রসবালা চা হাতে নিয়ে অন্যমনস্কভাবে বলে,
"বাচ্চাতে একবার হুদুমা পূজার কাথা শুনিসুং। মাওঘর পূজিসে। হামাক যাবারে নাই দেয়। কত আতি পূজিসে, হামরা নিন্দোত পড়ি, বোদে পাই নাই। তাও কাপড়া টাপড়া খুলি হোটে ক্যাংকরি পূজিবে বারে।"
"ঘুল্টুঙের মাক দেখিস এলায়। আন্দারোত ক্যামোতোন নাচিবে আর আটিয়া কোলার গছটাক কী এখেরে চুম্মা খাবে।"
ভেলুর মার কথায় সায় দিয়ে সুন্দরমণিও বলে,
"সচায় না। উয়ায় এখেরে একসারি হাউসালি বারে! নাচির ধোইল্লে থামেকে না এক কাথায়।"
আলোচনার মধ্যেই বানেশ্বরী এসে ঢুকল ওদের মাঝখানে। মুখটাকে হাসি হাসি করে কৌতুকমাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
"ওউর মাইয়ালা। তোমরা বোলে হুদুমা খেলাবেন? তে মোকো নেন।"
ভেলুর মাও হেসে বলে,
"দাঁতলা যে গোটায় বাকরাছিত। নাচির পাবো?"
এসব হাসি মস্করাকে পাত্তা না দিয়ে বসমতী বলে ওঠে,
"ন্যাও। সোগাকে জোটো কর। এইবার দিনটাও ভাল আছে। তাক করি আমাবোইস্যা পোইচ্চে শনিবার। এই শনিবারে।"
কথা যখন ঠিক হয়েই গেল তখন সবাই নিজেদের মতো ছড়িয়ে পড়ল সবাইকে জানাতে। এখানে গুজগুজ, ওখানে ফিসফিস। প্রকাশ্যে আলোচনা কিছু নয়। যদিও নিজের নিজের স্ত্রীদের কাছে পাড়ার প্রায় সব পুরুষই জেনে গেল। যদিও নিয়ম অনুযায়ী এই পূজায় পুরুষের প্রবেশ শুধু নিষিদ্ধ নয়, কোনোভাবে দেখাটাও নিষিদ্ধ। সেজন্য সব পুরুষরা ওইদিন বাড়িতেই থাকে।
র্নিদ্দিষ্ট দিনে ধু ধু মাঠের মধ্যে পূজার আয়োজন চলল। সাতটি পাতাওয়ালা একটি বীচিকলার গাছ জোগাড় করা হয়েছে। মাটিতে স্ত্রী অঙ্গটি এঁকে তার মাঝখানে কলার গাছটি পুঁতে দেওয়া হল। প্রত্যেকেই বস্ত্রবিহীন। বাঁচোয়া এই যে ঘোর অমাবস্যা বলে অন্ধকারে কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। হুদুমা পূজার নিয়মই হল অন্ধকারে পুজো করতে হবে।
সুন্দরমণি বলে,
"আটিয়া কোলার ঢোনা ঢুনিগিলা কোটে থুলেন? কোলা-কোদলিগিলা আনো এত্তি।"
পূজার জোগাড়ে ব্যস্ত সবাইই বয়স্ক। কারো শরীরে কোনো পোশাক নেই। বয়স্ক এবং সধবারাই হুদুমা পূজা করে। পূজার জোগাড় করতে করতেই সমস্বরে গান ধরে,
"দেহার কাপড় ফ্যালেয়া দিয়া
হুদুমোক আগোত ন্যাও বরিয়া
ডিং শাল শাল হুদুম দ্যাও
জোই জোগাড়ে বরিয়া ন্যাও।"
রসবালা আবছা আবছা সবাইকে দেখছে আর লজ্জায় ফিকফিক করে হাসছে। অন্ধকারেও ওর হাসি বুঝতে পেরে বসমতী ধমক দেয়, গম্ভীর গলায় বলে,
"ঠাকুরের নায় আচ্চি কোইনা মাই। অংকরি হাসা না যায়।"
আর একটু গম্ভীর হয়ে বলে,
"হামাক এলা কাহো বাঁচাবে তে হুদুমা ঠাকুরে বাঁচাবে। কাহো কাহো পূজা কোইত্তে না কোইত্তে জল আইসে। হামরাও দ্যাওয়াটাক ড্যাকে আনিমু।"
পুরানকালের কোন এক অজানা ঈশ্বরকে স্মরণ করে প্রায় পনেরোজনের মতো মহিলা হুদুমার গান আর নাচে মগ্ন হয়ে যায়। নাচ প্রত্যেকেরই যেন সহজাতভাবেই দখলে রয়েছে। স্ত্রী জননাঙ্গের ছবিটি আসলে মাতা বসুমতীর প্রতীক। তাঁর সন্তান হুদুমা হল আটিয়া কলার গাছটি। এই দুই মিলে একত্রে আসলে সৃষ্টির প্রতীক। হুদুমা দেবকে গান আর কামোদ্দীপক অঙ্গভঙ্গির নৃত্য দ্বারা সন্তুষ্ট করে তাঁর কাছে বৃষ্টির বর চাওয়া হয়। ফসলের বর চাওয়া হয়। আষাঢ় মাস ধানের বীজ বা চারা রোপনের সময়। এ সময় বৃষ্টি না হলে খরা অনিবার্য। বৃষ্টি আনার ব্রত নিয়ে বদ্ধ পরিকর দরিদ্র কৃষক রমনিগণ কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমুল নাচ আর গানে মত্ত হয়ে ওঠে। নৃত্যকালে কলার গাছটাকে প্রিয়তম ভেবে চুম্বন করতে থাকে। জড়িয়ে ধরে নাচতে থাকে। যেন বাইরের সমস্ত পৃথিবীকে ভুলে সবাই একাত্ম হয়েছে এই শূন্য প্রান্তরে। দয়িতের মতো কলাগাছটিকে একান্তভাবে আদরে চুম্বনে ভরিয়ে তুলছে। মারেয়া আজকে ঘুল্টুঙের মা। একটা গান শেষ হচ্ছে, পরক্ষণেই অন্য গান শুরু হচ্ছে। মাঝে কোনো বিরাম নেই। যেন ভূতগ্রস্তের মতো সবাই তালে তালে নেচে চলেছে।
"হিলহিলাছে কমোরটা মোর
শিলশিলাছে গাও
কুন পাথারোত গেইলে মুই
হুদুমের দেখা পাও
খসিয়া পড়িল পাটানিখান মোর
উদুলা হোইলেক গাও
কুন পাথারোত গেইলে মুই
হুদুমের দেখা পাও
পাথারোত বসিয়া আছোং
আয় রে হুদুম আয়
তোর দেখা পাইলে মোর
দেহাটা জুড়ায়।"
কতক্ষণ এই মাতালের মতো নাচ আর গান চলত কে জানে। কিন্তু এর মধ্যেই মেঘ ডাকার আওয়াজে সবাই চমকে ওঠে। ক্ষণিকের বিহ্বলতা। মুহূর্তে সবাই যেন দ্বিগুন আনন্দে নাচের মধ্যে নিজেদের সঁপে দেয়। গায়ে চড়চড় করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে থাকে। আনন্দ আর প্রবল আবেগে সে বৃষ্টি গায়ে মাখতে মাখতে সবাই যেন পাগল হয়ে ওঠে। কাকতালীয়ই হোক অথবা পূজার জন্যই হোক প্রবল বেগে বৃষ্টি নেমে তৃষিত ধরিত্রীকে ভিজিয়ে দিতে থাকে। টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিতে মাঠ-ঘাট নদী-নালা ভরে ওঠে। প্রকৃতিও যেন নবযৌবন বর লাভ করে হুদুম দ্যাওয়ের কাছে।
................................................................
একসারি - প্রবল অর্থে বোঝায়
অংকরি - ওরকম করে