সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
25-June,2023 - Sunday ✍️ By- অমিত কুমার দে 6.86K

রংভং : খুঁজে পেলাম তাকে/অমিত কুমার দে

রংভং : খুঁজে পেলাম তাকে 
অমিত কুমার দে
----------------------------------

সেবার তার খোঁজেই গিয়েছিলাম! ফেসবুকে কারো পোস্টে রংভং-এর ছবি দেখে পাগল-পাগল লাগছিল! মিরিক ছাড়িয়ে কত পাহাড়ি মানুষের কাছে জানতে চেয়েছিলাম – রংভং কোথায়? কেউ বলতে পারলেন না। কিন্তু ফিরে তো আসব না! তাই গোলপাহাড়ে গিয়ে থেমে পড়লাম। ওয়াংচেন তামাং-এর হোম স্টে-তে ঘর নেই সেদিন, তবু জোরজার করে একটা অকেজো ঘরকেই কোনোরকম বাসযোগ্য করে ঢুকে পড়েছিলাম! তারপর অসামান্য গোপালধারা চা-বাগানে ঘুরে বেড়িয়েছিলাম ভবঘুরের মতো। পরদিন চলে গেছিলাম সীমানা। নেপালে ঢুকে পশুপতি মন্দির দেখে জমজমাট বাজারে ঠকেও এসেছিলাম!
তেইশের জুনের এগারোতে নিজে স্টিয়ারিংয়ে বসলাম। বহুদিনের স্বপ্ন মিরিকের স্বপ্ন-স্বপ্ন রাস্তাটায় নিজে গাড়ি চালিয়ে যাব। বন্ধু সঞ্জীবকে সঙ্গে পেলাম। ও থাকলে অচেনা রাস্তাতেও গাড়ি চালাতে বাড়তি সাহস পাই! কাকতালীয়ভাবে রওনা দেবার আগের দিন সীমানা বাজারের বিশাল গুরুং হোয়াটস আপে কিছু পাহাড়ি ছবি পাঠালেন। তাঁর কাছে জানতে চাইলাম – সীমানা নয়, অন্য কোনও পাহাড়ি নির্জনে থাকবার ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন কিনা। তিনি এক গুচ্ছ অপূর্ব ছবি পাঠিয়ে জানালেন – ‘গুফাপাতাল’ বলে একটি অপরিচিত পাহাড়ি গ্রামে থাকবার বন্দোবস্ত করে দেবেন।
মাটিগারা ছাড়াতেই বৃষ্টিধোয়া কাঁচা সবুজের সমারোহ। সকালটা বেশ ছায়া-ছায়া। দুধিয়ায় গিয়ে প্রাত:রাশ সারলাম। খেলাম ভালো, কিন্তু হাসিমুখে তিন মহিলা গলা কেটে নিলেন! 
ক্রমাগত পাহাড়ে উঠছি, আর চালক হিসেবে আত্মবিশ্বাস বাড়ছে! পপি ধমক দিচ্ছে – “রাস্তার দিকে তাকিয়ে চালাও!” সঞ্জীব পপিকে আশ্বস্ত করছে – “ভয় পাস না, অমিত পাকা ড্রাইভারের মতোই চালাচ্ছে।” আর ড্রাইভারের ভরসা হ্যান্ড ব্রেক আর ফার্স্ট গিয়ার! 

সীমানা বাজারে পৌঁছতেই অঝোর বৃষ্টি। আর পাহাড়ি বৃষ্টি চিরদিন আমাকে মাতাল করে! রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ছাতা মাথায় খুঁজে বের করলাম বিশাল গুরুং-এর হোম স্টে। কিন্তু কোনওভাবেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল না, তিনি নেপালে এবং নেটওয়ার্কের বাইরে। আসবার সময় সীমানার আগেই পাইন বনের মধ্যে একটা হোম স্টে দেখে এসেছিলাম, সেখানেই রাত্রিবাসের ভাবনায় গাড়ি ঘোরালাম। সীমানা ট্যুরিস্ট স্পটে তখন পর্যটকের মেলা। একটি গাড়ি থেকে ড্রাইভার আমায় চিনতে পেরে বললেন – “স্যার, বেড়াতে এসেছেন? আজই ফিরবেন?” থাকার কথা জানানোয় সে বলল – “এখান থেকে গোপালধারার দিকে দু কিলোমিটার গেলে দেখবেন একটা রাস্তা পাইন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে একটা গ্রামে নেমে গেছে। ওখানে একটা হোম স্টে আছে, দারুণ আতিথেয়তা।”
চললাম সেই খোঁজে! সঞ্জীবকে বললাম – “লক্ষ্য রাখ।” মিলেও গেল। একটা পথ নেমে গেছে মূল রাস্তা থেকে, পাইন বনের ভেতর দিয়ে। একখানা পাইন গাছে ছোট একটা ফ্লেক্স সাঁটানো রয়েছে – “রংভং রিট্রিট ফার্ম-স্টে”। সঞ্জীব একটু দ্বিধান্বিত হলেও গাড়ি নামিয়ে দিলাম আলো-ছায়ার সেই মোহময় রাস্তায়। দু-বছর আগে এই রংভং-কেই তো খুঁজতে এসেছিলাম! পেয়েছি যখন আর ছাড়া যায়?
কিছু কিছু রাস্তা জীবনে চিরন্তন হয়ে থেকে যায়। এ পথটা তেমনই। এই স্নিগ্ধ নির্মল সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ আনাড়ি চালকের ভয়ভীতি সব উড়িয়ে দিল নিমেষে। পথে দেখলাম একটা ছোট্ট হোম স্টে – “শর্মা হোম স্টে”। বারান্দায় একজনকে দেখে গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম – “ঘর ফাঁকা আছে?” উত্তর সদর্থক এল, টাকাও খুব বেশি চাইলেন না। 
আমরা আরো নামতে লাগলাম। পাহাড়, চা-বাগান, জঙ্গল, ঝোরার সঙ্গে সঙ্গে এই চলাটা যেন একটা দীর্ঘ কবিতা। 
রংভং বস্তিতে পৌঁছে গাড়ি থামালাম। কিছু পাহাড়ি মানুষের সঙ্গে গল্পগুজব হল। তারা খামারে কাজ করছিলেন। গন্তব্য হোম স্টে পেরিয়ে এসেছি শুনে গাড়ি ঘোরালাম। গাছগাছালিতে ঢাকা “রংভং রিট্রিট ফার্ম-স্টে” খুঁজে পেলাম বটে, কিন্তু সেটায় তালা আঁটা। পাশের এক ছোট্ট নার্সারি স্কুলের মাস্টারমশাই মালিককে ফোন করে জানালেন – তিনদিন এই হোম স্টে বন্ধ থাকবে।
মন করে নিলাম ‘শর্মা হোম স্টে’তেই থাকব। পৌঁছে মনে হল নিজের পরম আত্মীয়ের বাড়ি এলাম। মালিক রাজেন শর্মা কোথাও একটা কাজে গেছেন। তাঁর সহধর্মিনী কী মিষ্টি হাসিতে স্বাগত জানালেন। ঘর খুলে দিলেন।
রাজেনবাবু কিছুক্ষণের মধ্যেই এলেন। এসেই আপন করে নিলেন। বললেন – “একদম নিজের বাসা মনে করুন।” পাহাড় আর পাইনবনকে চোখের সামনে এনে দেওয়া বারান্দাটা শুরুতেই ম্ন কেড়ে নিল! দুপুর গড়াতে চলেছে। লাঞ্চ জুটবে আশা করিনি। শর্মা-বৌদি কী দ্রুত ডিমের কারি, মুগডাল, সবজি, পাপড় ও আলু ভাজা, স্যালাড তৈরি করে দিলেন। তাঁর কর্তা আচারের কৌটো খুলে ট্রাডিশনাল বাঁশের আচার ও তেঁতুলের আচার বের করে দিলেন। 
পাহাড়ি গ্রামটার একটা অবর্ণনীয় মায়া আছে। দুপুরের খাওয়া সেরেই আমি আর সঞ্জীব হাঁটতে বের হলাম। পপি নিশ্চিন্ত ঘুমে ডুব দিল। হঠাৎ রহস্যঘন কুয়াশা ঘিরে ধরল আমাদের। সব গাছ, পথের বাঁকগুলো অদ্ভুত ছমছমে হয়ে উঠল। একটানা পাখি আর পাহাড়িয়া ঝিঁঝিঁর ডাক। কুয়াশা কাটতে কাটতে একটি মেয়ে একা নেমে আসছে। কাছে আসতেই চিনতে পারলাম – সীমানা ট্যুরিস্ট স্পটে আজই একে দেখেছি দারুণ নিষ্ঠা আর দক্ষতায় ট্রাফিক সামলাতে। সিভিক পুলিশ। এতটা পথ হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছেন। ‘নমস্কার’ জানিয়ে কথা বলতেই তিনি তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালেন, যেন আমরা কতকালের চেনা!

বিকেলে শর্মাজি আমাদের গ্রাম ঘুরিয়ে দেখালেন। তাঁর আত্মীয়দের বাসা। ধাপে ধাপে অর্গানিক সবজির চাষ। দেখালেন বুনো মোরগ এসে ঘুরে বেড়াচ্ছে সবজিক্ষেতে। জানলাম – এখানে দল বেঁধে জংলি হরিণও আসে। 
প্রতিটি ঝোরা ও ঝরনার সামনে বৌদ্ধ মন্ত্র লেখা পতাকা উড়ছে। এরা জলকে দেবতাজ্ঞানে পুজো করেন। শর্মাজির লিজ দেওয়া জমিতেই একটা ছোট্ট চা-ফ্যাক্টরি। চায়ের গন্ধে বাতাস ম-ম করছে। এক নেপালি মহিলা এক মনে ফুল গাছ লাগিয়ে চলেছেন, পাশে তাঁর তাগড়াই কুকুর ‘টোগো’। টোগো আমার বন্ধু হয়ে গেল নিমেষে। তাকে নিয়ে সর্পিল পাহাড়ি পথে হাঁটার ইচ্ছে প্রকাশ করতেই মালকিন হাসিমুখে অনুমতি দিলেন। 
সঞ্জীবের ইচ্ছে ছিল পরদিন লেপচাজগতে গিয়ে থাকবে। রাতে শর্মাজির সঙ্গে গল্প হচ্ছিল। তিনি বললেন, “নেপালে চলে যান – কন্যম। দারুণ লাগবে আপনাদের। আপনিই গাড়ি চালিয়ে যেতে পারবেন।”
আমাদের অনুরোধে শর্মাজিও আমাদের সঙ্গে নেপাল চললেন। রংভং থেকে রওনা হয়েই দেখা মিলল দু’জন সিভিক পুলিশ তরুণীর। গ্রামের মেয়ে, শর্মাজির পরিচিত। তারা নেপাল সীমানাতেই ডিউটিতে যাচ্ছে হেঁটে হেঁটে। আমরা গাড়িতে তুলে নেওয়ায় খুব খুশি তারা। তাড়াতাড়িই অনুমতি মিলল। 
তারপর নেপালের ঝকঝকে রাস্তায় গাড়ি ছোটালাম। বিদেশেও গাড়ি চালাব ভাবিনি তো কখনো! অবাক হয়ে দেখছিলাম নেপালের রাস্তা – কী সুন্দর বানানো। শর্মাজি জানালেন – কোরিয়া-র কারিগররা এ রাস্তা বানিয়েছিলেন। পথের কোথাও কোনও আবর্জনা ফেলা নেই। কী পরিষ্কার! 
কন্যমে পৌঁছে আমরা মুগ্ধ। এত সুন্দর আমাদের নাগালের মধ্যে! গাড়ি পার্কিং, ওয়াচ টাওয়ার কিছুর জন্যই কোনও টিকিট কাটতে হল না। গোল-মাথা চা-বাগান কত অপরূপ সৌন্দর্যে চোখ টেনে নিল – তা লিখে বোঝানো অসম্ভব। আমরা ঢেঊ-খেলানো সবুজে হারিয়ে গেলাম।
কন্যম থেকে আরো কয়েক কিলোমিটার উঠে একটা মন্দির আর লেকে শর্মাজি নিয়ে গেলেন। রাজহাঁসের দল কুয়াশা মেখে সাঁতার কাটছে আপনমনে। পথে ছোট্ট গ্রামীণ বাজার থেকে অর্গানিক সবজি কিনলেন শর্মাজি। পপির দাবিতে লকলকে স্কোয়াশের ডগা কিনলেন তিনি। রাতেই রান্না হবে!
অনেক অনেক ভালো-লাগা নিয়ে বেলা তিনটেয় হোম স্টেতে ফিরলাম। ডাইনিং ঘরে গিয়ে যেন অমৃত প্রতিটি পদ। 
বিকেলে শর্মাজি পাহাড়ের উৎরাই বেয়ে পাইন বনের গহন দিয়ে নিয়ে গেলেন তাঁর বাবা-মায়ের বাড়িতে। দুই পাহাড়িয়া প্রবীণের সঙ্গে সন্ধেটা কী যে ভালো কাটল বোঝানো কঠিন। শুনলাম পাহাড়ের মানুষের কত কত যুদ্ধের কথা। আশি অতিক্রান্ত বৃদ্ধ শোনাচ্ছিলেন তাঁর কৈশোর তারুণ্য যৌবনের গল্প। রাস্তাঘাট ছিল না। জঙ্গুলে গ্রাম থেকে কীভাবে বেঁচে থাকার লড়াই করতে হত তাঁদের। 
রাতের রংভং অসামান্য। ঘিরে থাকা সব পাহাড়ে আলো জ্বলছে। শর্মাজি চিনিয়ে চলেছেন – ওইদিকে নেপাল, ওই যে কার্শিয়াং, ওদিকটায় দার্জিলিং, ওই তো মিরিক...! হোম স্টে-র পাশেই তিনটে বসবার জায়গা। আমরা তিনজন বসে আছি চুপচাপ। ভালো-লাগা আচ্ছন্ন করলে কখনো কখনো কোনও কথা বলতে ইচ্ছে করে না।
ফিরবার দিন সকালে মন বলছে – এখানেই যদি থেকে যেতে পারতাম! শর্মাজি বললেন – “পাহাড়ি সবজি মিশিয়ে খিচুড়ি রেঁধেছি। দিনে কখন কোথায় খাবেন কে জানে! খেয়ে রওনা হন।” আহা, খিচুড়ির সে স্বাদ বাকি জীবনে ভুলব না। ‘খাদা’ পরিয়ে আমাদের বিদায় জানানো হল। শর্মাজির সঙ্গে বুকে বুক মিলিয়ে বললাম – “আত্মীয় হলাম কিন্তু! মনে রাখবেন।”
রংভংকে পেছনে রেখে কুয়াশা কেটে উঠছি। কী যেন ফেলে এলাম বারবার মনে হতে লাগল।

সীমানা পেরিয়ে সকাল সকাল জোড়পুখুরি গেলাম। রাস্তাটা কুয়াশায় কুয়াশায় অনবদ্য। বেশ খানিকটা সময় পাইনের গাছ-ঘেরা পাহাড়িয়া সরোবরের পাশে শান্ত স্নিগ্ধ কাটিয়ে চললাম লেপচাজগৎ। কিন্তু সেখানে পর্যটকের ঢল আর গাড়ির জ্যাম। কোনওমতে লেপচাজগৎ পেরিয়ে ঘুম-এ এসে স্টেশনের পাশে গাড়ি দাঁড় করালেন আনাড়ি ড্রাইভার। তাঁর চোখে-মুখে তখন বালকসুলভ কনফিডেন্স!! পৃথিবীর উচ্চতম রেলস্টেশনে তিনি নিজে গাড়ি চালিয়ে আসতে পেরেছেন! 
কার্শিয়াং-এর আগে বিখ্যাত ‘মার্গারেট ডেক’-এ চা খেতে ঢুকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও টেবিল মিলল না! দামি দামি চায়ের বিক্রি দেখে মনে হচ্ছিল – এ দেশের কত মানুষ ভালো করে খেতে পারে না! গেঁয়ো স্বভাব যায়নি, নামি-দামি রেস্তোরাঁ হোটেল দেখলে এখনো ভয় পাই! খুব সুন্দর বানিয়েছে রেস্তোরাঁটি। মন কেড়ে নিলেও মনে হল এ আমার জায়গা নয়! 
পথের ধারের একটা অনামী খাবার দোকানে পেট পুরে খেয়ে নেমে এলাম রোহিনী হয়ে। কোথাও সাপের মতো, কোথাও ধনুকের মতো সেই অসামান্য পথ আমাকে চুপিচুপি বলে রাখল – “পাহাড়ে গাড়ি চালানোর ভয় কাটল তো? আবার এসো কিন্তু!” 
---------------------------------------------------------------
শর্মা হোম স্টে-তে যেতে হলে যোগাযোগ : রাজেন্দ্র শর্মা – ৭০২৯৪৫৩৩৪১ 

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri