আর্থ-সামাজিক কারণে প্রভাবিত হচ্ছে ডুয়ার্সের ভাষাচর্চা
আর্থ-সামাজিক কারণে প্রভাবিত হচ্ছে ডুয়ার্সের ভাষাচর্চা
গৌতম চক্রবর্তী
-------------------------------------------------------------
আবার আর একটি ভাষাদিবস পালনের লগ্ন সমাগত। মাতৃভাষা দিবস। “মা তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতন”। এ কেবলমাত্র নোবেলবিজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তিগত অনুভূতি নয়, এ হচ্ছে সর্বকালের মানুষের চিরন্তন অনুভূতি। মাতৃদুগ্ধ যেমন শিশুর সর্বোত্তম পুষ্টি, তেমনি মাতৃভাষার মাধ্যমেই ঘটতে পারে একটি জাতির শ্রেষ্ঠ বিকাশ। মানুষের পরিচয়ের সেরা নির্ণয়ক মাতৃভাষা। মাতৃভাষা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের এক মৌলিক সম্পদ। মা এবং মাটির মতোই প্রতিটি মানুষ জন্মসূত্রে এই সম্পদের উত্তরাধিকারী হয়। সাধারণ অর্থে মাতৃভাষা বলতে আক্ষরিক অর্থে মায়ের ভাষাকে বোঝায়। একটা বৃহত্তর অঞ্চলে একই সাথে বিভিন্ন ভাষা প্রচলিত থাকে। এর মধ্যে বেশিরভাগ মানুষ যে ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করে সেটাই হচ্ছে সেই অঞ্চলের মানুষের মাতৃভাষা। মাতৃভাষা মায়ের মুখের আঞ্চলিক বুলি মাত্র নয়, মাতৃভাষা হচ্ছে একটি দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাষা যা তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যবহার করে। মাতৃভাষা বহতা নদীর মতো শতধারায় প্রবহমান। মাতৃভাষার মাধ্যমেই মানুষ প্রকাশ করে তার আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং আবেগ-অনুভূতি। মাতৃভাষাই মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রে তৃপ্তি এবং পরিপূর্ণতা দান করে। জাতীয় জীবনে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। জাতীয় জীবনের সার্বিক ক্ষেত্রে উন্নতি লাভ করতে হলে মাতৃভাষার কোন বিকল্প হতে পারে না। শিক্ষাদীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, শিল্প সংস্কৃতি এবং সাহিত্যের বিকাশে মাতৃভাষা হচ্ছে প্রধান মাধ্যম। মাতৃভাষা মানে কিন্তু শুধু বাংলা ভাষা দিবস নয়। মায়ের ভাষাতে যারা কথা বলে প্রত্যেকের পূর্ণ অধিকার আছে এই দিনটিতে তাদের মাতৃভাষা দিবস পালনের। আর সেই প্রেক্ষাপটেই আজ এই লেখার অবতারণা। আমাদের এই উত্তরবঙ্গ তথা ডুয়ার্স বা মুলত জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ার জেলার বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের ভাষাবৈচিত্র্য নিয়ে আলোচনা করতে গেলে একটু খোলা মন নিয়ে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে হবে। জলপাইগুড়ি জেলার ভাষাবৈচিত্র্য আলোচনা করতে গেলে পটভূমি না জানলে এখানকার ভাষাবৈচিত্র্য বুঝে ওঠা সম্ভব নয়।
জলপাইগুড়ি জেলার একটি অংশ ডুয়ার্স অর্থাৎ ভুটান প্রবেশের দরজা হিসাবে ইংরেজ আমল থেকে পরিচিত ছিল। মোট ১৮ টি দুয়ারের মধ্যে আসাম ডুয়ার্সে সাতটি এবং হিমালয়ের ভেতর দিয়ে ভারত এবং ভুটানের মধ্যে এগারোটি দুয়ার ছিলো বেঙ্গল ডুয়ার্সে। ডুয়ার্স অঞ্চলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিলো ভারতের প্রায় সবকটি ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষ এবং নৃগোষ্ঠীর জাতি, জনজাতির মানুষ এই অঞ্চলে বাস করত। এত জাতি এবং এত ভাষার সহাবস্থান শুধু এদেশ কেন, পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। জলপাইগুড়ি জেলায় চা বাগিচা সৃষ্টির আগে মূলত ভোটবর্মী সম্প্রদায়ের মানুষের বসতি ছিল। মেচ বা বোড়ো, টোটো, রাভা এবং গারো সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে ভূমিপুত্র ছিল। যখন ডুয়ার্স ভুটান এর অধীন ছিল তখন কিন্তু জনবসতি এত ব্যাপক ছিল না। মহানন্দা নদীর তীরবর্তী অঞ্চল দিয়ে কিছু রাজবংশী এবং কিছু নেপালি পরিবারের বসবাস ছিলো। কিন্তু তরাইয়ের গ্রামাঞ্চল তখন ছিল পুরোপুরি রাজবংশী অধ্যুষিত। তখন মোটের ওপর সংখ্যায় পঞ্চাশটির মতো সম্প্রদায় বাস করত এই অঞ্চলে। তখন অবশ্য ডুয়ার্স অঞ্চল বলতে বোঝাতো শুধু রংপুর-দিনাজপুর, কোচবিহার, এখনকার ডুয়ার্সের পূর্ব প্রান্তের ধূপগুড়ি, ফালাকাটা এবং মাদারিহাট। এসব অঞ্চলে তখন সংখ্যায় বেশি ছিল খেন, যুগি, নাথ, কৈবর্ত, দাস, মেচ, রাভা, গারো, টোটো, রাজবংশী জনজাতির মানুষ। একটি উল্লেখযোগ্য বিশেষত্ব সেই সময়ে লক্ষ্য করা গিয়েছিলো। প্রত্যেকটি জনজাতির মাতৃভাষা ছিল আলাদা আলাদা। স্যার যোশেফ ডালটন হুকারের হিমালয়ান জার্ণালের বিবরণ অনুযায়ী ১৮৫৪ সালে জলপাইগুড়ি ছিল এক ছোট্ট গ্রাম। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে জলপাইগুড়ি জেলা তৈরি হবার পর ১৮৭৬ সালে আলিপুরদুয়ার মহকুমা গঠিত হয় এবং ১৮৭৪ থেকে চা বাগিচা তৈরি আরম্ভ হয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে উত্তরবঙ্গের তরাই এবং ডুয়ার্স অঞ্চলের ভাষাচিত্র বেশ খানিকটা বদলাতে শুরু করে। চা বাগিচা পত্তনের হাত ধরে বেশ কয়েকটি জনজাতির মানুষ ভূমিচ্যুত হল। জলপাইগুড়ি জেলার মেচ, রাজবংশী, গারো, রাভা, টোটো ইত্যাদি সম্প্রদায় এবং গোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিটি ক্ষেত্রে সামাজিক, ধর্মীয় এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিপুল পরিবর্তন ঘটে গেল। চা বাগান পত্তনের পর প্রথম দিকে শ্রমিক হিসেবে এসেছিলেন নেপালিরা। দার্জিলিং এর মূল আদিবাসী, ভুটিয়া, লিম্বু, লেপচাদের সংখ্যালঘু করে নেপাল থেকে আসা গোর্খারা প্রধান হয়ে ওঠে। ফলে বিশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত ডুয়ার্স অঞ্চলের জনবিন্যাসে ঘটে যায় এক বিরাট রদবদল। কারণ বলাই বাহুল্য, চা বাগান এবং শিল্পের জন্য এখানে ঔপনিবেশিক চা বাগান মালিকেরা বাইরে থেকে আমদানি করতে থাকে অসংখ্য শ্রমিক।
চা বাগিচা স্থাপনের সময় ছোটনাগপুর, রাঁচি, সিংভূম, হাজারীবাগ, পুরুলিয়া, সাঁওতাল পরগনা, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা ইত্যাদি অঞ্চল থেকে অসংখ্য শ্রমিক আড়কাঠি এবং সর্দারের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়েছিল। তাই ডুয়ার্সেও সংখ্যাধিক্য হয়ে ওঠে মধ্য ভারত, ছোটনাগপুর অঞ্চল থেকে আসা আদিবাসীরা, যারা সাধারণভাবে মদেশিয়া নামে পরিচিত। আধিপত্য বিস্তার করতে আরম্ভ করল ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, ছোটনাগপুর, সাঁওতাল পরগনা এবং বস্তার থেকে আসা চা শিল্পের জন্য পরিশ্রমী আদিবাসী গোষ্ঠী। ওঁরাও, মুন্ডা, সাঁওতাল, চিক বড়াইক, নাগেশিয়া, মাহালি, ভূমিজ প্রভৃতি জনজাতি মিলে সংখ্যায় প্রায় ৩৫ টি। জলপাইগুড়ি জেলার চা অঞ্চলে যারা এলেন তাঁরা এসেছিলেন বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থেকে । জলপাইগুড়ি জেলায় বাগিচা পত্তনের সুবাদে এল ওঁরাও, মুন্ডা, সাঁওতাল, মাহালি, খাড়িয়া ইত্যাদি জনজাতির মানুষ। এ ছাড়াও এই অঞ্চলে কোরা, ভূমিজ, নাগেশিয়া, মালপাহাড়িয়া, হো ইত্যাদি জনজাতির মানুষও বসতি স্থাপন করল। ফলে জলপাইগুড়ি জেলায় অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জাতির জনসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে গেল এবং তাই দেখা গেল জলপাইগুড়ি জেলার যে ভাষাবৈচিত্র্য তার মূল কারণ এখানকার বিভিন্ন জাতি ও জনজাতির অবিরত স্রোতধারা এবং অভিবাসন। জনজাতি মানুষগুলির যারা লুপ্ত বা প্রায় লুপ্ত তারা তাদের ভাষাগত বৈশিষ্ট্য ধরে রাখলো জলদাপাড়া, টোটোপাড়া, খুনিয়া, সাতালি, মেচপাড়া, গারোপাড়ার মত এলাকা বা পাড়াগুলিতে। ক্ষেত্রসমীক্ষায় দেখা গেছে এই অঞ্চলে অনেক ছোট ছোট ভাষা সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ উত্তরবঙ্গে অনেক আছেন যারা নিজেদের মধ্যেই নিজস্ব ভাষায় কথা বলেন। কিন্তু বাইরে কথা বলার জন্য প্রতিবেশীদের ভাষা ব্যবহার করে থাকেন। ফলে দেখা যাচ্ছে ক্ষুদ্র ভাষাগোষ্ঠীর মানুষেরা নিজেদের সত্তা ক্রমশ হারিয়ে ফেলছেন। নতুন প্রজন্মের কাছে এই বিপুল পরিবর্তনে নিজেদের ভাষা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। জনজাতিগুলি নিজেদের মাতৃভাষার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারছে না। অনেকে ভুলে গিয়েছে আদতে কি ছিল তাদের মাতৃভাষা। ভোট চীনীয় বা ভোটবর্মী ভাষার ২৪ টি শাখা জলপাইগুড়িতে আছে। এগুলির মধ্যে বোড়ো, মেচ, রাভা, গারো, টোটো, ডুকপা, লেকচা, লিম্বু ইত্যাদি ভাষাগোষ্ঠী রয়েছে। প্রান্তিক উত্তরবঙ্গের উপর দিয়ে একের পর এক জনজাতির প্রবাহের স্রোত প্রবাহিত হয়ে কিছু না কিছু প্রভাব রেখে গেছে। বর্তমানে উত্তরের ভাষার যে বিচিত্র গতিপ্রকৃতি তার প্রধান কারণ হিসেবে বিভিন্ন ধরনের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ যে সকল কারণগুলি লক্ষ্য করা যায় সেগুলির মধ্যে রয়েছে জাতিগত এবং বর্ণগত জনবিন্যাস এর নিজস্ব স্বকীয়তা।
গ্রিফারসন ভারতীয় উপমহাদেশের নানা অঞ্চলের উপভাষা বিষয়ে যে গবেষণা চালিয়েছিলেন তার পরবর্তীকালে বিশেষ করে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ভাষা নিয়ে আর তেমন কোন ভাষাবিজ্ঞানসম্মত জরিপ হয়নি। গ্রিফারসনের হিসেব মতো লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া বাংলার আঞ্চলিক উপভাষা এবং বিভাষার সংখ্যা হিসাবে চল্লিশটিরও বেশি ভাষা খুঁজে পেয়েছিলেন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন প্রমুখ ভাষাবিজ্ঞানীরা বাংলা ভাষার প্রধান পাঁচটি উপভাষা নির্দেশ করেছিলেন। এগুলো হলো রাঢ়ী, বরেন্দ্রী, বঙ্গালী, ঝাড়খন্ডী এবং কামরূপী। আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানীরা উপভাষার ক্ষেত্রেও বর্গীকরণ এর তিনটি স্তর লক্ষ্য করেন। এগুলি হলো শিষ্টভাষা, জনভাষা ও লোকভাষা। উত্তরবঙ্গের জনবিন্যাসে প্রধান ভাষাগোষ্ঠী হলো অস্ট্রিক, দ্রাবিড় এবং ভারতীয় আর্য ভাষাগোষ্ঠী। এছাড়াও নানা ভাষা ও গোষ্ঠীর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। উত্তরবঙ্গের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে ছোট বড় নানাবিধ ভাষার প্রচলন রয়েছে। জনসংখ্যার বিচারে এই এলাকায় বাংলা ভাষার স্থান প্রথমে। হিন্দি, উর্দূ, সাঁওতালি, কুরুখ, সাদ্রী, নেপালি সহ অন্যান্য ভাষা প্রচলিত আছে। এগুলি ছাড়া অন্য যেসব ভাষা এই অঞ্চলে প্রচলিত আছে তাদের বাচক গোষ্ঠী এক লাখের উপরে নয়। জলপাইগুড়ি জেলায় বাংলা ভাষাভাষী মানুষ এখানে দীর্ঘদিন ধরেই এসেছেন একটা অবিরত প্রবাহের মতো। বসতিস্থাপন, চাকরি, অন্যান্য জীবিকা উপলক্ষ্য করে যেমন বাংলার বাইরে থেকে মানুষ এখানে এসেছেন, তেমনি বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল থেকেও ব্যাপক পরিমাণ মানুষ যাদের মাতৃভাষা বাংলা তারাও এসেছেন। উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার জনবিন্যাস বিশ্লেষণ করতে গেলে লক্ষ্য করা যায় অখন্ড বাংলায় পশম, চা, কমলালেবু, কাঠ, চামড়া, কৃষিজাত পণ্য, তামাক ইত্যাদির ব্যবসাসূত্রে বিহার, মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ থেকে যারা এসেছেন তাদের ভাষা হিন্দি। আবার গুজরাট, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, নেপাল, ভুটান, তিব্বত সহ নানা অঞ্চল থেকে মানুষ এসেছে জীবন এবং জীবিকার প্রয়োজনে।। আবার অনেকে এসেছেন শরণার্থী হিসেবে এখনকার বাংলাদেশ বা অধুনালুপ্ত পূর্ব-পাকিস্তান থেকে। ব্যাপক সংখ্যক মানুষ জেলার বাইরে থেকে এমনকি ভিন্ন প্রদেশ থেকে বাধ্য হয়েই কোন একসময়ে জীবিকার টানে এদেশে এসেছেন এবং জেলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন বলে জলপাইগুড়ি জেলায় বসবাসকারী মানুষ সবাই প্রায় বাংলা বোঝেন।
উত্তরবঙ্গ বাংলাদেশ সীমান্ত ছুঁয়ে থাকা জেলা কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার এবং জলপাইগুড়ি এককালীন ডুয়ার্সের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে আছে হাজার হাজার বছরের পুরনো ইতিহাস। এই অঞ্চল অর্থাৎ বিশেষ করে তরাই ডুয়ার্সকে মিনি ভারতবর্ষ হিসেবে কল্পনা করেন অনেকেই। বর্তমান সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় পরিমন্ডলে সব কিছুরই পরিবর্তন ঘটছে। বিশ্ব ভাষা ভান্ডার থেকে হারিয়ে গিয়েছে বহু ভাষা, ভবিষ্যতে আরো হারিয়ে যাবে। ভুবনায়নের কালে জলপাইগুড়ি তথা ডুয়ার্স অঞ্চলটির শতাধিক ভাষা বিলুপ্তির পথে। ডুয়ার্সের অধিকাংশ জনজাতির ভাষা বেঁচে থাকার প্রাচুর্য পাচ্ছে না। যে পরিমাণ সাংস্কৃতিক উদ্যোগ এবং পৃষ্ঠপোষকতা পেলে প্রায় লুপ্ত হতে বসা ভাষাগুলি কোনক্রমে যে টিকে যেতে পারে সেই ব্যাপারে কারো কোন উদ্যোগ নেই। আধুনিককালে শিষ্ট বাংলাভাষা বা প্রচলিত বাংলা শিক্ষিত শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের ভাষা। এই ভাষাই এখন নানা মাধ্যমে জলপাইগুড়ি জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে, চা বাগানের এলাকাতে এবং অরণ্যের জীবনে ছড়িয়ে পড়ছে বেতার, টিভি, সংবাদপত্র, সাহিত্য ইত্যাদি নানা গণমাধ্যমের সাহায্যে। ফলে জলপাইগুড়ি জেলার বাংলা ভাষা সহ অন্যান্য ভাষা বিভাষার ক্ষেত্রেও তার অনিবার্য প্রভাব দেখা যাচ্ছে। ফলে অনেকেই তাদের ভাষা, উপভাষা এবং ভাষার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ক্রমশ একটা মিশ্র সহজতর যোগাযোগ মাধ্যমের বাংলা ব্যবহার করছেন। উত্তরবঙ্গের মত বিপুল ও বৈচিত্র্যময় ভাষা-উপভাষা এবং বি-ভাষার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব শুধুমাত্র ভারত নয়, বিশ্বে দুর্লভ। এই বহুভাষিক অঞ্চলের ভাষার বিজ্ঞানসম্মত ভৌগোলিক জরিপ বা যথার্থ ক্ষেত্রসমীক্ষার কাজ সময়ে সময়ে বিভিন্ন গবেষকেরা বিচ্ছিন্নভাবে করলেও এখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ কাজ হয়ে ওঠেনি। বাংলার রাজধানী শহর কলকাতা থেকে অনেকটা দূরে নৃতত্ত্বের জাদুঘর আমাদের এই উত্তরবঙ্গে নানা জাতি নানা ভাষা নানা পরিধান এর সমাহার। সেই অঞ্চল আজ ভাষা সংকটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক ভাষা। বিশ্বায়নের সমকালে প্রভাবশালী ভাষার মত আত্তিকরণ প্রক্রিয়ায় পিছিয়ে পড়ছে জনজাতির ভাষা। একইভাবে নিজের ভাষার প্রতি আনুগত্য প্রকাশেও রয়ে গেছে অভাব।
শিক্ষা বা সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে ভাষা ও সংস্কৃতির কোনো বিরোধ হয়তো বা রয়েছে, আবার হয়তো বা নেই। হয়তো কোন সীমিত চিন্তাভাবনা একটি ভাষা বা জাতিকে হারিয়ে যেতে সাহায্য করছে যা আসলে আমাদেরই এক ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের কথা শুনতে শুনতে আমরা বড় হয়েছি। স্বাধীনতার পরে পশ্চিম পাকিস্তানের সরকার উর্দু ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। সেই সময় বাংলার মানুষ অধিকারের জন্য গর্জিয়ে উঠেছিল। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। সেই ভাষা দিবস আমরা হই হই করে পালন করি। তারপর সবকিছু ভুলে যাই। আসলে সবকিছুই দাঁড়িয়ে থাকে এক এক পরিস্থিতির ওপর। ভাষাবিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন ভাষা বৈচিত্র মুছে গেলে পৃথিবীটা ফ্যাকাসে হয়ে যাবে। ঠিক এই পরিস্থিতিতে কোন ভাষা মৃতপ্রায় চিহ্নিত হওয়া মাত্র বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা শুরু করতে হবে। একটি ভাষা অন্যের পরিপূরক, শত্রু নয়। একাধিক ভাষা আয়ত্তে থাকলে মস্তিষ্কে বুদ্ধির বিকাশ ঘটে। তবুও ভাষা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই কারও। উত্তরবঙ্গে জনজাতিদের অনেক ভাষাই হারিয়ে গেছে। নানা কারণে জনজাতির মানুষদের সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক একটি ভাষারও মৃত্যু ঘটছে। একের পর এক ভাষার মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে উত্তরবঙ্গের প্রান্তীয় অঞ্চলে। প্রায় ১২৫ টি ভাষা এই মুহূর্তে সংকটের মধ্যে রয়েছে যার মধ্যে রয়েছে ডুয়ার্স এবং তরাইয়ের জনজাতিদের ভাষা। সেই তালিকায় খুব সহজেই নাম চলে আসে টোটো, কুবাচ, কোচাক্রৌ, বানটাওয়া, গারচগ, লিম্বুদের নিজস্ব ভাষা লিম্বুকুরা। এছাড়াও আছে কুরুখ, লেপচা, মালদা জেলার চাঁইদের ভাষা, আসুরি, বডো। কত নাম বলা যায়! তাই আন্তর্জাতিক ভাষাদিবসের প্রাক্কালে একটা প্রশ্ন আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস মানে শুধু কি বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা? নাকি অন্য সব মাতৃভাষার অস্তিত্ব এবং চর্চা টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা নেবার ক্ষেত্রেও আমাদের কিছু দায়িত্ব এবং দায়বদ্ধতা থেকেই যায়।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴