জাস্টিসের দাবিতে উত্তরের বাগিচাতেও চলছে লড়াই/গৌতম চক্রবর্তী
জাস্টিসের দাবিতে উত্তরের বাগিচাতেও চলছে লড়াই
গৌতম চক্রবর্তী
‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। এই একটা দাবিতে কলম থেমে ছিল প্রায় তিন সপ্তাহ। মনঃসংযোগ আসছিল না। তিলোত্তমার ঘটনার নৃশংসতা আমাদের হৃদয়কে এতটা রক্তাক্ত করেছিল যে একটা অবসাদ, বিষণ্ণতা গ্রাস করেছিল আমাকে। কারণ এই পোড়া দেশের সিস্টেম। ব্রিটিশরা ভারত ছাড়ার আগে আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে যেসব ব্রিটিশ প্রণীত আইন দিয়ে গেছে সেগুলিকে স্বধীনতার আশি বছরেও আর সংস্কার করা গেল না। তাই নরাধম, নরপশুরা ধরা পড়লেও তদন্ত চলে ঢিমেতালে, তথ্য গোপন করার এজেন্সি সক্রিয় থেকে সক্রিয়তর হয়, আর খুন, ধর্ষণের অপরাধে অপরাধীদের ট্রায়াল চলতে থাকে বছরের পর বছর। আর এই সুযোগে ক্রাইম বাড়তে থাকে। একই ধর্ষণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। সমাজবিরোধীরা বুক চিতিয়ে সমাজে মাথা তুলে ঘুরে বেড়ায়। আর আমরা বিষাদগ্রস্ত হই। তিলোত্তমার ঘটনাও ব্যাতিক্রমী নয়। কিন্তু এই বিষাদের মধ্যেও বিদ্যুচ্চমকের মত মাথায় খেলে গেল ধুপগুড়ির বুকেও কিছুদিন আগে নৃশংস খুন এবং ধর্ষনের ঘটনা ঘটেছিল রেললাইনের ধারে। সেখানেও তো প্রশাসন তথ্য গোপন করে দেবার চেষ্টা করেছিল। ধর্ষণের ঘটনা আত্মহত্যা বলে চালাবার চেষ্টা করা হয়েছিল। তখন সিভিল সোসাইটি কোথায় ছিল? সেই মেয়েটির জন্য কতজন রাত জেগেছিল? বিশ্বাস করুণ আমার বোধ বা মনন বলে উঠলো যে সমস্ত তিলোত্তমারা নিজের হিম্মতে প্রশাসনিক সাপোর্ট ছাড়াই জাস্টিসের দাবিতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে সেটা তুলে ধরা আমার কর্তব্য। তাই দলমত নির্বিশেষে প্রথম দিনের অরাজনৈতিক রাতজাগা কর্মসূচীতে সামিল লক্ষ কোটি দেশ ও বিদেশের আমনাগরিক তিলোত্তমার জন্য যে লড়াই সংগ্রাম জারি রেখেছেন, আগামী দিনে সমাজের প্রত্যেক নারীর অধিকার সুরক্ষাতে পথে নামবেন এই নিশ্চয়তা প্রত্যাশা করি। তিলোত্তমার এই ঘটনার পর একটা কথা পরিষ্কার যে ন্যুনতম আত্মরক্ষার অধিকার অর্জন করা প্রয়োজন নারীদের। দুই একজন পুলিশ প্রশাসকদের জন্য যদি পুলিশ প্রশাসনের সামগ্রীক টিমের প্রতি ভরসা হারিয়ে ফেলে আম নাগরিক তাহলে আমি জাস্টিসের দাবিতে আন্দোলনকে সহমত জানিয়ে এটাই বলব অংশকে সমগ্র মনে করলে বিরাট ভুল হবে। ভণিতা না করে উত্তরের বীরাঙ্গনাদের কথা শুরু করি।
এলাম পানিঘাটা। শুনসান চা বাগানের ফ্যাক্টরি লাইনে পেয়ে গেলাম দুটি কিশোরীকে। শুনসান চা বাগানের ফ্যাক্টরি লাইনের মধ্যে দিয়ে নির্ভয়ে হাঁটছিল ললিতা এবং বিদি। বন্ধ পানিঘাটা চা বাগান তখন ঘুমোচ্ছিল। অনায়াসেই মেয়ে দুটিকে অপরাধীরা তুলে নিয়ে গেলেও কাকপক্ষীর টের পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু ওদের মনে কোনও ভয় নেই। 'নিঃঝুম রাস্তায় ভয় করে না?' প্রশ্ন থামিয়ে দিয়ে ওরা বলল, 'রঙ্গু পিসি আছে তো। তাই এখানে ওসব হয় না।' উত্তরের দার্জিলিং জেলার পানিঘাটা চা বাগান। এই চা বাগানের জেদি মেয়েটি চষে বেড়ায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে উত্তরবঙ্গের হারিয়ে যাওয়া মেয়েগুলিকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে। সে এখন 'আট হাজারের মা' রঙ্গু সৌরিয়া। শুধু পানিঘাটা কেন, উত্তরবঙ্গ ছাপিয়ে এখন সিকিমের মেয়েদেরও ভরসা হয়ে উঠেছেন পাহাড়ের কোলে মেয়েবেলা কাটানো রঙ্গু সৌরিয়া। অপরাধীদের চোখে চোখ রাখাটাকে জীবনের ব্রত করে ফেলেছেন তিনি। মহিলাদের ওপর অত্যাচার বন্ধ করতে নেশা বন্ধে জোর দেন। তবে জীবনকে অন্য স্রোতে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর লড়াইটা শুরু হয়েছিল ছাত্রাবস্থাতেই। সোনাদা থেকে বিজনবাড়ি যেখানেই পড়েছেন, পড়ুয়াদের অধিকার নিয়ে লড়াই করেছেন। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত দার্জিলিং সদর হাসপাতাল, ইডেন হাসপাতালে অসহায় রোগীদের পাশে থেকে নিঃস্বার্থ সেবা করেছেন। তাকে দেখে এগিয়ে এসেছে আরও অনেক মেয়ে। এই লড়াই শেষ পর্যন্ত অন্য স্রোত নেয়। দার্জিলিং গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পরই মেয়েদের নিয়ে কাজ করা শুরু তাঁর। পানিঘাটা, মিরিক, নকশালবাড়ির প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতে মেয়েদের আত্মরক্ষা, আত্মনির্ভরতার পাঠ দেওয়া শুরু করেন তিনি। কিন্তু আটকে রাখতে পারেননি মেয়েদের। বাগান থেকে গ্রাম, শহর, হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের সংখ্যাটা ক্রমে বেড়েই চলে। বলেন, ‘কাজ তো দিতে পারছি না। আর অভাবকে হাতিয়ার করেই কিছু মানুষ মেয়েগুলিকে হাতবদল করে দিচ্ছে। তবে যতদিন বাঁচব, খোঁজ পেলে মেয়েগুলোকে অন্ধকার গলি থেতে আলোর সরণিতে ফিরিয়ে আনব।’ তাই তিনি রাতের অন্ধকারে পা রাখেন ভিনরাজ্যের নিষিদ্ধ পল্লিতেও। জীবনকে বাজি রেখে উদ্ধার করেন মেয়েদের।
ইতিমধ্যেই রঙ্গু ফিরিয়ে এনেছে আট হাজারের বেশি মেয়েকে। তবে কাজ শেষ হয়নি। রঙ্গু সৌরিয়া চম্পাসারির দেবীডাঙ্গায় গড়ে তুলছে কাঞ্চনজঙ্ঘা উদ্ধার কেন্দ্রের শর্টটাইম শেলটার হোম। প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে গিয়ে তাঁর চোখ চিকচিক করে ওঠে। জল মুছে বলেন, 'অনেক মা তাঁর মেয়েকে ফিরিয়ে নিতে চান না সমাজের ভয়ে। ওই মেয়েদের জন্যই ঘরটি তুলছি। নতুন জীবন দিতে। মা কে দেওয়া কথা রাখতে।' রঙ্গু তাই ভরসার মানুষ হয়ে উঠেছেন পুলিশের কাছেও। চোখের সামনে মহিলাদের ওপর পুরুষদের লাগাতার অত্যাচার দেখতে দেখতে কিছুটা বড় হয়ে ওঠা সৌরিয়ার কথায়, ‘তখন খুব ছোট ছিলাম। রাতের পর রাত স্বামীর অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে অনেক মহিলা চা শ্রমিককে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিতে দেখতাম। সাতসকালে সংসারের যাবতীয় কাজ শেষ করে বাগানে পাতা তোলা এবং বাড়ি ফিরে ফের রান্না। এরপর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ছুটে আসতেন ওঁরা আমার মায়ের কাছে। দিনের পর দিন ওই ঘটনা দেখতে দেখতে ঠিক করে নিই এই অত্যাচার বন্ধ করতে হবে”। রঙ্গুর মতই পেয়েছিলাম আরেক বীরাঙ্গনাকে নকশালবাড়ি চা বাগান এলাকাতে। নাম "হিতকারী গুড়িয়া। পিছিয়ে পড়া অসহায় দরিদ্র আদিবাসী মহিলাদের শিক্ষার বিকাশ ও তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে জীবন উৎসর্গ করবেন ধরে নিয়েই হয়তো মেয়ের এহেন নামকরণ বাবা-মায়ের। মেয়ে বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করেছে। আদিবাসীদের উন্নয়নে জীবন বিলিয়ে দিয়েছে। কখনও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত আদিবাসী শিশুদের জন্য স্কুল খুলেছে, আবার কখনও আদিবাসীদের হাঁড়িয়া আর চোলাইয়ের নেশা থেকে বাঁচাতে দৌড়েছে। মহিলাদের সংগঠিত করে মহাজনদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে আদিবাসীদের জমি উদ্ধার করেছে। আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা আদিবাসীদের পতিত জমিতে জৈব চাষে উদ্বুদ্ধ করা, আদিবাসী মহিলাদের স্বনির্ভর করতে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, সেলাই সহ বিভিন্ন হাতের কাজের প্রশিক্ষণে শামিল করা-এককথাতে হিতকারীর হিতের তালিকাটা বিরাট।
নকশালবাড়ির মতো চা বাগানগুলিতে একটা সময় হাঁড়িয়া ও চোলাইয়ের নেশা মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মহিলাদের সংগঠিত করে হিতকারী এর বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেন।'ডায়োসেশন বোর্ড অফ সোশ্যাল সার্ভিস' নামে এক সংস্থায় যোগ দিয়ে মধ্যপ্রদেশের রায়পুরে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে আদিবাসীদের হিতসাধনে কাজ শুরু। সেখানে কয়েক বছর কাজ করার পর তাকে শামুকতলা এলাকার আদিবাসী মহল্লায় কাজ করতে পাঠানো হয়। সেটা ১৯৯৯ সাল। একমাত্র আদিবাসী মহিলাদের স্বনির্ভর করলেই আদিবাসী গ্রামগুলির আর্থ-সামাজিক বিকাশ ঘটবে বলে হিতকারী শামুকতলায় এসে বুঝতে পারে। তাই রোদ-বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে শামুকতলার আদিবাসী গ্রামগুলিতে সাইকেল নিয়ে ঘুরে ঘুরে মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে তাদের চাষাবাদ, ছোট ব্যবসায় শামিল করা শুরু করে। এখানেও মদ, জুয়া, মহাজনি ব্যবসার বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। সাফল্য আসে। হিতকারী 'সাঁওতালপুর নাগরিক অধিকার সুরক্ষা ওয়েলফেয়ার সোসাইটি' গড়ে তোলে। সংস্থাটি চার বছরেরও বেশি সময় ধরে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে শামুকতলা এবং তুরতুরি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক দিকটা বদলাতে শুরু করে। আদিবাসী গ্রামগুলিতে মধু চাষ, জৈব পদ্ধতিতে গোলমরিচ, রকমারি ফল, হলুদ, সর্ষে সহ বিভিন্ন রকম চাষ শুরু হয়। মহিলাদের জন্য সেলাই প্রশিক্ষণ শিবির শুরু হয়। তাঁদের কাজে সাহায্য করতে উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, আলিপুরদুয়ার জেলা প্রশাসন, জেলা শিল্প উন্নয়ন দপ্তর, নাবার্ড সহ বিভিন্ন সংস্থা হাত বাড়িয়ে দেয়। হিতকারীর মতে, সরকার আদিবাসীদের জন্য প্রচুর প্রকল্প চালু করেছে। কিন্তু আদিবাসীদের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা না এলে প্রকল্প দিয়ে কী লাভ? তাই তাদের সচেতন করার কাজ শুরু হয়। আদিবাসীদের কাছে প্রচুর জমি থাকলেও সেগুলি পতিত পড়ে থাকত। তাই ওই জমিতে চাষের বিষয়ে তাঁদের সচেতন কররে হিতকারী। এখন পতিত জমির পরিমাণ অনেকটাই কম। আদিবাসীদের মধ্যে নেশা করার প্রবণতা কমেছে। তবুও বহু কাজ বাকি। সেই সমস্ত কাজ পূর্ণ করতেই হিতকারী আরও অনেকটা রাস্তা চলতে চান।
গতকাল জিতি, কূর্তি চা বাগিচা ক্ষেত্রসমীক্ষা করে রয়ে গেলাম নাগরাকাটা। ভোরবেলা মর্নিং ওয়াক করতে করতে চলে এলাম নাগরাকাটার ইউরোপিয়ান ক্লাবের মাঠে। কাকভোর থেকে শুরু ফুটবল চর্চা যেন একঝলক বাতাস। পায়ে ফুটবল নিয়ে স্বপ্ন বেচছে চা বাগানের একদল ছাত্রী। তাদের দেখে এখন উৎসাহিত হচ্ছে আরও অনেকেই। কেউ কেউ এমনকি জাতীয় স্তরে যোগদানের সুযোগও পেয়েছে। ট্রায়ালে যাচ্ছে অনেকেই। কিভাবে হচ্ছে এমন অসাধ্য সাধন? নাগরাকাটায় ফুটবল প্রশিক্ষণে খেলোয়াড়ের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। এরপর সময় যত গড়িয়েছে, মেয়েদের সংখ্যাও তত বেড়েছে। অবশ্য ভাটা পড়ে ২০২০ সালে শুরু হওয়া করোনা সংকটের পর্বে। প্রতিদিন অভিভাবকদের দল তাদের ছেলেমেয়েদের মাঠে রেখে দিয়ে যাচ্ছেন। বদলে যাওয়া জমানায় ছাত্রীদের ফুটবলের প্রতি এমন একাগ্রতাকে কুর্নিশ। এখন সেখানে অনেক খেলোয়াড়। তাদের কেউ প্রথম শ্রেণিতে পড়ে, কেউ আবার কলেজ পড়ুয়া। বীরপাড়া থেকে শুরু করে মালবাজার-ডুয়ার্সের বিভিন্ন এলাকা থেকে তারা আসছে। শুধু একবুক স্বপ্ন নিয়েই নয়, এক আকাশ স্বপ্ন ছড়াতেও। বানারহাটের এক সরকারি হিন্দি কলেজের ছাত্রী রেশমি তামাং মেয়েদের বিভাগে রাজ্য দলে ট্রায়ালের সুযোগও পেয়েছিল। চূড়ান্ত স্তরে ঠাঁই হয়নি ঠিকই, তবে ভেঙে পড়ে নি। আরও কঠোর প্র্যাকটিস শুরু করেছে। তাকে দেখে আরও অনেক মেয়ে এখন খেলার মাঠে আসতে শুরু করেছে। ২০ কিলোমিটার দূরে নাগরাকাটা চা বাগান থেকে ইউরোপিয়ান ক্লাবের মাঠে আসে দশম শ্রেণির ছাত্রী জ্যোতি বারলা। তার একদিনও যদি প্র্যাকটিস কামাই হয়, তবে রাতে ঘুম হয় না। পড়াশোনার পাশাপাশি ফুটবলটাই তার জীবনের সব। এর আগে ওই ফুটবল মাঠ থেকেই মুজনাই বাগানের অঞ্জু তামাং এখন মেয়েদের জাতীয় দলের খেলোয়াড়। দার্জিলিংয়ের মেয়ে সুজাতা রাই এখান থেকেই ফুটবল খেলতে খেলতে ‘হোমলেস ফুটবল' বিশ্বকাপে দেশের প্রতিনিধিত্ব করে এসেছে। রাজ্যস্তরে বা কলকাতার লিগে খেলেছে সুস্মিতা লেপচা, নিশা ভুজেল, যশোদা ছেত্রী, পূজা বারলার মতো আরও একঝাঁক মেয়ে। এখন সেই পথেই হাঁটতে চায় নবম শ্রেণীর মাহেক খালকো, অসিতা সিং কিংবা একাদশের দীপিকা টোপ্পো, প্রেমা সোরেনরা।
সরস্বতীপুরের সন্ধ্যাই বা কম কিসের? আনস্টপেবল। চা বাগানের খেলা বলতে ফুটবল। কিছুটা ক্রিকেট। এই পরিস্থিতিতে ২০১৩ সালে সন্ধ্যার রাগবি খেলতে নামা। বাবা শ্যাম রাই বাগানের শ্রমিক। বাড়িতে মা পকচি ও ভাই প্রমোদের পাশাপাশি দারুণ দারিদ্রও রয়েছে। এই পরিস্থিতিতেও সন্ধ্যার দাঁতে দাঁত চেপে রাগবি খেলাটা চলেছে। ফলটাও হাতেনাতে মিলেছে। প্রথম বছরটা বাগানে বাগানে খেলার পর পরের বছরটায় জঙ্গল ক্রস ক্লাবের হয়ে খেলা। তারপর রাজ্যস্তর হয়ে দেশের জন্য শিবিরে নির্বাচিত হওয়া। অনূর্ধ্ব-১৭ এবং অনূর্ধ্ব-১৮ ভারতীয় মহিলা দলের ক্যাপ্টেন্সি করেছেন। অনূর্ধ্ব-১৭ থেকে শুরু করে দেশের সিনিয়ার টিমের হয়ে ইতিমধ্যেই আটবার প্রতিনিধিত্ব করা হয়ে গিয়েছে। ফ্রান্সে গিয়ে রাগবি খেলে নিজস্ব স্কিলে সবাইকে মাতিয়েছে। খেলো রাগবি ফাউন্ডেশনের স্কলারশিপ পেয়েছে। বর্তমানে কলকাতায় স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি মেয়েদের প্রশিক্ষণও দিচ্ছে। আসলে জীবন থেকেই তো গল্প হয়। মাত্র ২০ বছর বয়সে এভাবে দেশের অন্যতম হয়ে ওঠা, দুনিয়াজোড়া প্রচারের অংশ হওয়া, এসব কোনওদিন সম্ভব হবে বলে ভেবেছিল সন্ধ্যা? রাগবির মাঠে দুরন্ত বছর ২০-র যুবতী যেন কিছুটা লজ্জিত। তার বক্তব্য ফুটবল, ক্রিকেটে ছেলেদের আধিপত্যের মাঝে বাগানের মেয়েরা যেভাবে রাগবিকে আঁকড়ে ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে তা যদি অন্যদের অনুপ্রাণিত করে তবেই সাফল্য আসবে। দেশের রাগবিতে সরস্বতীপুর বাগানের একটা আলাদা অবদান আছে। এই বাগানের ন’জন মেয়ে ইতিমধ্যেই দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। আত্মতুষ্টিতে ভুগে নয়, রীতিমতো আত্মসমীক্ষা চালিয়ে সন্ধ্যা সহ আদিবাসী মেয়েরা ধীরে ধীরে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করছে।
চা বাগান, জঙ্গল, নেপাল সীমান্ত ঘেরা নকশালবাড়ি এখন মাটিগাড়া-নকশালবাড়ি বিধানসভার অঙ্গ। আলিপুরদুয়ার থেকে বানারহাটে এসে নকশালপন্থী শ্রমিক সংগঠনে যোগ দেন প্রদীপ দেবনাথ। পরে নকশালবাড়িতে এসে কাজ করেন। আপাতত ছা-পোষা মানুষের মতো জীবন কাটাচ্ছেন। টিনের দুই কামরার বাড়ির বারান্দায় বসে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে অনেক কথাই বললেন। চোখের সামনে পুলিশের অত্যাচার, গ্রামের পর গ্রামে বিদ্রোহ, অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, গোপন বৈঠক সবকিছুই উঠে এল সেই কথায়। প্রদীপবাবুর বাড়ির পাশেই ষাট ছুঁইছুই পুতলী ওঁরাও এর বাড়ি। নকশালবাড়ির সেফদুল্লা জোতের পুতলি বড় হয়েছেন কানু সান্যালের পিছন পিছন ঘুরে। এলাকায় দিনমজুর বিনোদ ওঁরাওয়ের সঙ্গে বিয়ের পর গ্রামেগঞ্জে ঘুরে কাজ করে ভোটটা ঠিকই দিতেন। একদিন দিন বদলের স্বপ্ন দেখেছিলেন পুতলিদেবী। আজ মেয়ে-মরদ মিলে দিনমজুরি করে কোনও মতে সংসার চালান। ভোটার তালিকায় নাম থাকা বা না-থাকার কোনও মানেই নেই পুতলি ওরাওঁয়ের কাছে। কয়েক বছর আগে কোনও এক অজানা কারণে ভোটার তালিকা থেকে নাম কাটা যায় পুতলিদেবীর। স্থানীয় মাতব্বর বাড়িতে চক্কর কেটে, গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানের সঙ্গে ঝগড়া করে আজ ভোটের বাজারে তিনি ব্রাত্য। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, ‘‘কানুবাবু চলে গিয়েছেন। এখন আর ভোট নিয়ে ভাবি না।’’ পুতলিদেবীর মতোই যেন ভোটে ব্রাত্য হয়ে গিয়েছে নকশালবাড়ি। ছ’দশকের পুরনো আন্দোলন, যা এক দিন গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, তার কোনও রেশই আর পড়ে নেই এখানকার ভোটে। ১৯৬৭ সালের জমি, চাষের অধিকারের লড়াই থেকে নকশালপন্থীদের উত্থান। তার স্মৃতি নিয়ে এখনও ১১ জন নিহতের লাল স্মারক মাথা তুলে রয়েছে ধান খেতের সামনে। কিন্তু কোথাও যেন সেই মেজাজ, সেই ধারাটা হারিয়ে গিয়েছে। কানুবাবু আর নকশালবাড়ি থমকে গেছে বইয়ের পাতায়। আর দশটা শহর, গ্রাম বা ব্লকের মতোই নকশালবাড়িও এখন একটা নাম মাত্র। ফিরতে ফিরতে আপনমনেই ভাবছিলাম হায়রে, তিলোত্তমা নগরীতে পান থেকে চুন খসলে কত প্রতিবাদ, মিটিং, মিছিল, অথচ উত্তরের রঙ্গু সৌরিয়া, হিতকারী গুড়িয়ারা প্রচারের আলোতে না থেকেও কত কাজ করে চলেছে কতরকম প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করেই।
তথ্যসূত্রঃ এই সময়, আনন্দবাজার পত্রিকা, উত্তরবঙ্গ সংবাদ, কৃতজ্ঞতা স্বীকার - শুভজিত দত্ত, এখন ডুয়ার্স, অমিতাংশু চক্রবর্তী-আইটিপিএ, তেরাই টি প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশন
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴