অপেক্ষা
অপেক্ষা
আশিস কুমার খাজাঞ্চি
^^^^^^^^^^^^^^^
সেদিন গোধূলিতে খবর পেলাম সব যন্ত্রণা পিছনে ফেলে চিরবিদায় নিয়েছে সে। এখন নাভাঙা ঘুম- রাজ্যের বাসিন্দা। পরম শান্তি পেলাম। দুচোখ একটুও ভেজেনি।
আমার
বড়পিসি - আমার সব থেকে কাছের বন্ধু, আমার শিশুবেলা থেকে বড়বেলা, আমার মা - আর নেই। দিন কয়েক আগে থেকেই গ্রামের বাড়ি থেকে মুঠো ফোনে একাধিকবার খবর আসত ," তোকে বারবার দেখতে চাইছে, একবার আয়।"
মারণ ক্যান্সারের অসহ্য যন্ত্রণা, দিনরাত কাতরানি, চিৎকার, চেঁচামেচি নিত্য সাথী হয়ে উঠেছিল শেষের দিনগুলোতে। ঐ স্মৃতির ভার বয়ে না বেড়াতে শেষ দেখার ইচ্ছেটাকেও সিন্দুকে বেঁধে রেখেছিলাম। আমাদের গাঁয়ের বাড়ি থেকে পিসির বাড়ির দূরত্ব মিনিট দশেকের। পিসির বিয়ের আগে অবধি পুরোটা সময় তার কাছেই কেটেছে। বাড়ির বাইরে পা রাখার পরেও খাওয়া ঘুম ছাড়া বাকি সময়টুকু পিসির কাছে কাটাতাম। এমনকি খাওয়াটাও প্রায়ই ওখানে হত। গ্রামের বাড়িতে যেতে আগে পিসির বাড়ি। আমি সোনারপুর থেকে বাড়ি ফিরব বাতাসের কাছে বার্তা পেলেও বারান্দায় পথ চেয়ে বসে থাকত। আগে পিসির কাছে, তারপর রাতের দিকে বাড়িতে যাওয়া। সেটা অভ্যেসে দাঁড়িয়েছিল। সুস্থ অবস্থাতেও প্রায়ই বলত ছেলেমেয়ে দুজনকে দেখিস, ওদের আর্থিক সাহায্যের প্রয়োজন হবে না। শুধু পাশে থাকিস।
জোর করে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে ব্রেস্ট টিউমার অপারেশন করানোর পরেই জীবনের সীমারেখা ডাক্তাররা স্পষ্ট এঁকে দিয়েছিলেন। তখন শেষ পর্যায়। একসময় কেমোরাও ক্লান্ত হল, হার মানল অপরাজেয় ক্যান্সারের কাছে। পঞ্চাশও ছোঁয়া হল না। আমার "স্নেহ" শব্দটির সংজ্ঞা না ফেরার পথে পাড়ি দিল।
মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে জানিয়ে দিলাম আমি যাব না। সে রাতের ঘুম তখন পিসির ডাকে বাঁধা,"একবার এলি না?" মনের সাথে লড়াই-এ হেরেই চলেছি। লেকটাউনে পরের দিন উচ্চ মাধ্যমিকের খাতা জমা দেওয়ার শেষ দিন। হেরেই গেলাম। একটু বেলার দিকে প্রধান পরীক্ষককে ফোন করে বারবার অনুরোধ করায় একদিন পরে দেওয়ার শর্তে অনুমতি মিলল।
মনস্থির করতে ইতিমধ্যে অনেক দেরি হয়েছে। ভাবলাম শ্মশানের ধোঁয়া টুকুই হয়ত পাব। বাড়িতেও কাউকে জানাইনি। খাতার প্যাকেটটি সাথে নিয়ে সোনারপুর থেকে বেরিয়ে পড়ি। ঘন্টা চারেক কমপক্ষে সময় পথকে দিতেই হবে। মাঝপথে বাড়িতে ফোন করে কাজের দিদির কাছে জানতে পারলাম এতক্ষণ দাহন করা শেষ হয়ে গেছে, বাড়িতেও কেউ নেই। সরাসরি শ্মশানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। শেষ নদী রায়মঙ্গল পেরিয়ে পাড়ার কাছাকাছি এসে জানতে পারি এখনও বাড়িতেই আছে।
পৌঁছে দেখলাম আমার মায়াভরা পৃথিবী আমার পিসি ওদের বাড়ির উঠোনে ঘুমিয়ে আছে। কপালে লাল সিঁদুরের টিপ,পায়ে আলতা। আমার মা, কাকিমা ও আরও অন্যান্যরা তাকে ঘিরে বসে আছে। মা আমাকে দেখা মাত্রই বলল," সেই এলি একদিন আগে আসতে পারলি না?" আমার কাছে কোন জবাব ছিল না। পিসির ছেলে, মেয়ে আর উপস্থিত জনেদের থিতিয়ে আসা কান্না আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেল। নীরবে পিসির মাথার কাছে বসলাম। মাথায়, কপালে কয়েকবার হাত বুলিয়ে শুধু বললাম, '' ঘুমাও, সেই কবে থেকে ঘুমাতে পারনি। পৃথিবীর কোন যন্ত্রণা তোমার ঘুমে আর বাধ সাধবে না।"
বারান্দায় ব্যাগ রেখে বসে রইলাম, আমার প্রিয় পিসিমাখা বারান্দায়। পুটু, পিসির মেয়ে, এখন এক উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষিকা। 2007-এ মায়ের মৃত্যুর অল্প কিছুদিন বাদে চাকরি পায়।
ও বলল, "দাদা, তোকে দেখার জন্যে দিনরাত শুধু বলত বড়পাগলকে একবার আসতে বল। শেষ নিঃশ্বাস ফেলার আগে অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বাবার পায়ের কাছে আছড়ে পড়ল। ঐ শেষ।" পিসি আমাকে বড়পাগল বলে ডাকতো। আমাদের গ্রামের দিকে বড় ছেলেকে বড়পাগল আর ছোট ছেলেকে বাছাপাগল বলে ডাকটা প্রচলিত।
শবযাত্রী হতে আমার আমি রাজি হল না। আমার ঐ মায়ের দেহ আমি আগুনে চিতাভস্ম হতে দেখতে চায়নি। বড় লাল সিঁদুরের টিপ পরা ঘুমন্ত স্মৃতিটুকু না হয় শেষ দৃশ্যে আমার জন্যে থাক। এসব ভাবছিলাম।
বিস্ময়ে আমার দুচোখ দাঁড়িয়ে গেল, যখন দেখলাম ''পিসিময় আমি - আমিময় সে'' চার জনের কাঁধে চেপেছে তার শেষ খেয়ায় পাড়ি দিতে। আমি আসার পর পুর ঘটনাটি সাত-আট মিনিটের মধ্যে ঘটে গেল। দশ মিনিট আগেও তো হতে পারতো। "তবে কি নিথর দেহেও তার একান্ত আদরের ছেলেটির অপেক্ষায় ছিল!!!"
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴