মায়াপথের মীড়-১১/সৌগত ভট্টাচার্য
মায়াপথের মীড়/১১
সৌগত ভট্টাচার্য
গলির মোড়ে বড় রাস্তার এইপার পর্যন্ত ছিল আমার সাম্রাজ্যের সীমানা। আমার রাজ্যপাটে গঙ্গাফড়িংয়ের মত উড়ে বেড়ানোর জন্য ছিল বড়মামার বিরাট একটা সাইকেল। হাফ প্যাডেল করে চালানো সাইকেলটি ছিল আমার রথ। আমিই সারথি, আমি সম্রাট, আমিই সাম্রাজ্যের একলা টহলদার।
হাফপ্যান্ট আর হাওয়াই চটি পরে বগল দিয়ে সিটটাকে চেপে, হাত দিয়ে সামনের রডটাকে শক্ত করে ধরে শুরু হত বন্ধুদের সঙ্গে সাইকেল রেস। গলির মধ্যে সাইকেল রেসের সময় জং ধরা চেন পড়ে যেত, চেন পড়া সাইকেল সারথী বেবাক মুখে তাকাতো অন্য সারথীর দিকে, রোদপড়া বিকেলে রেল লাইনের ধারে বাকি বন্ধু সারথীরা যেন দিগন্তের সূর্যাস্তের রং মাখা ফটো ফিনিশ ছোটবেলা!
দুপুরগুলো কখন যেন আলোকবর্ষের মত দীর্ঘ হয়ে উঠেছিল সাইকেল চাপা বিকেলের অপেক্ষায়। পুরোনো সাইকেলটি ধুয়ে মুছে রেডি করে রাখা। তারপর পকেটে মহার্ঘ্য চার আনা আট আনা সম্বল করে বড় রাস্তার এই পারে সাহা কাকুর দোকানে যেতাম পক্ষীরাজ নিয়ে। বড় রাস্তাই রাজ্যের সীমানা। নো-ম্যান্স ল্যান্ডে পেরিয়ে যাওয়ার পাসপোর্ট আমার নেই। সাহা কাকুর দোকানের কাঁচের বয়ামে সাজানো থাকত স্বপ্নের লেবু লজেন্স, ঝাল লজেন্স ,মৌরি লজেন্স, ঝাল চানাচুর। সিকি পয়সায় দুটো আট আনায় পাঁচটা। কিন্তু সাধ আর সামর্থের লড়াইয়ে সাধ যে অধরাই থাকে, সেকথা সাহা কাকুর দোকানের সাজানো বয়াম আমাকে হাফ প্যাডেল বেলায়ই শিখিয়ে দিয়েছিল। যখন কিশোরের মত হৃদয়-আকৃতির ক্ষীর ললিপপের দাম ছিল বারো আনা। জীবনের ষোলো আনা তখনও অনেক দূর!
বাড়ির উঠোনে শীতকালে কমলালেবু রাঙা অনেক রোদের সঙ্গে মুখ খোলা কিছু আচারের বয়ামও ছিল। সাইকেল নিয়ে উঠোনে এলেই কখন যে হাত চলে যেত আচারের বয়ামে! আচার মুখে পুরে সাইকেল নিয়েই আবার রাস্তায় দে ছুট। গলা শুকিয়ে কাঠ, রাস্তার কলের পাশে সাইকেল স্ট্যান্ড করিয়ে কলের জল আঁজলা করে খেয়ে, ভেজা হাত প্যান্টে মুছে আবার সাইকেল নিয়ে গলি ভুবনে কলম্বাস। কৈশোর জুড়ে রাস্তার ধারের কল দিয়ে অবিরাম মিনারেল ওয়াটারই পড়ত। প্লাস্টিকের সিলড মিনারেল ওয়াটারের বোতলগুলো ছিল আমার বড় হওয়ার অপেক্ষায়!
রোদে বেশীক্ষণ থাকলে সাইকেলের চাকার পাংচার অনিবার্য। পুরোনো লিকের পট্টি খুলে চোরালিক তো হতই। পাড়ার মোড়ে সুবল কাকুর সাইকেল সরানোর দোকান। কাঠের ছোট বাক্স, অর্ধেক মুখ খোলা তার ভেতরে বড় একটা কাঁচি টিউবের টুকরো লাল রঙের আঠা, লিক খোঁজার জন্য হাওয়ায় ফোলানো টিউবটিকে জলে ডোবালে লিকের জায়গা থেকে যে বুদবুদ বেরোত সেটা সাইকেল ফিটারের মত ম্যাজিশিয়ান হওয়ার স্বপ্ন বুদবুদ।
বাবার সাইকেলের সামনে লাগানো অর্ধশঙ্কু আকৃতির একটা লাইট, তার দিয়ে পেছনের চাকায় একটা ডাইনামোর সঙ্গে যুক্ত। সে কি অপার বিস্ময়ে কিশোর চোখে এই লাইট জ্বালানোর প্রযুক্তি বুঝতে চেষ্টা করেছি! যখন বাবা থাকত না অথচ সাইকেল থাকত বাড়িতেই সেই সময় ডাইনামোটাকে চাকার সঙ্গে লাগিয়ের সাইকেলটাকে স্ট্যান্ডে ওপর কাত করে জোরে প্যাডেল করতাম। না বোঝা প্রযুক্তি দিয়ে যে হলুদ উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠতো চাকার সঙ্গে ডাইনামর ঘর্ষণে, সেই হলদে আলোটা বোধহয় কিশোর বয়সের এক বিস্মিত বালকের চোখের মতোই উজ্জ্বল।
বাবার সাইকেলের সামনের রডে বসে সক্কাল বেলায় ঘুম না ভাঙা চোখে আমি স্কুলে যেতাম। ফিরতাম হেঁটে বন্ধুদের সঙ্গে। প্রতিদিন ভাবতাম বাবার মত আমারও একটা সাইকেল যে কবে হবে! বাবা বলত, এই সাইকেলটি নাকি বাবা চাকরি পাওয়ার পরে কিনেছে। কিন্তু আমি তো সবে ক্লাস ফোর। চাকরি পেতে অনেক দেরি। বাবা যেটুকু টিফিনের পয়সা দেয় বাড়ি থেকে সেটা দিয়ে তো লাল বরফ আর কালো হজমি কারেন্ট আলুকাবলি কিনতেই শেষ! কি ভাবে জামাবো সাইকেলের জন্য এতগুলো টাকা! তারমধ্যে সামনে আবার পুজো!
আষাঢ় মাসে রথের মেলা থাকে ফিরছি এক হাতে শক্ত করে ধরা গ্যাস বেলুন অন্য হাতটি বাবার হাতে। মেলা থেকে আমি একটি মাটির ঘটও কিনেছিলাম। সেই ঘটে আমি চার কোণা পাঁচ পয়সা পাঁচ কোণা কুড়ি গোল খাঁজকাটা দশ পয়সা ফেলতাম। সেটাই ছিল আমার নিজস্ব রাজকোষ। একদিন সঞ্চিত সব মোহরের বিনিময়ে নিশ্চিত পুষ্পক এসে দাঁড়াবে আমার বাড়ির টিনের দরজার সামনে। এই স্বপ্নেই বাড়ির টিনের দরজা থেকে হাফ প্যাডেলবেলা ঘুরে গেল হাই স্কুলের বড় লোহার দরজার দিকে।
ক্লাস সেভেনে আলজেব্রার দুঃখ ভুলিয়ে জীবনে প্রথম সম্পত্তি হল আমার নতুন সাইকেল। আসলে নতুন সাইকেল শুধু বাড়ির টিনের গেটের বাইরের পৃথিবীতে পর্যটক হয়ে যাওয়ার ক্যারাভ্যানই নয়, নিজের স্বতন্ত্র বড় হয়ে যাওয়াকে জানান দেওয়ার অধিকারও বটে। সকালে স্যারের বাড়ি পড়তে যাওয়া থেকে স্কুল। বিকালে পাড়ার ফুটবল মাঠ থেকে মুদির দোকান। ঘামের মত শরীরের সঙ্গে লেপ্টে থাকল আমার দ্বিচক্রের ঘূর্ণন। যা আবহমান.. যা চলছেই...
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴