সুধা সাগরের ঢেউ …
সুধা সাগরের ঢেউ …
রানা সরকার
~~~~~~~~~~~
বাংলা ভাষায় লেখা প্রাচীনতম সাহিত্যিক দৃষ্টান্ত হিসেবে 'চর্যাচর্য বিনিশ্চয়' নামে প্রাচীন বৌদ্ধ দোহার সন্ধান দিলেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। নেপালের রাজদরবার থেকে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি অনেকগুলি সহধর্মী পুঁথির সঙ্গে বাংলা ভাষায় লেখা 'চর্যাচর্য বিনিশ্চয়' এর পুঁথি খুঁজে পেলেন। পুঁথিটি প্রাচীন বাংলা ও নেপালি অক্ষরে লিখিত। এখান থেকেই বাংলা ভাষার আদি গ্রন্থ চর্যাপদ বাংলা ভাষার দিগ্দর্শন রূপে আমাদের কাছে পরিচিতি পেয়েছে। ভাষা সংস্কৃতির প্রবাহিত ধারাটি নদী প্রবাহের মতোই বাঙালি জনগোষ্ঠীর বৃহৎ জনপদ ও তার জনজীবনকে আবেগপ্লাবিত করেছে। হাজার বছরের পুরোনো আজকের বাংলা ভাষা সময়ান্তরে এক একটি বিবর্তনের মুখে আমাদেরকে দাঁড় করিয়েছে।
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল রাজদরবারে গ্রন্থশালা থেকে যেসমস্ত পুঁথি আবিষ্কার করেন তার মধ্যে যেগুলি তাঁর মতে প্রাচীন বাংলা ভাষায় রচিত মনে হয়েছিল সেগুলিকে একত্র করে ১৩২৩ বঙ্গাব্দে, ইং ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে "হাজার বছরের পুরান বাংলা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা" র সুসম্পাদনা করেন। এরই অন্তর্ভুক্ত হয় 'চর্যাচর্য বিনিশ্চয়'। নদী প্রবাহের মতোই এই ভাষা বিবর্তনের প্রতিটি ধারায় এগিয়ে এসেছে, এর আকার - আয়তন বেড়েছে বিচিত্র পথে। আজ একবিংশ শতাব্দীতে এ ভাষা সহস্রমুখী হয়ে ভাষা সংস্কৃতির অনন্ত প্রবাহে মিলিত হওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। এদেশে আর্য সংস্কার প্রবর্তিত হলে আর্য ভাষা তথা সংস্কৃত ভাষা বাঙালির অধিগত হল। স্বাভাবিকভাবে এর পর প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষাও এদেশে প্রচলিত হল। কালক্রমে সংস্কৃত - প্রাকৃত অপভ্রংশের খোলস ছেড়ে খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীর দিকে বাংলা ভাষার জন্ম হয়। সূচিত হয় ভাষা মানচিত্রে বাংলা ভাষার নিজস্ব এক চিত্রিত ভুবন।
প্রাকৃত ভাষা, সংস্কৃত নাটকে যে কোনো চরিত্রের মুখের ভাষায় দেখা যায়। প্রাকৃতে লেখা কাব্য ও নাটক পাওয়া গিয়েছে। প্রাকৃতের সাহিত্য গৌরব সংস্কৃতের মতো সুদূরপ্রসারী না হলেও তুচ্ছ করার মতো ছিল না। অঞ্চল ভেদে প্রাকৃতের চারটি স্তর আছে।
১) শৌরসেনী প্রাকৃত
২) মহারাষ্ট্রী প্রাকৃত
৩) মাগধী প্রাকৃত
৪) অর্ধমাগধী বা জৈনমাগধী প্রাকৃত ।
এদের মধ্যে শৌরসেনী ছিল শিষ্টজনের ভাষা। মাগধী প্রাকৃত ছিল নাটকে নিকৃষ্টজনের ভাষা। পূর্বভারতের প্রতি উন্নাসিক আর্য্ ব্যাকরণবিদদের এরকমই তাচ্ছিল্যের দৃষ্টান্ত। আমাদের বাংলা ভাষা এই মাগধীরই উত্তর পুরুষ। প্রাকৃত ভাষায় সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম কিছু শিথিল হয়েছিল। এতদ সত্ত্বেও ভাষা শৈলীতে একটা বাঁধন ছিল প্রাকৃত ব্যাকরণও লেখা হয়েছিল। কিন্তু ব্যাকরণের বাঁধন দিয়ে ভাঙনের হাত থেকে প্রাকৃত ভাষাকে বাঁচানো যায়নি। পরবর্তী কালে ভাষার নিয়ম কানুন আরও শিথিল হলে উচ্চারণও আরও বিকৃত হয়ে উঠল। এই পর্যায়টির নাম অপভ্রংশ। আমাদের বাংলা ভাষা এই মাগধী অপভ্রংশের সন্তান। তার আর কটি সন্তানের নাম হলো মৈথিলী, মাগধী, ভোজপুরিয়া, অসমীয়া ও ওড়িয়া। স্মরণ রাখা প্রয়োজন মাগধী অপভ্রংশ থেকেই বাংলা ভাষার জন্ম হল। খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে হয়ত বা তার কিছু আগে ।
খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দী থেকে শুরু করে আধুনিক কাল পর্যন্ত নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা বয়ে চলেছে। এ ভাষার বয়স অন্যূন হাজার বছর। ভাষাগত পরিবর্তনের চিহ্ন ধরে বাংলা ভাষাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। আদি যুগের বাংলা ভাষা বা প্রাচীন বাংলা ভাষার সীমা খ্রিষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত। এরপর মধ্য যুগের বাংলা ভাষার কাল অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত এর বিস্তার।
বাংলা ভাষার আদি পর্বে চর্যাপদের যুগ আমাদের কাছে আলো আঁধারির যুগ রূপে চিহ্নিত। চর্যাপদের ভাষাকে তাই সান্ধ্য ভাষা বলা হয়ে থাকে। দুর্বোধ্য আদি পর্বের এহেন ভাষাকে অধিগত করার জন্য সংস্কৃত ভাষার সাহায্যে বাংলা ভাষার অনাবিষ্কৃত উঠোনটি নিরূপিত হয়েছিল একদিন। ভাষাচার্য্য ড: সুনীতি কুমার চট্ট্যোপাধ্যায় ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষাবিদ ড: মহঃ শহীদুল্লাহ এই সান্ধ্য ভাষাটিকে বাংলাভাষার আদিরূপ বলে চিহ্নিত করেছেন। যৌথ সম্মতিতে এর উপস্থাপনা পরবর্তী ভাবীকালের মানুষ মাতৃভাষার দিগ্দর্শনটিকে চিনে নিয়েছিল।
বাংলা লিপির উৎপত্তি, বিবর্তন ও পরিণতির ইতিহাস সুবিস্তৃত এক বিস্ময়কর অধ্যায়। বাংলা ভাষা যেমন হাজার বছরের পথপরিক্রমায় উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হয়ে পরিপূর্ণ রূপ লাভ করেছে তেমনি বাংলা অক্ষরও নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে বর্তমানের এই রূপ ধারণ করেছে। পুঁথিপত্রের লিপি স্থায়ীপদ লাভ করল ছাপার অক্ষরে। সময়টা ছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ। ছাপার অক্ষরে বাংলা ভাষা প্রকাশে পরিপাট্য এবং এই সময়কালের আগে থেকেই মঙ্গলকাব্যের সূচনা। মঙ্গলকাব্যের সূচনা পর্বে ধর্মমঙ্গল কাব্য। ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে রচিত হলেও লৌকিক জীবনের ছায়াপাত ঘটেছে এই সমস্ত কাব্যে। বাংলা ভাষায় দেবদেবী বন্দনার অন্তরালে মাটির পৃথিবীর মানুষের জীবন কথা তাদের অস্তিত্ব ভাবনা উঠে এসেছে এখানে। বাংলা ভাষায় ছন্দোবদ্ধ পয়ারে এইসব দীর্ঘ কাব্যকথায় আঙ্গিক গত পরিবর্তনে মঙ্গলকাব্যের যুগ ভাষা শৈলীতে অন্য দিগন্ত চিনিয়ে দেয়। মঙ্গল কাব্যের শেষের দিকের কবি রায়গুণাকর ভারত চন্দ্র। অষ্টাদশ শতাব্দীর সংস্কৃতির প্রতীক পুরুষ। ভারত চন্দ্র সাহিত্যে বিশাল কিছু সৃষ্টি করতে চাননি, অষ্টাদশ শতাব্দীর বাস্তব ভোগ, সুখ - কলুষিত অবক্ষয়ী সমাজে তাঁর আবির্ভাব। 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যে এক প্রার্থনায় এই আশা প্রকাশ করেছেন যে "আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।" ভারত চন্দ্রের মনের আকাশ এই ধরণের ধুপ ছায়ার আলো আঁধারে বিচিত্র রেখাময় বিষাদ পূর্ণ দরদি অনুভূতির কাব্যকথার এক ঘনিষ্ঠ আবেগের প্রকাশ।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে ভারত চন্দ্রের মৃত্যুর পর একশত বছরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে কোন স্বচ্ছন্দ গতিপথ ছিল না। কোন প্রগতি গড়ে উঠতে পারেনি। একশত বছরের এই সময়কালের বাংলাভাষার ক্ষেত্রে নেমে এসেছিল বন্ধ্যাত্বকালীন চরম এক দুঃসময়। তবুও এই প্রবহমান ক্ষীণ ধারাটিকে ধরে রেখেছিলেন লোকায়ত জীবনের সাহিত্যপ্রাণ মানুষেরা। এল কবিয়ালদের যুগ। এ যুগের কবিয়ালদের মধ্যে লোকজীবনের কবিগানে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন কয়েকজন উল্লেখযোগ্য কবিয়াল। এঁরা হলেন এন্টনি কবিয়াল, রাম বসু, ভোলা ময়রা প্রমুখ। বাংলা ভাষার ক্ষীয়মান ধারাটি উজ্জীবিত থেকেছিল দীর্ঘদিন। রবীন্দ্রনাথের কাব্যগুরু বিহারীলালের আবির্ভাবকাল পর্যন্ত কবিয়ালদের যুগ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যগুরুর আবির্ভাবকাল প্রসঙ্গে তাই বলেছেন অন্ধকারের পর ভোরের কুঞ্জে প্রথম গেয়ে ওঠা প্রভাত পাখির গান। বাংলা ভাষা সাহিত্যে বিহারীলালকে তাই যুগসন্ধিক্ষণের কবি বলা হয়। একথা অনস্বীকার্য যে অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে কবিগান কলকাতা ও তাঁর চারপাশে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এই জনপ্রিয়তা অব্যাহত ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত। কালবৈচিত্র্যের বিচিত্র সমাহারে এরপর আরেক স্বতন্ত্র ধারায় যুক্ত হলেন কবি শ্রী মধুসূদন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মধুসূদন ছিলেন প্রথম আধুনিক কবি। বাংলা সাহিত্যে কবি মধুসূদন ও সমকালীন নব্যকবিদের আবির্ভাবে কবিগানের এই লোকগীতির ধারা ক্রমে ক্রমে লোপ হয়ে গেল।
বাংলা ভাষায় কাব্যরীতি এক ব্যতিক্রমী পৃথক ধারার প্রবর্তন করেন। এই ভাষার প্রথম আধুনিক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। বাংলা কাব্যে তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ভাবধারার সংমিশ্রণ ঘটালেন তাঁর রচিত মেঘনাদ বধ কাব্যে। তিনি সম্পূর্ণ নতুন এক অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রয়োগে পশ্চিমের কাব্য সাহিত্যের সঙ্গে নিজভাষার কাব্যধারার সুনিপুণ মেলবন্ধন সাধিত করেন। সেই অর্থে আন্তর্জাতিক সাহিত্য অঙ্গনে তিনি ভারতীয় সাহিত্য তথা বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যে সংমিশ্রিত ধারাটির প্রবর্তক এবং এই ধারাটিকে উজ্জীবিত রাখার প্রাণ পুরুষ। ইংরেজি ভাষাসাহিত্যে খ্যাতি অর্জনের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া কবি শ্রী মধুসূদন বাংলা ভাষাঙ্গনে ফিরে এসেছিলেন। মধুকবির স্বীকারোক্তিতে –
হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন -/
তা ছেড়ে অবোধ আমি অবহেলা করি -,
পরধনে লোভে মত্ত করিনু ভ্রমণ।
কবি ঈশ্বরগুপ্ত মধুসূদনের সমসাময়িক কবি। তাঁর সম্পাদিত সংবাদপত্র 'সংবাদ প্রভাকর' সম্পর্কে প্রচলিত পংক্তি কবি ঈশ্বর গুপ্তের বিপুল কর্মের পরিচয় তুলে ধরে বাংলা ভাষার উন্নতি কল্পে তাঁর সার্বিক প্রয়াসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনি বাংলা ভাষার প্রয়োগ সুন্দর দিকটির কথা মনে রেখে গুরুত্বপূর্ণ সৃজন কর্মে ঐকান্তিক ও সক্রিয় ছিলেন।
"কে বলে ঈশ্বর গুপ্ত ব্যাপ্ত চরাচর -
যাহার প্রভায় প্রভা পায় প্রভাকর।"
মধুসূদন, হেমচন্দ্র, নবীন চন্দ্র, গিরিশ চন্দ্র -এদের অধিকাংশ রচনার উপাদান পৌরাণিক কাহিনী। দেব দেবীরাই তাদের কাব্য নাটকের প্রধান চরিত্র। কিন্তু তাদের চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে কবিরা পুরোনো সাবেকি ধারাটি অনুসরণ করেননি। জীবনের যুক্তিবাদী সন্ধানী দৃষ্টিকোণ থেকে এঁরা দেবতাদের নতুনরূপে গ্রহণ করলেন। এখানে দেবতারাও সাধারণ মানুষের রূপে দেখা দিল।
ঊনবিংশ শতাব্দীর যুগান্তকারী ঘটনা হল পুঁথির যুগের অবসান এবং মুদ্রণ যন্ত্রের প্রয়োগ। এই আবিষ্কারে নবজাগরণের মন্ত্রটি ত্বরান্বিত হল। সমাজ ও রাষ্ট্রের সমগ্র বিষয় আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বিশেষ করে সাময়িক পত্ৰিকার সাহায্যে বাঙালির জীবনে নবতর জীবনধারার উন্মেষ ঘটল। য়ুরোপের রেনেসাঁস বাঙালির সমাজ জীবনে সংস্কারের পথ দেখাল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালির ধ্যানধারণা এবং বিভিন্ন কর্ম কাণ্ডের প্রতিফলন বাংলা গদ্যে বিপুল ভাবে প্রতিফলিত হতে শুরু করল। পন্ডিত বর্গের অনেকেই মনে করেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পন্ডিতরা এবং মিশনারী সাহেবরা শুধু বাংলা গদ্যের সৃষ্টিকর্মে জড়িত এমনটা নয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর দু-তিনশত বছর আগে থেকেই বাংলা গদ্যের ব্যবহার হয়ে আসছিল। প্রসঙ্গক্রমে বলা প্রয়োজন ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে লেখা কুচবিহার রাজ নরনারায়ণের একখানি চিঠিই হচ্ছে প্রাচীনতম বাংলা গদ্যের দৃষ্টান্ত। এর ভাষা ঠিক আধুনিক যুগের না হলেও একেবারে দুর্বোধ্যও নয়। "তোমার আমার সন্তোষ সম্পাদক পত্রাপত্রি গতায়াত হইলে উভয়ানুকূল প্রীতির বীজ অঙ্কুরিত হইতে রহে-"
বাংলা গদ্যের প্রসার লাভের জন্য ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের এক উৎসাহ ব্যাঞ্জক ভূমিকা ছিল। ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হল। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ১৮৫৪ সাল পর্যন্ত চালু থাকলেও ১৮১৫ খ্রীষ্টাব্দের পর বাংলা সাহিত্যে তার প্রভাব খর্ব হতে শুরু করে। কারণ এই সময়ে রামমোহন রায় কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বাংলা সাহিত্যের উন্নতিসাধনে তিনি সচেষ্ট হন এবং নানারূপ প্রগতিশীল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।
যুক্তিনির্ভর বক্তব্যকে লিপিবদ্ধ করে রামমোহন তাঁর নিজস্ব সৃষ্টিতে বাংলা গদ্যকে সাধারণের দুয়ারে পৌঁছে দিলেন। বাংলা ভাষার গদ্য এখানে সমাজ জীবনের কু-প্রথার বিরুদ্ধে প্রচার কার্যে ব্যবহৃত হল। রামমোহনের বেদান্ত তত্ত্বের বিরুদ্ধে লেখা পুস্তিকাও তাঁর রচনা বলে মনে করা হয়। রবীন্দ্র নাথ রামমোহন সম্পর্কে বলেছেন -'কী রাজনীতি, কী বিদ্যা শিক্ষা, কী সমাজ, কী ভাষা আধুনিক বঙ্গ দেশে এমন কিছুই নাই রামমোহন রায় স্বহস্তে যাহার সূত্রপাত করিয়া যান নাই। ভাষার বিকাশের দিক থেকে তাঁর কথা যথার্থ। গদ্যের মধ্য দিয়েই একটা জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্যের যথার্থ সংবাদ পাওয়া যায়। শুধু কাব্য কবিতায় পুরো বৈশিষ্ট্য ধরা যায় না। তাই গদ্যকে বলা হয়েছে লেখক প্রতিভার 'নিকষ পাথর'।
বাংলা জনকত্ব নিয়ে প্রায়শই সুধী মহলে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। কেউ বলেন রামমোহন বাংলা গদ্যের জনক। কারও মতে সে গৌরব বিদ্যাসাগরের জন্য। কেউ বা বলেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপকরা সেই গৌরব দাবি করতে পারেন। এ পর্যায়ের কোনটিরই স্বপক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ ঊনবিংশ শতকের বহু আগেই বাংলা গদ্যের জন্ম হয়েছিল। চিঠি পত্রাদিতে বাংলা গদ্যের ব্যবহার সুদূর ষোড়শ শতাব্দীতেই পাওয়া যায়। বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের জনক না হলেও শিল্প সম্মত গদ্য রীতির তিনি উদ্ভাবক। তাঁর মৌলিক ও অনুবাদ গ্রন্থগুলির ভাষা এই সত্যতাই প্রমাণ করে। বাংলা গদ্যে যতিচিহ্ন স্থাপন করে, পদবন্ধে ভাগ করে এবং সুললিত শব্দ বিন্যাস করে বিদ্যাসাগর তথ্যের ভাষাকে রসের ভাষায় পরিণত করেন। তাঁর পরিকল্পিত সাধুভাষাই প্রায় দেড় শতাব্দী ধরে বাঙালির লেখনীর মুখে ভাষা জুগিয়েছে। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন -," বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যভাষার উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত, সুপরিচ্ছন্ন এবং সুসংহত করিয়া তাহাকে সহজ গতি এবং কার্যকুশলতা দান করিয়াছেন -এখন তাহার দ্বারা অনেক সেনাপতি ভাব প্রকাশের কঠিন বাধাসকল পরাহত করিয়া সাহিত্যের নব নব ক্ষেত্র আবিষ্কার ও অধিকার করিয়া লইতে পারেন -কিন্তু যিনি সেনানীর রচনা কর্তা যুদ্ধজয়ে যশোভাগ সর্বপ্রথম তাঁহাকে দিতে হয়।"
যুগপর্বের বিভিন্ন ধারায় বাংলাভাষার নির্মাণ ঘটেছে। গদ্যে পদ্যে প্রয়োগ ঘটেছে তার। চর্চিত এই ধারা যুগে, যুগসন্ধিক্ষণে পূর্ণতা পেয়েছে। এই ভাষার অস্তিত্ব বিপন্নের সময়কালেও ভাষাকে রক্ষা করার পুণ্যব্রতে মাতৃভাষার উন্নতিকল্পে স্বহৃদয়তা যুক্ত হয়েছে -তাই হাজার বছরের বাংলা ভাষা বিবর্তনের মধ্যেও নতুন থেকে নতুনতর হয়েছে। এর গদ্যরীতি, বানান ও প্রকাশের আঙ্গিকে যুক্ত হয়ে চলেছে আধুনিকতা ও সমকালীন ভাষাশৈলীর লাবণ্যময় স্ববিশেষ অনুসঙ্গ।
ভাষা বিষয়ক সমীক্ষায় দেখা যায় পৃথিবীর আটটি প্রধান ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষা চতুর্থ স্থানে নির্ণীত হয়েছে। ভাষা মানচিত্রে একুশ শতকের দ্বারপ্রান্তে এসেও বাংলা ভাষাভাষী দুটি পৃথক দেশের মানুষ বাংলাদেশে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড, অসম এবং আন্দামান ও নিকোবরের বসবাসকারী মানুষের একই ভাষা এবং একই জনগোষ্ঠীর মানুষ। শিষ্ট বাংলা ছাড়াও লোকভাষায় বাংলার উপভাষা ও বি-ভাষার সহাবস্থানে বাংলা ভাষা আজ প্রতিবেশী অন্যসব ভাষার সঙ্গেও সৌহার্দ্যের বাতাবরণ গড়ে তুলেছে।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে রক্তাক্ত হয়েছে বাংলা ভাষী মানুষের গৃহ উঠোন - এই আন্দোলনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরের মানুষ নিজ ভাষাকে সম্মান ও শ্রদ্ধায় আগলে রাখার প্রাণের আকুতিতে আন্দোলনকে দীর্ঘায়িত করেছে। অকুতোভয় মানুষ ভাষা স্বীকৃতির লক্ষ্যে আন্দোলনমুখী থেকেছে দীর্ঘকাল। ঔপনিবেশিক শোষণ মুক্তির লক্ষ্যে ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠেছে একটি দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে। পূর্ব দিগন্তের সেই দেশ আজ বিশ্ব মানচিত্রে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র - বাংলাদেশ। পৃথিবীর ইতিহাসে এই বিরলতম ঘটনাকে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে মান্যতা দিয়ে এসেছেন সমগ্র বিশ্বের মানুষ। ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্র সংঘের বার্সেলোনার সম্মেলনে ভাষার অধিকার স্বীকৃতি পায়। ১৯৯৮ সালের ২১শে মার্চ ভ্যাংকুয়েরে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে মাতৃভাষার আন্তর্জাতিক দিবস রূপে পালন করার প্রস্তাব গ্রহণের পর ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর রাষ্ট্র সংঘের ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারির এই দিনটিকে সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রূপে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কার্যকর হয়েছে ২০০০ সালে। পৃথিবীর যে কোনো ভাষার মানুষ ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ভাষা দিবস রূপে গ্রহণ করার পর আজ সারা বিশ্বে ২১ শে ফেব্রুয়ারী একটি ঐতিহ্য পূর্ণ দিন হিসেবে স্বীকৃত।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴