ভাস্কর্যের আঁতুড়ঘর-২১/মৈনাক ভট্টাচার্য
ভাস্কর্যের আঁতুড়ঘর (পর্ব-২১)
মৈনাক ভট্টাচার্য
প্রদোষ দাশগুপ্তের ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য ‘বঁধু’
রবীন্দ্রনাথ প্রতিদিন তাঁর অনুরাগীদের কাছ থেকে প্রচুর চিঠি পেতেন। একদিন সকালে টাটকা তাজা চিঠিগুলো দেখতে দেখতে একটা চিঠিতে চোখ আটকে গেল। ছোট্ট একরত্তি এক মেয়ে রাণু, সহজ সরল চিঠিতে রবীন্দ্রনাথের কাছে জানতে চেয়েছে- ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পে ইরাণি বাঁদীর গল্পটা সেই বুড়ো বলল না কেন? চিঠিতে রাণুর কোন পদবী নেই, বেনারসের একটা ঠিকানা একটা অবশ্য আছে। ভাষা এবং ভাবে বোঝাই যাচ্ছে এ এক সরল শিশুর চিঠি। বেশ মজা পেলেন এমন এক চিঠি পেয়ে। যদিও কোন রকম পরিচয়ই নেই তবুও রাণুর আব্দার, বুঝিয়ে বলবার জন্য তাঁকে একবার রাণুর বাড়িতে আসতে হবে। না এসে রবীন্দ্রনাথের কোন উপায় ছিলনা কেননা এক অসম বয়সী অচেনা অদেখা শিশুমন যে নাহলে তাঁর সাথে আড়ি দিয়ে দেবে। আর এলে, বিনিময়ে রানুদের শোবার ঘরে তাঁকে শুতে দেবে এবং রানুদের পুতুলগুলো দেখতে দেবে। এই সরলতার সুত্রধরেই তো রাণুর সাথে ভানুর আলাপ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভানু সিংহ হয়ে ওঠা। তার পর ভানু সিংহের সাহিত্য তো ইতিহাস। এই রবীন্দ্রনাথই রাজশেখর বসুকে যখন বলেন-“সহজ কথা লিখতে আমায় কহ যে,/ সহজ কথা যায় না লেখা সহজে,” কিংবা পাবলো নেরুদা বলেন-“ সহজ করে পদ্য লেখা আমার কাছে সব চেয়ে একটা কঠিন কাজ”। শিল্পের মৌলিকতাকে অমরত্ব দিতে এমন সরলতার প্রভাব সব শিল্পমাধ্যমেই এমন অনেক ইতিহাস হয়ে আছে।
# #
রদ্যাঁর ভাস্কর্যের মোহে তাঁর কাজ চাক্ষুষ করতে চান কনস্টান্টিন ব্রাঁকুসি। জীবন্ত কিংবদন্তির সামনে দাঁড়িয়ে এক রোমানিয়ান-ফরাসি ভাস্কর দেখতে চান ভাস্কর্যের এই মহামানবের হাতের জাদু। কেননা কনস্টান্টিনের অন্তরের কোথায় গিয়ে যেন বার বার ঘাই দেয় এই লোকটার কাজের পূর্ণতা। এই একাগ্রতার কিছুটাও যদি ছুতে পারা যায় সেই আশাতেই তো কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসা এক আঠাশ বছরের যুবকের বুক বেঁধে প্যারিস যাত্রা। তড়-তড় করে কথা ভাব এগিয়ে যেতে থাকল। ছুয়ে দেখলেন রদ্যাঁর ঐশ্বর্য। শ্রদ্ধায় নত হয়ে যখন মোহভঙ্গের জন্য মন শক্ত করে ফেলেছেন তখন খোদ তাঁর ভাস্কর্যের ঈশ্বর জানতে চাইলেন-“ তুমি আমার সহকারী হিসেবে কাজ করবে?” এইবার যেন সব সত্য ওলট পালট হয়ে যেতে বসল। কত জন্মের পুণ্য, তবেই না এমন সুযোগ আসে। একটু সময় থম মেরে থেকে মোহের আবেশ থেকে বেড়িয়ে আসতে চাইলেন। সে তো আর একটা রদ্যাঁ হতে চায়না সে যে ব্রাঁকুসিই হতে চায়। ফিরিয়ে দিলেন এই মহাপ্রস্তাব। কেননা এমন প্রতিভার আবডালে থাকলে নিজের মৌলিক মেধার বিকাশ যে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। কনস্টান্টিন ব্রাঁকুসির দর্শণ বলে-“সহজ শিশুবোধ হারিয়ে ফেললে আমরা আমাদের জীবনকে স্তব্ধ করে দেই। তবে সারল্যই কিন্তু শিল্পের শেষ কথা নয়। বাস্তবতার প্রকৃত স্বরূপে পৌঁছতেই একজন শিল্পীকে সরল হতে হয়”।
এই মূহুর্তে প্রসঙ্গ কিন্তু ব্রাঁকুসি নয়, ভারতীয় ভাস্কর প্রদোষ দাশগুপ্ত। তবুও প্রদোষ দাশগুপ্তের কথা বলতে গেলে ব্রাঁকুসির কথা এসেই যায়। কেননা একটা সময়ের পর যখন প্রদোষ ভাস্কর্যে তাঁর নিজের ভাষা খুঁজে বেড়াচ্ছেন, তিনি অনুভব করলেন ভারতীয় দর্শণে ব্রহ্মাণ্ডের যে প্রত্যয় সেখানে সমস্ত শক্তি যেন একক একটি কেন্দ্রের আবর্তে বা আকর্ষণে সংহত। এই শক্তির ক্রিয়া যেন অবয়বের আয়তনিক জ্যামিতিতে বিভিন্ন তলের সংঘাত না থেকেও থাকে এক সমন্বয় ও সংহতি। ব্রাঁকুসিও তো এই দর্শণকেই উপলব্ধি করেছিলেন। ব্রাকুসির ভাস্কর্যের এই সরলতার ভেতরেই প্রদোষ খুঁজতে চাইলেন নিজের ভাষা, পেয়েও গেলেন। কেননা প্রদোষ দাশগুপ্তের কাজে আবেগের থেকে মেধা বা বুদ্ধির ভুমিকা অনেক বেশি। প্রদোষ কিন্তু তাঁর পরিনত বয়সে এসে নিজের কাজকে এই বোধে ব্যাবহার করেছেন। কেননা আমাদের দেশে ভাস্কর্যের সবচেয়ে প্রধান অন্তরায় পৃষ্টপোষকতার অভাব। ভাস্কর্য আবার এক শ্রম এবং ব্যয় সাপেক্ষ শিল্প। এই প্রতিকূলতার মধ্যে আমাদের দেশে ভাস্করকে বেঁচে থাকতে হয়। বিশিষ্ট শিল্প সমালোচক মৃণাল ঘোষকে প্রদোষ দাশগুপ্ত এক একান্ত আলাপচারিতায় একবার বলেছিলেন –“তখন ভাস্কর্যের বাজার যাকে বলে একেবারে ব্যারেন ল্যান্ড। আমাকে এত ধাক্কা খেতে হয়েছে...... তখন কোথাও কেউ ভাস্কর্য কেনে না”। ক্যালকাটা গ্রুপের প্রদর্শনিতে তাঁর একটা কাজ বিক্রি হয়েছিল পয়ষট্টি টাকায়। তার আগে মাত্র আর একটা কাজ তাঁর স্টুডিয়োয় এসে একজন কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন পচাত্তর টাকায়। এইত বাজার। তাই ভাস্কর্য নিয়ে পরীক্ষা নিরিক্ষা করবার অবকাশ কোথায়। চল্লিশের দশক অব্দি যদিও তাঁর কাজে ছিল সমাজ সচেতনতার প্রাধান্য। তারপর থেকে ধীরে ধীরে তিনি জোর দিতে শুরু করলেন রূপের শুদ্ধতায়। ভারতীয় ধ্রুপদী ভাস্কর্যের দর্শনকে পাশ্চাত্যের আধুনিক ভাস্কর্যের জ্যামিতিকতার সঙ্গে সমন্বিত করে তিনি গড়ে তুলেছিলেন তাঁর নিজস্ব রূপপদ্ধতি। ধ্রুপদী স্থৈর্য ও উদাত্ততা এবং রোমান্টিক অন্তর্মুখীনতা ও প্রতিবাদী চেতনার দ্বৈতের মধ্যে আন্দোলিত হয়েছে তাঁর রূপকল্পনা। এই দুই বিপরীত অনুভবকে তিনি মিলিয়েছেন তাঁর কাজে। এক ধ্রপদি অভিব্যাক্তির দিকে। সাথে ভাবনা ছিল ভারতীয় শিল্পকে আধুনিকতার উত্তরণের দিকে নিয়ে যাওয়া। রামকিঙ্করের পরে তাই বোধহয় উচ্চারিত ভারতীয় ভাস্কর্যের এক নাম এই প্রদোষ দাশগুপ্ত। তাঁর রূপাবয়বকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্যায়ে মুখাবয়ব ভাস্কর্য। চল্লিশ ও পঞ্চাশ দশকের তাঁর অনেক কাজে বিষয় ছিল বাঙালি জীবনের দৈনন্দিনতা এবং সমাজ ও রাজনৈতিক চেতনা থেকে। এই সময়ে ১৯৬৭তে তাঁর একটি কাজে ক্ষুধার বাস্তবতাকে ধরেছেন অভিব্যক্তিবাদী ভাঙনের মধ্য দিয়ে। যেই কাজ তাঁর বিখ্যাত ব্রোঞ্জ সংস্করণ ‘হাংরি ফ্যামিলি’।
এর পরবর্তিতে এসে প্রদোষ যেন আরও অনেক পরিণত। এই পর্যায়ে তাঁর ভাস্কর্যে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন গোলক, বেলনাকার ও শঙ্কু আকৃতির রূপাবয়ব নিয়ে। এর পর এসেছে ডিম্বাকৃতি বা ইলিপটিক্যাল ফর্ম নিয়ে তাঁর ভাবনা। ব্রাঁকুসির দর্শন ও ভারতীয় দর্শনের সাযুজ্য অনুভব করেছেন এর মধ্যে। এই মূলগত আকৃতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়েই তিনি অতীত ও বর্তমান, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সেতুবন্ধন করেছেন। এই ধ্রুপদী দর্শনই ভাস্কর্যে তাঁর নিজস্ব অবদান।
এই পর্যায়ের তাঁর বিশেষ আলোচিত একটি কাজ ‘দ্যা ব্রাইড’ বা ‘বধূ’। মাথার গুঢ় ভরের মৌলিকতায় বাঁকানো হাটু হয়ে যে ভাবে কাঠের বেসের সমস্ত কাজটাকে এক জ্যামিতিক প্রতীকে স্থাপন করেছেন সেটা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কাজটাকে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় বসার ধরনে হাঁটুর অবস্থান এবং পরিধেয় শাড়িতে প্রাশ্চাত্য ভাবধারা থেকে ভাস্কর প্রদোষ কিভাবে ভারতীয় ঐতিহ্যকে ব্যবহার করেছেন ব্রাঁকুসির ভাবনার নির্ভারতাকে। যদিও নববধূর মাথাটি নিষ্ক্রিয় এবং জড় দেখায়, তবে এর উত্থানের সামান্য কোণ এটিকে আশার একটি সংযত অথচ উত্সাহী শক্তি মনে হতেই পারে। কাজের ভেতর উঠে এসেছে এক বিমূর্ততার সাথে এক ছায়াময়তা যার কিছুটা আভাষ আমরা আগে পাই রামকিঙ্করের কাজে। ভাস্কর্যের এই রূপের নান্দনিকতা কেবল মাত্র সহজতম বোধের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায়। যা যে কোন মাধ্যমের একজন শিল্পীকে মাটির খুব কাছে গিয়ে তবেই আত্মস্থ করতে হয়।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴