103.চায়ের নিলাম ব্যবস্থার বিধি সরলীকরণ হোক/গৌতম চক্রবর্তী
102.এখনো মনে দোলা দেয় চা বলয়ের ফুটবল খেলা/গৌতম চক্রবর্তী
101.বাগিচার প্রান্তিক জনপদগুলির সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা/গৌতম চক্রবর্তী
100.আদিবাসী জনজীবনের সংস্কৃতিচর্চা (দ্বিতীয় পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী
99.আদিবাসী জনজীবনের সংস্কৃতি চর্চা (প্রথম পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী
98.চা বাগিচাতে গ্রুপ হাসপাতাল একান্তই জরুরি/গৌতম চক্রবর্তী
97.উত্তরের বাগিচাগুলিতে বিকল্প জ্বালানির স্বপ্ন দেখুক চা শিল্প /গৌতম চক্রবর্তী
96.সমঝোতার শর্তে বোনাস চুক্তি চা বাগিচার চিরায়ত খেলা/গৌতম চক্রবর্তী
95.করম পরবের আঙিনায়/গৌতম চক্রবর্তী
94.জাস্টিসের দাবিতে উত্তরের বাগিচাতেও চলছে লড়াই/গৌতম চক্রবর্তী
93.জাস্টিসের দাবিতে উত্তরের বাগিচাতেও চলছে লড়াই/গৌতম চক্রবর্তী
92.করোনাকালের লকডাউনে ডুয়ার্সের চা বাগিচা-২/গৌতম চক্রবর্তী
91.করোনাকালের লকডাউনে ডুয়ার্সের চা বাগিচা-১/গৌতম চক্রবর্তী
90.বাগিচার ডিজিট্যাল ব্যাঙ্কিং - ফিরে দেখা ( তৃতীয় পর্ব/গৌতম চক্রবর্তী
89. বাগিচার ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং ফিরে দেখা (দ্বিতীয় পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী
88.চা বাগিচার ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং - ফিরে দেখা (প্রথম পর্ব) /গৌতম চক্রবর্তী
87.দেবপাড়া টি গার্ডেন/গৌতম চক্রবর্তী
86.বিন্নাগুড়ি চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
85.লখীপাড়া টি গার্ডেন (দ্বিতীয় পর্ব) /গৌতম চক্রবর্তী
84.লখীপাড়া চা বাগিচা (প্রথম পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী
83.ইকো পর্যটনের সন্ধানে রামশাই টি এস্টেট/গৌতম চক্রবর্তী
82.ইকো পর্যটনের সন্ধানে রামশাই টি এস্টেট/গৌতম চক্রবর্তী
81.তরাই ও ডুয়ার্সে চা পর্যটন বিকশিত হোক/গৌতম চক্রবর্তী
80.ভূমি আইন মেনেই চা শ্রমিকদের পাট্টা প্রদান হোক (তৃতীয় তথা শেষ পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী
79.উত্তরের বাগিচায় পাট্টা এবং চা সুন্দরী প্রকল্প রূপায়নে যথাযথ বিধি মানা প্রয়োজন/গৌতম চক্রবর্তী
78.স্টাফ ও সাব-স্টাফদের বেতন জট আজও কাটল না-২/গৌতম চক্রবর্তী
77.স্টাফ ও সাব-স্টাফদের বেতন জট আজও কাটল না/গৌতম চক্রবর্তী
76.চা বাগিচা (দ্বিতীয় পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী
75.তোতাপাড়া চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
74.হলদিবাড়ি টি গার্ডেন/গৌতম চক্রবর্তী
73.তোতাপাড়া টি গার্ডেন/গৌতম চক্রবর্তী
72.কারবালা টি গার্ডেন/গৌতম চক্রবর্তী
71.আমবাড়ি টি গার্ডেন/গৌতম চক্রবর্তী
70.কাঁঠালগুড়ি চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
69.মোগলকাটা চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
68.রিয়াবাড়ি চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
67.নিউ ডুয়ার্স চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
66.পলাশবাড়ি টি এস্টেট/গৌতম চক্রবর্তী
65.চুনাভাটি চা বাগান/গৌতম চক্রবর্তী
64.চামুর্চি চা বাগিচা (প্রথম পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী
63.বানারহাট চা বাগিচা ( দ্বিতীয় পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী
62.বানারহাট চা বাগিচা ( প্রথম পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী
61.গ্রাসমোড় চা বাগিচা ( দ্বিতীয় পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী
60.চ্যাংমারী চা বাগান (দ্বিতীয় পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী
59.চ্যাংমারী চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
58.ধরণীপুর সুরেন্দ্রনগর (দ্বিতীয় পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী
57.করম পরবের আঙিনায়/গৌতম চক্রবর্তী
56.ডায়না টি গার্ডেন/গৌতম চক্রবর্তী
55.রেডব্যাঙ্ক চা বাগিচা ( দ্বিতীয় পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী
54.রেডব্যাংক টি গার্ডেন (প্রথম পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী
53.ক্যারন টি গার্ডেন ( দ্বিতীয় পর্ব )/গৌতম চক্রবর্তী
52.ক্যারণ টি গার্ডেন/গৌতম চক্রবর্তী
51.লুকসান টি গার্ডেন/গৌতম চক্রবর্তী
50.গ্রাসমোড় চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
49.ঘাটিয়া টি এস্টেট/গৌতম চক্রবর্তী
48.হোপ টি গার্ডেন/গৌতম চক্রবর্তী
47.হোপ টি গার্ডেন/গৌতম চক্রবর্তী
46.হিলা টি এস্টেট (দ্বিতীয় পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী
45.হিলা চা বাগান/গৌতম চক্রবর্তী
44.কুর্তি চা বাগিচা : সবুজের গালিচায় গেরুয়ার রং/গৌতম চক্রবর্তী
43.সাইলি টি গার্ডেন (দ্বিতীয় পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী
42.নয়া সাইলি চা বাগান/গৌতম চক্রবর্তী
41.কুর্তি টি গার্ডেন/গৌতম চক্রবর্তী
40.ভগতপুর চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
39.নাগরাকাটা চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
38.বামনডাঙ্গা তন্ডু চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
37.বাতাবাড়ি চা বাগান/গৌতম চক্রবর্তী
36.বড়দীঘি চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
35.কিলকট এবং নাগেশ্বরী টি গার্ডেন/গৌতম চক্রবর্তী
34.চালসা চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
33.সামসিং চা বাগান ( দ্বিতীয় পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী
32.সামসিং চা বাগান/গৌতম চক্রবর্তী
31.ইনডং চা বাগান/গৌতম চক্রবর্তী
30.চালৌনি চা বাগান /গৌতম চক্রবর্তী
29.মেটেলি টি গার্ডেন
28.আইভিল চা বাগান
27.এঙ্গো চা বাগিচা
26.নেপুচাপুর চা বাগান
25.জুরান্তী চা বাগান/গৌতম চক্রবর্তী
24.সোনগাছি চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
23.রাজা চা বাগান/গৌতম চক্রবর্তী
22.তুনবাড়ি চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
21.রাঙামাটি চা বাগান/গৌতম চক্রবর্তী
20.মীনগ্লাস চা বাগিচা-১/গৌতম চক্রবর্তী
19.সোনালি চা বাগিচা /গৌতম চক্রবর্তী
18.পাহাড়ের প্রান্তদেশে সবুজ গালিচায় ঘেরা এলেনবাড়ি/গৌতম চক্রবর্তী
17.নেওড়ানদী চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
16.নিদামঝোরা টি এস্টেট/গৌতম চক্রবর্তী
15.সাইলি চা বাগিচার সবুজ সমুদ্রে/গৌতম চক্রবর্তী
14.ডেঙ্গুয়াঝাড় চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
13.কুমলাই চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
12.শতবর্ষ অতিক্রান্ত ওয়াশাবাড়ি চা-বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
11.আনন্দপুর চা-বাগান/গৌতম চক্রবর্তী
10.বেতগুড়ি চা বাগান/গৌতম চক্রবর্তী
9.রাণীচেরা চা বাগান/গৌতম চক্রবর্তী
8.রায়পুর চা বাগান/গৌতম চক্রবর্তী
7.করলাভ্যালি চা বাগান/গৌতম চক্রবর্তী
6.মানাবাড়ি টি গার্ডেন/গৌতম চক্রবর্তী
5.পাথরঝোরা চা বাগান/গৌতম চক্রবর্তী
4.গুডরিকসের লিজ রিভার চা বাগানে/গৌতম চক্রবর্তী
3.রেডব্যাঙ্ক চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
2.সরস্বতীপুর চা বাগান-২/গৌতম চক্রবর্তী
1.সরস্বতীপুর চা বাগান/গৌতম চক্রবর্তী
করম পরবের আঙিনায়গৌতম চক্রবর্তীবিশেষ বৃক্ষ, পাথর, ফল, পশুপাখি ও গাছের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে পুজো বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে প্রচলিত আছে। গ্রামগঞ্জে হিন্দুরা তুলসী, বট, পাকুড়, শ্যাওড়া গাছ ঘিরে ব্রত পালনের উৎসব পালন করে যা প্রচলিত আছে যুগ যুগ ধরে। বহু ব্রতোৎসবে গাছকে সেইসব দেবদেবীর সঙ্গে পুজো করা হয়। সব শুভকাজে আম্রপল্লব, কলাবউ এবং ধানের ছড়া পূজিত হয়। আদিম কৃষি ও গ্রামীণ সমাজে পাথর, পশুপাখি পুজোর উপাচার হিসাবে ব্যাবহৃত হয়। খাসিয়া, মুণ্ডা, শবর প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মানুষেরা আজও গাছ, পশুপাখিকে পুজো করে। আদিবাসীরা প্রকৃতির সন্তান। তারা সারাবছরই প্রকৃতির পুজো করে। করম পুজো প্রকৃতির পুজো। ‘করম' উৎসবের সঙ্গে গাছ জড়িয়ে আছে গভীরভাবে। এখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় ধর্ম, সংস্কৃতি আর প্রকৃতি প্রেমের পরম্পরা। করমপুজো এলে উত্তরবঙ্গের আনাচ কানাচে শুরু হয় প্রস্তুতি। ডুয়ার্সের বিভিন্ন আদিবাসী মহল্লা বিশেষ করে চা বলয় করম পুজো উপলক্ষ্যে উৎসবের আমেজে মেতে ওঠে। সারারাত ধরে পুজো হয়। পুজোর পরদিন নদীতে বিসর্জন দেওয়া হয় করম রাজাকে। এই বিসর্জনকে কেন্দ্র করে অনেক জায়গাতে বিসর্জনের ঘাটগুলিতে মেলা বসে। সারারাত ধরে পূজোর অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে নৃত্যগীত চলে। অখিল ভারতীয় আদিবাসী বিকাশ পরিষদের নেতা পিটার মিনজ আমার বন্ধুস্থানীয়। পিটারের আমন্ত্রণে সেবার বানারহাটে সামিল হয়েছিলাম আদিবাসীদের করম উৎসবে। খোপায় অঙ্কুরিত শস্যদানা গুঁজে মাদলের তালে তালে বিসর্জনের মেলায় নেচেছিল পিটারের বোন সোনিয়া, অঞ্জলী, প্রীতিরা। পিটারের বোন অঞ্জলীর কাছ থেকে শুনেছিলাম করম পুজোর আগের রাতে ওরা গোল হয়ে বসে গল্প শোনে ‘দাদির’ মুখে। 'দাদি’র মুখে ওদের ভাষাতে ওদের মত করে ওরা শোনে একসময় ভয়াবহ আগুনে ছারখার হয়ে গিয়েছিল গোটা পৃথিবী। শুধুমাত্র নিজের কোটরে একজোড়া যুবক-যুবতিকে লুকিয়ে রেখে সৃষ্টি রক্ষা করেছিল করম গাছ। করলা ভ্যালি চা বাগানেই প্রথম দেখতে গিয়েছিলাম করম পূজোর উৎসবের আয়োজন। এই বাগানের কুলি লাইনে থাকত সোনম লাকড়া। সরল সাদাসিধে এই চা শ্রমিক পরিবার বাগানের পাশেই হোলি চাইল্ডের চার্চে খ্রীষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল। সোনমের পরিবারের সঙ্গে আমার খুব খাতির ছিল। সোনমের কাছ থেকে জেনেছিলাম উপবাস ব্রত পালন থেকে অনেক রীতি মেনে চলতে হয় করম পুজোয়। সোনমের ছেলে পিঙ্কু এসি কলেজে পড়ত। হাসিখুশী, প্রাণবন্ত যুবক। সেবার পিঙ্কু করম পুজো দেখার আমন্ত্রণ জানাল তার বাড়িতে। সকাল সকাল চলে গেলাম। এর আগে আদিবাসীদের অন্যতম এই উৎসব কোনদিন দেখিনি বলে একটা আলাদা উচ্ছ্বাস তো ছিলই। সকাল থেকে উপোস করে বিভিন্ন ধরণের নিয়ম পালন করল পিঙ্কুরা। অনুপা তিরকি, মিনা কেরকেট্টা এবং কুন্চিয়া কেরকাট্টা পিঙ্কুদের বাড়ির পাশেই থাকে। জানতাম অনুপার সঙ্গে পিঙ্কুর মন দেওয়া নেওয়ার পালা চলছিল অনেকদিন থেকেই। অনুপা মোহিতনগর স্কুলে দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ে। সূর্য ডোবার আগেই পিঙ্কুদের সঙ্গে রওনা হলাম রায়পুর চা বাগানে। সূর্য ডোবার পর রায়পুর চা বাগান থেকে কেটে আনা হল করমের ডাল। ডাল কাটার ক্ষেত্রে পিঙ্কুকে সহায়তা করল অনুপা, মিনা আর কুন্চিয়ারা। অতি সন্তর্পণে রায়পুর চা বাগান থেকে অত্যন্ত যত্নে করম গাছের ডালটিকে কেটে আনল তারা। কারণ তাদের পুজোর অন্যতম উপকরণ এই করম গাছের ডালটি মাটিতে পড়ে গেলে সকল অনুষ্ঠান ব্যর্থ হয়ে যাবে। ধামসা মাদলের ছন্দে নিজেদের নৃত্যের তালে তাল মেলাতে ভোলেনি এরা কেউই। অদ্ভূতভাবে লক্ষ্য করলাম পুজোকে কেন্দ্র করে আদিবাসী সমাজের আট থেকে আশি বছর বয়সের সকলেই আনন্দের জোয়ারে মেতে উঠেছিল। করমডাল কেটে এনে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা সহকারে সেই করমডালকে প্রতিষ্ঠা করা হল কুলি লাইনের মাঝখানে বড় মাঠে। এরপর শুরু হল পুজো। ওইদিন সন্ধ্যাতেই হল করমডালের বিসর্জন। অনুপার কাছ থেকে জেনেছিলাম এই করম পূজার সমাপন হয় পূজিতা করম দেবতার বিসর্জনের মধ্য দিয়ে।আর একবার করমের অনুষ্ঠান দেখেছিলাম মাল শহর লাগোয়া রাজা চা বাগানের কুলি লাইনে। সেবার সিসিএন থেকে ডকুমেন্টারি করতে গিয়েছিলাম। অবিবাহিতা তরুণীরা উপোস করে সুখানিঝোরা থেকে জাওয়া ফুল তুলেছিল। পুজোর ঠিক সাতদিন আগে থেকে জাওয়া ফুল সংগ্রহের মাধ্যমে পুজোর প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। আদিবাসী রীতি মেনে আখড়া বানিয়ে এই জাওয়া ফুল অন্ধকারে রাখা হয়। তাহলে সবুজাভ করম ফুল পুজোর সময় হলুদ রঙ ধারণ করবে। সাতদিন অন্ধকারাছন্ন স্থানে রাখা হবে সেই জাওয়া ফুল। তারপর করমপুজোর মূল অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হবে জাওয়া ফুলকে। মূল অনুষ্ঠানের দিন মালের বিডিও অফিস লাগোয়া মাঠে করম ডাল কেটে বৰ্ণাঢ্য শোভাযাত্রা সহকারে তা নিয়ে আসা হয়েছিল। তারপর শুরু হয় পুজো। সারারাত পুজো পর্ব এবং নাচগান চলে। নাগরা, মাদল, ঢোলের দ্রিমিদ্রিমি শব্দে তাল অনুরণিত হল এলাকায় এলাকায়। ছিল লোকসংস্কৃতির নানা অনুষ্ঠানও। ওইদিন বিকালেই করম ডালের বিসর্জন হয়। করম মেলাকে কেন্দ্র করে হল আদিবাসী নৃত্য এবং লোকসংস্কৃতির অনুষ্ঠান। তিনটে করম পুজোর অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে করম পুজো সম্পর্কে আমি যেটা জেনেছি সেটাই আমার এইবারের বাগিচা সফরের প্রতিপাদ্য বিষয়। পাহান সম্প্রদায়ের মানুষ একশো বছর আগে বিহার থেকে এখানে আসে। অনেকে ঝাড়খণ্ড থেকেও আসে। এদের প্রধান উৎসব করম ও সহরায়। তবে পাহানদের এই দুটি উৎসব ছাড়া সহরুল নামে আরও একটি বড়ো উৎসব রয়েছে। অতীতে তারা বনজঙ্গলে ঘুরে বেড়াত। হরিণ, খরগোশ, বেজি, ইদুর শিকার করত। এদের মাংস ও গাছের ফলমূল খেয়ে তারা জীবনধারন করত। ধীরে ধীরে জঙ্গল কেটে ঘরবাড়ি তৈরি করে বসবাস করতে শিখল আদিবাসীরা। চাষবাস শুরু করল। নির্বিঘ্নে জীবনধারণ ও শস্যের শ্রীবৃদ্ধি কামনায় তারা করম পুজো শুরু করে। করম বৃক্ষ বহুল। পত্রবিশিষ্ট। লাতিন নাম আদিনা কর্ডিফেলিয়া। অনেকে তাকে চাকলতা বৃক্ষ বলে। এই গাছকে তারা ভীষণ শ্রদ্ধা ভক্তি করে। করম পূজারিরা নৈবেদ্য দেন প্রকৃতির উদ্দেশে। তারা প্রকৃতির পূজারি, সারনা ধর্মাবলম্বী। উৎসব শুরুর সাতদিন আগে থেকে কুমারী মেয়েরা পরব শুরু করে। ভাদ্র মাসের একাদশীর পাঁচদিন আগে করমতীরা করম পুজোর জন্য উপবাস শুরু করে। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে নদীতে স্নান করে। তারপর বাঁশ দিয়ে তৈরি করে ছোট ডালা বা টুকরি। একে আদিবাসীদের ভাষায় বলে ‘টুপা। এই সময় ডুয়ার্সের বিভিন্ন এলাকায় করম পুজোর জন্য নদী থেকে বালি তুলে নেন আদিবাসী মেয়েরা। কলাপাতার উপর সেই বালি শুকিয়ে নেয়। তাতে সিঁদুর ও কাজলের টিপ দেয়। সেই শুকনো বালির সঙ্গে ধান, দুর্বা, কুর্তি, যব ও মাকাই এই পঞ্চশস্য মাখায়। কোন কোন অঞ্চলে বালিতে মেশানো হয় সাত রকমের শস্যদানা। ঝুড়িতে থাকে ধান, গম, যব, তিল, মটর, ছোলা ও ভূট্টা। তারা দক্ষিণ হস্তের তর্জনি দিয়ে ওই মিশ্রণ পাঁচবার তুলে জাওয়ায় (ডালিতে) রাখে। পরে বালির সঙ্গে মেশানো ওই শস্যদানাগুলিকে রাখা হয় ঝুড়িতে। একে বলা হয় জাওয়া ফলের ঝুড়ি। তারপর হাত দিয়ে বালি তুলে ডালি ভর্তি করা হয়। আর তার কিছু মিশ্রণ বটপাতার ঠোঙাতে রাখা হয়। যারা বালি তোলে তাদের করমতী বলা হয়। কুমারী বা যাদের বিবাহ হয়েছে কিন্তু সন্তান হয়নি, তারাই এই বালি তোলার কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে। সাতদিন ধরে প্রতিদিন অল্প অল্প করে জল দেওয়া হয় ঝুড়িতে। ঝুড়িগুলি রাখা হয় ঘরের অন্ধকার কোণে। জল পেয়ে অঙ্কুরিত হবে শস্যদানাগুলি। ওই অঙ্কুরের ঝুড়িগুলি করম রাজার কাছে নৈবেদ্য হিসেবে দেওয়া হয় পুজোর দিন। পঞ্চশস্য মিশ্রিত বালি ভর্তি ডালিকে জোগানোর জন্য প্রথম দিন করমতীরা পরস্পরের ঘাড়ে হাত দিয়ে পাক দিতে দিতে ‘জাওয়া' গান করতে থাকে। তারপর যব, ভুট্টা, মটর, মুগের মত বিভিন্ন শস্য তেল-হলুদ মাখিয়ে ওই টুপার মধ্যে বুনে দেয়।এই উৎসবের পুরোহিতদের বলা হয় ‘লায়া'। সেই ‘লায়া' এই পর্বে জঙ্গলের একটি নির্দিষ্ট গাছে গিয়ে লাল সুতো বেঁধে দিয়ে আসে। সেই গাছটিই হল করমগাছ। এই গাছটিকে দেখতে অনেকটা কদম গাছের মত। যে কোনও গাছ হলে কিন্তু হবে না। সেই করমগাছে ইংরেজির ‘ভি’ আকৃতির ডাল থাকতে হবে। পাঁচদিন পর একাদশীতে করম গাছের গোড়ায় সাদা সুতো বাঁধা হয়। সেখানে তেল-সিঁদুর লেপে-ধূপ-ধুনো জ্বালিয়ে পাঁচ টাকা দক্ষিণা দিয়ে ভক্তি ভরে প্রণাম করে গাছটিতে ওঠা হয়। তারপর একটি ডাল কাটা হয়। কাটা ডাল মাটিতে যাতে না পড়ে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়। করম পরবের দিন মেয়েরা সন্ধে হলে নাচগান করতে করতে সেই লাল সুতো বাধা গাছের ডালটা কেটে আনে। ঢোল বাজিয়ে ডালটি ঘরে নিয়ে গিয়ে চালে তোলা হয়। তারপর বাড়ির একজন পুরুষ উঠানে ডালটিকে পোঁতার জন্য গর্ত করে। উপবাসী করমতীরা গর্তে ধানদুর্বা-হলুদ ও একটাকা দিয়ে টুপার পাশে ডালটিকে পুঁতে দেয়। আর জাওয়াকে (ডালিকে) পোঁতা ডালের পাশে রাখা হয়। করমতীরা দাদাদের দেওয়া নতুন কাপড় পরে কাঁসার থালায় সাদা কাপড়ে মোড়া শশা, ধান, দুর্বা ও মাটির প্রদীপ সাজিয়ে তাকে পূজা করে। তারা ডালের চারপাশে গোল হয়ে বসে আমন ধানের পাতা হাতে নিয়ে করমের ব্রতকথা শোনে। একজন বয়স্ক লোক (পুরোহিত) তাদের এই ব্রত কথা শোনান। ব্ৰত কথাটি হল ধর্মা ও কর্মা নামে দুই ভাই ছিল। কর্মা ব্যাবসা করতে বিদেশে যায়। সেখান থেকে ফিরে এসে ধর্মাকে করম পূজা করতে দেখে। তা দেখে রেগে গিয়ে পূজার উপকরণ জলে ফেলে দেয়। তখন থেকে কর্মা নানা বিপদের সম্মুখীন হয় এবং দিনে দিনে নিঃস্ব হতে থাকে। অনুষ্ঠান বাড়িতে খেতে বসেও সে খেতে পায় না। তাই সে করম গুরুর নির্দেশে করম পুজো শুরু করে। এরপরই তার আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল হয়। তখন থেকে সকলে করম পুজো শুরু করে। ব্ৰত কথার শেষে করম পুরোহিত করমতীদের জিজ্ঞাসা করে যে তারা কবে পুজো করে? তখন করমতীরা বলে, আপান কারাম ভাইয়াকে ধারাম।'' তারপর তারা থালা হাতে ডালের চারপাশে ঘোরে এবং গান গাইতে থাকে। তারপর সারারাত ধরে চলে নাচ-গানের উৎসব। নাচ হয় অর্ধবৃত্তাকারে। ছেলেরা ধুতি, গামছা, গেঞ্জি পরে মাথায় গাছের ছোট ডাল বেঁধে নাচতে থাকে। মেয়েরা পরে হলুদ কিংবা সাদা লাল পাড় শাড়ি। ‘লায়া’ কিংবা গ্রামের বৃদ্ধ শোনান করম রাজার বীরগাথা। পাহান সম্প্রদায়ের মানুষ শশা, লুচি ইত্যাদি পূজিত করে ডালের পাতায় বেঁধে তা জলে দেয়। শোভাযাত্রা ও স্লোগানে পুজো সম্পন্ন হয়। প্রতি বছর সঠিক সময়ে সঠিক পদ্ধতিতে শস্যের শ্রীবৃদ্ধি ও সন্তান, সুখ-সমৃদ্ধির কামনায় এই উৎসব হয়। সামর্থ্য সীমিত হলেও দীর্ঘদিনের এই প্রথাটিকে তারা টিকিয়ে রেখেছে। স্বল্প আয়োজনে এ উৎসব পালিত হলেও চিত্ত বিনোদনে খামতি নেই। দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যাবেলায় ওই জাওয়াকে (ডালিকে) পিড়হার (পিড়ির) উপরে রেখে তাকে জাগানোর জন্য আগের মতোই সারিবদ্ধ হয়ে গান গাওয়া হয়। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম দিনে ডালিকে জাগানোর জন্য একই উপায় অবলম্বন করা হয়। এই পাঁচদিন করমতীরা মাথায় তেল সিঁদুর দেয় না। চুলে চিরুনি দেয় না। হলুদ, মাছ, মাংস খাওয়া যায় না। করম পুজোয় প্রকৃতির প্রতীক হিসেবে করম গাছের ডালকে কাপড় পরিয়ে দেবতা হিসেবে পুজো দেওয়া হয়। ‘করম পরব’ আসলে উর্বরতার উৎসব। প্রজননই যার মূল কথা। সেইজন্য ভরা ভাদ্র মাসেই ‘করম’ উৎসবটি হয়ে থাকে। বাংলা লোক উৎসবে করমের বিশেষ জায়গা রয়েছে। প্রকৃতি এবং নারীকে এই উৎসব মিলিয়ে দিতে পেরেছে। করমপুজোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন চা বাগান সহ বাগিচা অঞ্চলে উৎসব আয়োজন শুরু হয়। ৯ দিন ধরে অঙ্কুরিত হওয়া জাওয়া ফুল দিয়ে করম দেবতার আবাহন করে থাকে উত্তরবঙ্গের আদিবাসী সম্প্রদায়। করম গাছের তিনটি ডাল কেটে প্রথমে স্থাপন করা হয় পুজোর বেদিতে। তারপর চলে সাওতালি, কুরুক কিংবা মুন্ডারী ভাষাতে মন্ত্রোচ্চারণ। এর পাশাপাশি মন্ডপের বাইরে রাতভর ধরে চলে ধামসা মাদলের তালে তালে আদিবাসী নৃত্য। ছেচারী, তুষগো, চোরীকুশো, লাহসুমা এ সকল পুজোর স্পেশাল নাচের পাশাপাশি গাওয়া হয় করমের গান। শাস্ত্রমতে আশ্বিন মাসে হওয়া এইরকম পুজোকে রাজি করম বলে। এটাই মূল করম পুজো। যার মাধ্যমে প্রকৃতিকে পুজা করা হয়। ধর্মা ও কর্মার গল্প বাদে আর এক ধরনের করমের গল্প শুনেছিলাম মালবাজার শহরে রেলওয়ে ময়দানের পুজোতে। বিডিও কার্য্যালয় সংলগ্ন ময়দান এবং রেলওয়ে ময়দান দুই মাঠেই সেবার করম পুজো এবং মেলা হয়েছিল। রেলওয়ে ময়দানের পুজোতে সেবার রাঁচি থেকে যোগ দেন আদিবাসী সমাজের অন্যতম ধর্মগুরু বাবা রাম কুজুর। তাঁর কাছ থেকে শুনেছিলাম আদিবাসী ওঁরাও সম্প্রদায়ের ধর্মচর্চা অনুযায়ী, পুরাকালে একবার অগ্নিপ্রলয় হয়েছিল, লাভার মত আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছিল চারদিক থেকে। সে সময় নায়েক ও সারেন নামের দুই ভাইবোন ইশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলে তাদের করম গাছের কোটরে আশ্রয় নিতে নির্দেশ দেন ভগবান। আগুনে সব পুড়ে ছাই হলেও করম গাছের কোন ক্ষতি হয়নি। রক্ষা পান নায়েক ও সারেনও। সেই থেকে প্রকৃতির পুজোর মূল কেন্দ্রে থাকে করম গাছের ডাল। করম গাছকে রাজার সম্মান দেওয়া হয়। আদিবাসী সমাজের পুরোহিত অর্থাৎ পাহান নির্দিষ্ট রীতি মেনে করম ডালের পুজো দেন। এরপর থেকেই শুরু হয় উৎসব। আদিবাসী সমাজের সব থেকে বড় উৎসব করম পুজোয় মেতে ওঠেন ডুয়ার্সের আদিবাসীরা। সন্ধ্যা থেকে ডুয়ার্সের সর্বত্র পুজো ও করম মেলা শুরু হয়। করম গাছের ডাল ঘিরে এই পুজো মূলত প্রকৃতি বন্দনা। ধান সহ সমস্ত শস্য এবং চা বাগিচার ফসল যাতে ভাল হয় সেই কামনাতেই এই পুজো। সারা রাত পুজো প্রার্থনা চলার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলে।সেবার মালবাজার রেলওয়ে ময়দানের মেলাতে দেখেছিলাম শুভদিন মেনে এদিন মেলা প্রাঙ্গণে বিয়েও করেন অনেক আদিবাসী যুবক যুবতী। তবে পুজোর যে মূল আধার করম গাছ সেই গাছই বিলুপ্তির পথে চলে যাচ্ছে বলে উদ্বেগে ভুগছেন পুজোর আয়োজকেরা। আদিবাসী বিকাশ পরিষদের রাজ্য সহ সভাপতি তেজকুমার টোপ্পো ছিলেন মালবাজারের করম পুজোর অন্যতম আয়োজক। তাঁর কথায়, ‘‘করম গাছ হারিয়ে যেতে বসেছে। সরকারি তরফে দ্রুত নার্সারির মাধ্যমে এর সংরক্ষণ প্রয়োজন। রেলওয়ে ময়দানের পুজোর উদ্যোক্তা চন্দন লোহার জানিয়েছিলেন করম গাছ মালবাজার ব্লকে হাতেগোনা রয়েছে। করম গাছের ডাল ছাড়া পুজো হবে না। তাই গাছ কমে আসার বিষয়টি নিয়ে বন দফতরর ভাবনা চিন্তা করা উচিত। জলপাইগুড়ি-সহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অংশে করম পুজোর প্রচল রয়েছে। পঞ্জিকা অনুসারে, ভাদ্র মাসের শুক্লা একাদশীতে পালিত হয় এই উৎসব। কুড়মি সংগঠনগুলির দাবি মেনে করম পুজোয় পূর্ণ দিবস ছুটি ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। সরকারি উদ্যোগে করম পুজোর জন্য অর্থ বরাদ্দও করেছে আদিবাসী উন্নয়ন দফতর। কুড়মিদের অন্যতম প্রধান কৃষিভিত্তিক গণ উৎসবই হল করম। করম গাছের ডাল ঘিরে এই পুজো মূলত প্রকৃতি বন্দনা। ধান-সহ যাবতীয় শস্যের উৎপাদন যাতে ভাল হয় সেই কামনাতেই এই পুজো করা হয়। এর আগে করম পুজো ‘সেকশনাল হলিডে’ ছিল। অর্থাৎ ওই উৎসব যাঁরা পালন করেন, শুধু তাঁদেরই ছুটি থাকত। দিনটিকে সাধারণ ছুটির আওতায় আনার দাবি ছিল কুড়মি সংগঠনগুলির। ওই দিন পূর্ণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। করম পুজো উপলক্ষে বন্ধ থাকবে সমস্ত সরকারি স্কুল, কলেজ, অফিস। তাই আদিবাসীদের করম পুজো যে দিনে দিনে সার্বজনীন হয়ে উঠবে এতে কোন সন্দেহ নেই। তথ্যসূত্রঃ তেজকুমার টোপ্পো - আদিবাসী বিকাশ পর্ষদ, ব্যাকওয়ার্ড ক্লাশ ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্ট, রাম অবতার শর্মা, তথ্য সংস্কৃতি দপ্তর, আদিবাসী কল্যাণ মন্ত্রক এবং সরাসরি সাক্ষাৎকার ছবিঃ সংগৃহীত