ঘোমটা/শুক্লা রায়
ঘোমটা
শুক্লা রায়
পুজোর ছুটি চলছে। আমরা তিনজন সাইকেল ঠেলে ঠেলে এগোচ্ছি। তিনজন বলতে আমরা তিনটি মেয়ে। আমি, বিনতা আর কল্পনা। আমার নিজের নতুন সাইকেল। খয়েরি রঙের হিরো কম্পানির লেডিজ সাইকেল। রোদ ঠিকরে চকচক করছে। এই সাইকেলে উঠলে আত্মবিশ্বাসেরও লেভেল আপ হয়। বিনতা কল্পনাকে পেছনে বসিয়ে নীল রঙের একটা এভন সাইকেল চালাচ্ছে। বর্ষায় চাকার দাগ বসে গিয়ে সরু সরু দাগে শতধা বিভক্ত পথ। খুব সাবধানে চালাতে হচ্ছে। একেতে শুকনো খটখটে মাটি তার উপর এতভাবে কাদা বসে গিয়ে এবড়ো খেবড়ো হয়ে যাওয়া পথ। ওরা একজন হাঁফিয়ে গেলে অন্যজন চালাচ্ছে। যাচ্ছি এক বান্ধবীর শ্বশুর বাড়ি। খুব করে যেতে বলেছিল বিয়ের সময়। তারপর দেড় বছর পেরিয়ে গেছে আমরা আর যেতে পারিনি। আসলে যাওয়া হয়নি। আগের বার সিক্সে পড়তাম। এখন সেভেনে পড়ি। একটু বড় হয়েছি বলেই একা বের হওয়ার অনুমতিটুকু পাওয়া গেছে। তাও রাতে থাকার পারমিশন নেই। আসার আগে মায়ের কাছে একটা খাতায় বান্ধবীর বাড়ির ঠিকানাসহ প্রায় চোদ্দ গুষ্টির নাম তালিকা লিখে দিয়ে আসতে হয়েছে। বিকাল পাঁচটার মধ্যে বাড়ি না ফিরলে অনুসন্ধান কমিটি গঠন হবে, মানে বাবা আর ঠাকুর্দা মিলে খুঁজতে বেরোবে -এসব হুমকি মাথায় নিয়েও বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে চলেছি।
রাস্তায় সাইকেল চালাতে চালাতে আমরা মহা উৎসাহে পুরনো কথা আলোচনা করছি। বান্ধবীর নাম ধনলক্ষ্মী। আমরা মজা করে বলতাম তোর এই নিম কে রেখেছে রে? সেও হাসত। বলত কর্তা মা। ফাইভে থাকতেই শেষের দিকে ধনলক্ষ্মীর বিয়ে হয়ে গেল। শেষদিন স্কুলে এসেছিল আমাদের নিমন্ত্রণ করতে। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর খুশি খুশি দেখালেও স্কুলের শেষদিন চোখ ছলছল করে বলেছিল, তোরা যাবি কিন্তু। আমি কিন্তু খুঁজব তোদের। রাতে বিয়ে খাওয়ার বাড়ির অনুমতি মেলেনি। যাওয়াও হয়নি। কিন্তু ওর কথা আমরা ভুলিনি। অবসরে তিনটে মাথা এক হলেই ওর কথা আলোচনা করি। ও কীভাবে হেসে হেসে দেখাত শাশুড়ি কিছু বললে কেমন করে ঘোমটার আড়ালে ভেংচি কাটবে। আমরা হেসে গড়িয়ে পড়তাম। আবার কখনো বলত, 'হুঃ, আমি ঘোমটা দেবই না। ঘোমটা দিতে দিতে মাথার সব চুল নাকি উঠে যায়। আমার কাকির মাথায় এখন এক্কেরে অল্প চুল। আমাকে কেউ ঘোমটা দেওয়াতে পারবে না। হি হি হি।'
আমরা খুব চিন্তিত হতাম। বকবে না? ও হাসত। কে বকবে? ওখানে আমার বর আছে না? বর তো বৌকে বকতেই দেবে না। হু। তাই তো। আমারও খুব বিয়ে করতে ইচ্ছে করেছিল। কিন্তু আমার বাড়িতে আমার বিয়ে নিয়ে কোনো চিন্তাই নেই। খালি ভয় দেখায়, শাশুড়ি ধরে মারবে। তবে ধনলক্ষ্মী যতদিন স্কুলে ছিল এ গাছ ও গাছ থেকে পেয়ারা, আমের সময় কাঁচা আম, বড়ই, আমলকি -কোনো কিছুর অভাব ছিল না আমাদের। ওর কোঁচড়ে কিছু না কিছু থাকতই। ক্লাশঘরের দরজার কপাটের ফাঁকে ঢুকিয়ে চাপ দিয়ে ভেঙে সেসব ছোট ছোট টুকরো করে ভাগ হত। ইস ভাবলেই জিভে জল।
পুজোর শেষ। তবু প্রকৃতির মধ্যে একটা মা মা গন্ধ ছড়ানো। আমাদের পায়ের চাপে প্যাডেল ঘুরছে আর ধাতব আওয়াজ উঠছে। সব ছাপিয়ে আমাদের কন্ঠস্বর। আশেপাশের অনেকেই অবাক হয়ে তাকিয়ে।
প্রায় ভরদুপুরে আমরা একে তাকে জিজ্ঞেস করে একটা বাড়িতে ঢুকলাম। বিশাল উঠোন। ঝাঁটা হাতে ঝড়াৎ ঝড়াৎ করে ঝাঁট দিচ্ছে একটা বৌ। পরনে আধময়লা শাড়ি। আর কিছু বোঝার উপায় নেই। ঘোমটায় ঢাকা পুরো মাথাটা। মুখ দেখার উপায় নেই। আমাদের দেখে একজন লোক উঠে এল। উঠোনের একপাশে কিছু কাজ করছিল। ঝোঁকের মাথায় এসে তো পড়েছি। তিনজনেই লজ্জায় জড়সড়। কোনোরকমে ধনলক্ষ্মীর কথা বলতেই লোকটা ঝাঁটা হাতে বৌটাকে ডাকল। সেও এতক্ষণ ঝাঁটা হাতে করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছিল। কাছে যেতেই আমরা অবাক। আমাদের ধনলক্ষ্মী। ওর শাশুড়ি বেরিয়ে এসে ধনলক্ষ্মীকে বলল আমাদের ঘরে বসাতে। ছোট্ট ঘরটা নানান সিনেমার ছবিতে ভরা। আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। ধনলক্ষ্মী বলল একটু বস ঝাড়ুটা রেখে হাত মুখ ধুয়ে আসি। ও বেরিয়ে যেতেই আমাদের কেমন অচেনা অচেনা লাগল সব। আমাদের ধনলক্ষ্মী নেই। এই ধনলক্ষ্মী একদম আলাদা মানুষ যেন। ছেলে কোলে ফিরে আসতেই বিনতা এক টান দিয়ে ওর মাথার ঘোমটা খসিয়ে ফেলল। চেহারা দেখে আমরা হতবাক। কন্ঠার হাড় ঠেলে উঠেছে। কোটরে বসা চোখ। মাথাভর্তি চুলের সিকিভাগও নেই। শুধু চোখের হাসিটা এখনও আগের মতোই কৌতুকপূর্ণ।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴