শূন্য আমি পূর্ণ আমি/২০
শূন্য আমি পূর্ণ আমি/পর্ব : ২০
অমর চক্রবর্তী
~~~~~~~~~~~~~~~~~
আকাশ মায়ের মতো কোমল। নিকোলাস গিয়েনের এই কাব্যপংক্তি সদাসর্বদা আমার মাথায় ঘোরে। আসলে একটু বড় হবার পর থেকে মায়ের এই নরম মূর্তি দেখা হল না! শরীরে যে এত যন্ত্রণা ছিলো জানতাম না!আজ যখন একটা স্থায়ী চাকরিতে যোগ দিতে যাচ্ছি, চোখের সামনে মা নেই! না খেয়ে যে রোগটি হয়েছিল তার নাম পাইলোরিক স্টেনোসিস। সেই সময় ওষুধ কেনার পয়সা ছিলনা। শল্য চিকিৎসার উন্নতি চোখে পড়েনি! অপারেশনের পরেই চলে যান। মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে বেরোনো হল না!
ওদলাবাড়ি পৌঁছলাম। হরিদা প্রমীলা বৌদিও খুব আপন করে নিলেন। উনি বাংলা বিষয়ের ছাত্রচিত্তজয়ী মাস্টারমশাই। আমি শুরু থেকেই হরিশংকর সাহা বা হরিদাকে গুরুদেব বলতে শুরু করলাম। আমাকে উনি উচ্চমাধ্যমিক বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি সামান্য ক্লাস নিয়ে বেরোলাম বাড়ি খুঁজতে। আগে ডুয়ার্সের বাড়িঘর সেভাবে দেখিনি। দেখলাম চার পায়ের বাড়ি। অর্থাৎ চারটে মোটা থামের বাড়ি, নীচে ফাঁকা ওপরে ঘর। কেন রাতে টের পেলাম। একাদশ শ্রেণির এক ছাত্র আমি ক্লাস থেকে বেরোনোর পর আমার কাছে এলো।
-স্যার আপনি বাড়ি খুঁজতে যাবেন? একবার আমাদের বাড়ি দেখবেন?
-কি নাম তোমার?
-চন্দন সরকার স্যার।
-বেশ চলো।
বাড়িটার নাম আশীর্বাদ। ক্রান্তি রোগে পি ডব্লু ডি অফিসের কাছে। দেখলাম। পছন্দ হল। ওদের মূল ঘর থেকে একটু পেছনে যা আমার পক্ষে ভালো। নিরিবিলিতে পড়াশোনা আর পত্রিকার কাজ করতে পারব। আসবার সময় চোখে পড়ল সরকার প্রেস নামে একটা প্রেস আছে। ৮১সাল থেকে আমি চিত্রকল্প নামে একটি পত্রিকা করি টিউশনির পয়সায়। এবার বড়সড় পত্রিকা করব।
তো থাকার জায়গা হয়ে গেল। তরুণদা দুলুদা তো আছেনই, অসীমদা কিরণদা আর নির্মলবাবু সবাই কাছের হয়ে গেলেন। আর আমার বয়সী বন্ধু চৈতন্য সরকার। চৈতন্যকে নিয়ে ওদলাবাড়ি হাট বা বাজার থেকে স্টোভ হাড়ি কড়াই সব বাকিতে কিনলাম। সবাই নতুন মাস্টারমশাইকে সাদরে বাকি দিলেন।ব্যস্ আশীর্বাদে থিতু হলাম। সকালে স্কুলে যাবার আগে ডিম আলু সেদ্ধ ভাত রাতে পাউরুটি আর রসগোল্লা। শনিবার ক্লাস শেষে বাড়ির পথে। রবিবার থেকে আবার প্রথম গাড়ি ধরে এসে ক্লাস। এটা কিছু দিন পরে বদল হল এই রুটিনের।
মানাবাড়ি, স্কুল কম দূরত্ব ছিল না। কিন্তু যেতে ভারী আনন্দ পেতাম। হাইওয়ে পার হয়ে স্টেশনকে বাঁ হাতে রেখে ছোট্ট একটা বাঁশের সাঁকো পার হতে হতে আমি পাথরঝোরা পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে হাঁটতাম। পাহাড় তো মনকে উচ্চতায় টেনে নেয়। আমাকেও সব দুঃখ বেদনা ভুলিয়ে দিচ্ছিল। স্কুলে ঢোকার আগে পাশে চা বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে সবুজে চোখ জুড়াতাম। সবচেয়ে আনন্দময় ছিল ছেলেমেয়েদের কলকাকলি। এখন শুনি প্রায়ই কোনো না কোনো স্কুলে শিক্ষকরা ঘেরাও, অসম্মান। আমি দেখেছি অভিভাবকরাও পেছনে এলে আগে যাবার জন্য পেছন থেকে বলতেন "মাস্টারমশাই,- আসি।" কিম্বা সামনে থাকলে দাঁড়িয়ে পড়তেন। সে বড় সুখের দিন। আবার সে দিন সর্বদা সুখের নয়। মনে আছে ক্লাসে রচনা পড়াতে বলেছিলাম অকংগ্রেসি রাজ্যে সাম্প্রদায়িক অশান্তি কম। ব্যস্ পৌঁছে গেল কংগ্রেস অফিসে। একগুণধর ছাত্রের কারণে। নামটা মনে আছে,আজ আর বেদনার ভার নিতে চাইনে। পরে সেই ছেলেটি আমার খুব কাছের হয়েছিল।
প্রথমবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার গার্ড দেব।ভেনু মাল আদর্শ বিদ্যালয়। আমি প্রথম দিন আমাকে বার দেওয়া হয়নি আর প্রথম দিন এক অপ্রীতিকর ঘটনা। কোনো ছাত্র নকল করাছিল। নির্মলবাবু বাঁধা দিলে উনি পেছন ফিরতেই বাঁদরটা ওঁর সাদা শার্টে কালি ছিটিয়ে দেয়। তখন বলপেন সেভাবে চালু হয়নি। পর দিন ঠিক হয় আমরা সবাই ইনভিজিলেশনে থাকব এবং কোনোরকম টুকতে দেওয়া হবে না। একটা হৈ হৈ ব্যাপার।আমরা সবাই গেলাম। পরীক্ষা শুরু হবে আমি যে হল পেলাম তার অনেক ছেলেই বিড়ি টানছে। আমি বুঝলাম ওরা পরীক্ষার্থী ভেবে বিড়ি টেনে যাচ্ছে। ঘন্টা পড়ার পর যখন আমার হাতে প্রশ্নপত্র এলো। ওরা বিড়ি ফেলে ধুপধাপ প্রণাম করতে শুরু করল। আর মুখে বলতে লাগল "স্যার আমরা তিন বছর চারবছর পরীক্ষা দিচ্ছি। আমাদের একটু সাহায্য করবেন।" ওদের হাইট আর মাসেল দেখে আর আমার পুঁচকে চেহারা মনে রেখে বললাম, "হ্যাঁ বাবা দেব। শুধু তোমরা গোলমাল কোরো না।" এই বলে দরোজার বাইরে এসে হাঁটাহাঁটি করছি। যথারীতি গতকালের ঘটনা। প্রশান্তদা সব মাস্টারমশাইকে হল ছেড়ে বেরোতে বললেন। আমি জানতাম এই ঘটনাই ঘটবে। তাই বাইরে বাইরেই ছিলাম সোজা স্টাফরুম।তারপর সবাই মাল থানা। রিপোর্ট করে বেরিয়ে আসা। সেদিন দেখেছিলাম তরুণদা আর প্রশান্তদার প্রভাব।
'ত্বম হি গতি সত্তম'। জীবজগতের সবাই যাতে স্যাটিসফেকশনের পথে যেতে পারে, তার জন্যই চারিদিকে প্রস্তুতি। আমাদের জীবনের গতির ধারা যদি সেই তৃপ্তির পথে এগিয়ে চলে, চারিদিকে গার্ড করে তবে স্যাটিসফেকশনের দিকটা আরো বেশি জোর পাবে। এ এক বেদবাক্য। তো আমি প্রকৃতির মধ্যে খুঁজতে চাইলাম আমার সন্তুষ্টি। মালবাজার চালসা মেটেলি লিস ঘিস চেল নদীর তীরে। বন্ধ হল সপ্তাহান্তে বাড়ি যাওয়া। খাওয়া হচ্ছিল না। শরীর একটু খারাপ হল।দশম শ্রেণির ক্লাস নিতে গিয়ে কত ভালো ভালো ছাত্রী পেলাম। সুমন আগরওয়াল, মহুয়া চক্রবর্তী আরও অনেক। ক্লাস শেষে মহুয়া বললো "স্যার, আমার মা আপনাকে ডেকেছে।" বললাম, "যাবো।" যাওয়া হয়ে ওঠে না আর। ছুটি পেতেই বীরপাড়া। আমার প্রিয় কবি 'বনভূমি'র সম্পাদক, 'অললই ঝললই মাদারের ফুল' কাব্যগ্রন্থের কবি তুষার বন্দোপাধ্যায়-এর বাড়ি। অনেক গল্প, কবিতায় ডুবে যাওয়া।
না, পত্রিকাটা বের করতে হবে। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে সরকার প্রেস। সরকারদা খুশি মনে পত্রিকা ছাপতে চাইলেন।পান্ডুলিপি তৈরি করছি। মহাশ্বেতা দেবী নিজের গল্প, বাবা মণীশ ঘটকের কবিতা পাঠিয়েছেন। গল্প পেয়েছি শৈবাল মিত্রদের।অরুণ মিত্র সাগর চক্রবর্তী থেকে সমীর চট্টোপাধ্যায় অরুণেশ ঘোষ এবং একেবারে হালফিলের কবিদের।সব গুছিয়ে রেখেছি।প্রেস পেয়ে গেলাম। কিন্তু খাবার দিকে নজর দিতে হবে। সকালবেলায় কয়েকজনকে পড়ানোর পর ওই সেদ্ধভাত। রাতে আর রান্না করতে ইচ্ছে করত না। পত্রিকার কাজ, পড়াশোনা।
একদিন চলে গেলাম মহুয়াদের বাড়ি। আশীর্বাদ-এর পাশেই। মহুয়ার বাবা কালিদাস চক্রবর্তী লিসরিভার বাগানে চাকরি করেন। এখানে পেয়ে গেলাম এক মা'কে। তিনি বলেছেন "শুনেছি তুমি কষ্ট করে রান্না করে খাও। আর কষ্ট কোরো না। এখানে চলে আসো, আমাদের অনেক ঘর। তুমি আমাদের সঙ্গেই খাবে। ওদের একটু পড়া দেখিয়ে দিও তবেই হবে।" বললাম, "আসবো।" হ্যাঁ আমি আর পারছিলাম না! বেরোতে যাবো তখন একজন এলেন এবং আমাকে আনন্দের পথ দেখালেন বন্ধু হলেন। এবং অনেক গল্পের পর বললেন, "মাস্টারমশাই চলুন আমরা একটা সংবাদপত্র বের করি। অনেকটাই 'মিসলানি'র মতো।" সে একটা স্পেসিমেন কপিও এনেছিল। এই বন্ধু হলেন উত্তরবঙ্গ সংবাদ, বসুমতী, আকাশ বাংলা, ২৪ ঘন্টা এবং আরো সংবাদ মাধ্যমে কাজ করা সাংবাদিক পল্লব বসু। পল্লব বিখ্যাত হয় গোর্খাল্যান্ড এবং সুভাষ ঘিসিংয়ের কভারেজ করে। পল্লবের প্রথম কাজ এবং ব্রেইনচাইল্ড ভূমিষ্ঠ হল। আমি প্রথম সংখ্যাতেই ছিলাম।
আশীর্বাদ -এ থাকতে এক রাতে টের পেলাম কেন মানাবাড়িতে চার থামওয়ালা বাড়ি। মাঝরাতে বাজি পটকার শব্দে ঘুম ভাঙল।চন্দন বলল, "স্যার চেল বস্তি থেকে হাতি তাড়ানো হচ্ছে।" অর্থাৎ হাতি প্রায়ই হানা দেয়। হাতির যাতায়াতের জন্য নীচ ফাঁকা রেখে ওপরে ঘর। একটু ভয় পেলাম। ওদিকে শুনসান উদলাবাড়ি স্টেশন। লিখে ফেললাম, ওদলাবাড়ির হাতি আর মানাবাড়ির ভূত। এর চেয়ে ভয়ংকর কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছিলাম।একা লিস রিভার বাগানে যাচ্ছিলাম। বিকেলে বাস থেকে নামলাম। সামনে বাগরাকোট।নেমে হাঁটছি। ভ্যান গাড়ি পাইনি। একটু একটু এগিয়ে যাচ্ছি। দুটি পাতা একটি কুঁড়ি চোখ ভরে দেখতে দেখতে চলছি। ছোট ড্রেনটা থেকে বেড়ালের বাচ্চার আওয়াজ। উঁকি দিয়ে দেখতে গেছি। কে যেন সাইকেল নিয়ে আমাকে জামা ধরে টেনে বলেন, "তাড়াতাড়ি সাইকেলে ওঠেন মাস্টারমশাই। কি বিপদ ডেকে আনছিলেন। ওটা চিতার বাচ্চা। কাছাকাছি মা আছে!"
আমি শুধু ছায়াগুলোই দেখি। দিনান্তের পথ পাড়ি দিই।একটা জাপানী হাইকু পড়েছিলাম, 'জিনসেঈ বা/সাইয়েন দেকিনু/দোরা মা কা মা। অর্থাৎ জীবন এক দারুণ নাটক/যা মাত্র একবারই/অভিনীত হয়।' কিন্তু আমার জীবনে সম্পর্কে শুধু তুষারপাত। টাইমলাইনে মূর্ছনা। সূর্যকালে সব ঐশ্বর্য হারিয়ে শীতের আনাগোনা একলা পথে হাঁটার মনোবেদনা।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴