সানিয়া-১৩/নীলাঞ্জন মিস্ত্রী
সানিয়া/পর্ব-তেরো
নীলাঞ্জন মিস্ত্রী
^^^^^^^^^^^^^^^^^
ক্ষণিকেই
সংসারের বেড়াজালে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পরে যায় সানিয়া। সংসারের যা হাল তাতে
কোনমতেই এই মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। রামুকে একাই ফিরে যেতে হবে
তিস্তাচরের মহিষ বাথানে। রামু ভয় পায় কিন্তু কোনও উপায় নেই হাতের কাছে।
সানিয়ার কঠিন পরিস্থিতি বুঝে সানিয়াকে সাথে যাবার অনুরোধটুকুও করতে পারে না
রামু। সানিয়া রামুকে নির্ভয় দিয়ে বলে রাস্তাতো তার চেনাই হয়ে গেছে আর পথে
কোনও ভয়ও নেই। এখান থেকে সকাল সকাল রওনা দিলে সন্ধ্যে নাগাদ সে পৌঁছে যাবে
বাথানে। সে যেন বাথান মালিককে গিয়ে সবকিছু বুঝিয়ে বলে। সকাল সকাল গধেয়ার
কুঠির কুটির ছাড়ে রামু। জলঢাকা নদীর চর পর্যন্ত রামুকে নিয়ে যায় সানিয়া।
একরাশ দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে নদীর পাড়ে বসে অপেক্ষা করে ওপাড়ে রামুর মিলিয়ে
যাবার।
ঘরে ফিরে বাবার
সাথে কাজে হাত লাগায় সানিয়া। হাঁড়িতে ভাত চাপিয়ে দেয় বাবা। সানিয়া ব্যস্ত
হয়ে পরে ফুলমণির যত্নআত্তিতে। এতটুকুও কথা বলেনা ফুলমণি। শুধু অবাক চোখে
তাকিয়ে থাকে উপরদিকে। মাথা ঘোরাবার শক্তিটুকুও নেই। ছোট্ট বোনটার মুখের
হাসিটুকুও কেড়ে নিয়েছে জন্ডিস নামক মারনব্যাধি। ফুলমণির মাথার কাছে রাখা
নলপাপরের দিকে তাকিয়ে থাকে বাচ্চু। নলপাপর কয়টি বাচ্চুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে
বলে, ‘তোকে আজ আর বাবার সাথে কাজে যেতে হবে না। তুই ঘরে থাকিস। ফুলমণির
খেয়াল রাখিস। ওকে খাইয়ে দিস। আমি বাবার সাথে কাজে যাচ্ছি’। মাথা নেড়ে
সম্মতি জানায় বাচ্চু।
সানিয়া
বাবার সাথে বেরিয়ে পড়ে। দিনান্ত পরিশ্রম করে তারা অন্যের বাড়িতে। কাজ শেষে
দিনের হাজিরা মেলে। আজ কিছু বেশী পয়সা হয়েছে। বাবা নিশ্চিন্ত হয়। বাড়ি
ফেরার পথে চাল-ডাল-নুন-তরিতরকারি আর বাচ্চুর জন্য খাবার কিনে নিয়ে আসে
তারা। ফুলমণিকে কিছুই খাওয়াতে পারেনি বাচ্চু। না খেয়ে হয়তো মরেই যাবে
বোনটা। ওষুধ খেয়েও কোন কাজ হচ্ছে না। সেই বিকেলেই অন্য এক কবিরাজের বাড়ি
ছোটে সানিয়া। তার থেকে কিনে নিয়ে আসে জন্ডিসের ফাইল। বিশ্বাসভরে নিজের হাতে
খাইয়ে দেয় বোনকে। বোনের পাশেই শুয়ে পরে সানিয়া বাচ্চু। রান্না ঘরের এক
কোণায় পরে থাকেন বাবা। বোনের প্রতি সানিয়ার কর্তব্য দেখে বাবার বুকটা গর্বে
ভরে ওঠে। মানসিক শক্তি পেয়ে বলে
-হে ভগবান, তুই ঠিক সময়ে সানিয়াকে নিয়ে আসছিস। ও না আসলে মেয়েটা আমার আর বাঁচত না। ওর মা'র মতোই মরে যেত’।
অন্ধকার
ঘর। জেগে রয়েছে সানিয়া। দু’চোখের ঘুম উধাও। একপাশে ফুলমণি আর একপাশে
বাচ্চু শুয়ে। দাদার গায়ে পা তুলে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন বাচ্চু। সানিয়ার অলস
হাতদুটি ফুলমণির মাথায় হাত বোলায়। সানিয়া ভাবে রামুর কথা। ‘রামু ঠিকঠাক গেল
তো? সারাদিনে তো খাওয়াও জোটে নাই চ্যাংড়াটার। কোথায় যে আছে এখন। ওকে সাথে
আনাটাই খুব ভুল হয়ে গেছে’? ওষুধ খেয়ে হয়তো ফুলমণির কাজ হয়েছে। গতকাল রাতের
মতো আজ আর গোঙাচ্ছে না। দূরে থাকা চাঁদটা লক্ষ্য রাখছে সব। গুটিগুটি পায়ে
সে চলে এসেছে আম গাছটার উপর। দরজার উপর দিয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।
চাঁদের গায়ে মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে। মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে দু’চোখ বন্ধ
হয় সানিয়ার। ছেলেকে ঘুম পরিয়ে হপনী মুর্মু আকাশ পথ ধরে চলে যেতে থাকে অনেক
দূরে।
সপ্তাহতিনেক এভাবেই
কেটে যায়। ফুলমণি এখন অনেকটাই সুস্থ। শরীরে বল এসেছে তার। দু’বেলা দু’মুঠো
খেতে পারে। দুই দাদাকে সাথে পেয়ে সেও ভীষণ খুশী। খুশী বাচ্চুও। সেও
বাবা-দাদার সাথে কাজে হাত লাগায়। সানিয়া প্রতিদিন ভাই-বোনের জন্য খাবার
কিনে নিয়ে আসে দোকান থেকে। ফুলমণি বাচ্চু প্রতিদিন দাদার জন্য পথ চেয়ে বসে
থাকে। এভাবেই যত দিন যায় বড্ড মায়ায় জড়িয়ে পরতে থাকে সানিয়া। সংসারের
দায়িত্ব পালন করতে মোটেই খারাপ লাগছে না তার। ইতিমধ্যেই ঘরের চাল ঠিক
হয়েছে। পচে যাওয়া বেড়া সরানো হয়েছে। উঠোন থেকে জঙ্গল আর আগাছা সরানো হয়েছে।
উঠোন লাগোয়া একফালি জমিতে কুমরো-বেগুনের চারা পোঁতা হয়েছে। শাকের বীজ থেকে
ডাটারা উঁকি দিচ্ছে। ফুলমণিও কাজে বেশ পটু। নিয়ম করে কচি কচি হাতে দু’বেলা
উঠোন ঝাড়ু দেয়। আর একটু বড় হলে রান্নাবান্নাও শিখে যাবে। তখন বাবার কষ্টও
কমে যাবে অনেক। বাবার চোখ-মুখ দেখে ভালো লাগে সানিয়ার। তার ফিরে আসাটা যে
কতটা প্রয়োজন ছিল সেটা অনুভব করতে পারে সানিয়া। এভাবেই অভাব আর দুখের
সংসারটাকে, সানিয়ার ষোল বছরের দায়িত্বশীল কাঁধটা সুখের পরশ বইয়ে দেয়।
চার
বছর ধরে বাথানে কাজ করে সানিয়া মুর্মু হয়ে উঠেছিল একজন পাকা মৈষাল। মহিষ,
মৈষালবন্ধু আর তিস্তার মায়ায় জড়িয়ে ছিল তার মন। সে মায়া এমন মায়া যা সহজে
ভোলবার নয়। ভুলতে পারে না কোনো মৈষালই। সানিয়ার মন হঠাৎ করেই ব্যাকুল হয়ে
ওঠে। বাথান যাবার জন্য ছটফট করতে থাকে। একমাসের বেশী সময় অতিক্রান্ত হয়ে
গেছে। কতদিন দেখা নেই ভগলু কাকাদের সাথে। রামুর সাথে। রামু কি এখনও ওখানেই
আছে নাকি বাথান ছেড়ে চলে গেছে নিজের বাড়িতে? সব মহিষগুলি বেঁচে আছেতো? চিতি
মাঞ্জন মোটামালারা কেমন আছে? রাজা-রাণীই বা কেমন আছে? ওরা হয়তো আজও
অপেক্ষা করে রয়েছে।
আর
কিছুদিন বাদেই ঘোর বর্ষা শুরু হবে। তিস্তা ফুলে ফেঁপে উঠবে। তখন তিস্তার
তুফান পেরিয়ে পৌঁছানো যাবে না আর ওপাড়ে। তিস্তা বাড়লে কোন চরে বাথান বাঁধবে
মালিক? গতবারের মত যদি তিস্তা চরকে ধাওয়া করে তবে বাথান গুঁটিয়ে কোথায়
নিয়ে যাবে মৈষাল কাকারা? কি করে খোঁজ পাবে তখন সেই বাথানের? এসব চিন্তায় মন
খারাপ হয়ে ওঠে সানিয়ার। ইচ্ছে করছে দৌড়ে চলে যেতে বাথানে। কিন্তু যতবারই
তার মন ছুটে যেতে চায় বাথানে, বিবেক নামক পাথরটা তার দু’পা জড়িয়ে ধরে। ভাই
বোন বাবার কথা ভেবে নিজের মনকে শান্ত করে সানিয়া। নিজের পরিবারের প্রতি
দায়িত্বটাই যে সবথেকে বড় দায়িত্ব। কিন্তু এই বাথানিয়া মায়া? এই মায়া থেকে
সে মুক্তি পাবে কি করে? রামু-রাজা-রাণীরা যে শয়নে স্বপনে প্রতিনিয়তই
হাতছানি দিয়ে তাকে ডেকে চলেছে ।
বৃষ্টি
শুরু হয়েছে ভোরবেলা থেকেই। মনটা কেমন করে উঠে সানিয়ার। তবে কি বর্ষা ঢুকেই
গেল? আর মন মানছে না। ‘ফুলমণি বাচ্চু বাবা সবাইতো এখন ভালোই আছে’। সুতরাং
বুকে পাথরচাপা দিয়ে মনের ইচ্ছেটা সানিয়া বলেই ফেলে বাবাকে। বাবাকে কথা দেয়
কিছুদিন বাথানে কাজ করেই সে আবার বাড়িতে আসবে। এবার আর পয়সার থলি হারিয়ে
আসবে না। কোন উচ্চবাচ্য করেনা বাবা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে অবশেষে সানিয়াকে
কিছুটা অবাক করে দিয়ে সম্মতি জানায়। আনন্দে ভরে ওঠে সানিয়ার মন। পরের দিনই
হালকা বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পরে সানিয়া। জল বাড়লেও জলঢাকা পেরোতে তেমন
বেগ পেতে হয়নি। নদী পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ময়নাগুড়ি। ময়নাগুড়ি থেকে
রাজারহাট। ভাগ্যটা আজ তার ভীষণ ভালো। তিস্তার ঘাটে পৌঁছাতেই নৌকা মিলে যায়
বাথান যাবার নৌকাচালক সুনীল মৈষাল। দুধ দিতে এসেছিল বাজারে। সুনীল মৈষালকে
কাছে পেয়ে আনন্দ আর ধরেনা সানিয়ার। একে একে খবর নেয় সকলের। সবাই ভালো আছে
শুনে মনটা খুশীতে ভরে ওঠে। নদী পার হবার তর টুকুও যেন আর সইছে না তার।
পাহাড়ের বৃষ্টিতে নদীতে জল ভালোই বেড়েছে। ঘোলা জলে ঢেউ উঠছে মাঝে মাঝেই।
ছোট বড় ঢেউগুলিকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলে তাদের সলঙ্গা। নলবনের কাছে এসে নৌকা
থামে। এই এলাকার খুঁটিনাটি চেনে সানিয়া। একমাসের ব্যবধানে কিছুই পরিবর্তন
হয়নি তেমন। নলবন সরিয়ে বড় বড় পায়ে চলতে থাকে সে। অবশেষে বিস্তৃত বালুচর।
বালুর উপর মুচমুচে পলির আস্তরণ। এই ভূমিরূপ বলে দেয় জলে ঢেকেছিল এই চর। এর
উপর দিয়ে ছোটার মজাই আলাদা। প্রকৃতি যেন আজ তার জন্যই এমন পথ তৈরী করে
রেখেছে। আকাশ-বাতাস পশু-পাখি সবাই যেন তাকে স্বাগতম জানাতে তৈরী। বাথানের
টিনের চাল নজরে পরতেই সানিয়া দৌড় লাগায়। পৃথিবীর কোন শক্তিই যেন আজ তাকে
থামাতে পারবে না। সোতার উপরও তার দৌড় থামেনা। একবুক জলে পরে তার গতি থামে।
সেখান থেকেই রামু রামু বলে চিৎকার করে ডাকতে থাকে। প্রকৃতির কোলে এমন হৃদয়
খোলা আনন্দ দেখে তিস্তাও যেন ভারী তৃপ্ত হয়। কুলুকুলু ধ্বনিতে সেও ছুটতে
শুরু করে সানিয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴