চা-ডুবুরী-৩৫/সুকান্ত নাহা
চা-ডুবুরি/পর্ব : ৩৫
সুকান্ত নাহা
^^^^^^^^^^^^^^^
"বৃষ্টি তো ছুঁতেই হয় বৃষ্টি ছাড়া শিল্প পরাধীন
যেমন নারীর কাছে পরাধীন
আমাদের বৃষ্টিধোওয়া
বীজবন্ত ধান"- শিশির রায়নাথ
****************************************
ডুয়ার্সে বর্ষা এলেই দু'চোখ ঢেকে যায় সবুজ বিজ্ঞাপনে। চৌদিকে উপচে পড়া সবুজ, ভালবেসে দু'হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নিতে চেয়ে যেন বলতে চায়, 'এসো মাথা রাখো এই মখমলি চায়ের চাদরে। কান পাতো অরণ্যের নিবিড় ঘন চুলে। পাহাড়ি নদীর পার ঘেঁষে জেগে ওঠা নরম ঘাসে, উপত্যকার সবুজ বিভাজিকায় চোখ রেখে রোমাঞ্চিত হও।'
বর্ষায় চা গাছের আড়ালে আবডালে সর্পিল নালাগুলোয় শব্দহীন বয়ে চলে কাঁচ-স্বচ্ছ জল। সহসা মুষলধারায় মুহুর্তে জলের রঙ বদলে হয় গেরুয়া খরস্রোতা। স্বচ্ছ হতেই চোখে পড়ে ভেসে যাওয়া অজস্র কুচো মাছের ঝাঁক। ঝোরার গায়ে স্রোতের টানে নুয়ে থাকা জংলা আগাছার নিচে বালির ভেতর লাল চিংড়িদের ঘরসংসার। সেখানে শ্যাওলাসবুজ পাথরের নিচে আত্মগোপন করে থাকে ভীত কাঁকড়ারা। অন্ধকার নামতেই যারা নিঃসাড়ে বেরিয়ে আসে পাথরের নীচ থেকে। আর ঠিক তখনই কোনও এক সন্ধের চাঁদ খসে পড়া জলে, তারা ঝিলমিল রাতে, কিংবা ঝিরঝিরে বর্ষার নিকষ কালো অন্ধকারে ইতিউতি টর্চের আলোয় ওরা বেঘোরে ধরা পড়ে যায়। কালচে বাদামী দাঁড়াগুলো চেপে ধরে কালো কালো শক্ত আঙুলের থাবা। তারপর চালান করে দেয় টপাটপ বালতির ভেতর।
-"আপনি খাঁকড়া খাইবেন বাবু... খাইলে বলবেন....আইনে দিব। কাইল সাঁইঞ্ঝ ঘড়ি বহুত ধরলম। খাঁকড়া খাইলে শরীলে তাক্কত মিলে বহুত..." ভুটকু মেঝেতে উবু হয়ে বসে সত্যপ্রিয়কে বর্ষারাতে কাঁকড়া ধরার গল্প শোনায়। ওর কাঁকড়ার গল্পের সাথে জুড়ে যায় জলঢোঁড়া আর ঠেঙ্গি (জোঁক)র প্রসঙ্গ। কাঁকড়া পোড়ানোর রেসিপির সাথে মিশে যায় জ্বলতে না চাওয়া ভেজা কাঠ আর জল চোঁয়ানো ফুটো চালা। কর্তৃপক্ষের সেই চালা সারিয়ে না দেয়ার চিরন্তন ক্ষোভ। জলযন্ত্রণা কিভাবে বর্ষারাতে ওদের ক্লান্ত শরীর জুড়ে নেমে আসা ঘুম কেড়ে নিয়ে বিপর্যস্ত করে তোলে , আসে সেই দুঃসহ রাতযাপনের কথাও।
-" আপনি খুখরি খান, বাবু? খুখরি...। উ-যে বরসাতে ভুড়ু(উইঢিবি) উপ্রে জোয়ায়(গজায়) ,খুটিমারি ফরাসে(ফরেস্টে) ভি বহুজ্জোর মিলে...ফরাস দিকে গিলে আইনে দিব...খুখরি মে বহুত ভিটামিন আসে বাবু... খাইলে শরীলের দুখ-দর্দ, বিমার সোব ভাইগে যাবে...'"
সত্যপ্রিয় বেশ জানেন ভুটকু খুখরি অর্থাৎ মাশরুমের কথা বলছে। বলছে তো বলেই চলেছে। একবার বকবক শুরু করলে আর থামতে পারে না। এক এক দিন এক একটা বিষয় ওর মাথায় ঢোকে। আজ যেমন ঢুকেছে সত্যপ্রিয়র স্বাস্থ্য। ওর ধারনা সত্যপ্রিয়র শরীরটা ভেঙে পড়ছে দিন দিন। একটু ভিটামিন-টিটামিন খাওয়া দরকার। শক্তি বাড়ানো প্রয়োজন।
-" ....ঘরে মুরগি পালছি বাবু। আপনাকে চেঙনা(মুরগির বাচ্চা) আইনে দিব । মাঈজিকে বলব চেঙনা-ঝোল বানায় দিতে। চেঙনার ঝোলটা খাইলে ভি তাক্কত হয় বহুত..."
" তুই বরং এক কাপ চা করে আনতো রে ভুটকু। আর শোন্, আজ শরীরটা একটু ম্যাজম্যাজ করছে। চান করব না। তুই চা দিয়ে বাড়ি চলে যাস। বৌমা অফিস থেকে ফিরে খাবার বেড়ে দেবে, কেমন ।"
আসলে একটা ছুতো দেখিয়ে ভুটকুকে সরানোই উদ্দেশ্য ছিল সত্যপ্রিয়র। এক একদিন কথা বলে কানের পোকা নাড়িয়ে দেয় ছেলেটা। কথা বলার মানুষ পেলে যদিও বা ভাল লাগে এমন নিরন্তর কথকও আবার অসহ্য হয়ে ওঠে কখনও সখনও।
আজ কথা বলতে বা শুনতে কোনোটাই ইচ্ছে করছিল না সত্যপ্রিয়র। কাল রাত থেকে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি হয়ে চলেছে ডুয়ার্সে। রেডিওতে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে জানাচ্ছে আগামী আটচল্লিশ ঘন্টায় কুচবিহার, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার জেলাসহ, সিকিম ও হিমালয় সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গে প্রবল বৃষ্টিপাত হবে। গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়েছে কোথাও। অভ্যেসমতো ভোর পাঁচটা নাগাদ ঘুমটা যখন ভেঙেছিল বৃষ্টি যদিও ছিল না তখন। দম নিতে সাময়িক বিরতি নিচ্ছিল বোধহয়। বিছানা ছেড়ে সন্তর্পণে উঠে ভেতরের বারান্দার দিকের দরজাটা খুলতেই ইতস্তত জল দাঁড়ানো উঠোনটা অস্পষ্ট চোখে পড়ে। সত্যপ্রিয় অনুমান করেন ভোরের আলোটা আজ অন্যদিনের চেয়ে ম্রিয়মান। আঁধার ঘনানো মনখারাপি আলো জানান দিচ্ছে আকাশজুড়ে থমকে আছে স্তরীভূত ঝুলকালো মেঘ। হয়তো প্রস্তুতি নিচ্ছে তুমুল তোড়ে ভেঙে পড়ার। এমনটা ইদানিং আকছার ঘটছে। মেঘভাঙা বৃষ্টি, যাকে বলে ক্লাউড-ব্লাস্ট , এ জিনিসটা ডুয়ার্স অঞ্চলে আগে শোনা যেত না। এখন হামেশাই হচ্ছে। মেঘ ভেঙে একটা নির্দিষ্ট জায়গা জুড়ে প্রবলবেগে বৃষ্টি ঝরে পড়ে ভাসিয়ে দেয় রাস্তা, নালা, ঝোরা। ধস নামে চা-ভূমির প্রান্তভাগের মাটিতেও। ফুঁসে ওঠা পাহাড়ি নদীগুলো হরপা বানে ভাসিয়ে নিয়ে যায় ভাটির দিকের তীরবর্তি বস্তি, জনপদ, আবাদি জমিগুলো। কয়েক বছর ধরে বজ্রপাতের বহরটাও ভীষণ বেড়ে গেছে। আগেও যদিও বাজ পড়ত ডুয়ার্সে। কিন্তু এমন মুহুর্মুহু পিলেচমকানো বাজ পড়তে কস্মিনকালেও দেখেননি সত্যপ্রিয়। এসবই বিশ্ব উষ্ণায়নের ফল। পৃথিবীজুড়ে ব্যপক আবহাওয়া পরিবর্তন ঘটে চলেছে। গতরাতেই তো একজন রেডিওতে এই বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ায় কারণ সম্পর্কে খুব সুন্দর ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন।
বর্ষার দিনরাত্রি গুলো যেন কাটতেই চায় না সত্যপ্রিয়র। ঘরবন্দি মনে নানান স্মৃতি মেঘের মতো ঘনিয়ে আসে। এমনই একটানা ঘনঘোর বর্ষায় কাপড় না শুকোলে মালিকে দিয়ে সুনয়নী ভেজা কাপড়গুলো পাঠিয়ে দিতেন ফ্যাক্টরির হিটাররুমে। সেসময় বাসা লাইনের অনেক মাঈজিরাই এমন করতেন। হিটাররুমে টাঙানো মোটা জি. আই তারে কাপড় মেলে দিয়ে মালিরা বসে থাকত। শুকিয়ে গেলেই আবার সেগুলো নিয়ে আসত বেতের বাস্কেটে করে। বর্ষার মরশুম জুড়ে ফ্যাক্টরিতে পাতার ঢল। ভেজা কাঁচা পাতার শুকানোর বিশাল বিশাল হাওদার নিচে ক্রমাগত ঘুরে চলেছে দৈত্যাকার হট- এয়ার ফ্যানগুলো। ড্রায়ারের টেম্পারেচার লক্ষ্য রাখতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। হিটার রুমের "তাওওয়ালা"রা একটু পরপর বেলচা করে কয়লা ঢেলে যাচ্ছে স্টোকারে। এমনই এক বর্ষামুখর রাতে ডিউটি চলাকালীন হিটার রুমে ঢুকে একজন আদিবাসী শ্রমিকের কীর্তি দেখে বেশ অবাক হয়েছিলেন সত্যপ্রিয়। মাঝবয়সি ছেলেটা বেলচায় করে কিছু একটা নিয়ে স্টোকারের ভেতর ঢুকিয়ে রেখে দিচ্ছিল কিছুক্ষণ। খানিক বাদেই সেটা আবার তুলে এনে ঢেলে দিচ্ছিল মেঝেতে রাখা খবরের কাগজের ওপর।
কৌতূহলী হয়ে কাছে গিয়ে সত্যপ্রিয় জিজ্ঞেস করেন, " এগুলো কী রে?"
ছেলেটা প্রথমে একটু থতমত খায়। তারপর হেসে ফেলে চুপ করে থাকে। সত্যপ্রিয় ঝুঁকে ভাল করে লক্ষ্য করে দেখেন বেশ কয়েকটি ঝলসানো উচ্চিংড়ে। রাত বাড়লে আশপাশের ঝোপঝাড় থেকে উচ্চিংড়ে এসে ঢুকে পড়ত রুমের ভেতর। আর তখনই ওগুলো ধরে ফেলত ওরা। মৌমাছির বাচ্চা, বোলতার ডিম, এগুলো ওদের কাছে সুখাদ্য। কিন্তু উচ্চিংড়ে ঝলসে খেতে কখনও ওদের দেখেননি সত্যপ্রিয়। পাশেই রাখা নুন আর লংকা। আরেকজন হিটাররুমের এক কোণে কাঠ জ্বালিয়ে অ্যালুমিনিয়ামের গ্লাসে চা ঢালার আয়োজন করছে। বর্ষারাতে চা সহযোগে উচ্চিংড়ে ভাজা খাওয়ার আনন্দঘন মুহুর্তে সত্যপ্রিয়র আচমকা উপস্থিতি ওদের বিব্রত করে। ব্যাপারটা আঁচ করে সত্যপ্রিয় সরে আসেন। মানুষে মানুষে খাদ্যাভ্যাসের কি বিচিত্র তারতম্য। কেউ যা অখাদ্য ভাবে অন্যেরা সেটাকেই সোনামুখ করে মুখে তুলে নেয়।
ভাবতে ভাবতে ফ্যাক্টরির কাঁচের জানালার সামনে এসে দাঁড়ান সত্যপ্রিয়। চোখে পড়ে বাইরে বর্ষণমুখর মধ্যরাতে অবিরল ভিজে যাওয়া ঘাসজমি, কয়লার ডাম্পিং গ্রাউন্ড, দূরে অফিস লাগোয়া ফুল বাগানের বোগেনভিলিয়ার ঝাড়। অফিস গেটে চৌকিদার ঘুমটির পাশে লোহার পেটা ঘন্টাটা। গ্যারাজের বাইরে পড়ে থাকা ভ্রাম্যমাণ ক্রেশঘর, ট্রাক্টরের ট্রলিগুলো। সিকিউরিটি লাইট পোস্টের হলুদ আলোর নিচে ঝরে পড়ছে তিরের মতো অঝোর বৃষ্টিধারা। চাকরি জীবনে নাইট ডিউটি চলাকালীন এমন অনেক বর্ষাভেজা রাত ভেসে গেছে চোখের ওপর দিয়ে। আজীবন চা-পাতার গন্ধে জারিত সত্যপ্রিয় এখনও মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখেন ট্রাক্টরবোঝাই ভেজা পাতা এসে দাঁড়ালো ফ্যাক্টরির আনলোডিং ফ্লোরে। ট্রলিতে পাতার ওপর দাঁড়িয়েই খালাসিরা দুহাতে অথবা কাঁটাফাড়ুয়া (কাঁটাকোদাল) দিয়ে ব্যস্ত হাতে খালাস করছে পাতা। ওদের ঘাম-জলে ভেজা শরীরে সেঁটে আছে স্যান্ডোগেঞ্জি। কারো খালি গায়ে লেপ্টে আছে কুচি পাতা। লেপ্টে আছে পায়ে। খালাস করা পাতাগুলো ফের হাতে হাতে উঠে যাচ্ছে মনোরেল কনভেয়ারে। সেখান থেকে চেপে হপারের কাছে। হপার থেকে কাঁচা পাতা কাটার, ক্রাশার, গুগিরোলার, ফার্মেন্টিং মেশিন হয়ে ড্রায়ার রুমে। ফার্মেন্টিং মেশিন থেকে গেঁজানো চায়ের মনমাতানো সুবাস ভেসে আসতো নাকে। ড্রায়ার-রুম পেরোলেই সর্টিং রুম। সেখানে মেঝেতে কাপড়ের বালকিন-শিটের ওপর পড়ে থাকত বিভিন্ন গ্রেডের স্তূপাকার কালো চা । বর্ষায় পাতার মরশুমে কারখানার ভেতরটা গমগম করত। স্বপ্নের ভেতর এই দৃশ্য গুলো প্রায় দিন ঘুরেফিরে আসে। দেখে ঘুম ভেঙে যায়। মন ছুটে যায় সেই দিনগুলোর কাছে। কর্মমুখর সেই দিনগুলোয় একটুও ফুরসত মিলতো না। না সময়মত খাওয়ার, না বিশ্রামের। তবু সেই ব্যস্ত দিনগুলোয় অন্যরকম আনন্দ ছিল।
জীবনের অনেক ঘটনার সাথে বৃষ্টি জড়িয়ে আছে সত্যপ্রিয়র। প্রবালের চলে যাওয়ার দিনটিতেও এমনই বৃষ্টি ঝরেছিল। স্কুল থেকে দুপুর নাগাদ হঠাৎ অফিসের টেলিফোনে খবর আসে সিঁড়ি থেকে পড়ে সামান্য দুর্ঘটনা ঘটেছে ছেলের। খবরটা পেয়েই পাগলের মত ছুটেছিলেন সত্যপ্রিয় বাগানের গাড়িতেই । গাড়ি থেকে নেমে ঝিরঝির বৃষ্টির ভেতর দাঁড়াতেই চোখে পড়ে হেডমাস্টার মশায়ের ঘরের সামনে অস্বাভাবিক জটলাটা। সত্যপ্রিয় এগোতেই স্তব্ধবাক জটলাটা সরে গিয়ে রাস্তা করে দেয় । দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই চোখে পড়ে ভেতরে টেবিলের ওপর শায়িত তাঁর মেধাবী ছেলে প্রবালের নিথর শরীরটা। তাকে ঘিরে স্কুলের মাস্টার মশায়রা। শ্রাবণের কালো মেঘে ঢাকা চারপাশের থমথমে মুখগুলো নিষ্প্রাণ পাথরের মত দেখাচ্ছিল। অনেকেই প্রস্তাব দিয়েছিলেন বডি পোস্ট মর্টেম করার। সত্যপ্রিয় রাজি হননি। ঐ আদরের শরীরটা আর কাটাছেঁড়া হোক মন সায় দেয়নি কিছুতেই।
সত্যপ্রিয়র মনে পড়ে কাজলিডাঙা ছেড়ে কাঞ্চনপুরে চলে আসার দিনটিতেও বৃষ্টি ছিল । তেরপল টাঙিয়ে বাগানের ট্রাকে করে জিনিসপত্র নিয়ে আসতে হয়েছিল ওখান থেকে এখানে। আসার কদিন আগে থেকেই বাড়ির সকলের মুখভার ছিল কাশের মতই। শেকড় ওপড়ানোর ব্যথা সকলকে ভারাক্রান্ত করে রেখেছিল শ্রাবণ দিনের মতো। আসলে কাজলিডাঙা ছেড়ে কোনও দিন যে কোথাও চলে যেতে হবে সত্যপ্রিয় নিজেও ভাবেননি। পরিস্থিতি বাধ্য করেছিল তাঁকে। অফিসে কাজের চাপ যেমন ক্রমাগত বাড়ছিল তেমনি বেড়ে চলেছিল ইউনিয়নের দায়িত্ব। মাঝে কিছুদিনের জন্য বন্ধও হয়েছিল কাজলিডাঙা। সেসময় অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়েছিল সত্যপ্রিয়কে বাগান খোলানোর ব্যপারে। তার পরেও সাব-ডিস্ট্রিক্ট এর গুরুদায়িত্ব পালন করতে করতে কর্মক্ষেত্রে মনযোগ করতে পারছিলেন না মোটেই। শরীর ভেঙে পড়ছিল অত্যধিক কাজের চাপে। পরিবারের মানুষও বিরক্ত হয়ে উঠছিল ধীরে ধীরে। বাধ্য হয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার কথা যখন ভাবেন সত্যপ্রিয় ঠিক সেসময় কাঞ্চনপুর ফ্যাক্টরিতে গুদামবাবুর পদটা খালি হয়। ইউনিয়নের সভাপতি বরুনবাবুর খবরটা দিয়েছিলেন। ইন্টারভিউ দিতে এসেই চাকরিটা পাকা হয়ে যায়। কিন্তু কাজলিডাঙা ছেড়ে চলে যাওয়ার খবরটা বাড়িতে জানাতেই ছেলেমেয়েরা প্রবল আপত্তি জানাতে থাকে। কেবলমাত্র কাবেরী উপলব্ধি করতে পেরেছিল সত্যপ্রিয়র অবস্থাটা। আসার কদিন আগে থেকে বাড়িতে প্রায় অরন্ধন চলেছিল। বাসালাইনের আজ এ বাসা কাল ও বাসায় নেমন্তন্ন। কেউ বাদ রাখেনি নেমন্তন্ন করতে। আসার দিন কাজলিডাঙার মানুষ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সকলের চোখেই আকুল হয়েছিল শ্রাবণ।
-" চা লেন বাবু।" ভুটকু চা এনে সামনে রাখে। চায়ের কাপটা রেখেই চালু হয়ে যায় আকাশবাণী ভুটকু।
-" ইবার বোনাস কমতি দিবে শুনতেসি, বাবু। আগেবার পাতি কমতি ছিল। মালিকের নাফা হইলো না....কমতি দিলে তো ফিরসে ঝামেলা হোবে, বাবু! ইউনিয়ন তো মানবে নাই...হাজিরা ভি বাড়ল না... বুনাস ভি কম... কেন মানবে বাবু... বোলেন? " সত্যপ্রিয় চায়ের চুমুক দেন। কোনও উত্তর করেন না।
বোনাসের কথা শুনেই সত্যপ্রিয়র হুঁশ হয়, তাহলে কি পুজো এসে গেল!
অভ্যেস মতো দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারটার দিকে তাকান। সব ঝাপসা দেখায়।
-" আজ কত তারিখ রে...?"
-"ষোল তারিখ।" চটপট উত্তর দেয় ভুটকু।
তাইতো, আগস্ট তো প্রায় শেষ হতে চলল। আর তো দু'মাস। সময়মত দিলে তো সামনের মাসটাই বোনাসের । পুজো বোনাস, উৎসবের আগে চা-বাগানের মানুষের কাছে আরেকটি উৎসব। এই একটা বোনাসের জন্য সারাবছর বাগানের মানুষ চাতকের মতো বসে থাকে। স্বল্প মজুরিতে কায়ক্লেশে দিনকাটানো মানুষগুলোর হাতে এক লপ্তে অনেকগুলো টাকা। একটা সময় ছিল যখন এই বোনাসের টাকা পেয়ে গরীবগুর্বো মজুরেরা কী করবে ভেবে পেত না। কী কিনবে কীভাবে খরচ করবে ভেবে থৈ পেত না। সেই সুযোগ নিতো বাজারের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। তাদের ঠকিয়ে নিতো। বাজারে গিয়ে সর্বস্ব ফতুর হয়ে, নেশা করে মাতাল হয়ে, টাকা হারিয়ে ওরা ফিরে আসত ঘরে। পড়ে থাকত এখানে সেখানে। এখন আর সেই ছবি দেখা যায় না। চা বাগানের মানুষ এখন যথেষ্ট সচেতন। তারা এখন বুঝতে শিখেছে টাকার মূল্য। চা-শ্রমিকের ঘরে নতুন প্রজন্ম এখন ফ্যাশনদুরস্ত,শিক্ষিত, সচেতন।
-"ইবার পুজা হবে নাই বাবু?" প্রশ্নটা করে হাঁ করে চেয়ে থাকে ভুটকু সত্যপ্রিয়র দিকে।
-"কেন হবে না? হবে, প্রতি বার যেমন হয়।" সত্যপ্রিয় উত্তর দেন।
-" বিতে সাল তো ভাল হল নাই। আগের সোময় খুব ভাল হৈতো। যাত্রাগানা, আর্তিনাচ কত সুন্দর হৈত। মেলা বসত । আপনেরা একটা কিতাব বাইর করতেন। পুজা সোময় কত মানুষ আসত বাহার থিকে..." সত্যপ্রিয় বুঝতে পারেন ভুটকু কাঞ্চনপুরের শারদ পত্রিকা "আলোর ভুবন"এর কথা বলছে। এই পত্রিকাটি ছিল সত্যপ্রিয়র একান্ত নিজস্ব ভাবনার ফসল। প্রথম বছর এসে কাঞ্চনপুরের দুর্গাপুজো একেবারেই মনে ধরে নি । পরের বছর তাই সহকর্মী আরো দু একজনকে সঙ্গে করে সত্যপ্রিয় বাসা লাইনের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মহিলাদের কাছে আবেদন করেছিলেন এগিয়ে আসার। যাতে পুজোটা আরো জাঁকজমক করে করে যায়। সে বছরই একটি দেওয়াল পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন নেহাৎই ঝোঁকের বশে। বাগানের অনেকেই যে যেরকম পেরেছিল লেখা দিয়েছিল। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের হাতে আঁকা ছবিও ছাপা হয়েছিল। প্যান্ডেলে টাঙানো দেওয়াল পত্রিকা দেখতে এসেছিল অনেকেই। উৎসাহিত হয়ে পরের বছর বাগানের কিছু কচিকাঁচাদের নিয়ে পত্রিকাটি ছোট্ট ফোল্ডার আকারে প্রকাশিত হয়। । আড়ম্বর যতটা না ছিল আন্তরিকতা ছিল তার চেয়ে বেশি। বিনিময় মূল্য ছিল এক টাকা। ষষ্ঠীর দিন প্রথম প্রকাশ। পুজোর কটা দিন আশপাশ থেকে যারাই পুজো দেখতে এসেছিল উৎসাহী সকলের হাতে বাচ্চারা তুলে দিয়েছিল সেই সাহিত্যের ফোল্ডার। সত্যপ্রিয়র মনে পড়ে তৎকালীন ডিবিআইটিএর সেক্রেটারি চ্যাটার্জী সাহেব এসেছেন পুজো দেখতে, একটি মেয়ে কাছে গিয়ে ফোল্ডারটি এগিয়ে দেয়। হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে তিনি বললেন, " বাঃ বেশ তো! তোমার লেখা রয়েছে এতে?"
মেয়েটি ঘাড় নেড়ে বলে, " হ্যাঁ।"
-"কোনটা?"
মেয়েটি ফোল্ডার টি খুলে দেখায়। চ্যাটার্জী সাহেব চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলেন, "কত দাম এটার?"
মেয়েটি বলে "এক টাকা।"
তিনি পার্স খুলে দশ টাকা বের করে বলেন, "নাও দশ টাকা দিলাম। কেন জানো? এর থেকে এক টাকা বইটির দাম। বাকি ন'টাকা তোমার এই লেখার জন্য।"
মেয়েটি ভীষণ খুশি হয়ে ওঠে কথাটি শুনে। দৌড়ে এসে সত্যপ্রিয়কে ঘটনাটি শোনায়। সত্যপ্রিয় যদিও দূর থেকে সবই দেখেছিলেন। সেই শুরু, তারপর থেকে টানা পনেরো বছর " আলোর ভুবন" বের হয়। ফোল্ডার থেকে ছোট পুস্তিকার আকারে। বাগানের কচিকাঁচারা ছাড়াও বাইরের প্রতিষ্ঠিত কবি লেখকরা প্রতি বছর লেখা দিয়ে এসেছেন। এমনকি প্রখ্যাত সাহিত্যিক ডুয়ার্সের ভূমিপুত্র সমরেশ মজুমদার, তিলোত্তমা মজুমদারও লেখা দিয়েছিলেন পত্রিকাটিতে। তারপরে "মাদল" পত্রিকা প্রকাশের জন্য উন্মাদনার কথাও মনে পড়ে। পূর্ব এবং মধ্য ডুয়ার্সের চা বাগানের সাহিত্য সংস্কৃতি মনস্ক মানুষদের একত্রিত করে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করার প্রচেষ্টায় মেতে উঠেছিলেন সত্যপ্রিয়। পত্রিকার জন্য ডুয়ার্সের চা-বাগানের মানুষের কাছে যাওয়া, পত্রিকা কমিটি গঠন করে জায়গায় জায়গায় মিটিং করা, বিজ্ঞাপন যোগাড় করতে হিমসিম খাওয়া সব মনে পড়ে জীবনের এই শেষ বেলায় এসে। তার ওপর লেখার প্রূফ দেখে পত্রিকার অফিসে জমা করে ছাপানোর কাজের তদারকি করা যেন একটা চ্যালেঞ্জের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। চমৎকার দুটি সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর মূলত অর্থাভাবেই থমকে যায় "মাদল" এর যাত্রা। ঠিক এই সময় কাঞ্চনপুরে ডুয়ার্স সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করে সাড়া ফেলে দেওয়াটা আজও সত্যপ্রিয়কে তৃপ্ততায় ভরিয়ে তোলে।
সত্যপ্রিয়র মনে পড়ে ততদিনে "সবুজ কন্ঠ" ও "আলোর ভুবন" পত্রিকার প্রকাশক হিসেবে সাহিত্য সমাজের কাছে বেশ পরিচিতি লাভ করা হয়ে গেছে। লেখক, কবি, সাহিত্যিক, অধ্যাপকেরা অনেকেই চিনে ফেলেছেন সত্যপ্রিয় ঘোষকে। চা বলয়ের আদ্যোপান্ত একজন চা- বিশেষজ্ঞ ও সাহিত্য প্রেমী হিসেবে। তাঁদেরই একজন একদিন কাঞ্চনপুরের বাসায় এসে তাঁকে প্রস্তাব দেন ডুয়ার্সে একটি সাহিত্য সম্মেলন করার। বন্ধু অতীনও উৎসাহ যোগায় এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। সত্যপ্রিয় দিনরাত এক করে লেগে পড়েছিলেন সেই সম্মেলন বাস্তবায়িত করতে। নির্ধারিত দিনে বাগানের রিক্রিয়েশন ক্লাবের মঞ্চে অনুষ্ঠিত হল সেই সাহিত্য সম্মেলন। ডুয়ার্স তথা জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, শিলিগুড়ি ও আশপাশের চা বাগান থমকে কিছু বুদ্ধিজীবী মানুষ এসেছিলেন। সারাদিন কবিতা, গদ্যপাঠ, স্মৃতিচারণে চমৎকার কেটেছিল দিনটি। চা-বাগানের পরিসরে এমন একটি অনুষ্ঠানে কখনও তাঁরা আসেননি এই অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন সকলেই। কাঞ্চনপুর বাগান অর্থ ও অন্যান্য জিনিস পত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল। মঞ্চসজ্জা থেকে শুরু করে অতিথি আপ্যায়ন কোনও কিছুতেই ত্রুটি রাখেননি সত্যপ্রিয়। সবচেয়ে বড় চমকটি রেখেছিলেন খাওয়ার পাতে। অতিথি অভ্যাগতদের প্রত্যেককে খাওয়ানো হয়েছিল পদ্মপাতায়। ডুয়ার্স অঞ্চলে যে পাতা বিরল। সত্যপ্রিয় খোঁজ পেয়েছিলেন ধূপগুড়ির কাছে জটিলেশ্বর শিবমন্দির লাগোয়া পুকুরে প্রচুর পদ্ম ফোটে। ছুটেছিলেন সেই পদ্মপুকুর দেখতে। তারপর লোক লাগিয়ে নিয়ে এসেছিলেন সেই পদ্মপাতা। দুই মেয়ে, ছেলে এবং কাবেরী সকলেই সেদিন পাশে দাঁড়িয়েছিল সত্যপ্রিয়র। অনুষ্ঠান শেষে সকলে যখন সত্যপ্রিয়কে উষ্ণ কৃতজ্ঞতায় ভরিয়ে দিচ্ছিলেন সত্যপ্রিয় অনুভব করেন তার নিজের যতটা না আনন্দানুভব হচ্ছে কাবেরীর হচ্ছে তার চাইতে বেশি। সত্যপ্রিয়র যে কোনও সাফল্যে সে-ই যে খুশি হত সবচাইতে বেশি।
ভাবনার ঘোর কাটতেই সত্যপ্রিয় লক্ষ্য করেন ভুটকু সামনে নেই। সত্যপ্রিয়কে চিন্তামগ্ন দেখে হয়ত আর বেশি কথা না বাড়িয়ে নিঃশব্দে সরে গেছে কখন যেন । বৃষ্টি থেমে গিয়ে বাইরে ঝলমলে রোদের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। শেষ শ্রাবণে মাঝে মাঝে শরতের রোদ এসে যেন উঁকি দিয়ে দেখে যাচ্ছে তার আসার সময় হলো কি না। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়েছে হয়ত। বৌমারও আসার সময় হয়ে এলো। নাতনি এ সময়টায় স্কুলে থাকে। পুরো বাড়িটা নিঝুম হয়ে আছে। এই নির্জনতা মাঝে মাঝে চেপে ধরে অস্থির করে তোলে সত্যপ্রিয়কে। অস্থিরতায় চঞ্চল হয়ে ওঠা মনের ভেতর হঠাৎ ঝলক দেয় একটি নাম, সুবর্ণ।
অনেকদিন হয় ওর সাথে কথা হয় না। মাঝে অনেকটা সময় বয়ে গেছে। ছেলে ভাল নম্বর পেয়ে মাধ্যমিক পাশ করার পর ওর ভর্তির ব্যাপারে বেশ কয়েকবার কলকাতায় দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে সুবর্ণকে। ভাল নম্বর পেয়েও ভাল স্কুলে জায়গা মিলছিল না কিছুতেই। তখন ঐ শ্রাবস্তী নামের মেয়েটি ওকে নাকি খুব সাহায্য করেছে বলে জানিয়েছিল সুবর্ণ। কার্যত ঐ মেয়েটির সুপারিশেই শেষ মুহূর্তে পছন্দের স্কুলে ভর্তি করাতে পেরেছে ছেলেকে । একদিন এসব নিয়েই অনেকক্ষণ কথা হয় সুবর্ণর সাথে।
এতকিছুর পরেও শেষপর্যন্ত উপন্যাসটা শেষ করতে পেরেছে সুবর্ণ। পান্ডুলিপি চলে গেছে প্রেসে। কলকাতায় ছাপা হচ্ছে ওর প্রথম উপন্যাস যার অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছে সত্যপ্রিয়র জীবনের ছায়া। লেখাটি যেদিন পাঠায় সেদিন রাতেই ফোন করে বলেছিল, " কাকাবাবু, উপন্যাসের পান্ডুলিপি গতকাল পাঠিয়ে দিলাম বিজনদার কাছে। সেটি উনি কলকাতায় নিয়ে যাবেন। প্রূফটা বিজনদাই দেখবেন । ওঁর নিজস্ব প্রেস আছে। সেখান থেকে প্রকাশিত হবে বইটি। প্রচার, রিভিয়্যু সব দায়িত্ব বিজনদাই নিয়েছে। আশা করছি আগামী বইমেলায় বইটির আত্মপ্রকাশ ঘটবে। আশীর্বাদ করুন সব যেন ঠিকঠাক হয়ে যায়।"
-" আমার আশীর্বাদ সব সময় রয়েছে তোমার সাথে, সুবর্ণ।"
সেই শেষ কথা হয়েছিল তাও প্রায় দিন পনের আগে। মাঝে কলকাতা যাবে বলেছিল ছেলেকে দেখতে। তখনই বলছিল বাবার অসুস্থতাটা বেড়েছে। ওর বাগানেও কী নিয়ে যেন একটা অস্থিরতা চলেছে। ম্যানেজমেন্ট বদলি হয়েছে। নতুন ম্যানেজারের সাথে বনিবনা হচ্ছে না কারোর। সব নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছে। পরে ফোন করবে বলে আজ এতদিন হলো কোনও খবর নেই। কেমন আছে ও? মনটা উচাটন হয়ে ওঠে । মোবাইলটা চোখের কাছে নিয়ে সুবর্ণর নম্বরটা খোঁজার চেষ্টা করে চলেন সত্যপ্রিয়।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴