তোর্সার ঘরবাড়ি-২৫
তোর্সার ঘর বাড়ি//পঞ্চবিংশ পর্ব(শেষ )
মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস
------------------------------------------------------
'মাটির ভিটা ইটের প্রাকার বাইন্ ধি লি মন/ নদীর বাঁধের সড়ক ধইর্যা কইন্যা হইল ধন/ নৌকার হাল আইন্ ল চাঁদ দুহাত ভইর্যা মন/ ঐ যায় রে আলো ছায়ায় ঐ যায় রে কন্.....'
বুকের ভিতর হু হু টান। ভরা বর্ষার উথাল পাথাল নদী। টানা বৃষ্টিতে তোর্সা, সঙ্কোশ, মানসাই, কালজানিতে হলুদ সঙ্কেত। চরুয়া জীবনের হা হুতাশ তখনও যেমন এখনও তেমন। মিনি ফিরে যাবে আগামী মাসে। মানে বর্ষার উপান্তে। জুলাই আগষ্টেই সমস্ত পোষ্টের জয়েনিং বদলি এসব হয় সাধারণত।অফিশিয়াল অর্ডার বের হয়। অফিস থেকে জানিয়ে দিয়েছে। তিনবছরের বেশি এক কলেজে থাকার কথা না। সন্ধের দিকে আজ বৃষ্টি খানিকটা ধরেছে। সাগরদীঘির পাড় ধরে ফেরার পথে আজ টই টম্বুর দীঘি আর থির থির কাঁপন জলে বুক কেমন করে। কলেজে আজ সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া পর্ব ছিল। ক্যাটারিং এর ছেলেটার মুখে কার আদল খোঁজে প্রজ্ঞা ম্যাডাম। বহুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আর পারে না।
-তোমার নাম?- শুভাশিস ঘোষ।
-বাড়ি? - পাটাকুড়া।
- আরে! তুমি কি খোকন কাকুর...
বলতে হয় না।-হ্যাঁ। উনি আমার বাবা। আমি তো মার চাকরিটাই পেয়েছি। ট্রান্সপোর্টে আছি। সঙ্গে আমার স্ত্রীর 'বৈশাখি' ক্যাটারিং। সামলাই অবসরে। টোটাল রান্না ওই করে। মাসীও আছে।
- বা: বেশ বেশ। চোখের সামনে তখন প্রজ্ঞার ছোট্টবেলার মিনি জেগে ওঠে। ট্রান্সপোর্ট নাট্যমঞ্চ। অতসী পিসি, বাবা অভিজিত এমনকি মিত্র বাড়ির ছোট বৌও নাটক করছে তখন। একের পর এক। রিহার্সাল ঘর, আর মঞ্চের হাত ধরে মানুষ চিনেছিল মিনি। সেই অতসী পিসির ছেলের মুখে অবিকল বসে আছে খোকন কাকুর মুখ। মনটা ভাল হয়ে যায়। অন্বেষণ তো সেই এ শহরে পা দেওয়া থেকেই। প্রিয় মানুষের স্মৃতি নিয়ে আজ সন্ধে পর্যন্ত। বিকেল বা সকালের পুবের আকাশ অথবা উত্তরের দিকে তাকালে এখন আর রাজবাড়ির গম্বুজ চোখে পড়েনা। সাতমহলা ঘরবাড়ি আর নানা বিল্ডিং এ ঢেকে গেছে আকাশ। যেমন মদনমোহন বাড়ির একক গম্বুজ আকাশে আর একা নেই, ঠিক তেমনি রাজবাড়ির উঁচু মাথাও শহরের যেকোন প্রান্ত, দূর দূরান্ত থেকে আর নজরে আসেনা। তবু আছে, থাকবে চিরদিন। চলে যেতে হয় মানুষের ই। নগর শহর ভালোবেসে। অন্বেষণ জারি থাকে মনে মনে।
* * *
বিছানায় ব্যাগগুলো ছুঁড়ে দিয়ে ছোট হ্যান্ড ব্যাগ নিয়ে সেই বাঁধানো পাকা রাস্তা ধরে বাঁধে ওঠে মিনি। পা দুটো ভার হয়ে আসছে। তবু উঠতেই হবে। চরুয়ার মুখে লেখা আছে বন্ধুত্বের ইতিহাস। 'শুনশুনি' বাজারের দিকে হাঁটে সে। টাকাগাছের পথ এটা। কত যে দোকান, কত আনাজ, কত নদীয়ালি মাছের ভীড় থাকে সেখানে। ফলের দোকান, চা এর দোকান, জামাকাপড়ের দোকান ও বাদ পড়েনা চর এলাকার মানুষের প্রয়োজনে। চেনা অচেনা মুখ শুধু খুঁজেই যাওয়া সারাজীবন ধরে। ফেরার পালা এলে মনে হয় কেন দেখা হল না! ছায়াটুকু তো ছড়ানো থাকবে প্রজন্মান্তরের ইতিহাসে। তাও থাকেনা। শুনশুনি বাজারের দিকে যেতে গিয়ে থমকে তাকায় মিনি নদীর দিকে। সেই কাঠি গেড়ে জল মাপার কথা মনের ভিতর ফিরে আসে।...সেইযে হারানো বান্ধবী প্রেমিকের হাত ধরে ছুটেছিল অন্য পাড়ে উঠবে বলে...সে চর নেই জল শুধু জল। কোথায় বাঁশের সাঁকো! কোথায় কি! মাসান মন্দিরের গা ঘেঁষে জলের দাপটে দুলছে ভাঙা সাঁকো। বৃষ্টি ধরেছে তাই ঐ সাঁকোর উপর দিয়েই মানুষ জনের যাতায়াতের চেষ্টা। অন্যদিকে বড় বড় বাঁশ বাঁধা জাল বানিয়ে নিয়েছে চরের মানুষ। বহু মহিলা কোমর বেঁধে জাল হাতে মাছ ধরতে লেগেছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে মিনি, এভাবেই কি চরের ইতিহাস বদলে যায়! মানুষের অবস্থা, দারিদ্র এক ই থাকে। বাঁধের অন্যদিকের রাস্তার মানুষের মুখ ও শুকনো। নদী যদি ফুঁসে ওঠে! শহর ভাসিয়ে দেয়! এতখানি নিষ্ঠুর হবে কি নদী, লোকজন চর থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে নিয়েছে। বাঁধের উপর পাকা রাস্তায় সর্বস্ব নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল বৃষ্টি মাথায় করেও। কোন কোন জায়গায় সাহায্যকারী বন্ধু ত্রিপল টাঙিয়ে দিয়ে গেছে।শুকনো খাবার দিয়েছে। বাচ্চাগুলোর মাথায় মায়েদের আধশুকনো আঁচল। উপরে টিনঘেরা চায়ের দোকানে জটলায় বসে আছে কেউ। বৃষ্টি ধরলে কি হবে! ঘরের ভিতর যাবতীয় প্রয়োজন জলে ভেসে গেছে অথবা পলি ঢুকে জমে আছে। মাইকে প্রচার করা হচ্ছে, লাল সংকেত কোনদিকে। শুনশুনি বাজারের রমরমে আওয়াজ আজ কুপির আলোয় টিম টিম করছে। জলের ধারে কচুরীপানার মুহুর্মুহু ভেসে যাওয়া আর পাশের মাটির খন্ডের উপর ভেজা হাফপ্যান্টে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা আর ঘনারাম কখন যেন এক হয়ে যায়। ব্যাগের ভিতর বিস্কুটের প্যাকেট দিতে ইচ্ছে করে মিনির। চোখ জ্বালা করে ওর।...মুহূর্তের মধ্যে সে ছেলে কোথায় উধাও। ভেজা পলির উপর বসে কেউ জাল বানাচ্ছে। অগাধ জলে মাছ ধরবে বলে। নদীতে পাক খেয়ে উঠছে ফুলে ওঠা জল। জলবন্দী মানুষ সারারাত জেগেছে দু তিন দিন ধরে। যেটুকু বাঁচানো যায়, সেটুকুই সহায় তাদের। উত্তরের সর্বত্র বৃষ্টি আর বৃষ্টি। ভুটান পাহাড়ে বৃষ্টি হলে তার উপর ও অনেক কিছু নির্ভর করে।
* * *
ছায়া ছায়া বারান্দায় নিভু নিভু আলোয় তখনও চরের রতু, রঞ্জু, ওচারী, তিত্তিরীর নাতি নাতনী সহ এসে উঠেছে মিত্র বাড়ির বাইরের বড় বারান্দায়। সে ঢালা খিচুরি আর বর্ষা মানুষগুলোর করুণ মুখ সব একই থাকে। পরিবেশ পরিস্থিতি নাটকের কুশীলব বদলে যায়। এ সেই জীবন নাটক, এর নির্দেশক মেঘের আড়ালে থাকেন। দেখা যায়না।...এই যে ছেড়ে যেতে না চাওয়া মন কন্যা বেঁধে রাখতে চায় অবিরল অনর্গল, ছবি হয়ে থাকার মোহ, দৃষ্টি মায়া, মন মোহ যতদিন থাকবে। কতদিন? উত্তর পায়না মিনি নামের মত মানুষেরা। বর্তমানের প্রজ্ঞা পারমিতার অন্তরালে। রাত বাড়তে থাকা নদী গভীরে দূরে কি আলেয়া জ্বলে ওঠে আবার! একসঙ্গে কুকুরের হাহা রব। রাতের কোলে হরিধ্বনির আবছা সুর অনুরণন তোলে। কষ্ট আর মার বুকের গন্ধ আবেশ মাঝবয়সী মাইয়োপিয়ার চশমার আড়াল জলের পর্দায় ঢাকে।
* * *
ঘড়িতে রাত আটটা। কয়েকটা ফোন রিসিভ করতে করতেই নেমে আসছিল অবনীর সঙ্গে মিনি। চায়ের দোকানে আবার দেখা। অবনী বলছিল, পার্থক্যটা তুই ভাল বুঝতে পারবি, আমরা তো এখানে মাটি কামড়েই বুড়ো হয়ে গেলাম। খানিক কুয়োর ব্যাঙ মনে হয় নিজেকে। বাইরে না বেরোলে না কাটালে মাটির সম্পদ আর নাড়ি কাটা যন্ত্রণা কি বোঝা যায়!
- মনে হয় ঠিক ই ভেবেছিস। আমাদের কোন স্থির ভূখন্ড নেই, মালিকানা নেই বলেই 'সব ঠাঁই মোর ঘর আছে, সেই ঘর লব খুঁজিয়া/ দেশে দেশে মোর দেশ আছে...'
- তোর আগামীকাল ট্রেন কটায়?
-ঐ উত্তরবঙ্গে বেরোব। সকালে তিনবছরের জমে ওঠা ব ই পত্র, কয়েকখানা লাগেজ, বাক্স প্যাঁটরা ড্রাইভার নিয়ে চলে যাবে। গুরুত্বপূর্ন কিছু আমি নেব, আর রেখেও যাব কিছু। ফিরতে তো হবে, ফাইনালি কাগজ পত্রের জন্য। তারপর বাগডোগরা থেকে একটা ছোট ব্যাগ নিয়ে উড়ান।
- আর মিষ্টার...?
- উনি তো আর এক নদী পাড়ে একা। একা থাকাই ভবিষ্যৎ এখন। নদীর যাবতীয় আবর্জনা ধুয়ে যায় যেমন নির্জন স্রোতে, ঠিক তেমনিই আত্মবীক্ষণ, সমীক্ষা জরুরী একলা নদীর মত। দেখ না, মেয়েকেও বাঁধিনি আমি। ওর পরিচিত গন্ডী, বৃত্ত সব ই কি মিলে যায় মনে মনে! হয়না। সময়ের সঙ্গে সব বদলের গতি আর সেটাই মনুষ্যত্ব।...অবনী হাসে। ওকেও কেমন একা মনে হয়।
- আবার দেখা তো হবেই। এখানকার পাট তো সবে শুরু তোর। সে বুঝেছি। তোর মধ্যে যে চোরা টান মাটির, সেটা দেখি আর অবাক হই।
-চোরা টান নয় রে! প্রকাশ্যেই এ তোর্সার জলের গভীরে নৌকায় ভেসে যেতে পারি চিরদিনের মত। শুধু মাটির নীচে থেকে যাওয়া আমার রু এর সে নাভি কুন্ডলী বুকের মধ্যে বসে থাকে। গাছপালা শাখা মেলেছে সেখানে। হয়তো মার হাতে বোনা জবা গাছে এখন ও লাল ফুল ফোটে অথবা স্থল পদ্ম গাছের গোলাপি আধারের পাশে ঝোপের ভিতর দোয়েল আবার বাসা করেছে খড়কুটোয়, আবার হয়তো কোন হুলো কুড়িয়ে নিয়েছে মরণের ঘরে ডিম ফুটে বেরোনো বাচ্চাদের। দোয়েলের দুর্বল পাখশাট কি হুলোকে জব্দ করতে পারে! ঐ লাঠি হাতে পাহারায় মানুষকেই থাকতে হয়। ওরই নীচে একটু একটু করে মিশে গেছে নাভিমূল...-তোর্সার কন্যার লালিত জীবন কথা। সেও বড় হয়...বার বার।- হ্যাঁ অবনী। শেষবার ঐ জলাধারে মনে মনে স্নান সারলাম। এক ঝলক তাকিয়ে নিলাম কংক্রিট বাঁধের উপর থেকে গাছে ঢাকা আমাদের বাড়িটার দিকে। মনে মনে বাবা মার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলাম জানিস?...মেয়েকে শুধু মেয়ের মতোই রাখতে তো ওঁরা চাননি কোনদিন...সেই অভিমান ই বড় হয়ে থেকে গেল জীবনে আমার। অসম্ভব দৃঢ় ব্যক্তিত্বে জোরদার হয়ে উঠলে তখনই বাবার কথামত এখানেই লাইব্রেরী বানিয়ে থাকার মত দু কামরা কবেই করে নিতাম! মাটির স্বপ্নের আকাশ যেভাবে টেনেছে সেভাবেই চলেছি রে....
- আবার দেখা হবে। আবার শূন্য করে চলে যাবি...
গলার কাছে দলা পাকানো অনুভূতি। অবনীর হেঁটে যাওয়া শরীরটা মিলিয়ে যায় লম্বা রাস্তা ধরে গোলবাগানের দিকে। মিনি শ্লথ হয়ে আসা শরীরটা টেনে আনে কোলাপসিবলের কাছে। চমকে যায়। ছায়া মাখা হালকা আলোয় কে সরিয়ে দিচ্ছে কোলাপসিবল!
মাথার চুলগুলো পাতলা হয়ে এসেছে। উচ্চতা ছ ফুট। সোজা। অন্ধকারেও যে চোখদুটো চিনে নিতে পারে মিনি, সে চোখ পুনুর।...এতগুলো বছর! বুকের ভিতর অভিমানের নদী রক্ত হয়। অনেক আগে হলে উপচে যেত। এখন শক্ত প্রস্তরবৎ শরীর থেকে দুটো কথাই বেরিয়ে আসে
-কি মনে করে?...ও কি ঢোক গিলল!-না, মানে মিলু, অবনীদার ছেলে বলছিল তুই চলে যাচ্ছিস বদলী হয়ে...
-হুম্ এসেওছিলাম তো বদলীতেই। তাতে কি! কোথায় যাই কি করি, এখন তো মুক্ত স্বাধীন জল ময়ূর।' ফিজেন টেইলড্ জেকানা...চল্ উপরে, অনেকদিন পর দেখা যখন হল.. কথা বলবি চল্।
পুনু নি:শব্দে মিনিকে দোতলা পর্যন্ত অনুসরণ করে। চাবি খুঁজে বের করে জল ভরা ঝাপসা চোখ। বসার ঘরে চেয়ার টেনে নেয় পুনু।
- শোন্ দি ভাই, এই কাগজটা দেখ। পিছনে নারকেল গাছ আর জবাগাছের ঘেরায় তোর ঘরটা তেমনি আছে... ওটা সহ সমান উঠোন তুই নে। নিষেধ করিস না।
- কেন রে হঠাৎ!!...ঐ ঘর তো আমারই এখনো। তুই ফিরিয়ে দিবি কি?...ও থাক অমনিই থাক। মার লাগানো নিমগাছটা কেটে ফেলিস না যেন। ওর পাশেই রোহিনীর নাভিমূল মাটির নীচে। তোর্সার জল অকূল দরিয়ার মতো সূক্ষ্ম ছবির নৌকোর সুতো গেঁথে দিয়েছে তোর আর আমার মাঝখানে, সে সরায় কার সাধ্য!!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴