সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
23-November,2022 - Wednesday ✍️ By- অশোক গঙ্গোপাধ্যায় 208

অমর প্রেম

অমর প্রেম
অশোক কুমার গঙ্গোপাধ্যায়
~~~~~~~~~~~~~~~~

ঈশ্বরের পাশ-ফেলের তালিকায় আমার বাবা সুধাময় সেনগুপ্ত আর আমার মা সুপ্রিয়া সেনগুপ্ত দু’জনেই ফেল! তাঁদের বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়েছিল আমার জন্মের তিন বছরের মাথায়।যখন গুটি গুটি পায়ে কারো বাড়ি দাপিয়ে বেড়াচ্ছি।

বিচ্ছেদের কারণটা তুচ্ছাতিতুচ্ছ।
বাবার ভগবানে বিশ্বাস ছিল না। মা, ভগবানে বিশ্বাসী।মূল দ্বন্দ্বটা তা নিয়ে। 
বাবা বলে, ঈশ্বর হল মানুষের বিশ্বাস। মানুষের বাঁচা-মরা, ভালো-মন্দে তাঁর কোনো ভূমিকা নেই।
মা বলে বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর। তিনিই জন্ম, তিনিই মৃত্যু। তার বাইরে কিছু নেই। প্রথম প্রথম তর্ক-বিতর্ক, মান-অভিমান, পরে উভয় পক্ষের সম্মতিতে মিউচুয়াল সেপারেশন!............
সে ঘটনার পর সাতাশ বছর অতিক্রান্ত। আমি এখন ত্রিশ বছরের যুবা-পুরুষ। দেখতে শুনতে ভালো। ভালো চাকরি করি। বাবা, মায়ের বিচ্ছেদের সময়কার কথা আমার মনে নেই। তবে বড় হয়ে শুনেছি। সেই সময়ে বাবার বয়স বত্রিশ আর মায়ের বয়স ত্রিশ ছিল। আমার মা সুপ্রিয়া সেন একটি রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কের বড় অফিসার। বাবা সুধাময় সেনগুপ্ত কলকাতার একটি নামী কলেজের দর্শনের অধ্যাপক।
বাপের বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি। দু’দিকের স্বজন-পরিজনেরই একটি বদ্ধমূল ধারণা ছিল যেহেতু দুজনের বয়স অল্প, দেখতে সুন্দর, ভালো চাকরি করে। কাজেই ওরা একলা হাঁটবে না। পছন্দমতো সঙ্গী ঠিক জুটিয়ে নেবে। 
কিন্তু কোনো পক্ষের ধারণাই সঠিক হয়নি।
আমার বাবা-মা কেউই দ্বিতীয়বার মালাবদল করেনি। বা কারো সঙ্গে লিভ টুগেদারও করেনি।
 আদালতের নিরদেশে আমার, মা’র হেফাজতে থাকার কথা হলে, বদলির চাকরি জন্য আমার পড়াশুনার ক্ষতি হতে পারে আশঙ্কা করে আমাকে বাবার হেফাজতে রাখা হয়েছিল। কালুর মা নামে একজন সহৃদয়া মহিলা আমৃত্যু আমাকে নিঃস্বার্থভাবে দেখাশুনা করেছিলেন। 
স্কুলের ছটিতে আমি মার কাছে চলে যেতাম। বাবার তরফে কোনোদিন কোনো প্রতিবাদ প্রতিরোধ হয়নি। প্লেন বা ট্রেনের টিকিটটা বাবা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। 
ছেলেবেলার কথা আলাদা।
বড় হয়ে যখন মার কাছে যেতাম, মার কাছে বাবা নানারকম গল্পগাঁথা শুনে আমার বারবার মনে হয়েছে, আমার মায়ের কাছে বাবার মতো সর্বগুণ সম্পন্ন মানুষ পৃথিবীতে খুব একটা বেশি নেই।
নানা প্রসঙ্গে যখন পারিবারিক কথা উঠত আবেগঘন মুহূর্তে বাবার মুখ দিয়ে মায়ের যে দেবীরূপটা প্রকাশ হয়ে পড়ত তা শুনে আমার মনে হত আমার মায়ের মতো মা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি হয়না। 
আমার মা এখন মুম্বাইয়ে বিশাল কোয়ার্টারে একা। দুজন কাজের মেয়ে তাঁর দেখাশুনা করছে।
বাবা কলকাতাতে একা ফ্ল্যাটে। দিনে অফিস ক্যান্টিনে, রাতে হোম ক্যাটারিং।একজন কাজের মাসি সকালে এসে জামা কাপড় কাচা ধোয়া, বাসন মাজা, ঘর-দোর ঝাড় দেওয়ার কাজ করে যায়। 
আমি দিল্লীতে। আমার অবস্থাও অনেকটা তাঁদের মতো। 
তিনজন তিন জায়গায়। একাকী, নিঃসঙ্গ!
বাবা মা। দুজনেরই খুব ইচ্ছে আমি বিয়ে করে সংসারী হই। 
বিষয়টা একদিন আমার বান্ধবী সুনন্দাকে বলেছিলাম। 
সুনন্দা বলেছিল, ভারী অদ্ভুত নারে? দুজনের মধ্যে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, প্রেম, ভালোবাসা অফুরান। একটা অর্থহীন বিতর্কে জড়িয়ে অভিমানবশত শুধু নিজেদেরই বঞ্চিত করেননি তোকেও একটা বঞ্চনার জগতে ঠেলে দিয়েছেন।............
এবার পুজোতে কলকাতায় বাবার কাছে যাব ভাবছিলাম,কিন্তু পুজোর দিন পনেরো আগে একটা অভাবনীয় কান্ড ঘটল। ব্যাপারটা পুরোটাই কাকতালীয় হলেও বিষ্ময়কর।
মা টেলিফোন করে জানালো মুম্বাইতে পূজার মধ্যে একা থাকতে ভালো লাগে না। তোকে দেখতে ইচ্ছে করছে। সপ্তমীর দিন সকালের ফ্লাইটে আসছি।
আর আশ্চর্য পরের দিন বাবার টেলিফোন এল!
এবার প্রবাসী বাঙ্গালীদের পুজো দেখব খোকা, সপ্তমীর দিন সকালের ফ্লাইটে দিল্লী পৌঁছোচ্ছি। হিসেব করে দেখলাম মা দু’ঘন্টা আগে, বাবাদু’ঘন্টা পরে আসছে। সর্বনাশ! 
সাতাশ বছর পরে দুজনের মুখোমুখি দেখা। একটা অশুভ আশঙ্কায় আমার বুক কেঁপে উঠল। যদি কোনো কারণে ভূমিকম্প শুরু হয়! তাহলে আমি কী করব! সুনন্দাকে সব খুলে বললাম। সে বলল ওরা দুজনেই যে একদিনে আসছে, সে কথা ওদের বলোনি তো!‘পাগল নাকি! তাহলে ঘিয়ে আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে’। সুনন্দা বলল ভয় নেই, জ্বলবে না। 
মনে রেখ, এই একটাই সুযোগ এসেছে, তাকে কাজে লাগাতে হবে
সপ্তমীর দিন, মা ঠিক সময়মতো দু’ঘন্টা আগেই পৌঁছেছেন। মার শরীরটা বোধহয় ভালো যাচ্ছে না। সারা মুখে ক্লান্তি জড়ানো। 
অক্টোবর মাসে দিল্লীতে একটু ঠান্ডা পড়ে। 
মা বলল, তুই যে বাহাদুরি করে একটা পাতলা জামা পরে আছিস, ঠান্ডা লেগে অসুখে পড়লে কে দেখবে?
আমি হেসে বললাম, ঈশ্বর!
মা বলল, হ্যাঁ রে খো্কা, সুনন্দার সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছিস? আমাদের দুজনেরই কিন্তু বয়েস হয়েছে, তোর একটা স্থায়ী ব্যবস্থা করে না গেলে মরেও শান্তি পাব না। তাছাড়া এই বয়সে একে থাকতে আর ভালোও লাগছে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তুই সুনন্দাকে বাড়িতে নিয়ে আয়। 
আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল বলি, মাগো, সুনন্দার এই বাড়িতে আসা না আসাতে তোমার কি যায় আসবে।যাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসো তাকে বুকে টেনে নিচ্ছো না কেন? 
কথাটা বলার আগেই বাবা এসে গেল।
ড্রইং রুমের সোফাতে বসে মাকে ছা খেতে দেখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল বাবা। তারপর মুখে একটা শুকনো হাসি টেনে বলল কেমন আছো সুপ্রিয়া? 
মাও হাসল, ভালো। 
-তুমি
-মোটামুটি আছি। তবে গ্যাস্ট্রিকের পুরনো ব্যথাটা আবার চাগাড় দিয়ে উঠেছে। 
মার চোখদুটো কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠল।
-ওষুধ খাচ্ছো, নাকি আগের মতো নিজেই ডাক্তারি করছ?
বাবা কিছুটা সময় মার দিকে তাকিয়ে থাকল। মুখে আলতো হাসি। মা বলল, হাসছ যে! অন্যায় কিছু বলেছি? –বাবা বলল হাসছি এই কারণে যে আগের মাষ্টারির স্বভাবটা এখনও যায়নি দেখে। এবার মাও হাসল। জ্ঞানপাপী! ক্রনিক গ্যাস্ট্রাইটিস সহজে যায় না। শূন্য ঘরে বসে না থেকে অবসর সময়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরে সময় কাটাও। ভালো লাগবে। 
বাবা বলল তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে সুপ্রিয়া। মনে হয় ভুগছ। সুগার হল নাকি? 
-সুগার নয়। হাই প্রেসার আর থাইরয়েড। 
-তোমারও তো অষুধ খেতে এলার্জি। দুটোর অষুধই কিন্তু নিয়ম করে আজীবন খেতে হবে। 
মা বলল, নিয়ম করেই খাই । তবে মাঝে মাঝে ভুল হয়ে যায়। 
বাবা যেন এবার খানিকটা দৃঢ় হল।
 -অনেকদিন তো চাকরি করলে, এবার ভি আর এস নিয়ে ছেলের কাছে এসে থাকো। ওর বিয়ে দাও। ঘরে একটা বউ এলে সব অসুখ বিসুখ সেরে যাবে। 
মা গম্ভীরভাবে বল, তুমিও তো তাই করতে পারতে। এতদিন  কেন করোনি?
-চলে যাচ্ছে, তাই গরজ করিনি।
কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর আরো কিছুক্ষণ!
আমার অনুমান ছিল, ড্রইংরুমে চায়ের পেয়ালা হাতে মাকে বসে থাকতে দেখে বাবার চোখদুটো ঘোলাটে হয়ে যাবে। দেখলাম আমার অনুমান ভুল। এখন দুজনে যেন স্বাভাবিকের চাইতেও বেশি স্বাভাবিক। 
মা বলল কী দেখছ এমন করে?
ম্লান হেসে বাবা বলল, কীই আবার। অর্থহীন জীবনের সাতাশ বছর। অনেক বেশী সময় না গো? অথচ কীভাবে যেন কেটে গেল। মা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছল না মুখ মুছল বুঝতে পারলাম না। 
হ্যাঁ গো অনেক বেশী সময়! আসলে বোধহয় একটা ভাঙ্গা সাঁকোর দুপারে দাঁড়িয়ে দুজনে প্রতিক্ষায় থেকেছি। 
আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। 
‘-তাহলে এই সাতাশ বছর একা একা থাকা কেন, রাগ? ভাঙ্গা সাঁকোর উপর নির্ভর না করে নৌকো নিয়েই তো পার হতে পারতে?
বলেই ভয় হল। কোনো বিস্ফোরণ ঘটবে না তো? 
না, কোনো বিস্ফোরণ ঘটল না। 
আমাদের কথার মধ্যেই সুনন্দা ঘরে ঢুকেছিল। 
সে বলল, না কাকু, আর তোমাদের একা থাকতে হবে না। সামনের মাসের বাইশ তারিখ একটা ভালো দিন আছে। সেই মুহূর্তে দেওয়ালে হেঁটে যাওয়া টিকটিকিটা ডেকে উঠল ঠিক ঠিক ঠিক।.........

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri