গঞ্জহাটের আখ্যান/শেষ পর্ব - সুবীর সরকার
গঞ্জহাটের আখ্যান/শেষ পর্ব
সুবীর সরকার
৪৩.
তামারহাটের ভেঙে যাওয়া হাটের বাইরে আসতে আসতে সিকান্দার মিস্তিরি তার ঝাঁকড়া চুল নাড়াতে নাড়াতে বেশ মজাদার এক ভঙ্গি তার দীঘল শরীরে বহন করে আনতে থাকে আর কিঞ্চিৎ অন্যমনস্ক হয়েই গানের দু এক কলি কিংবা গেয়েই ওঠে -
"ও কি মাহুত রে
মোক ছাড়িয়া কেমনে যাইবেন
তোমরা হস্তির শিকারে"
এই গানের হাহাকারের মতন সুর বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে থাকে দ্রুত লয়ে।গঞ্জ বাজার খেত খামার আর মানুষের ঘরবাড়ি পেরিয়ে এই গান তার সুরসমেত মিশে যেতে থাকে গঙ্গাধর নদীর মস্ত বালার চরে।
৪৪.
সিকান্দারের চোখ ভিজে ওঠে।এই জীবন এই জীবন মায়া নিয়েই তো আবহমান বেঁচে থাকা মানুষের।
সিকান্দার হাঁটতেই থাকে। লিলুয়া বাতাসে দোল খায় সিকান্দারের মাথার বাবরি চুল।
ফাঁকা প্রান্তরে সে আচমকা দু তিন পাক নেচেই ওঠে আর ঝুঁকে পড়ে নুতন গানের ওপর -
"বিনা বাতাসে ভাসা
ঢোলে রে"
সিকান্দার সিকান্দার হয়েই থেকে যায়। দূরে ক্রমে আবছা হয়ে আসে তামারহাটের ভরসন্ধ্যাবেলা।
গঙ্গাধরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সিকান্দার মিস্তিরির
শরীরের পুলক সহসা ভেঙে যায়।তার প্রাচীন কালের কালো পাথরের মতো কপালে গভীর ভাঁজ পড়ে। সে কি তবে কিঞ্চিৎ বিচলিত হয়!
৪৫.
সিকান্দার আসলে নৌকো বানানোর দক্ষ এক কারিগর।আর এই জল ও জলার দেশে ধনী বল জোতদার বল জমিদার বলো বা গৌরীপুরের রাজাই বলো,নৌকো বানাবার কাজে প্রায় সারা বছরই ডাক পড়ে সিকান্দারের।প্রায় পঞ্চাশ বছর জুড়ে এই কাজ করে চলেছে সে।এই জনপদ তাকে সিকান্দার মিস্তিরি বলেই জানে। চেনে। একসময় সিকান্দার কালু বয়াতির দলে সারিন্দা বাজাতো। তার সারিন্দা কত কত ভরযুবতী নারীকে উন্মনা করেছে!কত নারীকে এক সংসার থেকে অন্য সংসারে ঠেলে দিয়েছে!কত চেংড়া কে বাউদিয়া করেছে! তার কোন ঠায় ঠিকানা নাই।
তাকে দেখলে এখনও কত মানুষ মজা করে গেয়ে ওঠে -
"কি ডাং ডাঙ্গালু বাপই রে
নাঠির গুতা দিয়া"
তবে কি সিকান্দার তার সারিন্দার জীবনের কথা ভাবছিল! না কি গয়েশ্বর ধনীর জোতজমি আর বাইচের নাও তাকে আরো আরো এক ভাবনার জটিলতায় ঠেলে দিচ্ছিল!
৪৬.
এভাবে আখ্যান শেষ হয়ে যায়। না কি নতুন কোন আখ্যান জেগে উঠতে থাকবে এই আপাত শেষ হওয়া আখ্যানের মধ্য থেকেই।
জন্ম জন্ম জুড়ে এটাই আবহমান সত্যি হয়ে বিরাজ করে। মানুষ বাঁচে।মানুষকে বেঁচে বর্তে থাকতে হয় এভাবেই আখ্যানের পর আখ্যান জড়িয়েই।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴