অপেক্ষা শেষে
অপেক্ষা শেষে
ব্রততী দাস
~~~~~~~~
সকালে ঘুম চোখেই একবার হোয়াটসঅ্যাপ আর মেসেঞ্জার-এ চোখ বুলিয়েই রাকা দিনটা শুরু করে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে আজ মেসেঞ্জারে একটা নামে চোখ আটকে গেল। বিহান ব্যানার্জী।
"কেমন আছিস? হ্যাঁ, ঠিকই চিনেছিস। আমিই সাহেব।"-- টেক্সট এ শুধু এটুকুই লেখা। রাকা এক লাফে উঠে বসে চোখটা কচলে আরেকবার ভাল করে মেসেজটা পড়ল। একমাস আটদিন আগে ও একটা মেসেজ পাঠিয়েছিল, "হাই, তুই কি সাহেব?" শুধু এটুকুই লিখে পাঠিয়েছিল। তারপর ভুলেও গিয়েছিল সেকথা। কারণ গত সতেরো বছরে এরকম অনেক চেষ্টাই ও করেছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তাই এবারও ফেসবুক ঘেঁটে, প্রায় চিরুনী তল্লাশি চালিয়ে, তেতাল্লিশজন বিহান ব্যানার্জীর থেকে যখন এই ব্যক্তিটিকে মেসেজ করেছিল, তখন ও আদৌ কোনও আশা করেনি। তবে কি সত্যিই এত বছর পর কথা হবে সাহেবের সাথে...
ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁইছুঁই। এসময় রাকার দম ফেলার সময় নেই। ছেলের দায়িত্ব আয়াকে বুঝিয়ে ছোটে বাস ধরতে। এক মিনিটও লেট হলে যে অফিস গিয়ে বসের বাঁকা কথা শুনতে হবে। বাসে এই আধঘন্টার জার্নিটা রাকার খুব ভাল লাগে। আসলে এই সময়টা এক্কেবারে ওর নিজের। কানে ইয়ারফোনটা গুঁজে, চোখ বন্ধ করে হারিয়ে যায় নিজের ভাবনাগুলোর সাথে।
লাঞ্চ টাইমে আজ আর ক্যান্টিনে গেল না ও কলিগদের সাথে। 'আচ্ছা ও কি সত্যিই সেই ছোটবেলার সাহেব? অন্য কেউ নয় তো? না... ফেসবুক প্রোফাইলে তো ওর বায়োডাটা যা আছে সবই প্রায় মিলে গেছে। আর ওর ফ্যামিলী ফোটোগুলোতে কাকু-কাকিমা, কুট্টি পিপি, সোনা ঠাম্মী সবাইকে দেখলাম। তাহলে ও অন্য কেউ কি করে হবে। আসলে সাহেবটা বড় হয়ে একদম পাল্টে গেছে দেখতে। তাই হয়ত চেনা যাচ্ছে না।' -- এসব আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে কখন যে লাঞ্চ ব্রেক শেষ রাকা খেয়ালই করেনি।
অফিস থেকে ফেরার পথে আবার একটা টেক্সট করল সাহেবকে - 'তোর কন্টাক্ট নাম্বারটা দিস তো'।
রাত ১১:২০। ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে রাকা ফোনটা করেই ফেলল।
"হ্যালো"...
"হ্যাঁ, বল" - ওপর প্রান্তের ব্যক্তির এত কনফিডেন্টলি বলা শুনে রাকা একটু থমকে গেল।
"কি রে চুপ করে গেলি কেন? কথা বলবি না?" -ওপাশের কথা শেষ না হতেই রাকা বলল, "তুই সাহেব বলছিস তো? আমি রাকা, (রক্তিমা)।"
"তোর হয়ত মনে নেই আমি কিন্তু তোকে রক্তিমা বলেই ডাকতাম। ওহহ্, বাই দ্য ওয়ে আমি বিহান, (সাহেব)।" - সাহেবের কথাতে এবার রাকা মনে মনে ভাবল যাক ও তাহলে ভুল করেনি।
"আমি খুব সহজে কিছু ভুলি না বুঝলি। কেমন আছিস তুই? জানিস তোকে আমি কত্ত খুঁজেছি। তোর ল্যান্ডলাইনে কত ট্রাই করেছি, কিন্তু আর লাইন পাইনি।" - রাকা এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেল।
"জানি। আমিও অনেক চেষ্টা করেছিলাম তোর সাথে কন্ট্যাক্ট করার, কিন্তু পাইনি রে। যাক আর ঝগড়া করিস না তো। কত বছর পর তোর সাথে কথা হচ্ছে বল তো? এই তোর তো ছেলে হয়েছে তাই না? ফেসবুকে ছবি দেখলাম। খুব মিষ্টি দেখতে, চোখগুলো এক্কেবারে তোর কপি।" - সাহেবের মুখের কথা শেষ না হতেই রাকা বলল, "তোর বুঝি মনে আছে আমার চোখ কেমন? কোনো দিন তাকিয়ে দেখেছিলি? তোর সাথে অনেক ঝগড়া জমে আছে।"
"এই আজ রাখি রে অনেক রাত হল। কাল অফিস আছে। শোন কাল কিন্তু আমি লাঞ্চ ব্রেকে ফোন করব। ফ্রি থাকিস। বাই। গুড নাইট।" - রাকা ফোন রেখে ঘুমোতে গেল। কিন্তু কিছুতেই ঘুম এল না সে রাতে। অনেক না বলা কথা, অনেক প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল।
সাহেব তো ওর ছোট্টবেলার বন্ধু। বন্ধু শব্দটার সমার্থক শব্দই ওর কাছে ছিল সাহেব। কিন্তু ক্লাস ফোরে যখন রাকারা দু্র্গাপুর ছেড়ে শিলিগুড়ি চলে এল ওর বাবার ট্রান্সফার হওয়াতে, তখন ওরা দুজনেই খুব কেঁদেছিল। সাহেব তো ওকে সাইকেল চালানো শেখাচ্ছিল। এবার আর কে শেখাবে? খেলবেই বা কার সাথে রাকা? তখন শুধু গরমের ছুটি আর পুজোর ছুটির অপেক্ষায় থাকত ওরা দুজনেই। দেখতে দেখতে হায়ার সেকেন্ডারিও শেষ। এবার থেকে খুব একটা বেশি আর যাওয়া হবে না দুর্গাপুর। রাকাও চলে যাবে দিল্লী হায়ার এডুকেশনের জন্য। রেজ়াল্ট বেরোবার আগে তাই এবার কিছুদিনের জন্য ঘুরেই আসতে হবে দুর্গাপুর। ওটাই যে রাকার কাছে হারানো শৈশব। দেখতে দেখতে সেবার সাতটা দিন যে কিভাবে কেটে গেল। ছোটবেলার সব বন্ধুদের সাথে আড্ডা, পাড়াতুতো পিসিমনি আর ঠাম্মা-দিম্মাদের আদর, আর অনেক অনেক ছেলেবেলা সবটা নিয়ে ছিল স্বপ্নের সাতদিন। রাকা কিন্তু পৌঁছেই একটু ফ্রেশ হয়েই চলে গিয়েছিল অঙ্ককাকুর বাড়ি। আসলে ওদের আর শঙ্করকাকুদের বাড়ি পাশাপাশি। ছোটবেলায় রাকা, সাহেব, পাপাই এদের সবাইকে একসাথে খেলতে দেখলেই কাকু অঙ্ক করাতে বসত। তাই ওরা মজা করে ডাকত অঙ্ককাকু। সাহেব কিন্তু অঙ্ককাকুরই ছেলে। রাকা তো আসলে সাহেবের খোঁজেই এত সকাল সকাল চলে এসেছে।
রোজ বিকেলে ওরা দুজনেই চলে আসত বটতলার মাঠে। এখন তো আর ছোটবেলার খেলাগুলো নেই, এখন দেখা হলেই দুজনের প্রচুর গল্প আর বাড়ি ফেরার পথে রবিকাকুর দোকানের গরম ফুলুরি।
এক রবিবার থেকে পরের শনিবার। আজই ওদের একসাথে তেলেভাজা খাবার শেষ দিন। কাল সকালেই তো রাকারা বেরিয়ে যাবে।
"আজ একটু দেরি করে যা না, কাল তো চলেই যাবি। চল না একবার ঘাটের দিকটা যাই। সূর্য ডোবার সময় খুব সুন্দর লাগে রে। একবার দেখবি চল।" - ঠিক এই কথাগুলোই বলেছিল সাহেব। রাকার সবটা ছবির মতো মনে আছে আজও।
বাড়ি ফেরার সময় রাকা বলেছিল, "কাল সকাল ন'টায় বেরোব আমরা। আসবি কিন্তু দেখা করতে।"
সাহেব ঘাড় নেড়ে বলেছিল, "হ্যাঁ, সাবধানে যাবি।"
সেদিনের রাতটা রাকার খুব অস্থির লাগছিল। আগেও তো অনেকবার দুর্গাপুর ছেড়ে গেছে। এরকম তো কখনও লাগেনি। কেন এমন লাগছে বুঝতে পারছে না, তবে মনটা ভীষণ অশান্ত ছিল সেই রাতে।
রাতে ভালো ঘুম হয়নি। ভোরের দিকে চোখ লেগে গিয়েছিল। হঠাৎ মায়ের ডাকে ধড়মড় করে উঠে বসল।
"সবাই রেডি রাকা, সাড়ে আটটা বাজে। তাড়াতাড়ি রেডি হ। গাড়ি চলে আসবে এখুনি।" - মায়ের কথার উত্তর না দিয়ে রাকা উল্টে জিজ্ঞেস করল, "মা সাহেব এসেছিল?" মায়ের মুখে 'না' শুনে একটু খারাপ লেগেছিল ঠিকই, তবে ও মনে মনে জানত সাহেব ঠিক আসবে।
গাড়ি চলে এসেছে। এখনই তো বেরোতে হবে। তাহলে কি আর যাবার আগে দেখা হবে না ওর সাথে... এসব ভাবছে এমন সময় পাপাই এসে বলল, "রাকাদি সাবধানে যেও আর খুব তাড়াতাড়ি আবার আসবে কিন্তু।"
"তোর দাদা কোথায়? আসবে না?" - রাকার কথার কোন উত্তর না দিয়ে পাপাই একটা গিফট প্যাক রাকার হাতে দিয়ে বলল, "এটা দাদা পাঠিয়েছে।"
"কি রে কোথায় সাহেব? এখনও ঘুমাচ্ছে তাই না? অলস কোথাকার। থাক ওকে আর আসতে হবে না।"- রাকা মুখে বলল ঠিকই আসতে হবে না, তবে মনে মনে জানত ও আসবেই।
"দাদা বাজারে গেছে। আমাকে এটা দিতে বলে গেছে তোমাকে। রাকাদি তুমি তাহলে রেডি হও। আমি এখন আসি। সাবধানে যেও। আর পৌঁছে ফোন করো কিন্তু। আসি গো, টাটা।"- এটুকু বলে পাপাই বেড়িয়ে গেল।
গাড়ি ছাড়ার সময় হয়ে গেল, এখনও তো সাহেব এল না। তাহলে কি আর আসবে না ও? সত্যি আসেনি সাহেব। রাকার সাথে আর দেখা হল না।
ট্রেন বর্ধমান স্টেশন ছেড়ে নিউ জলপাইগুড়ির দিকে এগিয়ে চলল। রাকার মনে একটাই প্রশ্ন, কেন এল না সাহেব? গতকাল তো ফেরার সময় বলল ও আসবে। তাহলে কেন এল না?
বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে ঢুকে আগে গিফ্টটা খুলল ও। একটা ছোট্ট ক্রিষ্টালের হার্ট আর সাদা কাগজে লেখা রবীন্দ্রনাথের কয়েকটা লাইন...
'দেখো সখা ভুল করে ভালবেসো না।
আমি ভালোবাসি বলে কাছে এসো না
তুমি যাহে সুখী হও তাই করো সখা,
আমি সুখী হব বলে যেন হেসো না।
আপন বিরহ লয়ে আছি আমি ভাল।
কী হবে চির আঁধারে নিমিষের আলো।।'
তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। প্রথম প্রথম দুজনেই চিঠি লিখত আর কখনও ল্যান্ডলাইনে ফোন। ধীরে ধীরে কাজের ব্যস্ততায় আর সময়ের সাথে সাথে যোগাযোগ কমতে থাকে। সেসময় মোবাইল, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এসব ছিল না। থাকলে হয়ত আজ ওদের গল্পটা অন্যরকম হতেও পারত। বাইরে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আর ঘুমিয়ে লাভ নেই। তবে আজ রাকা উত্তর চাইবেই সাহেবের কাছে। কেন সেদিন এল না সাহেব? কেন মন খুলে জানাল না ওকে ওর নিজের গল্পটা?
অফিস থেকে ফিরে রাকা সেদিন আর সময় পায়নি, রাতের আগে আর হয়ত ফোন করাও হবে না। ছেলেকে ঘুম না পাড়ালে যে ও নিজের জন্য এক মূহুর্ত সময় পায় না।
"কিরে ঘুমিয়ে পড়েছিস?"- রাকার কথার উত্তরে সাহেব বলল, "একটু হোল্ড কর, মেয়েকে ঘুম পাড়ালাম জাষ্ট।"
"হ্যাঁ রে বল এবার। জানিস তো মিঠি আমাকে ছাড়া ঘুমোয় না। তুই এখনও জেগে? ছেলে ঘুমোয়নি?" -সাহেব বলল।
"ও ঘুমিয়েছে বলেই তো ফোন করতে পারছি। তোর সাথে একটা কথা আছে।" - রাকার কথা শুনে সাহেব বলল, "হ্যাঁ, বল না কি?"
"তুই সেদিন আসিসনি কেন?" - রাকার কথায় অবাক হয়ে সাহেব বলল, "কোন দিন? কোথায় আসার কথা বলছিস?"
"যেদিন আমরা চলে এলাম দুর্গাপুর থেকে। তুই বলেছিলি সকালে দেখা করবি। বল কেন এলি না? আর পাপাই-এর হাতে যে গিফ্ট আর চিঠিটা পাঠিয়েছিলি সেটা নিজে হাতে দিতে পারলি না? কবিতার লাইনগুলো না পাঠিয়ে নিজের কথাগুলো নিজের মতো করে বলতে পারলি না? কেন বল???" - রাকার কথার কোন উত্তর সেদিন দিতে পারেনি সাহেব। অনেকক্ষণ চুপ করে ফোনটা ধরে থাকার পর শুধু বলেছিল, "আজ রাখি।"
রাকা জানত কোন উত্তর সে পাবে না। তবুও এত বছর ধরে যে কথাগুলো মনের ভেতর দানা বেঁধেছিল সেগুলোর উত্তর পাওয়া খুব দরকার ছিল। এবারও সাহেব কিছু বলল না। ও কি কোনোদিনও কিছু বলবে না। ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল রাকা।
সকালে ঘুম ভাঙতেই যথারীতি ফোনটা হাতে নিয়েই দেখে সাহেবের মেসেজ। কাল রাতেই করেছিল। রাকা খেয়ালই করেনি। আবারও কয়েকটা লাইন,
'সেদিন তোর ছিল যাবার তাড়া, আর আমার হারানোর ভয়...
তবে এখন আর কিছু হারাবার নেই, আছে পুরোনো বন্ধুকে নতুন করে ফিরে পাবার আশা।।'
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴