সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
27-November,2022 - Sunday ✍️ By- স্বর্ণজিৎ ভদ্র 164

অগস্ত্য যাত্রা

অগস্ত্য যাত্রা 
স্বর্ণজিৎ  ভদ্র 
÷÷÷÷÷÷÷÷÷

জানলা খুলতেই জোলো ঠাণ্ডা হাওয়া মুখে এসে লাগল। সবে ভোরের আলো ফুটেছে। জানলার সামনে রাখা এই চেয়ার টেবিলে বসেই আজকাল দিনের বেশি ভাগ  সময় কাটে সুবিমলের । আগে এই টেবিল চেয়ার থাকত বসার ঘরে। বসার ঘরটি বেশ বড় হওয়ায়,  তারই একপাশে সুবিমলের লেখালেখির জন্য জায়গা করে দিয়েছিল বীথি। এখন আর ওঘরে বিশেষ যাওয়া হয় না। তেমন আর কেউ তো আসেও না আজকাল। গত দুই দিন ধরে অবিরাম বৃষ্টি হয়েই চলেছে। সকালের দিকে বৃষ্টির জোরটা বেশি থাকে। খোলা জানলা দিয়ে জনশূন্য রাস্তায় বেশি দূর দৃষ্টি যায় না। কালো পিচের রাস্তাটি ক্রমশ ধোঁয়াটে হয়ে মিলিয়ে গেছে। ঘুম থেকে উঠে মনে হয়েছিল আজ অনেক কিছু লিখবে। পাতার পর পাতা লিখেই চলবে বৃষ্টির নিরবচ্ছিন্ন ধারার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। কিন্তু টেবিলের সামনে বসে লেখার ইচ্ছেটা চলে যায় সুবিমলের। চেয়ারে হেলান দিয়ে বুকের উপর হাত দুটি জড়ো করে চোখ বোজে।
 আজ  একুশে জুলাই, বীথির জন্মদিন। সুবিমল হিসাব করে, পুরো তিন মাস দশ দিন হল।  এমনই আকাশ  ভেঙে  বৃষ্টি এসেছিল সেদিন। বড় অদ্ভুত নিঃশব্দ ছিল বীথির  চলে যাওয়াটা। ঘটনার আকস্মিকতায় কয়েকদিন ঘোরের মধ্যে ছিল সুবিমল। অনেকজনের মাঝে মনে হতো, বীথি আছে কোথাও এখানেই, আসেপাশে, সবার মাঝে মিশে। এখুনি হয়ত স্বভাবসিদ্ধ ব্যস্ত পায়ে ও ছুটে বেড়াবে এঘর ওঘর। সে যে আর কোনদিন আসবে না, আর কোনদিন তাকে দেখা যাবে না, এই কঠোর সত্যের উপলব্ধি হতে বেশ কিছুদিন সময় লাগে সুবিমলের। ছেলে মেয়ে সবাই এসে তাদের সাধ্য মতো কর্তব্য করে গেছে। ওরা চলে যাবার পর সুবিমলের সঙ্গী হয় শূন্যতা আর একাকিত্ব। প্রথম প্রথম সারাদিনে ফোন আসতো অনেক। পরিচিতরা খোঁজ খবর নিত। ধীরে ধীরে ফোনের সংখ্যা কমতে শুরু করে। আজকাল সময়ের বড় অভাব, সবাই ব্যস্ত। শুধু অফুরন্ত সময়ের ভারে নুজ্ব্য সুবিমল অপেক্ষা করে অবসরের। 
 বেশ শীত শীত করছে, একটু চা খেতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু এখন রান্না ঘরে গিয়ে চা করতে ইচ্ছে করছে না। অনিতা আসা অবধি অপেক্ষা করবে কিনা ভাবে। এমনিতে আটটা নাগাদ অনিতা আসে। তবে আজ যা বৃষ্টি, আসতে হয়তো ওর দেরিই হবে। সুবিমল রান্না ঘরে গিয়ে চায়ের জল বসায়। উপরের ক্যাবিনেট থেকে চা পাতার কৌটা নামাতে গিয়ে দেখে তাকের ভেতরে নোংরা জমেছে, দু তিনটে আরশোলা ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেকদিন পর রান্নাঘরটা ভাল করে দেখে সুবিমল। মনে হচ্ছে এক মলিন আচ্ছাদনে সারা ঘর কেউ ঢেকে রেখেছে। আজকাল এই ঘরের ব্যবহার তেমন আর হয় না। অনিতা দুই বেলা এসে শুধু চা আর একটু জলখাবার তৈরি করে। হোম ডেলিভারিতে যা দেয় খেয়ে নেয় সুবিমল, গরম করার ঝামেলাতে আর যায় না।
বৃষ্টি মাথায় করে সময় মতোই আসে অনিতা। সকালের চা টা আর পুরো খাওয়া হয়নি, অর্ধেক পড়েই আছে। টেবিল থেকে কাপটি নিতে গিয়ে অনিতা বলে,
-“জ্যেঠু, তুমি আর একবার চা খাবে?”
“আরে ঠিক বুঝতে পারিনি। চা পাতাটা বোধহয় বেশি দিয়ে ফেলেছিলাম, কড়া হয়ে গেছে। তুই আর একবার একটু করে দিস।”
একটু পরে অনিতা দুধ কর্নফ্লেক্সের বাটিটা টেবিলের উপর রাখে,
-“এটা আগে খাও, তারপর চা করে দিচ্ছি।“
এর মধ্যে নতুন কিছু লেখা আর শুরু করা হয়নি। অসম্পূর্ণ একটি লেখাকেই  মাঝে মাঝে এগিয়ে রাখার চেষ্টা করে। অনিতা আসলে ওর সাথেই যা দু চারটে কথা হয় সারাদিনে। বাকি কথা তো সব নিজের সাথেই, বক্তা এবং শ্রোতার দুই ভুমিকাতেই সুবিমল স্বয়ং। লকডাউনের আগে অনিতা একটা নার্সারি স্কুলে বাচ্চা দেখাশোনার কাজ পেয়েছিল। মেয়েটা উচ্চ মাধ্যমিক পাস জেনে, বীথিই তদ্বির করে কাজটি করে দিয়েছিল। কে জানে এই অবস্থায় ওদের মায়নাপত্র দেয় কি না? 
 অনিতা ঘর মুছতে আসলে, সুবিমল বলে
- “হ্যাঁ রে, স্কুল থেকে মায়না টায়না ঠিকঠাক দেয় তোদের?” 
 মাথা নাড়ে অনিতা।
-“পুরো বেতন দেয় না, গত বছর দিত, এবছর কম দেয়।”
-“স্কুল থেকে মায়না ঠিক মত পাচ্ছিস না, তোর তো তাহলে অসুবিধা হচ্ছে।”
 ঘর মোছা বালতির সামনে উবু হয়ে বসে অনিতা। জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকায়। একটু হতাশ গলায় বলে, 
“ওই জন্যই তো একটা নতুন কাজ নিলাম, যতদিন না ইস্কুল আবার আগের মত হয়, ততদিন করে দেখি।”
সুবিমল জানে, লোকের বাড়ি কাজ করতে ভাল লাগে না মেয়েটার।  আত্মসম্মান বোধ প্রবল ওর। 
বৃষ্টির তেজটা একই রকম আছে। বারান্দায় এসে দাঁড়ায় সুবিমল। ব্যালকনির টবগুলিতে একটু জল দিতে পারলে ভাল হতো। বীথিকে কোন উপহার দিলে, সুবিমলকে তার সাথে একটি গাছের চারা দিতেই হতো। নিচের ছোট্ট বাগানটা বীথির হাতেই তৈরি। রঙ্গন মাধবীলতা বেল হাসনুহানা চাঁপা সব গাছ গুলি ফুলে ভরে আছে। কেন জানি বার বার মনে হচ্ছে, সুপ্ত স্পৃহা নিয়ে বীথি আজও অপেক্ষা করে থাকবে কোন নতুন উপহারের জন্য। তবে পার্থিব এমন কিছুই নেই যা বীথিকে এখন দেওয়া যাবে, আজ ও সব চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে। নিজের হাতে গড়া সংসার ঘর বাড়ি এতকাল ধরে গড়ে ওঠা অগণ্য সম্পর্কের বাঁধন, সব এক লহমায় ছিন্ন করে চলে গেছে ও। সুবিমল বুঝে পায় না কী সেই অঘম টান,যা অগ্রাহ্য করতে পারেনি বীথি, চলে গেল সম্পূর্ণ একা। সুবিমলের দৃষ্টি ঝপসা হয়ে আসে। ঘরে ফিরে আবার নিজের চেয়ারে এসে বসে। টেবিলের উপর রাখা ছবিটা অমরকন্টকে তোলা। নর্মদার তীরে বসে বীথি। গায়ের হলুদ শালের উপর শেষ বেলার রোদ এসে পড়েছে। বীথির এক ছাত্রীই ছবিটা বাঁধিয়ে দিয়েছে। ছবির দিকে তাকিয়ে সুবিমল মনে মনে বলে,  “নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে/ রয়েছ নয়নে নয়নে,/ হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে/ হৃদয়ে রয়েছ গোপনে”।
বাড়িতে সবার জন্মদিনেই বীথি পায়েস করত। বাধ ছিল শুধু নিজের বেলায়। ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে মার জন্য কেক আনত, কিন্ত পায়েস হতো না। সংসারের অমঙ্গলের দোহাই দিয়ে বরাবর এড়িয়ে যেত বীথি। এক অচেনা আনন্দে সুবিমলের মনটা ভরে ওঠে। এমন কিছু অমঙ্গলের অপেক্ষাতেই তো ও প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠে। প্রতীক্ষার অবসান যত তাড়াতাড়ি হবে ততই ভাল। 
ফোন থেকে একটি নাম্বার ডায়াল করে সুবিমল। ওপাশে পরিচিত মহিলার স্বর, 
“হ্যাঁ কাকু বলুন।”
সুবিমল একটু আমতা আমতা করে বলে,  “হ্যাঁ, মানে আজ মেনুতে একটু পায়েস পাওয়া যাবে?”
সুবিমলের আবদারে মহিলা সম্ভবত একটু অবাক হয়। ইতস্ততঃ করে বলে, “পায়েস তো এখন সম্ভব হবে না, তবে রসমালাই অথবা রাবরি দিতে পারব। চলবে কি?” অসম্মতি জানিয়ে ফোন রেখে দেয় সুবিমল। অনলাইনে অর্ডার দিলে ওরা কি পায়েস দিতে পারবে? অবশ্য তাতে লাভ নেই, কারণ ওসব কিভাবে অর্ডার দিতে হয় তা জানা নেই। অনিতাকে বললে অবশ্য হয়, নাকি নিজেই একবার চেষ্টা করবে। একটু আধটু রান্না জানে ঠিকই কিন্তু পায়েস কোন দিন করেনি। চিন্তায় ছেদ পরে অনিতার ডাকে, “জ্যেঠু, দরজাটা বন্ধ কর, আমি আসছি”। পেছনে তাকিয়ে দেখে অনিতা কখন যেন এসে দাঁড়িয়েছে।
অনিতা যাবার পর মেয়ের ফোন আসে। বেশ কিছুক্ষণ কথা হয় সুবিমলের সঙ্গে। শরীর স্বাস্থ্যের খোঁজ খবর নেয় মেয়ে। তবে বীথির বিষয়ে কোন কথা বলে না, হয়তো ইচ্ছে করেই প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যায় ও। দুপুরে খেতে বসে আজ কিছুই ভাল লাগল না। মুখটা বড় বিস্বাদ হয়ে আছে। বিছানায় অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করার পরেও ঠিকমতো ঘুম হয় না। তন্দ্রা ভাঙল কলিং বেলের শব্দে। এই বেলা অনিতার সামান্য কাজ থাকে। উঠতে গিয়ে বুঝতে পারে শরীরটা ঠিক নেই। এখন বৃষ্টি কমলেও আকাশ ভার হয়ে আছে। চা খেয়ে ধীরে ধীরে তৈরি হয় সুবিমল। অনেকদিন পর ছাতাটা খুঁজে বের করে। অনিতা চলে গেলেই সে বেড় হবে। 
 বসার ঘরে এসে থমকে দাঁড়ায় সুবিমল। ওয়ারড্রবের উপর রাখা বীথির বড় ছবিতে ফুলের মালা, কপালে চন্দনের ফোঁটা। সামনে রাখা ফুলদানিতে বাগান থেকে তুলে আনা বৃষ্টিস্নাত ভেজা ফুল। আধো অন্ধকার ঘরে ধূপকাঠির ধোঁয়া ছায়া ফেলেছে বীথির মুখে। ল্যাম্পশেডের আলোতে কাঁচের গ্লাসে রাখা জল যেন স্বচ্ছ স্ফটিক খন্ড। ছবির সামনে একটি পাত্র ঢাকা। সুবিমল কাঁপা হাতে ঢাকনা তোলে। ধূপ ও ফুলের সুগন্ধ ভেদ করে অনুভব হয় এক অনাবিল সুঘ্রাণ। সুবিমলের মনে হয় তার চার পাশের দেওয়াল গুলি আর নেই। সে দাঁড়িয়ে আছে নৈরজ্ঞনা নদীর তীর। সেনানী গ্রামের কোন বনিক জায়া রেখে গেছে এই পরমান্ন। সুবিমল চলতে শুরু করে সেই নদীর ধার ধরে। প্রার্থনা করে তার এই পথ যেন শেষ না হয়। বুকের ভেতরে চাপ ধরে আসে। দম নিতে কষ্ট হয়। মনে হচ্ছে হৃদপিণ্ডটা বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে। বহু বছর আগে এভাবেই তো পরমান্ন উপচারে সাধনার মার্গ পরিবর্তন করেছিল সিদ্ধার্থ। আজ সুবিমলের পালা, সিদ্ধার্থের পরিত্যক্ত পথেই হবে তার মুক্তি।
কতক্ষণ এখানে বসে আছে খেয়াল নেই। দূরে রাস্তার লাইট গুলি টিপ টিপ করে জ্বলে উঠছে। মাঠের অন্য বেঞ্চে যারা ছিল, এখন আর তাদের দেখা যাচ্ছে না। গোধুলির শেষ রংটুকু ফিকে হয়ে ক্রমশ  ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে মিশে যাচ্ছে। শ্রান্ত ডানায় একে একে সব পাখিগুলি বাসায় ফিরে আসে। নিস্তব্ধ গাঢ় অন্ধকার নেমে আসে সারা মাঠ জুড়ে। একটানা বৃষ্টির শব্দে আচ্ছন্ন সুবিমল অনুভব করে  বীথির উপস্থিতি। নিবিড় স্পর্শে সুবিমলের কাঁধে মাথা রাখে বীথি। সুবিমলের চোখ কপাল গাল ছুঁয়ে যায় বীথি চুল। রাত গভীর হয়, জলধারায়  ভেসে যায় মাঠঘাট বিশ্বচরাচর। বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে অনন্ত যাত্রার দুই পথিক। অবশেষে প্রবল বৃষ্টির ধারায় গলতে থাকে বীথির সত্তা, সুবিমল আপ্রাণ চেষ্টা করে দুই হাত দিয়ে বীথিকে আঁকড়ে ধরে রাখতে। ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে সুবিমল। ঠোঁটটা নড়ছে, কিছু বলার চেষ্টা করছে।  নীচে নেমে হাঁটু গেড়ে বসে, খামচে ধরে ভেজা মাটি। বৃষ্টির জল নোনা হয়ে গড়িয়ে পড়ে দুই গালে। বুক পেতে শুয়ে পড়ে নরম ঘাসের গালিচায়। ভারি হয়ে আসে শরীর, অনেক দিন পর দু চোখ জুড়ে আসে ঘুমে। পরম নিশ্চিন্ত ঘুম। বৃষ্টির জলে গলতে থাকে আরও একটি সত্তা।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri