চায়ের নিলাম ব্যবস্থার বিধি সরলীকরণ হোক/গৌতম চক্রবর্তী
চায়ের নিলাম ব্যবস্থার বিধি সরলীকরণ হোক
গৌতম চক্রবর্তী
কম্পিউটার এবং মাউস দিয়ে নয়। চায়ের নিলাম পরিচালনা হত হাতুড়ি ব্যবহার করে। এক একটি নির্দিষ্ট ‘লট’-এর প্রতি কেজি চায়ের ন্যূনতম দর হাঁকছেন অন্যতম নিলামকারী সংস্থার শীর্ষকর্তা। উল্টোদিকে বসা ৩০ জন বিক্রেতার অনেকে সেই দরের উপরে নিজেদের দর হাঁকছেন। সর্বোচ্চ দর স্থির হলে টেবিলে হাতুড়ির ঘা মেরে তাতে সিলমোহর দিচ্ছেন নিলাম পরিচালক। এটাই ছিল পরিচিত দৃশ্য। সাধারণভাবে চায়ের পাইকারি নিলামের পক্ষে কেন্দ্র, টি বোর্ড ও শিল্প মহল। কিন্তু এখনও দেশে উৎপাদিত চায়ের ৪০% নিলাম হয়। বাকিটা সরাসরি ক্রেতাকে বিক্রি করে বাগানগুলি। নিলামে চায়ের দাম সেভাবে ওঠে না বলেও শিল্পের একাংশের দাবি। তাই এই ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করার উপায় খোঁজার পাশাপাশি নিজেদের নানা সমস্যা তুলে ধরতে এক মঞ্চ গড়েছে নিলামকারী সংস্থাগুলি। নাম দি অ্যাসোসিয়েশন অব টি অকশনিয়র্স (এটিএ)। কলকাতার চা নিলাম কেন্দ্রের দু’নম্বর ঘরে বিশেষ নিলামের আয়োজন করেছিল এটিএ। সেখানেই পুরনো এই নিলাম প্রথার বিশেষ অনুষ্ঠানের ব্যাবস্থা করেছিল তারা। কৌতূহলবশত হয়ে আমার এক পরিচিত চা ব্যাবসায়ীর সঙ্গে এসেছিলাম কলকাতার এই চা নিলাম কেন্দ্রে। স্মৃতিমেদুর হয়েছিল চা শিল্প মহল। এক অবিস্মরণীয় ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলাম আমি। নিলামকারী সংস্থাগুলির সংগঠনের হাত ধরে এভাবেই সেখানে চারটি নিলাম সংস্থা মোট ৩.৬৯ লক্ষ কেজি চা পুরনো পদ্ধতিতে বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে। আগে অর্থোডক্স ও দার্জিলিং চায়ের নিলাম হত পুরনো প্রথা মেনে যার নাম ছিল ‘ইংলিশ অকশন মডেল’। গুয়াহাটির পরে কলকাতা ও শিলিগুড়িতেও চালু হয় চায়ের নতুন নিলাম (পাইকারি ব্যবসা) ব্যবস্থা ‘ভারত অকশন’। ‘ভারত অকশন পদ্ধতি’তে কলকাতা ও শিলিগুড়ি নিলাম কেন্দ্র ছাড়াও গুয়াহাটিতে সিটিসি, অর্থোডক্স ও চায়ের গুঁড়োর নিলাম হয়।
চা নিলামের যে ব্যবস্থাটি চালু ছিল সেটি ‘ইংলিশ মডেল' নামে পরিচিত। ইংলিশ মডেলে নিলাম মূল্য কী হবে তা টেস্টিংয়ের পর বাজারের চাহিদার ওপর নির্ভর করে। চায়ের নয়া নিলাম পদ্ধতি 'জাপানি মডেল'। এতে নিলাম প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ক্রেতা- বিক্রেতা থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবাই অংশ নেন। কিছুটা স্টক এক্সচেঞ্জের মডিউলের ধাঁচে ওই নিলাম ব্যবস্থার বাস্তবায়ন হয়। দুটি মডেলই সর্বোচ্চ দাম প্রাপ্তি নীতির ওপর তৈরি। অন্যদিকে নয়া 'জাপানি মডেল' নিলাম পদ্ধতিতে নিলাম মূল্য সিস্টেমই ঠিক করে দেবে। শেষ পাওয়া দাম সহ আরও নানা বিষয় গণনা করে সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে দাম কত হওয়া উচিত তা বলে দেবে। কোনও নিলামের অবিক্রিত চা সেদিনই যাতে বিক্রি করা সম্ভব হয় সে কারণে মূল নিলামের পর আরও একটি পরিপূরক নিলামের ব্যবস্থা থাকবে নয়া মডেলে। আসলে ২০২৩ এর অক্টোবর থেকে নিলাম পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন এসেছে। এখন শিলিগুড়ি, কলকাতা, গুয়াহাটি, কোচিন, কুন্নুর, কোয়েম্বাটোর সহ দেশের আটটি নিলাম কেন্দ্রের মাধ্যমে চা বিক্রি হয়। উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স-তরাইয়ের চা নিলামের জন্য একমাত্র ভরসা শিলিগুড়ি। জাপানি মডেল সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হলে সবক'টি কেন্দ্রেই একযোগে তা চালু হবে। উত্তরবঙ্গের একটি জনপ্রিয় পত্রিকার সাংবাদিক তথা আমার বিশিষ্ট বন্ধু শুভজিত দত্তের লেখা থেকে বিষয়টা জানতে পেরে যোগাযোগ করেছিলাম উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন টি ম্যানেজমেন্ট সংস্থার কর্তাব্যাক্তিদের সঙ্গে। শিলিগুড়ি টি অকশন কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান প্রবীর শীলের মত ছিল এর ভালোমন্দ সমস্ত কিছু খুঁটিয়ে জানা প্রয়োজন। টেরাই ইন্ডিয়ান প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (টিপা) এর চেয়ারম্যান মহেন্দ্ৰ বনসালের মত ছিল ত্রুটিহীন ব্যবস্থা হবে কি না সেটাই আসল কথা। ডিবিআইটিএ'র সম্পাদক সঞ্জয় বাগচী জানিয়েছিলেন ‘সবকিছু নির্ভর করছে উৎপাদক ও বিপণনকারীরা উপকৃত হচ্ছে কি না তার ওপর। জেলা ক্ষুদ্র চা চাষি সমিতির সম্পাদক বিজয়গোপাল চক্রবর্তীর মত ছিল নতুন ব্যবস্থা যদি ক্ষুদ্র চাষিদের স্বার্থ সুরক্ষিত করে তবেই স্বাগত।
পরে জেনেছিলাম নতুন ‘জাপানি মডেল’ এর পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন (পিপিপি) হয়েছিল শিলিগুড়ি চা নিলাম কেন্দ্রে। পিপিপি-র পর জাপানি মডেলের মাধ্যমে একটি নকল নিলামের (মক সেশন) আয়োজন করে হাতে-কলমে সবকিছু বুঝিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতিও টি বোর্ড নিয়েছিল। টি বোর্ডের শিলিগুড়ি জোনে থেকে জেনেছিলাম ক্রেতা-বিক্রেতা, ব্রোকার প্রত্যেকের কাছ থেকে তাঁদের বক্তব্য জানার পর সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে তবেই পদ্ধতিটি চালু হবে। টি বোর্ডের শিলিগুড়ি জোনের তৎকালীন উপনির্দেশক রমেশ কুজুরের কাছ থেকে শুনেছিলাম শিলিগুড়ি নিলামকেন্দ্রে শুধু পরিমাণগত রেকর্ডই হয় না, মোটের ওপর তৈরি চায়ের দামও উৎপাদকরা ভালোই পান। শিলিগুড়ি চা নিলামকেন্দ্র কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান প্রবীর শীলের কথায় এখানকার পরিকাঠামো যথেষ্ট ভালো। রয়েছে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধা। শুধু স্থানীয়রা বা কলকাতার ক্রেতারাই নন, শিলিগুড়ি নিলামকেন্দ্রের মাধ্যমে অসম, গুজরাট, হরিয়ানা, ছত্তিশগড়ের মতো নানা রাজ্যের ক্রেতারাও চা কিনছেন। দক্ষিণ ভারতের কুন্নুর, কোয়েম্বাটুরের মতো নানা নিলাম কেন্দ্রের চেয়ে এখানে বরাবরই বেশি চা বিক্রি হয়।১৯৭৬-এ চালু হওয়ার সময় শিলিগুড়ির নিলামকেন্দ্রের মাধ্যমে চা বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩ মিলিয়ন কিলোগ্রাম। আটের দশকের মাঝামাঝি থেকে নিলামের পরিমাণ বাড়তে থাকে। ১০০ মিলিয়ন কিলোগ্রাম চা বিক্রির মাইলফলক ছোঁয়া যায় ২০১৩ সালে। শিলিগুড়ি নিলামকেন্দ্রের সর্বোচ্চ রেকর্ড ছিল ১৪২ মিলিয়ন কিলোগ্রাম যা ২০১৯ সালে বিক্রি হয়েছিল। ১৫০ মিলিয়ন কিলোগ্রাম চা বিক্রির মাইলফলকও স্পর্শ করেছে শিলিগুড়ি চা নিলামকেন্দ্র। এই নিলামকেন্দ্র চালুর প্রায় ৫০ বছরের ইতিহাসে যা ছিল সর্বোচ্চ। পাশাপাশি দামের নিরিখে ২০২৩ সালে ডুয়ার্সের চা প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছিল অসমকে। ডুয়ার্স চা-কে রপ্তানির দাবিও জোরদার করা হয়েছিল।
শিলিগুড়ি নিলামকেন্দ্রের মাধ্যমে বর্তমানে ডুয়ার্স-তরাইয়ের ২০০ বড় বাগানের সিটিসি চা বিক্রি হয়। নিলামে অংশ নেয় এমন বটলিফ ফ্যাক্টরির সংখ্যা প্রায় ১২৫টি। চা বাগান বিশেষজ্ঞ রামঅবতার শর্মা মনে করেন, বাগানগুলি খোলাবাজারের চেয়েও নিলামকেন্দ্রের মাধ্যমে চা বিক্রিতে বেশি ভরসা রাখছে। সেই কারণে সাফল্য। চা নিলামের ইতিহাসে তৈরি হয় রেকর্ড। আবার সেই রেকর্ড ভাঙে আর গড়ে। গুয়াহাটি চা নিলামকেন্দ্রে এক কিলোগ্রাম চা বিক্রি হয়েছিল ৯৯ হাজার ৯৯৯ টাকায়। এখন পর্যন্ত এটাই ভারতে উৎপাদিত চায়ের সর্বোচ্চ দাম বলে জানিয়েছিলেন টি বোর্ডের কর্তারা। ডিব্রুগড়ের মনোহরি চা বাগানের ‘মনোহরি গোল্ড টি' রেকর্ড দামে বিক্রি হয়েছিল। অসমের সংস্থা সৌরভ টি ট্রেডার্স ওই চা কিনেছিল। প্রতিক্রিয়ায় টি বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রভাতকমল বেজবরুয়া বলেছিলেন ‘পরিমাণে কম হলেও প্রায় এক লক্ষ টাকা কিলো দরে চা বিক্রি হওয়া প্রমাণ করে যে, গুণগতমান ভালো হলে চায়ের ভালো দামই পাওয়া যায়’। প্রত্যেক বাগান মালিককে তাই ভালো চা তৈরি করার অনুরোধ রেখেছিলেন তিনি। মনোহরি বাগানের মালিক রাজেন লোহিয়া জানিয়েছিলেন পাতা নয়, কুঁড়ি দিয়েই বিশেষ পদ্ধতিতে তাঁদের চা তৈরি করা হয়েছে। সেই কুঁড়ি সূর্য ওঠার আগেই তোলা হয়েছে। প্রায় চার মাস ধরে সূর্য ওঠার আগে সেগুলি অল্প অল্প করে শুকিয়ে বিশেষভাবে রাখার পর তারপর সেখান থেকে চা তৈরি করা হয়। মে, জুন মাসে সেকেন্ড ফ্লাশের সময়ই কুঁড়িগুলো তোলা হয়েছিল। রাজেনবাবু জানিয়েছিলেন ‘অসমের মাটি, জলবায়ু এবং ব্রিটিশ আমলের প্রজাতির চা গাছ বিশেষ চা তৈরিতে সহায়ক হয়েছে।' মনোহরি বাগান পরের বছর দুই কিলোগ্রাম মনোহরি গোল্ড তৈরি করার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছিল। এক কিলো নিলামে পাঠানোর জন্য এবং আর এক কিলো বাগানের বিশেষ ক্রেতাদের দেওয়ার জন্য রাখা। সৌরভ টি ট্রেডার্সের সিইও এম মাহেশ্বরী জানিয়েছিলেন যে বাগান ভালো চা বানাবে সৌরভ টি ট্রেডার্স তাদের চা-ই ভালো দামে কিনবে যেটা। তারা কলকাতা, মুম্বই ও দিল্লিতে বিক্রি করবে।
২০২৩ সালের ২১ শে জুন ছিল আন্তর্জাতিক চা দিবস। টি বোর্ডের তরফে বাগানগুলিকে বিশেষ চা তৈরির আহ্বান জানানো হয়েছিল। জেনেছিলাম তাতে দেশের ১৬১ টি বাগান সাড়া দিয়েছিল। তাদের মধ্যে উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স, তরাই ও পাহাড়ের চা বাগানও ছিল। সেই বিশেষ চা নিলামে উঠেছিল ২১ জুন। শিলিগুড়ি, কলকাতা, গুয়াহাটি সহ দেশের মোট ৬টি কেন্দ্রে ওই প্রিমিয়াম কোয়ালিটির চা নিলাম হয়েছিল। টি বোর্ডের থেকে জেনেছি্লাম ‘চায়ের গুণগতমান বাড়ানোর লক্ষ্যেই’ এমন পদক্ষেপ। শিলিগুড়ি চা নিলাম কেন্দ্র কমিটির সহ সভাপতি প্রবীর শীলের কাছ থেকে জেনেছিলাম সকাল ৮টা থেকে নিলাম পর্ব শুরু হয়। যে সমস্ত বাগান এতে অংশ নিয়েছিল তারা প্রত্যেকে ন্যূনতম ৫ ব্যাগ করে বিশেষ মানের চা তৈরি করে পাঠিয়েছিল। টি বোর্ড সূত্রে জানা গিয়েছিল এই স্পেশাল চায়ের নিলামে সিটিসি ও অর্থোডক্স দু'ধরনের চা পাঠিয়েছিল বাগানগুলি। চা মালিকদের অন্যতম সংগঠন ডিবিআইটিএ’র তৎকালীন সম্পাদক সঞ্জয় বাগচীর কাছ থেকে জেনেছিলাম ‘ডুয়ার্সে সাধারণত অর্থোডক্স চা তৈরি হয় না। তবে একটি বাগান এবার ওই ধরনের চা তৈরি করে বিশেষ নিলামে অংশ নিচ্ছে। বিষয়টি ঐতিহাসিক’। জলপাইগুড়ি জেলা ক্ষুদ্র চা চাষী সমিতির সম্পাদক বিজয়গোপাল চক্রবর্তীর কাছ থেকে জেনেছিলাম টি বোর্ডের এই উদ্যোগের ফলে ক্ষুদ্র চাষিরা উৎপাদিত কাঁচা পাতা থেকে ভালো মানের চা তৈরি করেছে এবং বটলিফ ফ্যাক্টরিগুলির একাংশও অংশ নিয়েছে যা উৎপাদনের উৎকর্ষতা বাড়াতে ভবিষ্যতের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। জেনেছিলাম ২০২০-২১ সালে ডুয়ার্সের চা এর উৎপাদন ভালো হয়েছিল এবং অসমের চা এর তুলনায় ডুয়ার্সের চা বাজারে বেশি দাম পেয়েছিল। বিদেশের বাজারে অর্থোডক্স চায়ের চাহিদা বৃদ্ধি পাবার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে অর্থোডক্স চায়ের প্রসার ঘটানোর জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছিল টি বোর্ড।
এই মুহূর্তে বিশ্ব বাজারে প্রভুত্ব করছে চারটি কর্পোরেশন। লিপটন এবং পিজিটি প্রস্তুতকারক ইউনি লিভার, টেটলি প্রস্তুতকারক টাটা টি, একটি চা ট্রেডিং কোম্পানি ভ্যান রিস এবং একটি চা প্যাকিং কোম্পানি জেমস ফিনলে। বিশ্বের মোট চায়ের বাজারের ৮৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে কয়েকটা মাত্র বহুজাতিক কোম্পানি। ফলে চা শিল্পে মার্কেটিং দক্ষতা এবং প্রভাব সহজেই অনুমান করা যায়। ভারতবর্ষের অন্যতম চা উৎপাদক এবং রপ্তানিকারক অঞ্চল আমাদের এই উত্তরবঙ্গ। বিভিন্ন মিডিয়া রিপোর্ট এবং অন্যান্য ফিল্ড এনকোয়ারি থেকে যেটা বোঝা যায় যে বর্তমানে বাগিচা শিল্পে মালিকেরা বা ম্যানেজমেন্ট বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক কারণে প্রায় প্রতি বছর নানাপ্রকার চাপের মধ্যে থাকলেও শিল্পে লোকসানের কথা শোনা যায় না বললেই চলে। ফলে এই শিল্পের ভেতরের ছবিটা দেখে আমাদের গর্বিত হওয়া উচিত ছিল। কারণ লোকসান থাকে খাতায় কলমে। কিন্তু লাভের গুড় পিঁপড়াতে খায়। অন্যান্য কৃষি পণ্যের মতই চায়ের ক্ষেত্রেও উৎপাদন পরবর্তী পর্যায়গুলিতে চায়ের মান বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দামও বাড়তে থাকে এবং সেই কারণেই এই পর্যায়গুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রসেসিংয়ের প্রতিটি পর্যায়ে যেমন ব্লেন্ডিং, প্যাকেজিং, মার্কেটিং সবকিছুতেই মূল্যযোগের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। ফলে এই ধাপগুলো অত্যন্ত লোভনীয় এবং এগুলি মূলত ক্রেতা দেশগুলির চা কোম্পানিগুলি করে থাকে। এখান থেকেই বড় কর্পোরেট মুনাফা শুরু হয়। দূরদর্শিতার অভাব, সুষ্ঠু আর্থিক এবং প্রশাসনিক পরিকল্পনার অভাবে অনেক বাগান রুগ্ন হয়ে রয়েছে সামগ্রিক অব্যবস্থার ফল স্বরূপ। ফলে কর্পোরেট দুনিয়াতে তাদের চা ভালো দাম পায় না মধ্যস্বত্ত্বভোগী এবং দালালদের যোগসাজসে। কিন্তু এদের কাউকেই প্রকৃত অর্থে রুগ্ন বলা চলে না। তার সঙ্গে প্রচারের ঘাটতি এবং সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করাও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার জন্য দায়ী।
২০২০ সালে শিলিগুড়ি চা নিলাম কেন্দ্রের সেন্টারের থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে দেখেছিলাম সেই আর্থিক বছরে দাম কমেনি, বরং বেড়েছে এবং কয়েক মাসের মধ্যে আরও বাড়ার সম্ভাবনা ছিল। যেমন ২০১৯ সালে ডুয়ার্সে চা উৎপাদন হয়েছিল ১৯৯ মিলিয়ন কেজি এবং এর মধ্যে নিলাম হয়েছিল ১৩৮ কেজি। গড়ে প্রতি কেজি সিটিসি বিক্রি হয়েছিল ১৫৩ টাকায়। ( তথ্যঃ উত্তরবঙ্গ সংবাদ, মে, ২০১৯) সিটিসি চায়ের ক্ষেত্রে উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১৩৭ মিলিয়ন কেজি এবং এর মধ্যে সিটিসি চা কেজি প্রতি ১৩৬ টাকায় বিক্রি হয়েছে। নিলাম হয়েছে মোট ১৩৪ মিলিয়ন কেজি। বটলিফের ক্ষেত্রে ডুয়ার্সের চা ১১৫ টাকা এবং তরাইয়ের চা ১১২ টাকা প্রতি কেজি হিসাবে বিক্রি হয়েছে। সমস্যা তৈরি হয় কোন বাগান জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে চা এর দাম ভালো না পেলে। এর পেছনে বহুবিধ কারণ থাকে যেগুলির সঙ্গে শ্রমিকদের সরাসরি কোন সম্পর্ক থাকে না। অথচ যেসব মানুষগুলির জীবনযাত্রা এই বাগানকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় তাদের উপর এই ঘটনাগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে এবং তখনি শুরু হয় মজুরী, বোনাস, পি এফ, গ্র্যাচুইটি নিয়ে সঙ্ঘাত। বেশ কিছু ‘বেনিয়া বেওসায়ী’ ইচ্ছাকৃতভাবে বাগান লোকসানে চলছে বলে দিনের পর দিন বাগান বন্ধ করে রাখেন। উদাহরণস্বরূপ রায়পুর, মানাবাড়ি, রামঝোরা ইত্যাদি বাগানগুলির উল্লেখ করা যায়। কয়েকবছর অবহেলা এবং অনিয়ম চালানোর পরে মালিকদের স্বচ্ছন্দে লুটপাট চালিয়ে নিরাপদে পালিয়ে যেতে দেওয়া হচ্ছে সেটাও দেখা যায়। এই পরিস্থিতি সাম্প্রতিককালে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। চা বাগানে অপুষ্টি, দারিদ্র্য, এবং মৃত্যুর ভয়াবহ ঘটনাগুলিকে বন্ধ করা এবং শ্রমিকদের তাদের দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবন থেকে বের করে আনার একমাত্র রাস্তা হল চা শিল্পকে তাদের পরিচালন পদ্ধতিতে মৌলিক পরিবর্তন এনে বাগানগুলি যাতে সক্রিয় থাকে এবং সুষ্ঠুভাবে চলে তার ব্যবস্থা করা।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴