সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
103.চায়ের নিলাম ব্যবস্থার বিধি সরলীকরণ হোক/গৌতম চক্রবর্তী

103.চায়ের নিলাম ব্যবস্থার বিধি সরলীকরণ হোক/গৌতম চক্রবর্তী

102.এখনো মনে দোলা দেয় চা বলয়ের ফুটবল খেলা/গৌতম চক্রবর্তী

102.এখনো মনে দোলা দেয় চা বলয়ের ফুটবল খেলা/গৌতম চক্রবর্তী

101.বাগিচার প্রান্তিক জনপদগুলির সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা/গৌতম চক্রবর্তী

101.বাগিচার প্রান্তিক জনপদগুলির সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা/গৌতম চক্রবর্তী

100.আদিবাসী জনজীবনের সংস্কৃতিচর্চা (দ্বিতীয় পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী

100.আদিবাসী জনজীবনের সংস্কৃতিচর্চা (দ্বিতীয় পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী

99.আদিবাসী জনজীবনের সংস্কৃতি চর্চা (প্রথম পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী

99.আদিবাসী জনজীবনের সংস্কৃতি চর্চা (প্রথম পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী

98.চা বাগিচাতে গ্রুপ হাসপাতাল একান্তই জরুরি/গৌতম চক্রবর্তী

98.চা বাগিচাতে গ্রুপ হাসপাতাল একান্তই জরুরি/গৌতম চক্রবর্তী

28-October,2024 - Monday ✍️ By- গৌতম চক্রবর্তী 1.19K

চা বাগিচাতে গ্রুপ হাসপাতাল একান্তই জরুরি/গৌতম চক্রবর্তী

চা বাগিচাতে গ্রুপ হাসপাতাল একান্তই জরুরি
গৌতম চক্রবর্তী

সেবার গিয়েছিলাম নাগরাকাটা সার্কিটে ফিল্ড ওয়ার্কে। গাঠিয়া চা বাগানের দুই নম্বর কুলি লাইনের শ্রমিক বস্তি। সেখানেই পেয়েছিলাম বাগানের বাসিন্দা অবন্তী ওরাওকে। আর্থিক সংকটের জেরে চর্মরোগের চিকিৎসা করাতে পারে নি অবন্তী। অবন্তীর কুড়ি বছর বয়স হলেও রোগের জন্য মনে হয় দশ বছর বয়স। সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে এই রোগ। বাগানের দুই নম্বর শ্রমিক বস্তির বাড়িতে শুধু বাবা রতিয়া ওরাও। তিনি চা বাগানের চা শ্রমিক। সকাল হলেই তিনি কাজে বেরিয়ে যান। রতিয়া রান্না করতে পারলে অবন্তীর খাবার জোটে। না হলে জলই ভরসা। চর্মরোগে আক্রান্ত বছর কুড়ির ওই তরুণীকে চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন পুরোপুরি নিরাময় সম্ভব না হলেও চিকিৎসা করালে নিয়ন্ত্রণে থাকে এই রোগ। কিন্তু টাকা না থাকার ফলে নিয়মিত সেই চিকিৎসা করাতে পারেন নি তার বাবা রতিয়া ওরাও। দিন আনি দিন খাই পরিবারটি সকলের কাছে সাহায্যের আর্জি জানিয়েছিল। বাড়ির উঠোনে বসে অবন্তী জানিয়েছিল যে সে ভালো হতে চায়। কেন যে এরকম হলো তা ভগবানই জানেন। অবন্তীর বাবা রতিয়া আগে অবন্তীকে ওর দিদির বাড়িতে রেখে দিয়েছিলেন। ওদেরও অভাবের সংসার। তার পক্ষেও চিকিৎসার খরচ জোগানো সম্ভব নয়। কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে না এলে এ রোগের চিকিৎসা সম্ভব নয়। শেষ যখন দেখেছিলাম শারীরিকভাবে দূর্বল হয়ে পড়ছিল অবন্তী। বাগানে কর্মরত সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীরা চিকিৎসক দেখানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। চিকিৎসক বেশ কিছু পরীক্ষার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু ওইসব পরীক্ষা বাগানে সম্ভব নয় বলে সেই সব পরীক্ষা আর করা হয়ে ওঠেনি। বাগানের উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের স্বাস্থ্যকর্মী সোনালী সামন্ত জানিয়েছিলেন পরিবার্টির আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ। তাই অবন্তীর জন্যে খুবই দুঃখ হয় তাদের। নাগরাকাটা হাসপাতালের এক চিকিৎসক জানিয়েছিলেন যেহেতু রোগটি দুরারোগ্য তাই ধারাবাহিক চিকিৎসা করা হলে তবেই রোগটি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। দুরারোগ্য চর্মরোগে আক্রান্ত অবন্তীর মতো অসহায়রা চা বাগিচার কোণে কোনে। তাদের পাশে দাঁড়াবে কে?

ডুয়ার্সের চা-বাগিচা অঞ্চল অনেকগুলো সাবডিস্ট্রিক্টে বিভক্ত ছিল। দলগাঁও, বিন্নাগুড়ি, নাগরাকাটা, চালসা, ডামডিম, ওদলাবাড়ি, কালচিনি ইত্যাদি। প্রতিটি সাবডিস্ট্রিক্টে একজন করে বড় ডিগ্রিধারী চিকিৎসক থাকতেন। এমআরসিপি কিংবা এফআরসিএস। তাঁরা বসতেন সেন্ট্রাল হসপিটালে। সঙ্গে থাকতেন একজন করে প্যাথোলজিস্ট। এই সেন্ট্রাল হসপিটালেই এই সব চিকিৎসকের অধীনস্থ সমস্ত বাগানের রোগীদের প্যাথোলজিকাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হত অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে। এই এমআরসিপি কিংবা এফআরসিএস চিকিৎসকদের অনেকেই ছিলেন রয়্যাল কলেজ অব ফিজিসিয়ান/সার্জারির সদস্য। তাঁদের বলা হত ডাক্তার সাহেব। এই ডাক্তার সাহেবরা সপ্তাহে একদিন ‘রোটেশন’-ভিত্তিতে বিভিন্ন বাগানে যেতেন। তখন বাগানের ইউরোপীয় উচ্চ পদাধিকারীরা যেমন চিকিৎসা পরিষেবা এঁদের কাছ থেকে পেতেন, তেমনই চিকিৎসা পেতেন বাবু ও শ্রমিক শ্রেণিও। চা-বাগানেই পর্যাপ্ত ওষুধপত্র মিলত। বছর শেষে ডিসেম্বর মাসেই কম্পাউন্ডার সারা বছরের ওষুধের রিকুইজিশন হেড অফিসে পাঠিয়ে দিতেন। বিরাট প্যাকিং বাক্স করে জানুয়ারি মাসেই চলে আসত সে সব ওষুধ। সে সময় চা-বাগান থেকে রোগী রেফার করার ব্যাপারই ছিল না। চা-বাগানেই সব ধরনের চিকিৎসা হত। এমনকি, ছোটখাটো সার্জারিও। কোয়ার্টারে ডাকলেও ডাক্তারকে আলাদা ‘ভিজিট’ দিতে হত না। মাঝে মাঝে ক্যাম্প হত, বাচ্চাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার, মায়েদের জন্যও। কোনও শ্রমিক অসুস্থ হয়ে কাজে যেতে না পারলেও তাঁর পুরো বেতন কাটা হত না। দিনের মজুরির দুই-তৃতীয়াংশ তিনি পেতেন। ছয়ের দশকে সেন্ট্রাল হসপিটাল বন্ধ হয়ে গেল। বহু বাগানের ডাক্তারদের কোয়ার্টার উঠে গেল বা অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারদের কোয়ার্টার হয়ে গেল। অবসর নিলে ডাক্তার আর কম্পাউন্ডারের শূন্য পদে আর নিয়োগ হল না অনেক ক্ষেত্রেই। বাগান দেশীয় শিল্পপতিদের হাতে যাওয়ার পরে চিকিৎসার হাল অনেকটাই শেষ হয়ে গেল। বন্ধ হতে লাগল অনেক হাসপাতাল। ওযুধের সরবরাহ বিঘ্নিত হল। এখন চা-বাগানে পর্যাপ্ত ওযুধ সব ক্ষেত্রে মেলে না। চিকিৎসক নেই অনেক বাগানেই। সেই সুযোগে হাতুড়ে-সংস্কৃতি ফের মাথা চাড়া দিয়েছে।

উত্তর বাংলার অর্থনীতির স্তম্ভ হল চা বাগান। নানাবিধ কারণে আর্থিক দিক থেকে কমজোরি চা বাগিচাগুলি হয় বন্ধ অথবা রুগ্ন অবস্থায় ধুঁকতে ধুকতে চলছে। বাগিচাগুলিতে প্রতিবছর বহু মানুষ অপুষ্টি এবং চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করে। মজুরি চুক্তি এখনো পর্যন্ত কার্যকর হয় নি। মালিকপক্ষের নেতিবাচক মানসিকতার শিকার চা বাগিচার মজুরেরা। উত্তরের অর্থনীতির এই সংকটকাল নতুন প্রজন্মের হাতে জীবন ধারণের জন্য যথেষ্ট কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে পারেনি বলে উত্তরের চা বাগিচাগুলি থেকে হাজার হাজার মানুষ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের শহরগুলিতে জীবিকার খোঁজে পাড়ি দিচ্ছে। উত্তরবঙ্গে এমন কোন চা বাগিচা নেই যেখানে বিবাহিতা স্ত্রী অথবা মা এবং সন্তানদের বাড়িতে একা ফেলে রেখে পুরুষ শ্রমিক ভিনরাজ্যে কাজের সন্ধানে যান নি। করোনার সময় উত্তরবঙ্গের গ্রামগুলি যখন ভিনরাজ্য থেকে বাড়িতে ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকে ভরে গিয়েছিল তখন অনেকেই ভয় পেয়েছিল যে এই শ্রমিকেরা কেরালা বা মহারাষ্ট্রের মত উচ্চ করোনা সংক্রমিত রাজ্য থেকে ফিরে এসেছে বলে এরা গ্রামগুলিতে সংক্রমণের হার অনেক বাড়িয়ে তুলতে পারে। এই পরিযায়ী শ্রমিকদের পরীক্ষা করার মত পরিকাঠামো উত্তরের জেলাগুলোতে ছিল না। উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজে যে করোনা পরীক্ষার পরিকাঠামো তৈরি হয়েছিল সেটা আটটা জেলার জন্য ছিল অপর্যাপ্ত। আর যতই গলাবাজি করুক না কেন রাজ্য সরকার বা রাজ্য সরকার নিযুক্ত তথাকথিত বিশেষজ্ঞ দল, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের পাঠানো পরিদর্শক দল করোনা সংক্রমণে আক্রান্ত রোগীদের  চিকিৎসা ব্যবস্থার গাফিলতির ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের নেতিবাচক মনোভাব এবং তথ্য গোপন করার মানসিকতাকে যে উলঙ্গ করে দিয়ে গিয়েছিল সেটা তো জলের মতোই পরিষ্কার। তারপরে তিস্তা, তোর্সা, মহানন্দা, বালাসন দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে।

মনে পড়ে দেবপাড়া বাগানের চা শ্রমিকদের কল্যাণকর ব্যবস্থা দেখে ব্রিটিশ সরকার নিযুক্ত স্বাস্থ্য কমিশন খুবই সন্তোষ প্রকাশ করে। ১৯২২ সালের দিকে বাঙালি উদ্যোগের বাগানগুলির শ্রমিক কর্মচারীদের সুচিকিৎসার জন্য আইটিপিএ থেকে দুজন এমবিবিএস ডাক্তারকে গ্রুপ মেডিক্যাল অফিসার হিসাবে নিয়োগ করা হয়। একজনের হেড অফিস দেবপাড়া বাগানে এবং অন্য জনের হেড অফিস গোপালপুর বাগানে করা হয়। গ্রুপ মেডিক্যাল অফিসারদের কাজ ছিল গ্রুপ এর অধীনে বাগানগুলির শ্রমিক কর্মচারীদের সুচিকিৎসা সুনিশ্চিত করা এবং বাগানগুলির চিকিৎসা এবং গণ স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ব্যবস্থার উন্নতি বিধান করা। ২০১৩ সাল। মমতা সরকারের প্রথম দফার শ্রমমন্ত্রী তখন ছিলেন পূর্ণেন্দু বসু। পাহাড় থেকে ডুয়ার্স পর্যন্ত উত্তরবঙ্গের প্রতিটি চা বাগান ধরে ধরে বিশেষজ্ঞ দল তৈরি করে পরিকাঠামোগত সমীক্ষা করেছিল রাজ্য শ্রমদপ্তর। সমীক্ষার নির্যাস হিসাবে চা শিল্পের উন্নতি এবং শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য দশ দফা সুপারিশ করেছিল শ্রমদপ্তর। সেই সুপারিশগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল বাগানের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন। সেক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি বাগানের জন্য একটি করে গ্রুপ হাসপাতাল তৈরীর কথা বলা হয়েছিল। পাশাপাশি চা বলয়ের প্রতিটি মহকুমায় একটি করে সেন্ট্রাল হাসপাতাল তৈরির সুপারিশও করেছিল রাজ্য শ্রম দপ্তর। সেই সুপারিশের কথা রাজ্য সরকারের পাশাপাশি টি বোর্ডকেও জানানো হয়েছিল। সরকারি সেই সমীক্ষায় চা বাগানগুলির স্বাস্থ্য কাঠামোর কঙ্কালসার চেহারা প্রকাশ্যে এসেছিল বলে সেই কারণেই গ্রুপ হাসপাতাল তৈরিতে গুরুত্ব দিতে বলেছিলেন সমীক্ষকরা। উত্তরবঙ্গে সেইসময় নথিভূক্ত চা বাগিচার সংখ্যা ছিল ২৭৬ টি। রাজ্য শ্রম দপ্তর ৩২ টি গ্রুপ হাসপাতাল এবং সাতটি সেন্ট্রাল গ্রুপ হাসপাতাল তৈরির সুপারিশ করেছিল। কোন কোন চা বাগানের জন্য কোথায় কোথায় হাসপাতাল তৈরি হবে, পরিচালনার জন্য অর্থের যোগান কোথা থেকে আসবে সেটাও স্পষ্ট করে সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু উত্তরবঙ্গের কয়েক লক্ষ চা শ্রমিকের উন্নয়নে শ্রমদপ্তরের এই সুপারিশ আজও কার্যকর হয়নি। বছরের পর বছর ধরে ফাইলবন্দী হয়ে পড়ে রয়েছে এই সমস্ত সুপারিশগুলি। 

জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালটির সম্প্রসারণ এবং জনসাধারণের চিকিৎসার উপযুক্ত করে তোলেন শহরের চা শিল্পপতিগণ। অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন শশী কুমার নিয়োগী। উনি হাসপাতালের প্রথম অবৈতনিক অধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। তৎকালীন ব্রিটিশ ডেপুটি কমিশনারের সহায়তায় উনি ইউরোপিয়ান প্ল্যান্টার্সদের কাছেও হাসপাতাল সম্প্রসারণের জন্য আর্থিক সহায়তা পেয়েছিলেন। পুরুষ এবং মহিলা রোগীদের জন্য আলাদা চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং হাসপাতালে ভর্তির জন্য আলাদা আলাদা ওয়ার্ড করে দেন। ১৯২১ সালে বাংলার গভর্নর লর্ড রোনাল্ডশে গোপালপুর বাগানে আসেন। ঐ আসরে ইংরেজ প্ল্যান্টারদের মধ্যে কয়েকজন নাম করা সাহেবও আমন্ত্রিত ছিলেন। ঐ আসরে যোগেশ ঘোষ জলপাইগুড়িতে একটি মেডিক্যাল স্কুল স্থাপনের প্রস্তাব রাখেন এবং বাঙালি চা শিল্পপতিদের তরফে সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দেন। পরিকল্পনা এবং তদবিরের জোরে ১৯৩০ সালে জলপাইগুড়িতে জ্যাকসন মেডিক্যাল স্কুল স্থাপিত হয়। এটা বাঙালি চা শিল্পপতিদের একটা মহৎ কাজ ছিল। আর সাম্প্রতিককালে? ডুয়ার্সের চা বলয়ে শতকরা ৮০ শতাংশই অপুষ্টিতে আক্রান্ত। এর মধ্যে মাল, মেটেলি, নাগরাকাটায় অপুষ্টির হার সবচেয়ে বেশি। চা বাগিচায় অপুষ্টির হার সর্বাধিক। আলিপুরদুয়ার এবং জলপাইগুড়ি জেলার চা বাগানগুলিতে অপুষ্টিতে আক্রান্ত মা এবং শিশুর সংখ্যা বেশি। ২০২০ সালে প্রতিচী ইনস্টিটিউটের একটি সমীক্ষার প্রাথমিক রিপোর্ট প্রকাশ করেছিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। সেই রিপোর্টে দেখা গেছে আদিবাসী শিশুদের একটা বড় অংশ খাদ্য সংকটে ভুগছে। সরকার যতই অস্বীকার করুক জলপাইগুড়ি জেলা স্বাস্থ্য দপ্তরের রিপোর্টেও উঠে এসেছিল সেই একই তথ্য। প্রতিচী ইনস্টিটিউটের ডুয়ার্সের প্রতিনিধির কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম স্বাস্থ্য দপ্তর মাত্রাতিরিক্ত অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের কথা যা বলেছে বাস্তবে সংখ্যাটা এর চেয়ে অনেক অনেক বেশি।

বেরিয়ে পড়েছিলাম চা বাগিচাগুলিতে খোঁজখবর নিতে। জানা গেল নবজাতকদের দেহের ওজন যেখানে কয়েক মাসের মধ্যে আড়াই থেকে সাড়ে তিন কেজি হবার কথা সেখানে চা বলয়ে শিশুদের ওজন বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেড় থেকে দু কেজি হচ্ছে। শিশুর সঙ্গে মায়ের দেহেও রক্তাল্পতা দেখা যাচ্ছে। বহু ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই বিয়ে হওয়া নারী অপুষ্ট শিশুসন্তান প্রসব করছে। খোঁজখবর নিয়ে জানলাম পুষ্টিকর খাবার খেতে না পাওয়ার ফলে মায়ের সঙ্গে শিশুও অপুষ্টিতে ভুগছে। বন্ধ চা বাগানে এই মাত্রাতিরিক্ত অপুষ্টিতে অর্থাৎ অ্যাকিউট ম্যালনিউট্রিশনে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০০ জন। এই তথ্য যখন নিয়েছিলাম তখন জলপাইগুড়ি জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ছিলেন ডাক্তার জগন্নাথ সরকার। তাঁর কাছ থেকে জেনেছিলাম স্বাস্থ্য দপ্তর এবং আইসিডিএস এর করা সমীক্ষা থেকে জেলার ৯৫ টি শিশুকে মাত্রাতিরিক্ত অপুষ্টিতে আক্রান্ত বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তাছাড়া সাধারণ এবং মাঝারি গোছের অপুষ্টিতে আক্রান্তদের নামও ছিল। জেনেছিলাম মূল সমস্যাটা পানীয় জলের। বীরপাড়ার মত এলাকায় পানীয় জলে ডলোমাইট এর মাত্রা এতটাই বেশি যে সেখানে অপুষ্টির পেছনে জল একটা বড় কারণ। রেশন দোকান থেকে শ্রমিকরা শর্করা জাতীয় খাবার সংগ্রহ করে থাকে। আর আইসিডিএস এর সেন্টারগুলো চা বলয়ে খিচুড়ি সেন্টার নামে পরিচিত। কিন্তু দূষিত পানীয় জল তো রান্না থেকে শুরু করে সব কিছুর মধ্য দিয়ে শরীরে ঢুকছে। আলিপুরদুয়ারের ডেপুটি সিএমওএইচ অফিস থেকে জানতে পেরেছিলাম আলিপুরদুয়ার জেলায় অপুষ্টি সংক্রান্ত বিষয়ে সমীক্ষা চালানোর মত কোন পরিকাঠামো তাদের নেই। এই ব্যাপারে তথ্যও নেই তাদের কাছে। নারী এবং শিশু কল্যাণ দফতরের আইসিডিএস এগুলো দেখে। তারা তথ্য দেয়। সেই অনুযায়ী তাঁরা ব্যবস্থা নেন। 


আলিপুরদুয়ার হাসপাতালে পুষ্টি পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে যেখানে ১০ টি বেড রাখা আছে। সবসময় চেষ্টা করা হয় অপুষ্টিতে আক্রান্ত রোগীকে সেই বেডে ভর্তি রাখা। কিন্তু কোথায় কত সংখ্যক অপুষ্টিতে ভুগছে সেটা বলার মত কোন সমীক্ষা তখনো হয়নি। সেরকম পরিকাঠামো সেখানে ছিল না বলে জানিয়েছিলেন ডেপুটি সিএমওএইচ। জলপাইগুড়ির জেলাশাসক যখন শিল্পা গৌড়িসারিয়া ছিলেন তখন মা এবং শিশুর জন্য জেলা প্রশাসন ক্যাম্প করে প্রয়োজনীয় ওষুধ দিয়েছিল। যারা মাত্রাতিরিক্ত অপুষ্টিতে আক্রান্ত তাদের জন্য বিশেষ নজরদারি করার ব্যাবস্থাও ছিল। আলাদা চিকিৎসার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট আইসিডিএস সেন্টার, আশা কর্মী এবং গ্রাম পঞ্চায়েতগুলির রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নেওয়া হয়েছিল। দূষিত জল এবং অপুষ্টিকর খাবার মা এবং শিশুদের অপুষ্টির জন্য প্রাথমিকভাবে দায়ী বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। মূলত জেলার বন্ধ এবং চালু চা বাগানে মেডিকেল ক্যাম্প শুরু করে প্রশাসন। তাই গ্রুপ হাসপাতালের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে যখন চা শ্রমিক সংগঠনগুলো সরব হয়েছে এবং চিকিৎসায় বারবার পরিকাঠামোগত অভাবের অভিযোগ উঠেছে তখন গ্রুপ হাসপাতালগুলি তৈরি হলে উত্তরবঙ্গে সেই সমস্যা অনেকটাই মেটানো সম্ভব হতো বলে মনে করছেন চিকিৎসকদের একাংশ। চা বাগিচায় গ্রুপ হাসপাতালের প্রয়োজনীয়তা সকলেই যখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে তখন সরকারি গাফিলতিতেই যে গ্রুপ হাসপাতালগুলো তৈরি হয়নি সেটা জলের মত পরিষ্কার। তাই শ্রম দপ্তর এর সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে সবাইকে নিয়ে আলোচনা করে দ্রুত চিকিৎসা কাঠামো উন্নয়নে গ্রুপ হাসপাতাল তৈরিতে সার্বিকভাবে সকলের পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং সকলের সকলকে সহযোগিতা করা একান্তই প্রয়োজন। চা বাগিচাগুলিতে চিকিৎসা সংক্রান্ত পরিষেবা প্রদানের ক্ষেত্রে গ্রুপ হাসপাতাল নির্মাণের জন্য যে চুক্তি হয়েছিল তা যদি সেই সময় বাস্তবায়িত হতো তাহলে উত্তরের চা বাগানগুলি নিয়ে এত চিন্তা ভাবনার কোন অবকাশ ছিল না।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri