মনের মতো করে নিজেকে সাজিয়ে তুলছিল আনন্দী। শাড়ির গাঢ় এই মেরুন রং খুব ভালো যায় ওর কমপ্লেক্সনের সঙ্গে। হাতে, কানে, গলায় অক্সিডাইজের গয়নায়, চোখের আর ঠোঁটের হালকা রঙে, কপালের টিপের উজ্জ্বলতায় আয়নায় একান্ত নিজের 'আমার আমি'কে মন দিয়ে দেখছিল বহুদিন পর। ভালোবাসছিল প্রাণভরে।
'মামণি, কোথায় তুমি?'.... বিথীকার ক্ষীণ কন্ঠস্বর ভেসে আসে পাশের ঘর থেকে। শাড়ির আঁচল কাঁধ ছাড়িয়ে পিঠের দিকে ছড়িয়ে দিতে দিতে শাশুড়ি মায়ের ঘরের দিকে পা বাড়ায় আনন্দী।
ছেলের বিয়ের বছর কয়েক আগে একটি দুর্ঘটনায় সাঙ্ঘাতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিথীকাদেবীর শরীরের বেশ কিছু অংশ। ব্যয়বহুল অস্ত্রোপচার ওনার প্রাণ বাঁচিয়ে দিলেও শরীরকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। এই মানুষটি একসময় কত অল্প বয়সে স্বামীহারা হয়ে শক্ত হাতে ছেলেকে মানুষ করেছেন। অরুনাভর যাবতীয় দুর্বলতা তাই মাকে ঘিরে। বিয়ের পর মাকে দেখাশোনার কোনো অবহেলা যাতে না হয়, শুধুমাত্র কাজের লোকেদের ভরসায় পড়ে থাকতে না হয় ওনাকে, তাই ফাইন আর্টসের কৃতী ছাত্রী আনন্দীর সমস্ত উচ্চাশাকে বিসর্জন দিতে হয়েছে। পেশা হিসেবে তো দূরস্থান, ভালোবাসার বিষয়টিকে নেশা বা চর্চা হিসেবেও ধরে রাখতে পারেনি সে। বিয়ের এক বছরের মাথায় ছেলে এসেছে। সময় বয়ে গেছে নিজের ধারায়। সেই ছেলেও বিগত কিছু বছর যাবৎ পড়াশোনার সূত্রে ও এখন সদ্য পাওয়া চাকরি নিয়ে বাড়ি থেকে অনেক দূরে।
'এই তো আমি....'
ওনার সারাদিনের যাবতীয় কিছুর নির্ভরতা আনন্দীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার বালিশে মাথা ছোঁয়ালেন বিথীকা। চোখের দৃষ্টিও ক্ষীণ এখন.. শ্রবণশক্তিও। যে কারণে আনন্দীর শয্যাও এখন পাকাপাকি ভাবে স্থানান্তরিত হয়েছে শাশুড়িমায়ের পাশটিতে।
বহু বছর পর আজ সন্ধেবেলা অরুনাভর কাছ থেকে কিছুটা সময় চেয়ে নিয়েছে আনন্দী। অফিস থেকে অরুনাভ ফিরে এলেই তার গন্তব্যে রওনা দেবে সে। বাইরে সন্ধের ছায়া গাঢ় হচ্ছে ক্রমাগত। একে একে ঘরগুলোয় বাতি জ্বেলে দিতে দিতে ড্রইং রুমের দেওয়ালে টাঙানো ছবিটিতে এসে দৃষ্টি স্থির হয় আনন্দীর। পিছিয়ে যায় আরও প্রায় দুটো বছর।
সেবার তিন চারটে দিনের জন্য অরুনাভর ভরসায় বিথীকা দেবীকে রেখে ছেলের ডাকে কলকাতা ছুটতে হয়েছিল আনন্দীকে।ছেলের পড়াশোনার জন্য থাকবার অস্থায়ী বাসাবদল, গোছগাছ এসবে সাহায্য করবার জন্যই যাওয়া। এরই ফাঁকে একদিন ছেলের সঙ্গে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করতে করতে একটি চিত্র প্রদর্শনীতে ঢুকে পড়েছিল ওরা। এ ছবি, সে ছবি দেখতে দেখতে একটি ছবিতে এসে চোখ আটকে গিয়েছিল আনন্দীর। ছবিটিতে আকাশী শাড়ি পরে থাকা এক নারীর প্রতিকৃতি, যে দুহাত আকাশের দিকে তুলে মুখে অনাবিল আনন্দ নিয়ে বৃষ্টিকে বরণ করে নিচ্ছে। ছবিটি শিল্পীর রং ব্যবহারের অসাধারণ নৈপুণ্যে বৃষ্টির নেমে আসা, বিদ্যুতের চমক, ঝড়ের উন্মত্ততা সবকিছু মিলে বড় বেশি বাস্তব। বৃষ্টিস্নাতা মেয়েটিকে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে ভেতর থেকে কেঁপে উঠেছিল আনন্দী। এ তো হুবহু তারই মুখ। কতগুলো বছর আগে ফেলে আসা সেই দিনটিই যেন উঠে এসেছে এই ছবিতে। ছবিটি তৎক্ষণাৎ সংগ্রহ করেছিল সে। ছবিটির নীচে খুব ছোট করে লেখা ছিল, 'পিছুটান'....আর তার নীচে চিত্রকরের নাম ....।
এরপর এক আশ্চর্য কৌতূহল ভর করেছিল আনন্দীকে। মন বলছিল, এমনও সম্ভব?যার হাতের নিপুণ কাজে আনন্দীর মুখটি আঁকা হয়েছিল তাকে ঘিরে তীব্র এক আগ্রহ তাড়া করতে শুরু করেছিল। শিল্পীর নাম জানা থাকায় নেট সার্চ করে ওনার সৃষ্টি সম্ভার খুব সহজেই চোখের সামনে এসেছিল। ওনার সৃজনের পসরা ধন্য করছিল আনন্দীর শিল্পীসত্তাকে। দুচোখ ভরে ওনার নিখুঁত কাজগুলো দেখতে দেখতে মন সবসময় বলে উঠত, 'হ্যাঁ, ঠিক এমনই তো.. ঠিক এমনই আমিও করতে চেয়েছিলাম..' আনন্দীর স্বপ্নের সৃষ্টিরা এই জাদুকরের সোনার কাঠির ছোঁয়ায় জেগে উঠেছিল যেন। আঁকার মাধ্যমে যে ভাবনা, যে কথা, যে গল্প বোনার বীজ আনন্দীর মনে গাঁথা ছিল, তারই স্ফূরণ ছিল এই শিল্পীর সৃষ্টিগুলি। নিজের হারিয়ে ফেলা সুপ্ত ইচ্ছেগুলোকে এত জীবন্ত, এত প্রাণময় করে খুঁজে পেয়ে এর স্রষ্টাকে নিজের অজান্তেই কখন যেন ভালোবাসতে শুরু করেছিল সে। যার মনে ওর নিজের ভাবনার সেই পিছুটানের ছবি আঁকা আছে, সেই মানুষটিকে দেখবার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাড়া করছিল ওকে। ছবিতেই দেখা হয়েছিল। শিল্পীর কাজের সঙ্গে শিল্পীর ছবি খুঁজে পেতে দেরি হয়নি। মনের মধ্যে গেঁথে নিয়েছিল পুরোপুরি অপরিচিত অথচ মনের খুব কাছাকাছি জায়গা করে নেওয়া সেই মুখটিকে। আনন্দীর একঘেয়ে ছন্দে বয়ে চলা প্রাত্যহিক জীবন প্রাণ পেয়েছিল। বসন্ত হারিয়ে গিয়েও ফিরে এসেছিল তার দোরগোড়ায়।
আনন্দীদের শহর থেকে বেশ কাছেই একটি শহরে দুদিন আগেই এই স্বনামধন্য চিত্রকরের আঁকার প্রদশর্নী ছিল। আজ ঘরে ফিরবার পথে কয়েক ঘন্টার জন্য আনন্দী যেখানে থাকে সেই শহরে, তাদের বাড়ির খুব কাছেই আসবেন উনি, প্রধান অতিথি হিসেবে খুব নামী একটি সংস্থার বাৎসরিক অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করতে। এর সবটাই স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছিল আনন্দীর।
মানুষটিকে অনেক দূর থেকে হলেও একবার শুধু চোখের দেখা দেখবার জন্য অধীর প্রতীক্ষা জমছিল চোখের তারায়। ওনার সৃষ্টিই আনন্দীর সঙ্গে ওনার একমাত্র সংযোগ আর 'পিছুটান' এক অপার বিস্ময়, যা থেকে এই ভালোবাসার পথচলা শুরু। অরুনাভর কাছে তাই আজ নিজের স্বভাবের বাইরে গিয়ে আর্জি রেখেছিল অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবার।
সন্ধে গড়িয়ে রাতের দিকে এগিয়ে চলেছে। অরুনাভ ফেরেনি এখনও। আনন্দীর পরিপাটি সাজগোজ অনেকটাই শিথিল এই মুহূর্তে। ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে অনুষ্ঠানের শেষে প্রতীক্ষার মানুষটি এখন হয়তো বা ঘরে ফেরার পথে। চোখের কোণে অভিমান জমছে আনন্দীর। না, অরুনাভর প্রতি অভিমান নয়, অরুনাভর থেকে কোনো প্রত্যাশাই রাখেনি সে এতগুলো বছরে। অভিমান হচ্ছে নিরপরাধ, অদেখা, সেই অর্থে সম্পূর্ণ অচেনা সেই মানুষটির ওপর। এত ব্যাকুলতা যার জন্য, তিনি আনন্দীর ডাক শুনতে না পেয়ে এত কাছে এসেও কেনো দেখা না দিয়ে চলে গেলেন! একতরফা এই আবেগ অর্থহীন জেনেও বাষ্প জমছে মনের আকাশে। বৃষ্টি হয়ে নেমে আসছে চোখের কোল বেয়ে অঝোর ধারায়।
ততক্ষণে বাইরেও কালবৈশাখীর তান্ডব, সঙ্গে অঝোর ধারায় বর্ষণ শুরু হয়েছে। মনের মধ্যে কী যেন হয়ে যায় আনন্দীর। বন্ধ দরজা খুলে একছুটে নেমে আসে খোলা লনে। আকাশের দিকে দুহাত তুলে বৃষ্টির কাছে সঁপে দেয় নিজেকে। চোখের অভিমানী কাজল বৃষ্টি আর কান্নায় ধুয়ে যেতে যেতেও মনের গভীরে প্রিয় নামটিকে লিখে রাখে সযত্নে।