও, ওর যে চিকিৎসা চলছে যেকোনো ওষুধ ওর খাওয়া চলে না। মা না হতে পারার কষ্ট টা ভুক্তভোগীর ই যে সবচেয়ে বেশি একথা বোঝাবে কাকে??
নিজের ঘরে বসে আকুল প্রার্থনা করছিল মেয়েটি। একটা “মা” ডাক শোনার জন্য উথাল পাথাল করে ওর মন। না ওর বর কিন্তু সহমর্মিতা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ওর জন্য কিন্তু সংসার বড় নিষ্ঠুরতা করে মাঝে মাঝে। মন উতলা হয় একটা কচি হাতের স্পর্শের জন্য! ঘুণপোকার মত এক অসুখ বাসা বেঁধেছিল শরীরে যার মাসুল দিয়ে যাচ্ছে ও সুদে আসলে।
পেরিয়ে গেল বেশ কয়েকটি দিন। আজ টেস্টের রিপোর্ট আসবে। কেউ জানেনা লুকিয়ে প্রতি মাসেই ও টেস্ট করে, আগে বাড়িতেই করত এখন করে না, নেগেটিভ রেজাল্ট পেয়ে পেয়ে ক্লান্ত কিছুটা বা অভ্যস্থ ও। অপেক্ষায় থেকে থেকে বিকেল গড়িয়ে গেল। ও জানে আবার নেগেটিভ… আবার…
বাইকের আওয়াজে চোখ বন্ধ করে শক্ত হয়ে নিজের ঘরে বসে থাকে ও। টের পায় ওর বর ঢুকল।
-“এই নাও তোমার রিপোর্ট, দেখো”
চোখ খোলে ও, কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজটা নেয়…. পজেটিভ!!!!
অনাবিল হাসি নিয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওর আগত সন্তানের পিতা। আনন্দের ঢেউ ওঠে বাড়িময়!!
একটা পজেটিভ রিপোর্ট জীবনের মোড় টাকে যেন হটাৎ করে ঘুরিয়ে দিল মেয়েটির। একসময় প্রায় আশা ছেড়েই দিয়েছিল ও, আস্তে আস্তে মনের গভীরে অনুভব করতে শুরু করল একটি নতুন প্রাণের অস্তিত্ব কে, শরীরেও।সে এক অদ্ভুত ভাললাগার অনুভূতি! বহুদিন পর ফিরে চাইল নিজের দিকে।
মেয়ের চোদ্দ বছরের জন্মদিনে পায়েস রান্না করতে গিয়ে মনে পড়ে গেল পুরোনো কথা। এক শীতরাতে আকুল হয়ে কেঁদেছিল যার জন্যে এক শরতের শিউলি ঝরা সকালে সে এসেছিল মেয়েটির জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ হয়ে।