করোনাকালের লকডাউনে ডুয়ার্সের চা বাগিচা-১/গৌতম চক্রবর্তী
করোনাকালের লকডাউনে ডুয়ার্সের চা বাগিচা
প্রথম পর্ব
গৌতম চক্রবর্তী
জলপাইগুড়ি জেলার বাগিচাপর্ব প্রায় শেষের দিকে। ব্যাপক বর্ষা, তীব্র গরম এবং কিছু শারীরিক সমস্যার জন্য এইমাসে বাগিচাগুলির সমীক্ষা করতে যেতে পারিনি। আবার শুরু হয়েছে কাজ। এইমাসেই গুটিয়ে নেব বাকি বাগিচাগুলির ক্ষেত্রসমীক্ষা। তাই জুলাই আর আগস্ট মাস মিলে পরিকল্পনা করেছি সামগ্রীকভাবে ডুয়ার্সের বাগিচাগুলিকে নিয়ে করোনাকালীন সেই ভয়ঙ্কর সময়ে আমার যে অভিজ্ঞতা সেটা তুলে ধরব। আসলে লকডাউনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল চা বাগিচা আর চা বাগিচা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত লাখো মানুষ। আমি ছিলাম তার প্রত্যক্ষদর্শী। লকডাউনেও আমি তথ্য সংগ্রহ করেছি। ঘুরে বেড়িয়েছি ডুয়ার্সের পথে পথে মানুষের জীবনযন্ত্রনাকে কলমবন্দী করতে। প্রেক্ষাপট ২০২০ সাল। ২০১৯-২০ আর্থিক বছরের ২০২০ এর ফার্স্ট ফ্লাশের পাতা তোলা শুরু হওয়ার মাসখানেক সময়ও কাটেনি। তার মাঝেই ২০২০ সালের মার্চ মাসে উপস্থিত হল করোনা সংকট। ২০২০-২১ সালের কেন্দ্রীয় বাজেট পেশের প্রাকমূহুর্তে পাহাড়, তরাই এবং ডুয়ার্সের চা বাগিচা আবার যখন নতুন উদ্যমে উৎপাদন শুরু করতে চলেছে, ঠিক তখন করোনা ভাইরাস এর ধাক্কায় ফার্স্ট ফ্লাশের উৎপাদন সংশয়ের মুখে পড়ল। করোনার ধাক্কায় ফার্স্ট ফ্লাশ সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হল। সমগ্র মার্চ মাসব্যাপী ডুয়ার্সের প্রায় সব চা বাগানে পাতা তোলা গেল কমে। করোনা সংক্রমণ আটকাতে রাজ্যের বহু শহর সহ অনেক গ্রামীণ এলাকায় প্রাথমিক অবস্থায় লকডাউনের নির্দেশিকা জারি করা হয়। সেই নির্দেশিকার আওতায় চা বাগান ছিল কিনা প্রাথমিক অবস্থায় তা স্পষ্ট করে জানানো হয়নি। এদিকে বাগানগুলি বন্ধের ব্যাপারে কোনো সরকারি নির্দেশিকা না পাবার ফলে চা মালিকদের সংগঠন অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়ে। করোনা সংকটের জেরে চা-বাগানেও লকডাউন হবে কিনা সেই প্রশ্নে জল্পনা তুঙ্গে ওঠে চা শিল্প মহলে।
প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় রেখে চা বাগানের ম্যানেজমেন্ট সংগঠনগুলি কাজ করতে শুরু করে। জলপাইগুড়ি জেলাশাসকের দপ্তরে করোনা মোকাবিলায় জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ার জেলার সমস্ত চা বাগানগুলি কী কী ব্যবস্থা নিচ্ছে সেটা জানার জন্য চা বাগান কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। জলপাইগুড়ি জেলার তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার অজিত রঞ্জন বর্ধন, জলপাইগুড়ি জেলার তৎকালীন জেলাশাসক অভিষেক তেওয়ারি এবং জেলা পুলিশ সুপার অভিষেক মোদী সহ চা বাগান পরিচালনা সমিতি থেকে প্রায় সব সংগঠনের প্রতিনিধিরা মিলিত হয়ে চা বাগানগুলির কি কি সমস্যা রয়েছে করোনা মোকাবিলার ক্ষেত্রে সেগুলো নিয়ে মত বিনিময় করেন। এরই মাঝে ডুয়ার্সের অধিকাংশ চা বাগান বন্ধ হতে শুরু করে। একটা সময় আর কোন চা বাগানে কাজ হচ্ছে না বলে প্রশাসনের কাছে খবর এসে পৌঁছায়। চা বাগান খোলা থাকলেও শ্রমিকরা কাজে আসতে ভয় পেতে শুরু করে। এর মধ্যেই লকডাউন এর ঘোষণা। চা বাগানে লকডাউন থাকবে কিনা তা নিয়ে যুক্তি-পাল্টা যুক্তি শুরু হয়। চা শিল্প সংশ্লিষ্ট মহল এবং মালিকপক্ষ চা বাগিচাতে গুজব ছড়ানোর আশঙ্কায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তাঁদের ধারণা ছিল কোনভাবে যদি করোনা নিয়ে গুজব ছড়িয়ে যায় তাহলে ভয় পেয়ে শ্রমিকেরা কাজে না এলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চা শিল্পের জন্য দূর্দিন ঘনিয়ে আসবে। করোনা ওয়েভের প্রথম ধাক্কায় ২২ মার্চ প্রকাশিত সরকারের নির্দেশিকায় সমস্ত রকম গণপরিবহন পরিষেবা, দোকান, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, কারখানা, কর্মশালা এবং গুদাম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে পাঁচ থেকে সাত জনের বেশি জনসমাগমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। নির্দেশিকায় দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কার্শিয়াং, কালিম্পং, আলিপুরদুয়ার এবং জয়গাঁ শহরের উল্লেখ থাকলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলের উল্লেখ ছিল না।
২৪ শে মার্চ প্রকাশিত নির্দেশিকায় গোটা রাজ্যে লকডাউন জারির আদেশ দেয় প্রশাসন। ফলে করোনাকালে ডুয়ার্সের সবুজ গালিচায় কেমন যেন ছন্দপতন হল। আচমকাই কেমন যেন সব ওলট-পালট হয়ে গেল। একদিন কাজ বন্ধ থাকলেই সংসারে টান পরে চা শ্রমিকদের। বাগিচার কর্মচঞ্চল জীবন আটকে গেল চার দেওয়ালে। বাগান বন্ধ, কাজও বন্ধ, সামনে শুধুই হতাশা এবং অন্ধকার। আসলে অভাবের সঙ্গে লড়াই করে চা বাগানের শ্রমিকেরা। তারা প্রবল কষ্টসহিষ্ণু। কিন্তু করোনাকালীন পরিস্থিতিটা একদম আলাদা এবং অচেনা। চা বাগান কি খোলা থাকবে— লকডাউনের চতুর্থ দিনে ফের সামনে এল সেই প্রশ্ন। দেশের খাদ্য মন্ত্রক একটি নির্দেশিকা রাজ্যে পাঠিয়ে বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রীর একটি তালিকার উৎপাদন, বিলি বণ্টনকে লকডাউনের সময়েও ছাড় দিতে বলে। সেই তালিকায় ছিল চা এবং কফি। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকার চা শিল্পকে লকডাউনের আওতা থেকে ছাড় দিতে আগ্রহী ছিল। প্রতিটি জেলার জেলাশাসককে এ বিষয়ে নির্দেশিকা জারি করতে রাজ্যের মুখ্যসচিবকে অনুরোধ করেন কেন্দ্রীয় খাদ্য মন্ত্রকের সচিব পুষ্পা সুব্রহ্মণ্যম। ২০২০ সালের ২৪ মার্চ রাজ্যের মুখ্যসচিব প্রকাশিত নির্দেশিকায় গোটা পশ্চিমবঙ্গে লকডাউন আরোপের আদেশ থাকায় সেই বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে চা শিল্পমহল। একই দিনে রাজ্যের সবকটি চা-বাগানের সংগঠনের যুগ্ম কমিটি এবং চা মালিক সংগঠনের যৌথ কমিটি সিসিপিএ রাজ্যের মুখ্য সচিবকে দুটো চিঠি পাঠিয়েছিল। একটি চিঠিতে বলা হয়েছিল যেহেতু চা আবশ্যিক খাদ্যসামগ্রীর আওতায় পড়ে তাই লকডাউনে বন্ধ হওয়ার কথা নয়। অন্য চিঠিতে আর্জি জানানো হয়েছিল বাগানে কাজ না হলেও যেন কীটনাশক ছিটানোর অনুমতি দেওয়া হয়। চা মালিকদের সংগঠনের যৌথ মঞ্চ কনসালটেটিভ কমিটি অব প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (সিসিপিএ) চেয়ারম্যান বিবেক জৈন রাজ্যের মুখ্যসচিবের কাছে প্রয়োজনীয় নির্দেশ চেয়েছেন। বিবেক জৈনের কথায়, “যদি কীটনাশক না ছড়ানো হয়, তা হলে চা বাগিচার অপূরণীয় ক্ষতি হবে।” কিন্তু বিধি বাম। হুকুম টলেনি সরকার বাহাদুরের।
আসলে টানা তিন সপ্তাহ চা বাগানে কীটনাশক না পড়লে চা গাছে রোগ সংক্রমণ হবে। তা সামাল দিতে গোড়ার কিছুটা উপর থেকে চা গাছ কেটে ফেলা ছাড়া উপায় থাকবে না। সেটা হলে লকডাউন ওঠার পরেও তিন মাস চা পাতা উৎপাদন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। সামাজিক দূরত্ব মেনে কীটনাশক ছড়ানোর কাজ চলতে পারে বলে চা পরিচালকদের দাবি ছিল। আবার চা শ্রমিক সংগঠনগুলির যৌথমঞ্চের আহ্বায়ক জিয়াউল আলমের কথায়, “করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা চা বাগানে সবচেয়ে বেশি। কোনভাবেই শ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ করা চলবে না।” বারংবার সরকারের কাছে এই দাবিই জানিয়ে এসেছিলেন বাগান মালিকদের সংগঠনগুলি যে সামাজিক সুরক্ষা মেনেই তাঁরা বাগানে শ্রমিকদের দিয়ে কাজ চালাবেন। এদিকে চীন, ইরান, জাপান এবং জার্মানির দরজা চায়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায় ২০২০ এর ফেব্রুয়ারির শেষ থেকেই। চায়ের রপ্তানি পুরোপুরিভাবে বন্ধ হয়ে যায়। তখন থেকে ঘরের বাজারের ওপর চাপ পড়তে থাকে। যেসব বাগানের চা সরাসরি রপ্তানি হয় সেখানে উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া হয়। এদিকে তরাই এবং ডুয়ার্সের বড় বড় চা বাগানগুলিতে লকডাউন চেয়ে রাজ্যের প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারির কাছে আবেদন জানায় চা শ্রমিক সংগঠনগুলোর জয়েন্ট ফোরাম। লক ডাউনের চতুর্থ দিনে কেন্দ্রীয় সরকার একটি নির্দেশিকা রাজ্যে পাঠায়। তাতে বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রীর একটি তালিকা ছিল যেগুলির উৎপাদন, এবং বিলিবন্টনকে লক ডাউনের সময়কালেও ছাড় দিতে বলা হয়েছিল। সেই তালিকায় ছিল চা এবং কফি। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকার চা শিল্পকে লকডাউন এর আওতা থেকে ছাড় দিতে আগ্রহী ছিল। প্রতিটি জেলার জেলাশাসককে এই বিষয়ে নির্দেশিকা জারি করতে বিষয়টি রাজ্যের মুখ্য সচিবকে অনুরোধ করেছিল কেন্দ্রীয় খাদ্যমন্ত্রকের সচিব।
করোনা ভাইরাস নিয়ে চলা লকডাউন এর মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের চা বাগানগুলো খুলে স্বাভাবিক কাজকর্ম করার অনুমতি দিলেও বাগিচা শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার স্বার্থে রাজ্য সরকার প্রাথমিক অবস্থায় বাগান চালু না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। চা বাগানের উৎপাদন এলাকাকে ৭টি এলাকায় ভাগ করা হয়৷ সেগুলি হল, ডামডিম, চালসা, নাগরাকাটা, বিন্নাগুড়ি, দলগাঁও, কালচিনি ও জয়ন্তী সাব-এরিয়া। আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়ি প্রশাসনিক জেলার সবকটি চা এলাকা মিলে বাগানের সংখ্যা প্রায় ১৫০৷ পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং পাহাড় এবং ডুয়ার্স অঞ্চলে মোট ২৮৩ টি বাগান রয়েছে যেখানে স্থায়ী এবং অস্থায়ী মিলিয়ে শ্রমিক সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখ। সাপ্তাহিক রেশন ছাড়া তাদের মাথাপিছু দৈনিক আয় করোনাকালীন পরিস্থিতিতে লকডাউনের সময় ছিল ১৩২ টাকা ৫০ পয়সা। এছাড়াও দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ার জেলা মিলিয়ে চল্লিশ হাজার ছোট চা বাগান ছিল যেখানে প্রায় এক লাখ শ্রমিক কর্মরত ছিল সেই সময়। করোণা সংক্রমণের প্রথম ঢেউতে লকডাউনে উত্তরবঙ্গের তরাই এবং ডুয়ার্সের বেশিরভাগ বড় বড় চা বাগান দোলাচলে পরে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যজুড়ে লকডাউন সম্পূর্ণ ঘোষণা করার পরে ক্ষুদ্র চা বাগানের মালিকপক্ষের সর্বভারতীয় সংগঠন সিসটার সর্বভারতীয় সভাপতি বিজয়গোপাল চক্রবর্তী হস্তক্ষেপ করায় প্রথমেই ক্ষুদ্র চা বাগানগুলি বন্ধ হয়ে যায় এবং বটলিফ ফ্যাক্টরিগুলো তাদের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। কিন্তু তখনো কিছু কিছু বড় বাগিচা খোলা থাকার জন্য প্রশাসনিক সমস্যা তৈরি হয়। টি অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়ার সাধারণ সম্পাদক প্রবীর কুমার ভট্টাচার্যের দাবি ছিল ২০২০ সালের ২৩ শে মার্চ লকডাউন সম্পর্কে জারি করা রাজ্য সরকারের নির্দেশিকায় চা বাগান অধ্যুষিত অঞ্চল বন্ধ রাখার কোনো উল্লেখ ছিল না।
তখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নবান্নে সাংবাদিকদের জানিয়ে দেন বাগান খোলার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার সবুজ সংকেত দিলেও উত্তরবঙ্গের জেলাগুলি আসাম, নেপাল, ভুটান এবং বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী হওয়ার ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রোগ সংক্রমণের বেশ কিছুটা ঝুঁকি থাকায় চা-বাগানগুলি না খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ এবং তার জেরে চলা দেশজোড়া বিপর্যস্ত অর্থনীতিতে মানুষের সুরক্ষার স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না সরকারের। তবে বিকল্প চিন্তাভাবনাও সরকারের ছিল যেগুলো নিয়ে বলা হয়েছিল চা বাগিচা মালিক, পরিচালক বর্গ এবং বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের সঙ্গে সরকার শীঘ্রই আলোচনা করে পরিপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এই পরিস্থিতিতে লকডাউনের ফলে পুরোপুরিভাবে চা বাগিচাগুলি বন্ধ হয়ে যায়। ইতিমধ্যে অসমের শ্রমদপ্তর একটি নির্দেশিকা জারি করে সেখানকার কোন প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক-কর্মচারীদের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কারণে কাজ থেকে ছাঁটাই করা যাবে না বলে নির্দেশ জারি করে। পাশাপাশি মজুরিও কাটছাঁট করার কোন রকম প্রশ্ন নেই বলে জানিয়ে দেয়। এমনকি অস্থায়ী শ্রমিকেরাও এই নির্দেশিকার আওতায় আসবেন বলে জানানো হয়। করোনা পরিস্থিতির কারণে যদি কাজ বন্ধ হয়ে যায় তবে সেই সময় তাদের কর্মরত হিসেবে বিবেচনা করতে হবে বলেও নির্দেশিকা জারি করা হলে পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করে উত্তরবঙ্গের চা বাগিচা বলয়ে। চা-শ্রমিকদের জয়েন্ট ফোরামের আহ্বায়ক মনি কুমার দার্নাল, আলিপুরদুয়ারের সাংসদ এবং বিজেপির চা শ্রমিক সংগঠন ভারতীয় টি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জন বারলা প্রমুখ চা-বাগানগুলির সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সেখানেও যাতে সবেতন লকডাউনের কথা ঘোষণা করা হয় সেই আর্জি জানান।
অন্যদিকে তৃণমূলের চা শ্রমিক সংগঠন তরাই ডুয়ার্স প্ল্যান্টেশন ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি নকুল সোনার, তৃণমূল কংগ্রেসের চা শ্রমিক সংগঠন চা বাগান তৃণমূল কংগ্রেস মজদুর ইউনিয়নের সভাপতি মোহন শর্মা রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটকের কাছে চা বাগান বন্ধ থাকার বিষয়টি জানতে চেয়ে পত্রালাপ করেন। তাঁরা জানান স্বাস্থ্য দপ্তরের কড়া নজরদারিতে সরকারি নির্দেশিকা মেনে কাজ হোক। কিন্তু কাজ কম করালেও শ্রমিকরা যাতে তাদের পুরো মাসের মাইনে এবং রেশন পায় সেই ব্যাপারেও কড়া নজরদারি চালাক সরকার। বাগানগুলির পরিস্থিতি বিবেচনা করে শ্রমিক সংগঠনগুলো শ্রমিকদের মজুরি দিয়ে লক ডাউন এর পক্ষে সওয়াল করে। চা মালিকদের সংগঠনের যৌথ মঞ্চ কনসালটেটিভ কমিটি অফ প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (সিসিপিএ) চেয়ারম্যান বিবেক জৈন রাজ্যের মুখ্য সচিবের কাছে প্রয়োজনীয় নির্দেশ চেয়ে পাঠান। বেশ কিছু বাগানে বকেয়া মজুরি শ্রমিকদের দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এরপর শ্রমিকদের মজুরি কি হবে সেটা কেউ স্পষ্ট করে কিছু বলেনি বা এই ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় নি। এই ধরনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে শুরু হলো লকডাউনের চা বাগানে কাজের অনুমতি পর্ব। ইতিমধ্যেই ডুয়ার্স ব্র্যান্চ টি অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়ার নতুন সম্পাদক রূপে নিযুক্ত হন সঞ্জয় বাগচী। তৎকালীন টি অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়ার ডুয়ার্স শাখার সম্পাদক বর্ষীয়ান এবং অভিজ্ঞ রাম অবতার শর্মা, আইটিপিএর অমিতাংশু চক্রবর্তী প্রমুখ জানান সরকারি নির্দেশিকায় কোন এলাকাগুলো বন্ধ থাকবে তা স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হলেও সেই মোতাবেক চা বাগানগুলি তার মধ্যে পড়ছে না। তাই সমস্তরকম সর্তকতা অবলম্বন করেই কাজ চালানো হতে থাকে।
চা বলয়ের মূল পাঁচ জেলার মধ্যে জলপাইগুড়ির ক্ষেত্রে কেবল জেলা শহরকে লকডাউনের আওতার মধ্যে রাখা হয়। আলিপুরদুয়ারের ক্ষেত্রে জেলা শহর এবং জয়গাঁকে রাখা হয়। দার্জিলিং এর ক্ষেত্রে দার্জিলিং, কার্শিয়াং এবং শিলিগুড়ি শহরকে ওই তালিকায় রাখা হয়। কালিম্পং এর ক্ষেত্রেও জেলা সদরকেই বাছা হয়। উত্তর দিনাজপুরের সমস্ত এলাকা লকডাউনের আওতায় থাকে যেখানে অনেক ছোট চা বাগান রয়েছে। সরকারি নির্দেশিকা অনুযায়ী ওই সমস্ত জায়গার ফ্যাক্টরিও বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দেশিকায় উল্লেখিত এলাকার মধ্যে খুব বেশি বড় চা বাগান না পড়লেও গণপরিবহন ব্যবস্থা থমকে যাওয়ার ফলে তার প্রভাব অন্য বাগানগুলোর ওপরেও পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। শিলিগুড়ি চা নিলাম কেন্দ্র ২৫ শে মার্চ পর্যন্ত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নিলাম কেন্দ্রের ওয়্যারহাউজ বন্ধ থাকে। প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে শুরু করে ফ্যাক্টরিগুলো। বটলিফ ফ্যাক্টরিগুলো ক্ষুদ্র চা চাষীদের কাছ থেকে কাঁচা চা পাতা যে নেবে না সে কথা প্রাথমিকভাবে জানিয়ে দেয়। চা মালিকদের সংগঠনগুলি প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলতে থাকে এবং যেমন যেমন নির্দেশ আসতে থাকে সেই মোতাবেক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হতে থাকে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴