প্রকৃতির রাজ্যে এক অনন্য ডুয়ার্স
প্রকৃতির রাজ্যে এক অনন্য ডুয়ার্স
রানা সরকার
------------------------------------------------
এই নিবিড় বনদেশ। এখানে অরণ্য অভয়। এই অভয়ারণ্যে একদল বুনোহাতি হঠাৎ ঢুকে পরে সাঁওতাল পাড়ায়। বনমধ্যে হাতির খাবার কখনো নিঃশেষিত হয় । এখানে তাই হেমন্তের মাঠভরা ধান মাঝেমধ্যেই লুঠ হয়। এই লুঠেরা একদল ঐরাবত। প্রতিরাতে বনের গভীর থেকে নেমে আসে পাকা ফসলের খেতে। দুঃসাহসী রাতের পাহারাদাররা শক্ত উঁচু গাছে ঘর বাঁধে। এখানে ডুয়ার্সে বনের পাশে ফসলের খেতকে পাহারা দেয়ার এই ঘরকে টং ঘর বলে। হেমন্তের ধানখেতের পাশে এই টং ঘরে উঠে বসে থাকা পাহারাদাররা সারারাত হাতি তাড়ানোর জন্যে বাজি পটকা ছাড়াও হাতির অনুপ্রবেশ ঠেকাতে উদ্ধত মশাল জ্বেলে রাখে। সারা বছরের খাবার জোগাড়ের জন্য হাতির সঙ্গে এই অসম লড়াই। হেমন্তের এই দিনগুলিতে প্রতিদিন দিগন্ত জুড়ে এক একটি খন্ডচিত্র।
এই আবহকালীন ডুয়ার্সের বিভিন্ন সময়ের ইতিহাস আমাদেরকে এক শান্ত সুন্দর সবুজ অরণ্যের জনজীবনের মুখোমুখি দাড় করিয়ে দেয়। এই মুগ্ধ চিত্র আজও তার অতীতকে খুঁড়ে নিয়ে নেপথ্যের দীর্ঘ ইতিহাস এবং জনজীবনের বিবর্তন আমাদেরকে ডুয়ার্স ভূখণ্ডের সঙ্গে পরিচিত করেছে। ১৮৬৬তে সার্জন রেনির 'ভোটান আন্ড দ্য স্টোরি অব দ্য ডুয়ার ওয়ার ' বইটি লেখেন ,তখন পর্যন্ত আজকের জলপাইগুড়ি জেলার জন্ম হয়নি। অবশ্য ১৮৬৫ তে লেখা হয়েছে বঙ্কিমচন্দ্রের " দুর্গেশ নন্দিনী " উপন্যাস। সে সময়েও ছিল ডুয়ার্স শব্দের ব্যবহার। তিস্তার পূর্ব অংশ অর্থাৎ জলপাইগুড়ি শহর থেকে তিস্তা পেরিয়ে যে এলাকা ডুয়ার্স নামে পরিচিত সেখানেও পূর্ব ডুয়ার্স এবং পশ্চিম ডুয়ার্সের ভাগ আছে। " ডুয়ার্স " শব্দটি খুব সঙ্গত ভাবেই দুয়ার বা প্রবেশ দ্বার অর্থে ভুটানে প্রবেশের দরজা ডুয়ার্স এলাকাতেই যুক্ত হয়ে রইলো। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ ভুটান যুদ্ধের পর ১৮৬৯ এ জলপাইগুড়ি জেলার জন্ম হয়। দুটি ঐতিহাসিক ঘটনা সংগঠিত হওয়ার পর আরেক নগরী তথা একটি জেলার গোড়া পত্তনে সমগ্র জলপাইগুড়ি জেলার বিস্তীর্ণ প্রাকৃতিক ভূ-ভাগ ডুয়ার্স নামে চিহ্নিত হয়ে এক ভৌগোলিক ভূখণ্ডের সঙ্গে আমাদের নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়। ভাবতে ভালো লাগে ইতিহাসের পথ অনুসরণ করে বঙ্কিম চন্দ্রের প্রথম উপন্যাস দুর্গেশ নন্দিনী রচিত হয় ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে। বঙ্কিম উপন্যাসের সূচনা পর্বে বললেন -" ৯৯৭ বঙ্গাব্দের নিদাঘ শেষে একদিন একজন অশ্বারোহী পুরুষ বিষ্ণুপুর হইতে মান্দারবনের পথে একাকী গমন করিতেছিলেন। " ইতিহাস মন্থনের মধ্য দিয়ে বিশালাকার চরিত্র গুলিকে নিয়ে বঙ্কিমের স্বচ্ছন্দ বিহার আমাদের কাছে প্রথম উপন্যাসের স্বাদ এনে দেয়। বাংলা উপন্যাসের প্রথম অশ্বারোহী বঙ্কিম স্বয়ং। সমসাময়িক সেই সময়ে অর্থাৎ দুর্গেশ নন্দিনী রচনার চার বছর পর জলপাইগুড়ি জেলার জন্ম। এই ঘটনার আগে এবং পরে এক সঠিক অবস্থানে "ডুয়ার্স " তার অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলো। দ্বিতীয় ঘটনা সার্জন রেনি ১৮৬৬ তে তাঁর লেখা বই 'ভোটান আন্ড দ্য স্টোরি অব দ্য ডুয়ার ওয়ার ' এই দীর্ঘ সমীক্ষায় ডুয়ার্সের আবহকালীন সীমারেখায় এক একটি দুয়ারকে স্পষ্টীকরণ করলেন।
১৮ টি দুয়ারের অবস্থান এবং এ সকলের সংক্ষিপ্ত পরিচয় এই বক্ষমান আলোচনায় আমাদের এক উপলব্ধিতে সমগ্র ডুয়ার্সকে চিনে নিতে সাহায্য করে। দুয়ারগুলি হলো :- ১) ডালিমকোট -আগে পশ্চিম ডুয়ার্সে ,এখন জেলা দার্জিলিং এলাকায়। ২) ময়নাগুড়ি বা জুমের কোর্ট - ছিল পশ্চিম ডুয়ার্সে ,এখন জলপাইগুড়ি জেলায় । ৩) চামুর্চি বা সামচি - আগে পশ্চিম ডুয়ার্সে ,এখন জলপাইগুড়ি জেলায়। ৪) লক্ষ্মী বা লাককি - আগে পশ্চিম ডুয়ার্সে এখন জলপাইগুড়ি জেলায়। ৫) বক্সা বা পশাখা -আগে পশ্চিম ডুয়ার্সে ,এখন আলিপুর দুয়ার জেলায় ৬) ভলকা বা ভুলকা - আগে পশ্চিম ডুয়ার্সে , এখন আলিপুরদুয়ার জেলায়। ৭) বরা - আগে পশ্চিম ডুয়ার্সে, পরে আসামের গোয়ালপাড়ায় ,শেষে কোকরাঝাড় জেলায় । ৮) গুমর - এখন আসামের কোকরাঝাড় জেলায় ,আগে গোয়ালপাড়া জেলায়। ৯) রিপো -আগে আসামের গোয়ালপাড়া জেলায় ,এখন আসামের কোকরাঝাড় জেলায়। ১০) চেরাঙ বা ছেরাঙ - আসামের গোয়াল পাড়া জেলায়। ১১) বাগ বা ছোটা বিজনি - এখন আসামের বিজনি। এবার বাকি ৭ টি আসাম ডুয়ার্স। বাকি ১১ টিকে বলা হত বেঙ্গল ডুয়ার্স। জলপাইগুড়ি জেলায় পড়েছে পাঁচটি ,একটি দার্জিলিং জেলায় এখন। ১২) গুড়িগুমা-এখন আসামের দরং জেলায়। ১৩ ) কালিং - এখন আসামের দরং জেলায়। ১৪) বংসকা - এখন আসামের কামরূপ জেলায়। ১৫) শুরকুল্লাম - এখন আসামের কামরূপ জেলায়। ১৬) ছাপাঘড়ি বা চাঁপাগুৰি - এখন আসামের কামরূপ জেলায়। ১৭) চাপাঘামা - এখন আসামের কামরূপ জেলায়। ১৮) বিজনি - এখন আসামের কামরূপ জেলায়।
পাহাড়ি খরস্রোতা একাধিক নদীর তীর জুড়ে বিরাট আয়তনের বনভূমি ,চায়ের সবুজের সজীবতা নিয়ে কাছে এবং দূরে গড়ে ওঠা চাবাগান। এখানে আকাশ আছে ,আছে ঘুমের মতো পাহাড়। এই জনপদের বিস্তীর্ণ দুদিকের গভীর বনভূমিগুলোর ভেতরে হাতি ও অন্যান্য বন্য প্রাণীর পরম নিরাপদের আশ্রয়। সেকারণে এখানকার বনস্থলীকে কোথাও আবার অভয় অরণ্য বলা হয়। গড়ে নেওয়া হয়েছে অভয় অরণ্যের জন্য নিভৃত পরিকাঠামো। অবিভক্ত জলপাইগুড়ি জেলায় দুটি অভয়ারণ্য ছিল। জেলা ভাগ হওয়ার পর জলদাপাড়া অভয়ারণ্য আলিপুরদুয়ার জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। জলপাইগুড়ি জেলাতে এখন গরুমারা অভয়ারণ্য। এই অভায়ারণ্যটি এখন জাতীয় উদ্যানের (national park ) মর্যাদা পেয়েছে। পাহাড়ের সানুদেশে বনভূমির অবস্থান আর বহতা নদী সমূহ রায়ডাক , সংকোশ , কালজানি ও তিস্তার প্রবাহকে নিয়ে কিছু ভিন্নতায় শাখানদীগুলিও ডুয়ার্স থেকে নেমে আসা নদীর পরিচিতিতে পৃথক নদীপথে ব্রহ্মপুত্রে মিশেছে। এই আবহকালীন ডুয়ার্স একই ভাবে চিহ্নিত সীমারেখায় পুরনো গন্ধে ছড়িয়ে রেখেছে এক বুনো মাদকতা। ডুয়ার্সে ভূখণ্ডের বিস্তৃতি কতগুলো দুয়ার পেরিয়ে অন্য ভূখন্ডের সঙ্গে সংযোগ রেখেছে। অতীত ইতিহাসের সে পথে আমাদের পথ চেনার পর্বে ডুয়ার্সকে চিনে নিতে হয় স্যান্ডার্স রিপোর্টের বিবরণ থেকে আবার সার্জেন রেনির 'ভোটান আন্ড দ্য স্টোরি অব দ্য ডুয়ার ওয়ার ' থেকে । ডুয়ার্স অর্থে যুক্ত হয়েছে একাধিক দরজা। এই দরজা থেকেই এসেছে দুয়ার। বলা ভালো প্রবেশদ্বার। হিমালয়ের গিরিপথ দিয়ে ভুটান থেকে ভারতে আসার মোট ১৮ টি দুয়ার । প্রকৃতির সেই রাজ্য যার অনাবিল দিগন্তের নীরব ও নিভৃত স্পর্শে আগলে রেখেছিলো এখানকার আরণ্যক জীবনকে। সার্জেন রেনি তাঁর বইয়ে ডুয়ার্স নামের ব্যাখ্যায় জানিয়েছিলেন পতিত এই জায়গাটি অত্যন্ত উর্বর রয়েছে। অনেক উন্নত ফসল ফলনের সম্ভাবনাময় সুদূর বিস্তৃত একটি স্থান। আরেকজন ইংরেজ সার্ভেয়ার আসলে ইডেন তিনিও জায়গাটিকে দখল নেয়ার সুপারিশ করেছিলেন। উন্নতমানের তুলো ও বহুমূল্যের কাঠের বিপুল আয়োজনের এই স্থানটি হ'ল ডুয়ার্স। ইডেন বলেছিলেন -" অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সমৃদ্ধ এই এলাকা আমাদের হাতে এলে কয়েক বছরের মধ্যে আমরা ধনী হয়ে উঠব। " তিনি আরো বলেছিলেন -"এটাই ভারতের একমাত্র জায়গা যা আমাদের মতো ইউরোপিয়ানদের বসবাসের পক্ষে উপযুক্ত। " জলপাইগুড়ি জেলায় তিস্তা থেকে সংকোশ নদী পর্যন্ত ১৬০ কিমি লম্বা এলাকা পশ্চিম ডুয়ার্স। আজকের বক্সা দুর্গ যার নাম "ভুটানি পাশা খা "। এর অস্তিত্ব কতকালের ,কারাই বা এই দুর্গটি তৈরী করেছিল ? এসব প্রশ্নের শেষ নেই। কথিত আছে মীরজুমুলার আক্রমণের ভয়ে কোচবিহারের রাজা প্রাণনারায়ণ ১৬৬১ সালে প্রায় ১ বছর এখানে লুকিয়েছিলেন। দুর্গটি ভুটিয়া সম্প্রদায় তৈরী করে ডুয়ার্স এলাকায় আক্রমণ সংগঠিত করার জন্য। " সার্ভে আন্ড সেটেলমেন্ট অব দ্য ওয়েস্টার্ন ডুয়ার্স " ( ইন দ্য ডিস্ট্রিক্ট অব জলপাইগুড়ি ) ১৮৮৯ থেকে ৯৫ এক বিশাল রিপোর্ট ডি.স্যান্ডার্স পশ্চিম ডুয়ার্সের সেটেলমেন্ট অফিসার হিসেবে তাঁর কাজ শেষ করেন ৮ই মার্চ ,১৮৯৫ এ। ১৮৬৪ থেকে ১৮৬৮ পর্যন্ত চার বছর পশ্চিম ডুয়ার্স পৃথক জেলার মতো শাসিত হয়েছিল। স্যান্ডার্সের এই প্রতিবেদনে ডুয়ার্সের গাছপালা ,জনবিন্যাস ,ধর্ম , আচার-আচরণ ,নদী , অর্থনৈতিক অবস্থা ,রাজস্ব সংস্থান ইত্যাদি বিষয় আলোচিত হয়েছে। জীবজন্তু বিষয়ে এখানে বিচিত্র পাখি ,বহুজাতের মাছ নিয়ে এই আলোচনা লিপিবদ্ধ । এই বিশাল রিপোর্ট তৈরী করতে তখনকার দিনে খরচ হয়েছিল ৩,৭৫,১০৫ টাকা। স্যান্ডার্স সাহেবের এই রিপোর্ট তৈরিতে পূর্ববর্তী সার্জেন রেনির 'ভোটান আন্ড দ্য স্টোরি অব দ্য ডুয়ার ওয়ার ' বইটির কাছে বারবার ঋণ স্বীকার করেছেন। তবে স্যান্ডার্সের বই তুলনাহীন। ডুয়ার্স গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপট শুধু নয় এর অতীত অবস্থানে আলোআঁধারী মিলন পর্বে এখানকার জনবিন্যাসের লোকায়ত জীবন আদিম জনগোষ্ঠীর মানুষকে ঘিরে নৃ -তত্ত্বের গবেষণায় উঠে আসে এক বিচিত্র বর্ণময় অতীত ।
সার্জন রেনির 'ভুটান এন্ড টি স্টোরি অফ দুয়ার ওয়ার' বইটিতে দেখানো হয়েছে সমভূমি থেকে উত্তরে পাহাড়পথে ভুটানে যাতায়াতের জন্যে যে ১৮টি পথ বা দুয়ার বহুবচনে দুয়ারগুচ্ছ তা থেকেই ইংরেজেরা ডুয়ার্স নাম বেছে নেয়। ইংরেজি ডোর বা হিন্দুস্তানী উচ্চারণে দরওয়াজা থেকে দুয়ার এসেছে। এভাবেই ডুয়ার্সের নানা স্থানের নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুয়ার - যেমন আলিপুরদুয়ার , কুমারগ্রামদুয়ার , বক্সাদুয়ার ইত্যাদি। ১৮টি দূয়ারের মধ্যে রিনির হিসেবে তিস্তা থেকে মানস পর্যন্ত বেঙ্গল ডুয়ার্স আর বাকি ৭টি আসামে। মানস থেকে ধানসিঁড়ি নদী পর্যন্ত তার বিস্তার। এখন অবশ্য তিস্তা থেকে সংকোশ নদী পর্যন্ত এলাকাটিকে ডুয়ার্স ধরা হয়। তবে জলপাইগুড়ি জেলার জন্ম ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে ১লা জানুয়ারী এবং এই জলপাইগুড়ির বেশির ভাগ এলাকাই ডুয়ার্স এর অন্তর্গত। প্রসঙ্গক্রমে অতীতটাকে আবার সামনে এনে আমরা জানতে পারি বিস্তীর্ণ ডুয়ার্সের এতদাঞ্চলের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে দুই রাজশক্তি কোচবিহারের রাজা এবং ভুটানরাজ বারংবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন ১৭১৪ থেকে ভুটানীরা কোচবিহার আক্রমণ করতে থাকে। একবার ভুটানীদের হারতেও হয় নাজিরদেওরের কাছে। ভুটিয়াদের আটকানোর জন্যে তৈরী হয়েছিল মাটির বাঁধ , যা ডুয়ার্সের শামুকতলা ও ভাটিবাড়ির কাছে এখনো দেখা যায়। ১৭৭৩ সালে কোচবিহার ও কোম্পানির মধ্যে চুক্তি হয় ফলে কোচবিহার করদ রাজ্যে পরিণত হয়। ইংরেজরা ভুটানীদের তাড়ানোর দায়িত্ব নেয়। ১৭৭৩ সালের এপ্রিলে যুদ্ধ শেষ হয়। ভুটানীরা পালিয়ে যায়। আসলে ইংরেজরা ভুটানের ভেতর দিয়ে তিব্বতে বাণিজ্য করতে চেয়েছিলো। বাস্তবে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
১৭৭৪ সালে ভুটানের সঙ্গে কোম্পানির চুক্তি হলো। এই সুযোগে ভুটানীরা বেশ কিছু সুবিধা আদায় করে নেয়। ডুয়ার্স এলাকায় ভুটানের আধিপত্য বজায় ছিল ১৮৬৪ পর্যন্ত। বর্ষা শেষে ভুটানীরা রাজস্ব আদায় করে ফের বর্ষা আসার আগেই ফিরে যেত। ডুয়ার্সে আইনের শাসন বলতে কিছুই ছিলোনা। তবে ভুটিয়ারা সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে দেশীয়দের সাহায্য করেছিল। ইডেনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জানা যায় ১৮৬৪ সালে ডুয়ার্স দখল হয় দ্বিতীয় ভুটান যুদ্ধে। ১৮৬৫ সালের এগারো নভেম্বর সিনচুলা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো বক্সায়। চুক্তির ফলে দুয়ার অঞ্চল এলো ইংরেজদের দখলে। এর পর বক্সাদুয়ার মহকুমার মর্যাদা পায়। ১৮৬৯ সালের ১ লা জানুয়ারী জলপাইগুড়ি জেলার সৃষ্টি। এতদিন সমগ্র জলপাইগুড়ি জেলা যার অন্তর্ভুক্তিতে ছিল বিস্তীর্ণ ডুয়ার্স অঞ্চল এবং সমগ্র অঞ্চলটি তদানীন্তন রংপুর জেলার আওতাধীন ছিল। ১৮৬৯ সালের ১ লা জানুয়ারিতে জলপাইগুড়ি জেলার সৃষ্টির পরে ফালাকাটায় মহকুমা স্থাপন করা হয়। এরপর আবার বক্সায়। অবশেষে আলিপুরদুয়ারে মহুকুমাদপ্তর উঠে আসে। এই নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণের মধ্যে দিয়ে আদিম ডুয়ার্সের জনপদের জনজীবন বার বার আবর্তিত হয়ে এসেছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি ডুয়ার্সের এই বিশাল জনপদে বহু ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বাস ছিল একসময়ে। সমগ্র জলপাইগুড়ি জেলায় যে ডুয়ার্সের অবস্থান ছিল সেখানে আদিম জনগোষ্ঠীর মানুষের ১৫১ টি কথ্য ভাষার সন্ধান পাওয়া যায়। ১৯৬১ র জনগণনায় এই ভাষাভাষী মানুষের অস্ত্বিত্ব সন্ধানের পর নৃবিজ্ঞানের নতুন গবেষনার দুয়ার খুলে যায়। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর নাম অনুসারে সমগ্র ডুয়ার্সের অনেক জায়গা নামাকরণ হয়েছে - যেমন জলদাপাড়া। এখানে জলদা সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস ছিল। আজ এই জনগোষ্ঠীর মানুষের নিজস্ব কোনো পরিচিতি নেয়। এভাবেই ডুয়ার্সে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষের পরিচিতি হারিয়ে গেছে। ডুয়ার্সে বিভিন্ন ক্ষুদ্র জন গোষ্ঠীর মানুষের নিঃশব্দে এক একটি প্রস্থান ঘটেছে। আসলে বাণিজ্যিক প্রসারপর্বে ভাষার যেমন সংকোচ ঘটে , বিলুপ্তিও ঘটে। জনজীবনে অন্য জনগোষ্ঠীর আধিক্য ঘটলে পৃথক ভাবে পুরোনো জনসত্তাটি হারিয়ে যায়। বৈচিত্রময় ডুয়ার্সের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। তবু বলা যায় এককভাবে কোনো সংস্কৃতি নয় - ডুয়ার্স জুড়ে রয়েছে এক মিশ্র সংস্কৃতি।
ইউরোপীয় বণিক মহলের অনুসন্ধান চলছে তখন। ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপীয় বণিক সম্প্রদায়ের এক গভীর অন্বেষণের সূত্র ধরে বাণিজ্যিক উপকরণ এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণের বাস্তবতা খতিয়ে দেখতে ডুয়ার্সে নদী পথে এলেন এক ফিরিঙ্গি পর্যটক -রেল্ফফিচ। ডুয়ার্সে নদীপথে সেসময়ে বাণিজ্যের সন্ধানে আসা ফিরিঙ্গি পরিব্রাজকের নদী বন্দরে অবতরণকে ঘিরে অমিয় ভূষণ মজুমদারের "মধু সাধুখাঁ " একটি ছোট উপন্যাস।
মধু সাধুখাঁ ঘুরছে নদীপথে। তাঁর সঙ্গী ফিরিঙ্গি রেল্ফফিচ ষোড়শ শতকের শেষদিকে ডুয়ার্স অঞ্চলে এসেছিলেন। খবর নিচ্ছিলেন ব্যবসা বাণিজ্যের। বাস্তব আর কল্পনা মিশিয়ে তৈরী হয় এক আশ্চর্য্য দৃশ্যকাব্য।ডুয়ার্সের রূপকল্পনায় সংযুক্ত জলপথের নদী মানচিত্রের এক মনোরম এবং পূর্ণপ্রকাশ ঘটে এই উপন্যাসটিতে। ধরলা দিয়ে ভেসে চলেছে বজরা। শিঙিমারির স্রোতে ঢুকে পরে -চলে হরিণ শিকার। চোখে পড়ে সতীদাহের দৃশ্য। চিলাপাতা ছুঁয়ে এগোয় মধু সাধুখাঁর বজরা। কালজানি দিয়েও এগিয়ে চলে। চেচা খাতায় নৌকা ভিড়েছে। রেল্ফফিচ তার ঝোলা নিয়ে সেখানেই নেমে পড়ে। রেখে যায় তার হাতে লেখা কিছু নথি আর তামাকের বীজ। তারপর হাটের ভিরে হারিয়ে যায়। মধু যেতে চায় ব্রহ্মপুত্র উজিয়ে গৌহাটি। খানিক ইতিহাস খানিকটা কল্পনা মিশিয়ে এই সুদূর অতীতের রহস্যময় স্বপ্নলোকের ছায়ায় তিমির প্রান্ত ডুয়ার্স জেগে ওঠে।
দূরের অতীত এবং সমসাময়িক পরবর্তী সময়কালকে ঘিরে ডুয়ার্সের প্রকৃতি নির্ভর জনজীবন আবর্তিত হয়েছে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে লাভবানের স্বপ্ন নিয়ে ব্রিটিশ ভারতের বণিক সম্প্রদায় এ অঞ্চলে চা -এর সাম্রাজ্য গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৮৪০ সালে দার্জিলিং এ চাবাগান গড়ে উঠল। জলপাই ডুয়ার্সে চাবাগানের গোড়া পত্তন হয় ১৮৭৪ সালে। ডুয়ার্সের মধ্যভাগে গজলডোবায় প্রথম চা বাগানের সূচনা হয়। শুরু হল ডুয়ার্সে চাবাগান গড়ে তোলার লাগাতার প্রয়াস। প্রকৃতির এই রাজ্যে স্থানীয় অধিবাসীদের দ্বারা চাবাগান গড়ে তোলার কাজ সাধিত হয়নি। ভারতের নানা জায়গা থেকে শ্রমিক সংগ্রহ করা হয়েছিল। এই শ্রমিকেরা মূলত এসেছিলো মাদ্রাজ ,ওড়িশা ,ছোটনাগপুর ,রাঁচি ,সিংভূম ,হাজারীবাগ ,লোহারদাগা প্রভৃতি জায়গা থেকে। ওঁরাও ,মুন্ডা,লোহার ,চামার , সাঁওতাল ,খরিয়া প্রভৃতি সম্প্রদায়ভুক্ত আদিবাসী শ্রমিকেরা কঠোর অনুশাসনের মধ্যে চাবাগান গড়ে তোলার প্রাথমিক কাজে অগ্রণী ভূমিকা নেয়। একাধিক ক্রমে শুরু হলো পতিত জমি উদ্ধার এবং সেই সঙ্গে বন কেটে চায়ের উপযোগী জায়গাতে চা বাগান গড়ে তোলার মধ্যে শান্ত ডুয়ার্সের জনজীবনে এলো মুক্ত জোয়ার। ক্রমে ডুয়ার্সে এক আর্থিক বুনিয়াদ তৈরির লক্ষ্যে একের পর এক চাবাগান গড়ে উঠল। আরেক পর্বে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে স্বাদেশিকতায় উদ্বুদ্ধ বাঙালি তথা ভারতীয় চা-কররা ব্রিটিশদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় চা বাগান স্থাপনা শুরু করলেন। চা উৎপাদনে ডুয়ার্সের চায়ে বিশদ্ধতার নিরিখে অন্য এক প্রশংসনীয় বাণিজ্যিক মাত্রা যুক্ত হল। এই সময়ে ডুয়ার্সের বাঙালি মালিকানাধীন বিভিন্ন চা বাগানের টি কোম্পানির বিভাগীয় অফিস বা কার্য্যালয় জলপাইগুড়ি শহরে স্থাপনা শুরু হ’ল। ডুয়ার্সের শহর জলপাইগুড়ির ঔজ্জ্বল্যতা ক্রমান্বয়ে বেড়ে উঠতে শুরু করলো। শুধু মাত্র চা য়ের বানিজ্যায়নের পথ ধরে। ডুয়ার্সের সেই সোনালি তরলের স্বপ্নময় যুগের কিছু অতীত নিদর্শন আজ অতি পুরনো এই শহরে ছড়িয়ে রয়েছে। চাবাগান ভিত্তিক টি কোম্পানির অফিস বাড়িগুলো আজও এই শহরে অতীতের সাক্ষ বহন করছে। এগুলোর মধ্যে গোপালপুর হাউস ,গুরজাঙঝরা বিল্ডিং ,ভান্ডিগুড়ি টি এস্টেট ,নাহাটা হাউস ,সীতানি গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ ইত্যাদি।
আজ ডুয়ার্সের কিছু বন্ধ চা বাগান, অর্ধাহারে অনাহারে শ্রমিকদের মৃত্যু ,বন কেটে বসতি নির্মাণের মধ্যে নিঃশেষিত ডুয়ার্স ধ্বংসের মুখে। এই নষ্ট সবুজায়ন একএকটি হতশ্রী দিনের মুখোমুখি প্রতিদিন দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে আমাদেরকে।
ডুয়ার্সের আর্থিক বুনিয়াদ তৈরির কারিগর সেই পরিযায়ী শ্রমিক মহল এখানকার রূপ রস গন্ধ সর্বাঙ্গে মেখে নিয়ে নিজস্ব ভুবনটিকে চিনে নিয়েছিল একদিন।শেকড়ের সন্ধানে অন্য কোথাও নয় ,এ একান্তই তাদের নিজস্ব বাসভূমি। উত্তীর্ণ পরবাসে নিজবাসে এই জনগোষ্ঠীর মানুষ সহমর্মিতায় স্থায়ী এক সাহসী উত্তর পুরুষ। ভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষের জীবিকার সংগ্রাম এখানে কখনো স্ব-গোত্রীয় মানুষের সম্মিলিত শক্তির সঙ্গে বলীয়ান হয়ে ওঠে। আবার এক অসম লড়াই সংগঠিত হয় হিংশ্র কিছু পরিযায়ী জন্তুর বিরুদ্ধে। এখানে মানুষ এবং জন্তু বিশেষ নিজ নিজ ক্ষেত্রে পরিযায়ী। তাই দুয়ার গুচ্ছ বা ডুয়ার্স যেখানে উন্মুক্ত সেই প্রবেশ দ্বারে আবহকালীন যাত্রাপথ এসে মিশেছে। ছাড়পত্র ছাড়া মানুষ এবং হাতির অবাধ যাতায়াতের দুয়ার কোথাও বা করিডোর সহজেই পরিচিতি পেয়েছে।
ডুয়ার্সের এই উদার অরণ্যে এখনো স্থান হয় ভিন প্রদেশের বুনো হাতির এবং অরণ্য প্রদেশের বিভিন্ন বন জন্তুর। আজকের মায়ানমার রাষ্ট্রের বনস্থলীর পথ ধরে এই বুনো হাতির দল মনিপুর হয়ে কখনো আশ্রয় নেয় অসমের মানস অভয়ারণ্যে। এখান থেকেই এই হাতির দল সংকোশ নদী পেরিয়ে উত্তরের এই অরণ্য সংকুল প্রদেশে আশ্রয় নেয়। নদী পেরিয়ে অন্য বনতলে আশ্রয়ের খোঁজে একই সঙ্গে ৫ টি হাতির মৃত্যুর খবরে বিচলিত মানুষজন জেনে যায় বাজ পড়ে বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে হাতিগুলোর শোচনীয় মৃত্যু হয়েছে। পরিযায়ী মানুষের মতো ডুয়ার্সের বনজঙ্গলে পরিযায়ী হাতির খাদ্য সংকট তীব্র হলে হাতিদের লোকালয়ে নেমে আসার ঘটনা স্বাভাবিক। এখানেই ডুয়ার্সের পরিচিতি। তবুও এক অতীত তার হারানো বৈভব মিশ্র সংস্কৃতির আবহে অরণ্য প্রকৃতির পাশে এক উন্মুক্ত জনারণ্যে এখানে অতীত দিনের মাইল ফলকের পাশে দূরের গঞ্জকে দেখিয়ে দেয়। দূর ও কাছের সহজ নৈকট্যে ডুয়ার্স এখনো বিনোদিনী - বড় আবেদনময়ী।
ঋণ স্বীকারে ' চায়ের দেশের জলছবি এবং অন্যান্য ' - অর্ণব সেন
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴