সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
16-December,2022 - Friday ✍️ By- নীলাঞ্জন মিস্ত্রী 4.28K

তিস্তাবাথান-১৫

তিস্তা বাথান/পর্ব-১৫
নীলাঞ্জন মিস্ত্রী
^^^^^^^^^^^^^^^^^^

প্রধানত যুবকদেরই মৈষালের ভূমিকায় দেখা যেত সেদিন। তাঁদের শরীরের গঠন ছিল সুঠাম, বলিষ্ঠ ও আকর্ষণীয়। গান বাজনায় তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত পারদর্শী। নদীর চরে মহিষ ছেড়ে দিয়ে তারা মশগুল হত দোতরার ডাঙে, বাঁশির সুরে। দোতরায় ঠোকর মেরে  উদাত্ত কন্ঠে গাইত তাঁদের হৃদয় নিংড়ানো গান। তাঁদের এই গানকেই আমরা মৈষালি গান বলে থাকি। মৈষালি গানকে অনেকে ভাওয়াইয়ার সাথে গুলিয়ে ফেলেন - কারণ ভাওয়াইয়াতে মৈষাল বা মহিষরক্ষক এবং রাখাল নিয়ে গানের সংখ্যা অনেক বেশি। আসলে মৈষালি হল ভাওয়াইয়া সংগীতের অন্যান্য সুরের মধ্যে একটি সুরমাত্র। ভাওয়া কথাটির বাস্তবিক অর্থ মহিষের চারণভূমি। অনেক গবেষক এটাও বলেছেন এই ভাওয়া থেকেই ভাওয়াইয়া শব্দটির জন্ম হয়েছে। সে যাই হোক না কেন মৈষাল বন্ধুর বাঁশির সুর, দোতরার ডাং আর তাদের উদাত্ত কন্ঠের গান সেসময় মন বিদীর্ণ করে তুলত স্থানীয় গৃহবধূ, বাল্যবধূ, যুবতী মেয়ে বা বাল্য বিধবাদের। তাঁরা প্রেমে পড়ে যেতেন, মায়ায় জড়িয়ে পড়তেন মৈষাল বন্ধুদের সাথে। কিন্তু এই প্রেম ছিল ক্ষণস্থায়ী। কারণ বর্ষা শুরু হবার আগেই যে তাঁদের বাথান নিয়ে চলে যেতে হবে মালিকের বাড়ি বা ভাটির দেশে। এখান থেকেই জন্ম নিত বিরহের। মৈষালি গান প্রধানত বিরহের বা পরকীয়া সম্পর্কের গান। কিছু গানে আপেক্ষিক ভাবে অশ্লীলতাও রয়েছে। মৈষালি গানগুলিতে যেমন মৈষাল বন্ধু্রা নিজেদের ভাব ব্যক্ত করেছেন তেমনি তিস্তাপারের মহিলা-যুবতিরাও ভাওয়াইয়ার সুরে (মৈষালি) তাদের মনের ব্যথা-বেদনা-বিরহ-চাওয়া-না পাওয়াগুলি, অপূর্ব শব্দচয়নের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। এই গানগুলি আজও বহুল প্রচলিত। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বর্তমান সময়ের মৈষালি গানের শব্দে, উচ্চারণ ও গায়কীতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ দু-একটি পুরনো গান তুলে ধরা হল।

'ওদিয়া ওদিয়া জানরে মৈষাল
মৈষাল যানরে দোতরা বাজেয়া
কোনবা কথায় হইছেন গোসা
না দেখেন ফিরিয়া মৈষাল রে'।

অথবা

'আজি বাথান বাথান করেন মৈষাল রে
আরে ও মৈষাল বাথান করেন ওরে বাড়ি।
ঘরে থুইয়া যুবতি নারী
কায়বা করে চাকুরী মৈষাল রে'।

আবার নায়েব আলি(টেপু) রচিত...

'ওরে ভইষের যেদিন অধিবাস
ওরে ধনীর মাইয়ার আউলাইল ক্যাশ রে।
ওরে ধনীর মাইয়া চিমসা কাটি
ওরে বাতান পূজাত নাই দেয় বাতি রে'।

১৯৬৮ সালে তিস্তার ভয়াবহ বন্যার কথা আমরা সকলেই জানি। সে সময়ে বহু বাথান মহিষ সহ বিলুপ্ত হয়ে যায়। বহু গ্রামের ভেতর তিস্তা ঢুকে গিয়ে গতিপথ পরিবর্তন করে নেয়। এছাড়াও ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পর পূর্ববঙ্গের বহু মানুষ কেউ সরকারি পুনর্বাসন পেয়ে আবার কেউ সরাসরি তিস্তাচরে এসে ঘর বাঁধেন। তিস্তার অববাহিকা জুড়ে ফসলের চাষ শুরু করেন। বর্তমানে শুধুমাত্র তিস্তার গতিপথটুকু বাদ দিয়ে পুরো অববাহিকা জুড়ে ফসলের চাষ করা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই তিস্তাবক্ষের সেদিনের সেই মধুয়া, ঝাপসী, কাশিয়া বা হোগলার বন আর নেই। দেখা মেলে না মহিষের প্রিয় খাদ্য টুটুয়া বা ক্যান্যা ঘাসের। যেটুকু হোগলা বা কাশিয়া জন্মে সেটাও আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে বা ট্রাক্টর চালিয়ে উৎখাত করে জমি তৈরি হচ্ছে।  তাই তো সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে গেছে মহিষের চারণভূমি বা ভাওয়া। 
যে কজন মৈষাল এখনো পর্যন্ত টিকে রয়েছেন তাঁদের কথা না বললেই নয়। গাধার মতো খাটতে হয় তাঁদের সকাল থেকে রাত। দিন, বার, সময় ভুলে যান তারা। ঘরে বসে শান্তিতে দু'মুঠো ভাত খেতে পারেন না। এমনকি প্রকৃতির ডাকেও ঠিক ভাবে সাড়া দিতে পারেন না। কারণ একটু চক্ষুর আড়াল হলেই মহিষেরা ঢুকে যাবে ফসলের ক্ষেতে। আর একটি কথা না বললেই নয় - বাথান কোন  নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি নয়। বাথান সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে রয়েছে স্থানীয় রাজবংশী সমাজ, মুসলিম সমাজ, রাজবংশী মুসলিম সমাজ, হিন্দু মুসলিম সমাজ, আদিবাসী সমাজ, নেপালি সমাজ, মেচ সমাজ এবং স্বাধীনতার পরবর্তিকালে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত মানুষেরাও। বাথানের পুরনো মালিকেরা গত হয়েছেন। মহিষেরা দিনে দিনে দুর্বল হচ্ছে। শরীর হয়েছে রুগ্ন। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হাঁটা মহিষেরা থমকে যাচ্ছে একটু হেঁটেই। তাদের পেট ভরার মতো ঘাসটুকুও নেই বর্তমান তিস্তা বক্ষে । প্রয়োজনীয় জলটুকু ছাড়া আর যে কিছুই মেলে না এখন তিস্তাচরে। তাইতো একের পর এক বাথান উঠে গেছে তিস্তাচর থেকে। যে পাঁচটি টিকে রয়েছে বাথান মালিকেরা তা বেচে দেবেন বলে মনস্থির করে ফেলেছেন। হয়তো বড়জোর আর দু' একটি বছর। তারপর তিস্তাবক্ষ থেকে পুরোপুরিভাবে বিলুপ্ত হবে কয়েকশো বছরের পুরানো এই বাথান সংস্কৃতি। 
সবশেষে সবার জন্য দুটি অপরিচিত মৈষালি লাইন। 

'দাদারে দাদা মৈষালের বড় দুখ।
ভিজা গামছা মাথাত দিয়া ভইষের ছেকায় দুধ'।।

তিস্তা বাথান পর্বের আজ ইতি টানলাম। বহু কথা বলা বাকি থেকে গেল। পূর্বের প্রতিটি পর্বে আপনারা  যেভাবে গঠনাত্মক ও অনুপ্রেরণামূলক মন্তব্যের মাধ্যমে উৎসাহিত করে গেছেন তা ঝুলিতে পুরে সযত্নে রেখে দিয়েছি। তিস্তা ও তিস্তাকেন্দ্রিক জীবন নিয়ে লেখালেখি কম হয়নি। যা হাতের কাছে পেয়েছি তার সবটাই নিজের কাছে সংগ্রহে রেখেছি। তিস্তার ভূগোলের ইতিহাস থেকে ভবিষ্যতের কথা জানবার ও বোঝবার চেষ্টা করেছি। এই জানা ও বোঝবার জন্য কয়েক বছর ধরে তিস্তার উৎস থেকে বেলতলীর ঘাট পর্যন্ত তিস্তার দু'পার, তিস্তার প্রতিটি চর ও মধ্যতিস্তা ঘুরে বেড়িয়েছি। যা লিখেছি ভেবে লিখিনি। বিষয়ের কাছে সশরীরে পৌঁছে লিখেছি। অক্ষর বিন্যাসকে ধোঁয়াশার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা থেকে বিরত থেকেছি। তিস্তা সংক্রান্ত সমস্ত বই সংগ্রহে থাকলেও দু-একটি তথ্যভিত্তিক বই ছাড়া পাঠ স্থগিত রেখেছি। কারণ আমি নিজের চোখেই তিস্তাকে জানবার চেষ্টা করেছি। পুরো ক্ষেত্রসমীক্ষা থেকেই উঠে এসেছে এই বাথান কথা - যার সিকি ভাগ তোলা থাকল ভালোবাসার এই সহজ উঠোনে। 'সহজ উঠোন' ও তার সমস্ত গুণমুগ্ধ পাঠকের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ হয়ে রইলাম।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri