অলৌকিক ডুয়ার্স/অমিত কুমার দে
অলৌকিক ডুয়ার্স
অমিত কুমার দে
^^^^^^^^^^^^^^^^^
একটা বিশাল পাথর আড়াল তৈরি করে।
পাপড়খেতির অতিকায় পাথরটা
নিরেট শব্দে কোনো কোনো দিন
ঈশ্বরের গল্প শোনায়
হাতে তুলে দেয় ঝিনুকজল
তারপর বলে : যাও, গুম্ফা ডাকছে!
এ আমার এক অলৌকিক ডুয়ার্স!
কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ঢেকেছিল রিশপের মেঘেরা
পাহাড়চূড়ায় মেঘে মেঘে লেখা হচ্ছিল – ওঁ
অজস্র জোঁক আমার রক্তের জন্য
আবেদনপত্র নিয়ে দাঁড়িয়েছিল ঘাস ও পাতায়
ফার্ন গাছের ভেতর ঢুকে যাচ্ছিল
আমার বনজ শরীর
আমি এক আহাম্মক গতকাল পাইন-মেয়ের প্রেমে পড়েছি!
এ আমার এক অলৌকিক ডুয়ার্স!
ঝান্ডিতে ভোর জেগে উঠলে
আমার সঙ্গে মর্নিং ওয়াকে যায় একটি হলদে কুকুর
ঝর্নার কাছে উৎসকথা শুনতে চাইলে
পাহাড়ি পাখিরা আমাকে অবিশ্বাস করে
রাস্তার ওপর জল নেমে এলে
আমি থেমে পড়ে কেঁপে উঠি
আমি আর আমার কুকুর ডুবে যাই হিমের চাদরে!
এ আমার এক অলৌকিক ডুয়ার্স!
গরুবাথানে নদী ছিনিয়ে নিয়েছিল আমার ছাতা
সেদিন তুমুল বৃষ্টি এসে তোলপাড় করেছিল
মীনগ্লাস থেকে গরুবাথান
সব গাছ ঝুঁকে পড়ে বলছিল : বাড়ি যাও
কিন্তু এসব রাস্তায় এলে আমার কোনো বাড়িঘর থাকে না
আমি অবিশ্বাস্যভাবে তখন বৃষ্টির দখলে
ভেতরভেজা দিনযাপনের সবকিছু ছিনিয়ে নেয় ডাকাত-বাতাস!
এ আমার এক অলৌকিক ডুয়ার্স!
মিশন হিল বাগানের চায়ে চুমুক দিতে দিতে নিঃসঙ্গ হই
মীনাক্ষীকে ডাকতে গিয়ে ডেকে উঠি
কিলকট কুর্তি জিতি
সিপসু-র কমলাহাটের ট্রাক তুলে নেবে আরো একদিন
পাথর পেরোতে জানে কুশলী ড্রাইভার
সে কি জানে কীভাবে অজান্তে করে অপরূপ ফেরি?
বিড়ির গন্ধে আমি ধূপ পাই, ধুনো পাই, পেয়ে যাই পাহাড়ি আতর
এ আমার এক অলৌকিক ডুয়ার্স!
নাগরাকাটা বিডিও অফিসের সামনে সন্ধে রাতের দিকে যায়
বিদ্যুৎবিহীন বাগানের ছেলেমেয়েরা লাইটপোস্টের নীচে
বইখাতা খোলে, রিফিলে জড়ানো থাকে অন্ধকারকুচি
কালভার্টের ওপর বসে শুনে নিই বাগিচাসংবাদ
সব টাকা ফুরালে মানুষ কত নির্বিকার হয়
বন্ধ বাগান থেকে কালপেঁচা ডাকে
কীভাবে কান্নাগুলো জমে জমে ছিঁড়ে ফেলে গেটের নোটিস!
এ আমার এক অলৌকিক ডুয়ার্স!
রেডব্যাঙ্কে দিনদুপুরে গা ছমছম করে
চিতাবাঘ ওঁত পাতে মানুষের নষ্ট ডেরায়
মানুষের চাউনি পাল্টে যায়
ধামসা মাদলে জমে চাপ চাপ ব্যর্থ অভিমান
নিহত শ্রমিক এসে সুনসান রাস্তায় হাঁটে
ফ্যাক্টরিদরজায় গিয়ে ধাক্কা দেয় করোটি আর আঙুলের হাড়
পাথর ভাঙতে যায় কাজহীন বন্ধ রেডব্যাঙ্ক
এ আমার এক অলৌকিক ডুয়ার্স!
একদিন আমি আর লুনা যাই তাসাটির দিকে
তুষার বাড়ুজ্জের মেয়ে আমাকে চিনিয়ে দেয় সব ছায়াগাছ
আমি তাকে দিতে চাই অললই ঝললই মাদারের ফুল
একদিন মাকড়াপাড়ার পাহাড়ে বসে কথা ছিল
আমরা দুজন মিলে একে একে পড়ে যাব
যাবতীয় তুষার বন্দ্যোপাধ্যায়
লুনা গেছে না ফেরার দেশে, বীরপাড়া যেতে আমি বড় ভয় পাই
বুলবুলি নিয়ে গেছিল মেটেলির ম্যানেজার বাংলোয়
অত বড় বাড়িটায় কে থাকে, ঝোপের ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয়
বিস্মিত সমতলী কলেজবালক
প্রান্তবেলায় এসেও কুর্তির বাংলোর দিকে হাঁ করে তাকায় সে
পাহাড়কে জাগিয়ে দিয়ে বেজে ওঠে মন্দিরের ঘন্টা
কুমাইয়ে ফ্যাক্টরির সাইরেন শুনে পায়ে পায়ে নেমে যায়
পাকদন্ডি পথ, গাছের ছায়া দেখে সময় দেখছে কয়েকটি নদী
এ আমার এক অলৌকিক ডুয়ার্স!
মধুবনী আসলে তো নদী নয়
সে আমাকে দিয়েছিল নীল নীল জল
সে আমাকে গেঁথে দেয় শুরুর অক্ষর
একখানা জিপগাড়ি, লড়ঝড়ে
আমাকে ভেতরে তুলে অরণ্য দু’ভাগ করে
নিয়ে যায় নাথুয়াবাজারে
নোনাইয়ের চিঠি আমি কতবার পৌঁছে দিই মধুবনীর হাতে!
সূর্য ডোবার পর কালাপানির ওপার থেকে
দলবেঁধে নিজের বাথানে ফেরে মহিষের দল
বিলুপ্ত খয়েরবনে ধুলো ওড়ে
নেপালি ছাত্রীটি এসে দিয়ে যায় মোষের দুধের ঘন চা
বিকেলটা গাঢ় হলে ডেকে ওঠে ডজন ময়ূর
ক্ক্যাও-ক্ক্যাও দীর্ঘস্বর ছমছম করে
কুপির আলোয় আমি এসে বসি বাথানমালিক ছেত্রী-র ঘরে!
এ আমার এক অলৌকিক ডুয়ার্স!
নরেন রায়ের হাতে কী জাদু আছে ঈশ্বর জানেন
তিনি কাঠের গহনে দেন ভাওয়াইয়া গান
শক্ত কাঠও ক্রমে জেনে নেয় চটকা বা দরিয়ার মানে
কিছুটা দূরেই গোনাথ রাভা মেয়েদের নিয়ে বনের উঠোনে
শিখিয়ে চলেন চিংড়িশিকারের নাচ
বাগিচার বসতিতে সাদরি গান আর দলবদ্ধ ছন্দের ভিড়
আমি যেন রূপান্তরিত হই মৃত্তিকামানুষে!
এ আমার এক অলৌকিক ডুয়ার্স!
এখানেই পোঁতা আছে আমার পতাকা
এখানেই কিছু গাছ রেখে দেবে পোড়ানোর কাঠ
এখানেই নদী দেবে বিশুদ্ধ জল
এখানেই আমাকে নেবে মানুষ পতঙ্গ আর রাতজাগা মাঠ!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴