অন্তহীন আকাশের নীচে : অন্তিম পর্ব/দেবপ্রিয়া সরকার
অন্তহীন আকাশের নীচে
অন্তিম পর্ব
দেবপ্রিয়া সরকার
কয়েকমাস পর...
উত্তরবঙ্গে গত কয়েকদিন ধরে জোরালো শীত পড়েছে।সকাল থেকে কুয়াশার চাদরে মোড়া থাকে আকাশ সঙ্গে দোসর ঠান্ডা হাওয়া। কোনও কোনও দিন বেলার দিকে একটু রোদ উঠছে, আবার বিকেল হতে না হতেই সাদা ফিনফিনে কুয়াশা এসে ঘিরে ফেলছে চারপাশ। জানুয়ারি মাসের এই সময়টায় এমনই আদুরে শীতের ঘেরাটোপে আবদ্ধ থাকে বাংলার উত্তর প্রান্ত। কয়েকদিনের এই জম্পেশ শীতকে চুটিয়ে উপভোগ করে স্হানীয় মানুষ। মেলা, খেলা, জলসা, চড়ুইভাতির দেদার আয়োজন হয়।
আজকের দিনটাও এমনই এক শীতকাতুরে কুয়াশামাখা দিন। সকাল থেকে ভারী ব্যস্ত পাখি। তাদের কোচিং সেন্টারে প্রথমবার অনলাইন ক্লাসের আয়োজন করা হয়েছে। সুদূর বর্ধমান থেকে পাখিদের গুগল মিটে ক্লাস নেবে ইন্দ্রায়ুধ। একমাস হল বর্ধমান রাজ কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছে সে। আর মাস দেড়েক পরেই পাখিদের ফাইনাল পরীক্ষা। ইন্দ্রায়ুধের খুব খারাপ লাগছিল ফাইনাল পরীক্ষার আগ মুহূর্তে ছাত্রছাত্রীদের ছেড়ে যেতে, কিন্তু একান্ত নিরুপায় হয়েই তাকে আসতে হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের অনুরোধে তাই আজ সে ব্যবস্হা করেছে অনলাইন ক্লাসের।
নাকেমুখে দু’টো ভাত গুঁজে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল পাখি। কোচিং সেন্টারের ওয়েবক্যাম লাগানো কম্পিউটার ঘিরে বসে আছে ছাত্রছাত্রীরা। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই মনিটরের স্ক্রিনে ভেসে উঠল ইন্দ্রায়ুধের মুখ। টানা কুড়ি মিনিট ধরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ব্যাখ্যা করল সে। ছাত্রছাত্রীদের করা বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিল। মন দিয়ে ইন্দ্রায়ুধের বক্তব্য শুনছিল পাখি। মাঝেমধ্যে কিছু ইম্পরট্যান্ট পয়েন্টও নোট করে নিচ্ছিল। সকলকে পরীক্ষার আগাম শুভেচ্ছা জানিয়ে ক্লাস শেষ করল ইন্দ্রায়ুধ।
পাখির সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায় যোগাযোগ আছে ইন্দ্রায়ুধ এবং স্বয়ংদ্যুতির। মাঝে মাঝেই একে অপরের সঙ্গে হাসিখুশি ছবি পোস্ট করে তারা। তাদের সম্পর্ক যে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না পাখির। এখন আর স্বয়ংদ্যুতিকে নিয়ে তার মনে কোনও দ্বিধা, দ্বন্দ্ব নেই। বিগত কয়েকমাস ধরে অনেক ঝড় বয়ে গিয়েছে তার মনের ওপর দিয়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাস্তববাদী হয়েছে সে। এখন অনেকটাই পরিণত পাখি। ঠিক, ভুলের পার্থক্য করতে শিখে গিয়েছে। পড়াশোনা ছাড়া অন্য কিছুর প্রতি আর তার আকর্ষণ নেই।
বন্ধু অর্পিতার জন্মদিন উপলক্ষে ক্লাস শেষের পর বন্ধুরা সকলে মিলে রাজবাড়ি সংলগ্ন পার্কে গিয়ে হাজির হল। কেক কাটা এবং ছোটখাটো একটা পার্টি হল সেখানে। লোহার জাল ঘেরা রাজবাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পাখির মনের চোখে ভেসে উঠল ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু ছবি। বড় হওয়া ইস্তক ঊষারানীর মুখ থেকে রাজবাড়ির গল্প শুনে আসছে। নাজানি কত কতদিন রাজা, রানি, রাজকুমারীদের গল্প শুনতে শুনতে কল্পনার জগতে হারিয়ে গিয়েছে সে। আচমকা বুকের ভেতরটা খালি হয়ে এল পাখির। মনের চোখে ভেসে উঠল ঊষারানীর মায়াময় মুখখানা। অনেক অনেকদিন সে ঊষারানীর কাছে যায়নি। মায়ের মুখে শুনেছে ঊষারানীর অসুস্থতার খবর। আজকাল আর বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না তিনি। কথাবার্তাও বলেন না কারও সঙ্গে। শয্যাশায়ী ঊষারানীর সেবাযত্নের ভার বকুলের ওপর, তাই তার দায়িত্বও বেড়েছে বহুগুণ। হঠাৎ পাখির দু'চোখ জলে ভরে উঠল। বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুত পা চালালো সে। ঘোরের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে পৌঁছে গেল ঊষারানীর বাড়ির দোরগোড়ায়।
প্রতিদিনের মতো আজও লেপ-কম্বল মুড়ি দিয়ে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছেন ঊষারানী। ঘনঘন চোখের পাতাগুলো কাঁপছে তাঁর। বন্ধ চোখের ওপারে ধরা পড়ছে এক ধূসর জগতের ছবি। পৃথিবীর সীমা ছাড়িয়ে জেগে থাকা সেই জগতের গা ঘেঁষে বয়ে চলেছে এক স্রোতহীন নদীর ধারা। তার পাড়ে বাঁধা আছে একটা ছোট্টো ছই দেওয়া নৌকা। হাওয়ার দাপটে কাঁপছে নৌকোটা। সেই নৌকোর ভেতর বসে আছে একজন পনেরো, কুড়ি বছরের ছেলে। তার মুখে হালকা দাঁড়ি-গোঁফের রেখা। মোহময় দুটো চোখ মিলে দেবেন্দ্র তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। একটু একটু করে এগিয়ে চলেছেন ঊষারানী। অবাক হয়ে তিনি দেখছেন নৌকোটাকে। দেবেন্দ্র অপেক্ষা করছেন ঊষারানীর জন্যে। তিনি সওয়ার হলেই তাঁকে নিয়ে কুয়াশাঢাকা আবছায়া নদী পথে রওনা হবে নৌকো।
পাখি ঘরে ঢুকে দেখল বকুল, জয়শীলা, রাঘবেন্দ্ররা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ঊষারানীর দিকে। বকুলের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই সে ফিসফিস করে বলল, কাল থেকে খাওয়া দাওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করেছে। সকাল থেকে অনেকবার ডাকাডাকি করেও সাড়া পাইনি।
বকুলের মুখ থেকে কথাগুলো শুনে পাখির মনটা বিষাদে ভরে উঠল। তবে কী দিদা আর...
সে কিছু বলার আগেই বকুল আবার গলা নামিয়ে বলল, ডাক্তারবাবু এসেছিলেন। সব দেখে শুনে তিনি জবাব দিয়ে গিয়েছেন। বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে বড়মা। শুধু প্রাণের স্পন্দনটুকু রয়ে গিয়েছে। ডাক্তারবাবু বলেছেন আর হয়তো কয়েক ঘন্টা...
কথা বলতে বলতে গলা ধরে এল বকুলের। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে। পাখি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল ঊষারানীর সামনে। সকলের অলক্ষ্যে স্পর্শ করল তাঁর হাতের আঙুলগুলো। একটু যেন কেঁপে উঠলেন ঊষারানী। তিনি তখন অলীক স্বপ্নে মশগুল। ধীর পায়ে চলতে চলতে পৌঁছে গিয়েছেন নৌকোর খুব কাছে। দেবেন্দ্র হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তাঁর দিকে। একবার পেছন ফিরে চাইলেন ঊষারানী। তারপর দেবেন্দ্রর হাত ধরে উঠে পড়লেন নৌকোয়।
একটা জোরালো শ্বাস বেরিয়ে এল ঊষারানীর বুকের ভেতর থেকে, সেই সঙ্গে পাখির হাতের আঙুলগুলোও চেপে ধরলেন সর্বশক্তি দিয়ে। একটু একটু করে শীতল হতে থাকল স্পর্শ। পাখি হতভম্বের মতো চেয়ে আছে ঊষারানীর দিকে। তাঁর চোখের মণি স্হির হয়ে রয়েছে। থেমে গিয়েছে বুকের ওঠানামাও। রাঘবেন্দ্র এগিয়ে এসে ঊষারানীর নাকের কাছে হাত রেখে শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে কিনা পরীক্ষা করে দেখল। তারপর মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। ‘মা’ বলে বুকফাটা আর্তনাদ করে উঠল জয়শীলা। বকুল দৌড়ে ঘরে ঢুকে কান্নায় ভেঙে পড়ল। শুধু স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল পাখি। ঊষারানীর কঠিন, শীতল মুঠোয় ধরা হাত অনেক কষ্টে টেনে বের করে আনল সে। পাখির চোখের সামনে তার প্রিয় দিদা তলিয়ে গেল চিরনিদ্রায়। প্রথম এতো কাছ থেকে পাখি কোনও মৃত্যু দেখল। দিঘির মতো শান্ত ঊষারানীর দু’চোখের দিকে তাকিয়ে পাখির বুক ঠেলে আকুল কান্না বেরিয়ে এল।
সূর্য একটু একটু করে পশ্চিমের দিকে ঢলে পড়েছে। দিকচক্রবালে লেগেছে লালিমার ছোঁয়া। ঊষারানীকে নিয়ে নোঙর খুলে অনন্তের পথে নৌকো পাড়ি দিয়েছে। নৌকোয় বসে প্রসন্ন দৃষ্টিতে ঊষারানী দেখছেন পরিজনদের কাঁধে চেপে তাঁর অন্তিম যাত্রার দৃশ্য। বাতাসে ভাসছে ধূপের গন্ধ। উদাত্ত কন্ঠে হরি ধ্বনি দিচ্ছে পাড়ার ছেলের দল।
আবহমানকাল ধরে ইতিহাসের পারম্পরিক ধারা একইভাবে বহমান। সময় গড়িয়ে যায় নিজের নিয়মে। দিন গড়িয়ে রাত হয়। রাতের শেষে আসে ভোর। রক্তমাংসে গড়া মানুষের নশ্বর শরীরও ছাই হয়ে ধুলোয় মিশে যায় একদিন। রয়ে যায় কেবল ফুরিয়ে যাওয়া সময় আর হারিয়ে যাওয়া মানুষের ইতিবৃত্য। তার মধ্যে কিছু কিছু স্মৃতিকথা লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে উত্তর প্রজন্মের জন্য আবার কত কত ঘটনা মহাকালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায় চিরকালের মতো। অন্তহীন আকাশের নীচে শুধু জেগে থাকে বর্তমানের জীবনধারা। সমকালীন সমাজের প্রতিনিধি হয়ে স্বয়ংদ্যুতি, ইন্দ্রায়ুধ,পাখি, ভিক্টরের মতো চরিত্ররা খুঁজে ফেরে নিজেদের ভাল থাকার রসদটুকু।
(সমাপ্ত)
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴