আকাশের কাছাকাছি
আকাশের কাছাকাছি
গীর্বাণী চক্রবর্তী
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
নাম ক্যায়া হ্যায় তুমহারা?
....স্যামুয়েল!
নামটা কোনোক্রমে বলেই ছেলেটা ওয়াটার বটল, পানি বটল বলে চেঁচিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোর দিকে এগিয়ে যায়। ছেলেটার বাঁ হাতে একটা মিনারেল ওয়াটার বটল আর ওই কাঁধেই অনেকগুলো জলের বোতল ভর্তি ব্যাগ। ডান হাতে লাল নীল চেক চেক প্রিন্টের ছাতা ধরা। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি ছেলেটার দিকে।
দুদিনের ছুটিতে পাহাড়ে বেড়াতে এসেছি। যদিও এই ভরা বর্ষায় পাহাড়ে যাব শুনে অনেকেই আঁতকে উঠেছে। কিন্তু তাদেরকে কি করে বোঝাই বর্ষার পাহাড়ি সৌন্দর্যের প্রেমে যে আমি পাগল। ঝাড়া হাত পা আমার, তাইতো নিজের গাড়ি নিয়ে একাই বেরিয়ে পড়ি। আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে কিছুটা উঠেই যে আশঙ্কাকাটা মনের ভেতর খচখচ করছিল তাই ঘটে গেল। রাস্তায় নাকি ধস নেমেছে। পরিষ্কার হবে তারপরেই এগোতে পারব। তা প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে বসে আছি। সামনেই অগুনতি গাড়ির মিছিল। রাস্তার একদিকে সবুজ চাদর জড়িয়ে গম্ভীর পাহাড়ের সারি। আরেকদিকে গভীর খাদ দিয়ে ফুলেফেঁপে ওঠা ভয়ংকর সুন্দরী তিস্তা বয়ে চলেছে। এরইমধ্যে কখনও টুপটাপ কখনও অঝোরে মেঘ বৃষ্টি ঝরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। তখনই স্যামুয়েল নামের ছেলেটাকে দেখি জলের বোতল বিক্রি করতে। বয়স পনেরো ষোলো হবে। লালচে ফর্সা গায়ের রঙ, রোগাটে গড়ন, চোখের তারা নীল আর মাথা ভর্তি সোনালী চুল। পুরো সাহেবি চেহারা ।
বৃষ্টিটা এখন অনেকটাই ধরে এসেছে। একটা পাতলা দুধের সরের মত সাদাটে রোদ পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। গাড়ির জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি জলের বোতলের ব্যাগটা এখন আর স্যামুয়েলের কাঁধে নেই। ছাতাটাও বোধহয় কোথাও রেখে এসেছে। তার বদলে হাতে একটা স্টিলের ফ্লাস্ক আর কাগজের কাপের প্যাকেট নিয়ে চায়ে….. চায়ে গরম বলে গাড়িগুলোর পাশ দিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। আমি ততক্ষণে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়েছি। কি মনে হতে ছেলেটাকে আবার হাত নাড়িয়ে ডাকি।
চা পিবেন? একমুখ নিষ্পাপ হাসি ছড়িয়ে দিয়ে সে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়।
দাও। স্যামুয়েল তুমি বাংলা জান? বেশ অবাক হয়েই প্রশ্নটা করি।
থোড়া থোড়া…….. বলেই ছেলেটা আমার হাতে চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিয়ে ছুট লাগায়। স্যামুয়েলের চা বিক্রিও শেষ। কাছে আসতেই বলি, পানি লাগবে স্যামুয়েল।
এক মিনিট স্যার। আভি লাতা হুঁ…….. আবার সে জলের বোতল ভর্তি ব্যাগটা নিয়ে আসে। একটা জলের বোতল এগিয়ে দিতেই বলি, ব্যাগে তোমার আর ক'টা জলের বোতল আছে?
ঔর চার বটল পানি আছে…….
বেশ, ওই চারটাও দিয়ে দাও আমাকে। জল চা এগুলো কোথা থেকে আনছ স্যামুয়েল? আমার প্রশ্নে স্যামুয়েল হাত দিয়ে একটু দূরে পাহাড় ঘেঁষা ছোট্ট একটা ঝুপড়ি দোকান দেখিয়ে বলে, গাঁও কি এক বুড্ডি দাদির দুকান আছে। ওহি সে লিয়ে আসছি। চায়ে পানি সব খতম। দাদিকে রুপিয়া দে কে আভি হাম ঘর যাবে। কথাগুলো শেষ করে স্যামুয়েল একগাল হাসে।
আর তোমার প্রফিট? হেসে স্যামুয়েলের দিকে তাকিয়ে বলি।
স্যামুয়েলের নীল চোখে তখন আকাশ ছোঁয়া সবুজ পাহাড় ছায়া ফেলেছে। আমার কথা শুনে ও যেন ভীষণ অবাক হয়ে যায়। তারপর ধীরেধীরে বলে, প্রফিট! প্রফিট কুছ নেহি হ্যায়। লাভ নুকসান সব কুছ তো গডের ঘরে জমা থাকে। ঠিক কাঁহা না স্যার?
তিস্তা থেকে উঠে আসা ঠান্ডা বাতাস ঝাপটা মারছে চোখেমুখে। অপার বিস্ময়ে স্যামুয়েলের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলি, ঠিকই বলেছ। তা তোমার ঘর কোথায়?
ইয়ে পাহাড় কি উসপার হামার ঘর আছে স্যার। রাস্তার পাশেই প্রাচীরের মত উঠে যাওয়া পাহাড়টার পাকদন্ডীর দিকে তাকিয়ে বলে স্যামুয়েল।
পাঁচটা জলের বোতল আর চায়ের দাম দিতে গিয়ে দেখি একটা বোতলের দাম ও ফেরত দিয়ে দিল। বেশ হকচকিয়ে গিয়ে বলি, সে কি স্যামুয়েল একটা বোতলের দাম নিলে না?
নেহি স্যার! ওহ হামার তরফ থেকে আপনার জন্য গিফট আছে। বাই স্যার। হ্যাভ এ গুড ডে। কথার মাঝেই ছেলেটার সারামুখে ছড়িয়ে থাকে সেই দেব সুলভ হাসি।
কেন কে জানে এত লোক থাকতে স্যামুয়েল আমাকেই জলের বোতল উপহার দিয়ে গেল। ধস নামা রাস্তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। গাড়ির মিছিল অল্প অল্প করে এগোচ্ছে। গাড়ির স্টিয়ারিং সামলে পাশে পাহাড়টার দিকে তাকাতেই চোখে পড়ে বিশাল অজগরের মত পাহাড়টাকে পেঁচিয়ে রাখা পাকদন্ডী বেয়ে স্যামুয়েল ওপরে উঠে যাচ্ছে। কত কথা ওর সাহেবি চেহারা দেখে তখন থেকে মনে ঘুরছে। না জানি কবে ওর পূর্বপুরুষ এদেশে এসে এখানকার জল মাটির সাথে মিশে গেছে। জানিনা ও ভিনদেশী না কি স্বদেশী। তবে এতটুকু বুঝতে পেরেছি ও মানুষ হওয়ার লড়াইয়ে নেমেছে। পাহাড়ের পাকদন্ডীর বাঁকে মেঘ বৃষ্টির দেশে স্যামুয়েলের শরীরটা মিলিয়ে যাচ্ছে। পাহাড় জুড়ে আবার ঝেঁপে বৃষ্টি নেমেছে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴