সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon

একান্নবর্তী-২/গৌতম কুমার ভাদুড়ি

একান্নবর্তী/২
গৌতম কুমার ভাদুড়ি 

চির-মা

মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তেও তিনি জানতে চাইতে পারেন আমরা ভালো আছি কিনা। নমুনা দিই। একবার আমি সসন্তান যেতে বাধ্য হয়েছিলাম বারাসাতে। সেটা আমার শ্বশুরবাড়ি। নানা কারণে তখন সেখানে তৃতীয়জন আর কেউ থাকত না। স্বামীর শুশ্রুষা করতে করতে এবং অন্যান্য নানাবিধ কারণে আমার শ্বশ্রূমাতা নিজেই তখন শয্যাশায়ী কিন্তু ঘূণাক্ষরেও জানাননি কাউকে। আমরা যখন পৌঁছেছি তখন সকাল সাতটার মতো। দেখি উনি বহু আগেই ঘুম থেকে উঠে স্বাভাবিক মানুষের মতো, বরং আরও বেশি যত্নে আমাদের জন্য ডাল তরকারি পোস্তবাটার আয়োজন করে রেখেছেন। আমরা যদি গিয়েই আবার বাইরে চলে যাই সেই আশঙ্কায়। অনায়াসে অনেকগুলো বকাবকি সহ্য করলেন এবং শেষ পর্যন্ত সেদিন সন্ধেবেলাতেই তাঁকে সত্যিই ভর্তি করতে হল নার্সিংহোমে। যাবার সময় পর্যন্ত ডাক্তারবাবুকে চা দেওয়া হল না বলে তাঁর কি আক্ষেপ! মানুষটি প্রকৃত অর্থে আমাদের সকলেরই মা – সন্ধ্যা পারিয়াল, আমার শ্বশ্রূমাতা।
খুব যে ভেবেচিন্তে এসব করেন তিনি তা হয়ত নয়। আসলে মানুষটার মানসিক গঠনটাই ওরকম। 
আর একটা বিশেষ গুণ দেখেছি ওনার মধ্যে। উনি কখনও বিলাপ করতে জানেন না। কোনও কিছুকেই খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে একেবারে তারই জন্য প্রাণ মন সমর্পণ ওনার ধাতে নেই। সেজন্য যে কোনও অবাঞ্ছিত বিষয়কে সহজেই তুচ্ছ করতে পারেন। কেউ অপমান করলেও হেসে তার সঙ্গে কথা বলার ক্ষমতা খুব সাধারণ নয়, উলটে তিনি হয়তো বা তার জন্য ঈশ্বরের কাছে আশীবাদ প্রার্থনা করতে বসে গেলেন। প্রত্যাশা বলে কিছু নেই, কেউ কিছু দিলে খুশি হন, তখুনি ভুলেও যান। সংসারে থেকেও ঘোরতর অসংসারী যেন। তবে মাঝে মাঝে আমাদের পাল্লায় পড়ে পরনিন্দায় যোগ দিলে, সব ভুলে নানান কিছু বলে ফেলেন, হাসিঠাট্টা করেন, হয়ত কিছু না ভেবেই। ধরিয়ে দিলে ভয় পান, হাসেন।
সর্বভূতে দয়া অকৃত্রিম। তবে ভূতেই অবশ্য বেশি দয়া লক্ষ্য করা গেছে।
সবচেয়ে যেটা বিস্ময়কর সে হল ওনার সহ্যগুণ। মানুষ যে পরিস্থিতিতে মাথা কুটতে থাকে সমতুল পরিস্থিতিতে উনি কত শান্ত কত চিন্তাহীন, ভাবলে অবাক হই। একবারের কথা খুব মনে আছে। সকাল থেকেই মুখটা ফোলা ফোলা, থুপ থুপ করে হাঁটছেন, পা দুটোকে যেন টেনে টেনে চালাতে হচ্ছে। প্রদীপ- ডাক্তার এসে অসম্ভব লাল হয়ে যাওয়া মুখ দেখেই বললেন, প্রেসার বেড়েছে। সত্যিই দুশো পঞ্চাশ বাই একশো আশি প্রেসার নিয়ে হাত পা থরথর করে কাঁপছে। উনি নিজে থেকেই বলছেন আমি বাড়িতে থাকলে তোমরা বিপদে পড়বে আমাকে একটু নার্সিং হোমে দিয়ে এসো। সে যাওয়ার সময়ও সব ব্যবস্থা করে তবে বেরোলেন। কেউ পারবে না। মৃত্যুকেও ভয় পান না। কেবল ঠাকুরকে জল দেওয়া হল কিনা আর স্বামীকে ইনসুলিনের পর খেতে দেওয়া হল কিনা এই তাঁর ধ্যান। বড়োজামাই ছাড়া আর সকলকে দরাজ হাতে দিয়েছেন। আমি নাকি কবে বলেছিলাম আমার কিছুর দরকার নেই, উনি সেটাকেই চিরসত্য বলে জেনেছিলেন। আরে বাপ দ্বিতীয়বার তো জানতে চাইতে হয়?
পোশাকে-আশাকে আধুনিক নায়িকাদেরও হার মানাবেন। সমস্ত জামাকাপড় ঠিকমতো পরেছেন, কোনদিন দেখিনি। জামাইদের চোখের ওপরেই উনি ক্যাটরিনা সেজে ঘরময় থালাবাটি নিয়ে ছুটছেন। দেখা হলে- হে হে, যা গরম, বাবা, বেশি কাপড় জড়াতে পারি না। তোমরা তো সন্তানই আমার। বোঝ এবারে! 
আমার মাঝে মাঝে খোঁজ পড়ত মশারি টাঙিয়ে দেওয়ার কাজে। ওনারও ধারণা ছিল এই কাজটিতে আমার ডিপ্লোমা কোর্স করা আছে। ফলত সবাই যখন সমবেত হতাম, এই কাজটি আমাকে করতে হত। আমি পাশাপাশি শায়িত আমার শ্বশুর শাশুড়ির গোল গোল পেটে মৃদু পায়ের চাপে বিছানাময় চষে বেড়াচ্ছি কারণ মশারির ফিনিশিং হচ্ছে গোঁজায়, তাতে যেন গোঁজামিল না থাকে। অতএব কাতুকুতু বা গায়ে পা লাগলেও তা দোষের নয়, কিংবা সেসবের জন্যই তো মশারি ব্যবস্থা। এরকম সব মজার দিন ছিল সেসব।
সন্ধ্যা পারিয়াল একটি মঠের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, অবশ্যই দীক্ষিতও ছিলেন, সুতরাং তাঁর নিত্যকার জীবনচর্যা আশ্রমিক ভাবনায় প্রভাবিত ছিল। তা সত্বেও বলি, আমার দেখা অনেক সাধু সন্তেরও কিছুদিন এরকম একজন মানুষের সান্নিধ্যে থেকে আচরণবিধি সম্যকভাবে অনুসরণ করতে পারলে সমাজের আরও বেশি কল্যাণ হত। তাঁর জীবদ্দশায়, পাছে আঘাত পান তিনি সেই সংশয়ে কথাটা বলতে পারিনি, কিন্তু আজ তাঁর অবর্তমানে এই খাঁটি কথাটা আপনা থেকেই বলা হয়ে গেল।
আশ্চর্য মানসিক শক্তির অধিকারিণী ছিলেন এই মানুষটি। জীবন এবং মৃত্যুকে তিনি নিজস্ব অনুভব দিয়ে এমন করে উপলব্ধি করেছিলেন যে যে-কোনও মৃত্যুকেই খুব স্বাভাবিক বলে ভাবতে আর কষ্ট হত না তাঁর। খুব সামান্য কটা দিনের রোগভোগের অবসানে তিনি চলে গেছেন কিন্তু সে যাওয়ায় এতটুকু আক্ষেপ ছিল না কোনও, যেন যেতে পেরে খুশিই একরকম। অথচ যাবার পূর্বমুহূর্তেও ভুলতে পারছেন না লক্ষ্মীমাসির কথা। লক্ষ্মীমাসি ছিল তাঁর সর্বক্ষণের সেবিকা, বেশ স্থূল বেতনের সৌখিন আয়ামাসি, যাকে কিছু কাজই করতে হত না কোনদিন। তো তিনি বলেই ফেলেছিলেন, মাসিমা গো তুমি যখন থাকবে না আমি কোথায় যাব? সেই লক্ষ্মীমাসির চিন্তায় মৃত্যুপথযাত্রিণীর যেন শান্তি নেই। দুটি মেয়েকে ডেকে ডেকে দায়িত্ব দিয়ে গেলেন, তিনি চলে যাবার পর যেন লক্ষ্মীর একটা মোটা মাইনের চাকরি তারাই খুঁজে দেয়। এর খানিক পরে সজ্ঞানেই আমাদের মায়া কাটিয়ে তিনি তাঁর কাঙ্ক্ষিত জগতের পথে হাস্যমুখ অভিযাত্রিণী। আসছি বলে শেষ হাসিটুকু ফুটিয়ে তুললেন ঘুম নেমে আসা চোখের তারায় । কোনও দুঃখ নেই, ফিরে দেখা নেই - চলো দেবদূত, চলো কোথায় নিয়ে যাবে।  

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri