আমি এক যাযাবর-২৭/শৌভিক কুন্ডা
আমি এক যাযাবর (পর্ব ২৭)
শৌভিক কুন্ডা
আগের দিন ভরা বর্ষার স্রিয়াংখোলা চোখের সামনে ছিলো। সকালে অভিজিৎ আর এই অরণ্যবাসের রাঁধুনি উস্কে দিলো, অন্যপথে হেঁটে স্রিয়াংএর কাছে যাওয়ার জন্য। ওরাও চললো গাইড হিসেবে। বস্তির ফাঁকা ফাঁকা বাড়িঘর, এলাচ বাগান, আদার ক্ষেতের ভেতর দিয়ে পৌঁছনো গেল মিনিট কুড়িতে। কিন্তু পায়ের নাগালে তখনও নয়। যেমন তীব্র স্রোত, তেমনই গর্জন, আর জল ছুঁতে গেলে ততটাই পেছল পাথুরে নাবাল! সাহস পেলাম না, কোনমতে এক পা দু পা করে এগিয়ে ঝুঁকে হাত ছোঁয়ালাম জলে। বরফ গলা ঠান্ডা, আর স্রোতের কথা তো বলেইছি। দুয়েক মুহুর্ত আঙুল ভিজিয়েই তুলে নিতে হ'ল। তারপর অভিজিতের ইশারায় ফের এগিয়ে চলা। এবার আর গ্রামপথ না, নদীর উঁচু পার ঘেঁষে চড়াই-উতরাই। মনে হলো এ পথে স্থানীয় মানুষেরাও তেমন চলেন না। প্রয়োজন পড়ে না বলেই বোধহয়। কোথাও কোথাও এতটাই ভাঙাচোরা, ভয় করছিলো পারবো কি না। অভিজিৎ ঠিক বুঝে নিচ্ছিলো, সময় মতো হাত বাড়িয়ে সাহায্য করছিলো। উৎপল'দা কার সাথে যেন মোবাইলে কথা বলতে বলতে পিছিয়ে পড়েছে অনেকটা। তাতে আমার লাভ হ'ল এই, বিশ্রাম নেওয়ার জন্য একটু দাঁড়াতে পারলাম। এবার সামনের রাস্তা অনেকটা খাড়া। আমাদের রাধুনি বন্ধু কোত্থেকে একটা গাছের ডাল ভেঙে খুকরী দিয়ে কেটে দিব্যি একটা ভর দেওয়ার লাঠি বানিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিলো, সঙ্গে মিষ্টি, সরল হাসি। এবার লাঠি ঠুকে ঠুকে, কখনো অভিজিতের বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরে ধরে, ওপরের দিকে ওঠা শুরু হ'ল। পাহাড়ি, জঙ্গুলে, পাথর মাটির রাস্তা। মনে পড়ছিলো কম বয়সে এমন পথে, এর চাইতেও কঠিন পথে কতো অনায়াস পা ফেলেছি! লকডাউন পর্বের পরপরও, খুব বেশিদিন তো হয় নি, বক্সা ফোর্টের রাস্তায় হেঁটে উঠেছি (অবশ্য সেবারও হাতে লাঠি আর সঙ্গে গাইড)! এইসব ভাবতে ভাবতে একটু মন খারাপই হয়ে যাচ্ছিলো, উৎপল'দার ডাকে সম্বিৎ ফিরলো, "এটা কি ফুল রে, দ্যাখ তো!" তাকিয়ে দেখি অন্যমনস্ক ভাবে পেরিয়ে এসেছি পাহাড়ের গায়ে ফুলে ফুলে সাদা গাছ একটা। গন্ধরাজ! এই জনমানুষহীন, পরিত্যক্ত পাহাড়ি পথের ধারে আলো বিছিয়ে আছে। কে রেখে গেছিলো ওকে এই বিভুইয়ে কে জানে!
এবার চলতে চলতে অপূর্ব এক সাঁকো স্রিয়াংখোলার যে পার দিয়ে আমরা হাঁটছিলাম সেদিক থেকে অন্য পারে চলে গেছে। বাঁশের তৈরি, সরু। দুজন কোনোমতে পাশাপাশি যেতে পারে। অভিজিৎ তরতরিয়ে ওপারে চলে গেল, পেছনেই ছিলাম আমি। ওর যাওয়ার সময় সাঁকো যে ভাবে দুলছিলো, তাতে আমি পা বাড়িয়েও থমকে গেলাম। ওপার থেকে ইশারা করলো অভিজিৎ, জলগর্জনের ওপর দিয়ে গলা তুলে ডাকলো, "আ যাইয়ে, কুছ ডর নেহি! " অতএব সাঁকোয় পা। আর পা রাখার সাথে সাথেই দুলুনি পায়ের নিচে! এক বার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম উৎপল'দা আর আমাদের আর এক সঙ্গী তখনও বেশ কিছুটা পেছনে। যা আছে কপালে ভেবে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম, অবশ্যই পাশের বাঁশরেলিং আঁকড়ে! পায়ের নীচে পাথরে পাথরে বাধা টপকে ফুঁসে চলেছে খোলা। দু চার পা এগোতে এগোতে অস্বস্তি কেটে গেল। এবার রেলিং ছেড়েই হাঁটতে পারলাম। ও পারে পৌঁছতে অভিজিৎ আমার মোবাইল, জ্যাকেট নিজের হেফাজতে নিয়ে আবার ফিরতে বললো সেতুর ওপর, ছবি তুলবে। ততক্ষণে বাকি দুজনেও ওপারের থেকে সাঁকোতে পা রেখেছে। বেশ কিছুক্ষণ কাটলো ছবি তুলে, স্রিয়াংএর চলন দেখে। তার পর আবার হাঁটা শুরু। এবার রাস্তা এঁকেবেঁকে হলেও অনেকটা বেশি খাড়াই।
এতটাই, যে মাঝেমাঝেই দাঁড়িয়ে পড়তে হচ্ছিলো আমাকে। হাওয়ায় শীতলতা আছে, কিন্তু রোদও উঠেছে। থেমে ঠেকে এগোচ্ছি আর দীর্ঘ অনভ্যাসে হাঁফিয়ে যাচ্ছি, মাঝেমধ্যেই দাঁড়িয়ে শ্বাস স্বাভাবিক করে নিতে হচ্ছে। হয়তো আমাকে সান্ত্বনা দিতেই অভিজিৎ বললো, আপনি তো এ বয়সেও কতখানি হাঁটছেন, আপনার হাঁটুর বয়সী অনেকেই হাল ছেড়ে দেয় সাঁকো অব্দি পৌঁছে! এমনি করে করে একসময় মূল পাকা রাস্তায় পৌঁছলাম। আমি দরদর করে ঘামছি, নিশ্বাসও স্বাভাবিক হচ্ছে না। রাস্তার ধারে কয়েক পা এগোতে একটা ছোট্ট ঘর, পরে বুঝলাম দোকানই, অভিজিৎরা আমাদের সেখানে নিয়ে গেল। ভেতরে গিয়ে বসলাম। খোলা জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস এসে আস্তে আস্তে ক্লান্তি, পরিশ্রমের স্বেদ মুছিয়ে দিতে লাগলো। মালকিন এসে জল দিয়ে গেলেন, এবং ট্রে থেকে গ্লাস নামিয়ে হাত জোড় করে নমস্কার করলেন। আমরা চাএর কথা বলতে ঘাড় নেড়ে অল্প হেসে বোঝালেন, হবে। চা এলো, গন্ধটা সন্দেহজনক না, কিন্তু অন্যরকম। বেশ গবেষণা চললো দুজনের, শেষ পর্যন্ত উৎপল'দাই ঠিকঠাক লক্ষ্যে পৌঁছলো, নিশ্চয়ই কাঠের জ্বালানিতে তৈরি, সেই ধোঁয়ার গন্ধ আমাদের ছোটবেলার উঠোন থেকে ভেসে এসেছে এত বছর, এত দূরের পথ পেরিয়ে এই মাজুয়ায়। মালকিন জানালেন অনুমান একদমই ঠিক, তা ছাড়াও, এ চা হ্যান্ডপ্লাকড, হোমমেড। চায়ের দাম দিতে গেলে আবারও নমস্কারের ভঙ্গিতে অস্বীকার করলেন! এই অপ্রত্যাশিত আতিথেয়তার ঘোর কাটতে না কাটতে আর এক চমক। অভিজিৎদের কোথাও দেখতে পাচ্ছিলাম না এতক্ষণ। আমাদের এই দোকান বা বাড়িতে বসিয়ে রেখে কোথায় উধাও হয়ে গেছিলো যে! এবার জানতে পারলাম। দুই ভ্রামণিকের শরীরের অবস্থায় চিন্তিত হয়ে বাড়ি অব্দি গিয়ে সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে এসেছে ওরা। সত্যি বলতে তাতে একটু অপ্রস্তুত হলেও, আরাম এবং স্বস্তি পেলাম খুবই। বাড়ি ফিরতেই কৃপাশার চিন্তিত প্রশ্ন, "হাউ ডু য়ু ফীল নাও?" হ্যাঁ, হোটেল নয়, বাড়িতেই ফিরেছি, বুঝলাম। দুপুরের পাতে গুন্দ্রুক স্যুপ, কালি দাল, মূলি আচার, আমার চাহিদামতো। তা ছাড়াও আলু চিলি, ডিম আর পাঁপড়। আর হ্যাঁ, এখানে ভাত বেড়ে দেওয়ার মধ্যেও ছেলেবেলার অতিথি আপ্যায়নের স্মৃতি! সেরকমই বাটিতে ভাত চেপে থালার ওপর গোল করে বসিয়ে দেওয়া। রাতের জন্য ফাকসা এসে যাবে, নিশ্চিত হলাম। এরপর বিছানায় শরীর ফেলার অপেক্ষা ছিলো শুধু!
ঘুম আনতে সময় এমনিতেই লাগতো না, তার ওপর শুরু বৃষ্টি! জেগে উঠতে উঠতে সন্ধ্যে। ফের হেঁটে আসা ঝোরার পাশ থেকে।আড্ডাপাথরে কিছুক্ষণ। বসে থাকতে থাকতে বারবার মনে পড়ছিলো, "অদ্যই শেষ রজনী!"
রাতের রান্না উৎপলদার হাতে, আহা সে অমৃতবরাহ! পরদিন সক্কাল সক্কাল উঠিয়ে দেবে অভিজিৎ, সেই মাজুয়া-দার্জিলিং একমাত্র গাড়ি সাতটায় গেটে আসবে! আমাদের জায়গা বুক করা আছে। রাতে ঘুম খুব ভালোমতো হ'ল না। ছেড়ে যাওয়ার মনখারাপ, সময়মতো উঠতে পারা না পারার দোলাচল, এসব ভাবনার ভেতরেই কখনো একটু চোখ লেগে আসা। ঠিক ছ'টায় চা পেলাম। সাড়ে ছ'টায় ব্রেকফাস্ট। সেরে, ব্যাগপত্র নামিয়ে, নীচের আড্ডাজোনে অপেক্ষা। ফোন এলো অভিজিতের কাছে। গাড়ি আসছে, তবে আটটা হয়ে যাবে! শেষ পর্যন্ত সাড়ে আটটা নাগাদ সত্যি সত্যিই এলেন তিনি! চরিত্রে এক ছিটে কালি লাগতে দেন নি! এবারও তার চলন নিজের মরজি মাফিক। কেবল এ গাড়ির মালিকের যে, তা-ই নয়, মাজুয়া ছেড়ে অনেক দূরে চলে এসেও মনে পড়ে, আমাদের পেছনে যেমন প্রতি মুহুর্তে সময়ের সজাগ নির্দেশ, ছোট্ট পাহাড়ি জনপদটিতে তা নেই। তার প্রয়োজনই নেই।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴