বাগিচার ডিজিট্যাল ব্যাঙ্কিং - ফিরে দেখা ( তৃতীয় পর্ব/গৌতম চক্রবর্তী
বাগিচার ডিজিট্যাল ব্যাঙ্কিং - ফিরে দেখা
( তৃতীয় পর্ব)
গৌতম চক্রবর্তী
উত্তরবঙ্গে দার্জিলিং পাহাড় ধরে এবং ছোট ছোট চা বাগান মিলে ৩১৬টি চা বাগান রয়েছে। প্রায় সাড়ে চার লক্ষ মানুষ সরাসরি চা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। ২০১৬ সালে নোট বাতিলের পরবর্তী সময়ে চা বাগানগুলিতে ক্যাশলেস মজুরি প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেবার কেন্দ্রের তরফে রীতিমতো সার্কুলার জারি করে এ ব্যাপারে বাগানগুলিকে উদ্যোগী হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে বছরে এক কোটি টাকার বেশি নগদে তুললে কেন্দ্র ২% উৎসে কর (টিডিএস) কাটার নীতি এনেছিল ২০১৯ সালের নির্বাচনোত্তর বাজেটে। নোট বাতিলের পরে কেন্দ্রীয় সরকার এক কোটি টাকার বেশি অঙ্কের নগদ লেনেদেনের উৎসে ২% কর কাটার নিয়ম চালু করায় বিপাকে পড়েছিল চা বাগানগুলি। সেই বিপুল লেনদেন করার মতো উপযুক্ত প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা নিয়েও কিছুটা সংশয় ছিল সংশ্লিষ্ট মহলে। বাগানে ব্যাঙ্কিং পরিকাঠামোর অপ্রতুলতার কথা কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের কাছে তুলেছিল তারা। জবাবে সেই সব বাগানের তালিকা চেয়েছিলেন নির্মলা। সেই তালিকা তৈরি করে দেওয়ার কথা জানালেও চা শিল্পের অনেকেই সংশয়ী ছিল এটিএম গড়লেই শুধু হবে? কারণ খরচের পাশাপাশি তা চালানোর প্রযুক্তি-সহ নানা প্রতিবন্ধকতা এখনও রয়েছে। উপযুক্ত সার্বিক পরিকাঠামো তৈরি না হওয়া পর্যন্ত কর প্রত্যাহার করাই একমাত্র সমাধানসূত্র বলে মনে করেছিলেন তাঁরা। মার্চ মাসে কেন্দ্রীয় বাজেটের পর ২০১৯ সালের পুজোর মুখে বাগিচার মজুরী সংকট এবং টিডিএস সমস্যা জটিল আকার ধারণ করল। পুজোর মুখে জোড়া ধাক্কায় জর্জরিত হতে লাগল উত্তরবঙ্গের চা শ্রমিকরা। একদিকে ন্যুনতম মজুরি থেকে রাতারাতি হাত ধুয়ে ফেলল রাজ্য সরকার। অন্যদিকে ব্যাংকগুলি টিডিএস কাটায় শ্রমিকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মজুরি দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় খুঁজে পেল না চা বাগান কর্তৃপক্ষ। সব মিলিয়ে পুজোর মাসে চা শ্রমিকদের উপর কালবৈশাখী ঝড় আছড়ে পড়ল।
নির্মলার সঙ্গে শিল্প ও ব্যবসায়ীদের আলোচনাচক্রে বাগানে নগদ লেনদেনকে ঘিরে ওই কর আরোপের সমস্যার কথা তুলেছিলেন টি বোর্ডের চেয়ারম্যান তথা চা শিল্পের প্রধাণ কর্তা প্রভাত বেজবড়ুয়া। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছিলেন বাগানের তালিকা দিলে এক মাসের মধ্যে সেখানে এটিএম চালু করা হবে। চা শিল্পের প্রধান কর্তা টি বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রভাত বেজবড়ুয়া কেন্দ্রের দরবারে আর্থিক সঙ্কট এড়াতে চা বাগানগুলির টিডিএস কাটার বিধি শিথিল বা প্রত্যাহারের আর্জি জানিয়েছিল। কেন্দ্র তাতে সাড়া দেয়নি। তবে অর্থমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন কোন বাগানে এটিএম চাইলে সেই তালিকা দিলে এক মাসে তা চালু হবে। চা শিল্পের প্রশ্ন ছিল শুধু এটিএম তৈরি করলেই হবে? তা চলার উপযুক্ত দ্রুতগতির ইন্টারনেট পরিষেবা কই? ব্যাঙ্কগুলি এই সব প্রত্যন্ত অঞ্চলে এটিএম খোলার খরচ বইতে রাজি হবে তো? এটিএম চালুর পরে প্রযুক্তিগত সমস্যায় এটিএম বিগড়ে গেলে তখন? তাই চাপে ছিল চা বাগানগুলি। কেন্দ্রও কোন সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয় নি। ব্যাঙ্কের কর্তারাও কিছু প্রতিবন্ধকতার কথা বলেছিলেন। তাদের আর্জি ছিল যতদিন না এটিএম চালুর উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়া যাচ্ছে তত দিন অন্তত চা শিল্পের ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রত্যাহার করা। আয়কর জমার সময় টিডিএস রিফান্ডের সুবিধা থাকলেও তাতে সময় লাগে। টান পড়ে বাগানের কার্যকরী মূলধনে। অথচ বাগানে হাতে গোনা ব্যাঙ্কের শাখা ও এটিএম থাকায় নগদ লেনদেন ছাড়া উপায় নেই। তাই দু’সপ্তাহ অন্তর শ্রমিকদের মজুরি মেটাতে গিয়ে বাগানগুলির উপর ভয়ঙ্কর কোপ পড়ে। টিডিএস ফেরত পেতে শ্রমিকদের ১৫-২০ কিলোমিটার দূরে ব্যাঙ্কে যেতে হয়। বাগান এলাকায় সুষ্ঠু ব্যাঙ্কিং পরিষেবা চালু না হলে টিডিএস এর আওতা থেকে বাগানগুলিকে বাদ রাখার দাবি জানিয়েছিলেন বাগিচা ম্যানেজমেন্টের কর্মকর্তারা।
শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি দেওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়ম, দালালরাজ ও ইউনিয়নবাজি খতম করে স্বচ্ছতা আনতেই চা শিল্পে ক্যাশলেস ব্যবস্থা চালুর কথা ঘোষণা করে কেন্দ্র। কিন্তু ঘোষণাই সার। ওই ব্যবস্থা চালু করার জন্য বাগানে পরিকাঠামো গড়ে তোলার কাজ বাস্তবায়িত হয়নি। উত্তরবঙ্গের চা শিল্পে তিনটি বৃহৎ চা মালিক সংগঠন ডিবিআইটিএ, আইটিপিএ ও টাই। আইটিপি এর ৩৮টি চা বাগানের মধ্যে সাতটি ও টাইয়ের ২৫টি বাগানের মধ্যে পাঁচটি বাগানে ক্যাশলেস ব্যবস্থা চালু আছে। ডিবিআইটিএর ৮৩টি চা বাগানের মধ্যে সিংহভাগ বাগানে দেড় বছরেও কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষণা মতো ক্যাশলেস ব্যবস্থা চালু হয়নি। এ জন্য দরকার বাগানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখা কিংবা ব্যাঙ্কের এটিএম কাউন্টার। সেটা মাত্র ১০ শতাংশ বাগানে এতদিনে করা সম্ভব হয়েছে। নাগরাকাটা সিপিএম পার্টি অফিসে পেয়ে গেলাম রবীন রাইকে। সিপিএমের চা শ্রমিক সংগঠন চা বাগান মজদুর ইউনিয়নের আলিপুরদুয়ার-কোচবিহার জেলার সাধারণ সম্পাদক রবীন রাই দুঁদে ট্রেড ইউনিয়ন লিডার। জানলাম ডুয়ার্সের চা বাগানগুলিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাধের ডিজিটাল বা ক্যাশলেস ব্যবস্থা কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। করোনাকালীন সময়ে কেন্দ্রীয় সরকার নির্দেশ দিলেও ৯০ শতাংশ চা বাগানে আজও ক্যাশলেস ব্যবস্থা চালু হয়নি। আসলে ক্যাশলেস করতে হলে ব্যাঙ্কের শাখা, এটিএম কাউন্টার খোলা সহ পরিকাঠামো ব্যবস্থা আরও উন্নত করা জরুরি। কিন্তু বহু চা বাগান এলাকায় এসবের কিছুই এখনও হয়নি। তাই এখনও সিংহভাগ শ্রমিকের মজুরি দেওয়া হচ্ছে নগদে। ক্যাশলেস ব্যবস্থা সর্বত্র চালু না হওয়ার জন্য চা শ্রমিক ও চা মালিক সংগঠনগুলি কেন্দ্রীয় সরকারকেই দায়ী করেছে। তাদের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় সরকার ক্যাশলেস ব্যবস্থা চালুর কথা ঘোষণা করলেও বাগানে এই সংক্রান্ত কোনও পরিকাঠামো তৈরির ব্যাপারে উদ্যোগী হয়নি।
বানারহাটে পেলাম তৃণমূল সমর্থিত তরাই-ডুয়ার্স প্ল্যান্টেশন ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নকুল সোনারকে। নকুলবাবুর কাছ থেকে জানতে পারলাম তাঁদের ইউনিয়ন ক্যাশলেস ব্যবস্থার বিরোধী নন। তাঁরাও চান বাগানগুলিতেও ক্যাশলেস ব্যবস্থা চালু হোক। কিন্তু এ জন্য পরিকাঠামো গড়ে তোলা দরকার। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার সেই পরিকাঠামো গড়ে তুলতে ব্যর্থ। তাঁদের মতে, ক্যাশলেস ব্যবস্থার জন্য বাগানে এটিএম কাউন্টার সহ অন্যান্য পরিকাঠামো কেন্দ্রীয় সরকারকে গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার সেই পরিকাঠামো গড়ে তুলছে না। শুধু মুখে বলে যাচ্ছে ক্যাশলেস ব্যবস্থা করা হচ্ছে। টিডিএস ইস্যুতে আলিপুরদুয়ারের সাংসদ জন বারলার সঙ্গে সেই সময়ে যখন কথা বলেছিলাম তখন তিনি বিষয়টি নিয়ে দ্রুত সরকারের সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানিয়েছিলেন। এই টানাপোড়েন চলতে চলতে করোনা পরিস্থিতির উদ্ভব হলে প্রশাসনিকভাবে পুরো ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে যায়। চা বাগানগুলি নগদে মজুরীর পথেই চলতে থাকে। কিছু প্রতিষ্ঠিত বাগান ডিজিটাল মজুরীর দিকে এগিয়ে যায়। জেলাশাসকের দপ্তরের কনফারেন্স হলে চা শিল্পের বেতন, মজুরি দিতে পরিকাঠামোর উন্নয়ন বিষয়ক বৈঠকেও এই প্রসঙ্গ উঠে আসে। চা শিল্পের ভরা মরসুম শুরু হওয়ার আগে মজুরি সংক্রান্ত এই বিষয়টি নিয়ে বাগানগুলোতে ডামাডোল তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন ইউনিয়নের নেতারা এবং মালিকপক্ষ। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার ফলে সেই সংকট থেকে সাময়িক অব্যাহতি মেলে চা শিল্প মহলের। টিডিএস ইস্যুতে চা মালিকরা ক্যাশলেস মজুরির রাস্তায় হাঁটতে চাইলেও বেঁকে বসেছিলেন শ্রমিকরা। ফলে উত্তরবঙ্গের চা বাগানগুলির একাংশে শ্রমিক আন্দোলন নতুন করে দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। বিভিন্ন চা বাগান নোটিশ দিয়ে শ্রমিকদের উদ্দেশে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলি আপডেট কিংবা অ্যাকাউন্ট না থাকলে দ্রুত তা খুলে নেওয়ার নির্দেশ দিতে শুরু করলে দলমত নির্বিশেষে শ্রমিক সংগঠনগুলি ক্যাশলেস মজুরির বিরুদ্ধে সরব হয়।
জলপাইগুড়ি জেলায় অন্তত ২৫ হাজার ক্ষুদ্র চা বাগান রয়েছে। ক্ষুদ্র চা চাষির সংখ্যা অন্তত ৪০ হাজার। এর মধ্যে শতকরা ৫০ শতাংশ ক্ষুদ্র চা চাষির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হয়েছে। অন্যদিকে ডুয়ার্সে মোট বড়ো চা বাগানের সংখ্যা ১৫৪। শ্রমিক সাড়ে তিন লক্ষ। এর মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ শ্রমিকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হয়নি। ক্ষুদ্র ও বড়ো চা বাগানগুলি নোটবন্দির সময় থেকে অ্যাকাউন্ট খোলার চেষ্টা করলেও আজও তা হয়নি। তাই অধিকাংশ চা বাগানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলেনি। অনেক চা বাগানেই মোট শ্রমিকের ৬০-৭০ শতাংশের অ্যাকাউন্ট খোলাই হয়নি। ফলে আজও অধিকাংশ চা বাগানই নগদে মজুরি দিচ্ছে। এমনকি বাগান সংলগ্ন শহর এলাকায় ডুয়ার্সে বেশিরভাগ জায়গাতেই ব্যাংক কিছু থাকলেও এটিএম নেই, খোলা হয়নি গ্রাহক পরিসেবা কেন্দ্র। ফলে নগদে মজুরি দেওয়া ছাড়া উপায় নেই চা বাগিচা কতৃপক্ষের। ডুয়ার্সের সব চা বাগানের শ্রমিক ও কর্মচারীকে অনলাইনে বেতন দিতে হলে পরিকাঠামোর উন্নয়নে নজর দেওয়া প্রয়োজন। জয়েন্ট ফোরামের অন্যতম আহ্বায়ক তথা সিপিএম প্রভাবিত চা বাগান মজদুর ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল আলম জানিয়েছিলেন জোর করে চা বাগানের মতো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শ্রমিকদের নগদহীন অর্থনীতির দিকে ঠেলে দেওয়া হলে তার ফল যে কী মারাত্মক হবে তা কেন্দ্রকে বুঝতে হবে। ফোরামের আরেক আহ্বায়ক তথা এনইউপিডব্লিউ এর সাধারণ সম্পাদক মণিকুমার দার্নালের যুক্তি ছিল চা বাগানে ব্যাংক থাকা তো দূরের কথা, এমনও বহু শ্রমিক রয়েছেন যাঁরা ব্যাংকের মুখই দেখেননি। এমন পরিস্থিতিতে নগদে মজুরি দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। তৎকালীন চা বাগান তৃণমূল কংগ্রেস মজদুর ইউনিয়নের সভাপতি মোহন শর্মা জানিয়েছিলেন রাজ্যের দুই মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস ও মলয় ঘটক টিডিএস ইস্যুতে টি বোর্ড ও রিজার্ভ ব্যাংকের কর্তাদের সঙ্গে দেখা করবেন।
আলিপুরদুয়ারের সাংসদ তথা ভারতীয় টি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি জন বারলা তাঁর নিজস্ব ব্যাতিক্রমী পথে হেঁটে সরব হয়েছিলেন নগদ মজুরির দাবিতে। তাঁর দাবি ছিল টিডিএস আরোপ করা হয়েছে মালিকদের ওপর। শ্রমিকদের ওপর নয়। মালিকদেরই নগদে মজুরি প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। জয়েন্ট ফোরামের পক্ষ থেকে সার্বিকভাবে জানানো হয়েছিল চা শিল্পকে টিডিএসের আওতার বাইরে রাখার দাবি জানিয়ে ফোরামের তরফে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তিনি কী পদক্ষেপ করেন সেদিকেই তাকিয়ে রয়েছেন তাঁরা। নয়তো শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আন্দোলন করবে। আলিপুরদুয়ারের সাংসদ তথা বিজেপি প্রভাবিত চা শ্রমিক সংগঠন ভারতীয় টি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি জন বারলা বাগানে বাগানে ব্যাংকিং ব্যবস্থা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত চা শিল্পকে যাতে টিডিএস-এর আওতার বাইরে রাখা হয় সে ব্যাপারে দ্রুত অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানালেন। এটা ঘটনা যে বহু শ্রমিকের তখনও ব্যাংক অ্যাকাউন্টই নেই। থাকলেও বাগান থেকে টাকা তোলার ব্যবস্থা নেই। এই সময়কালে চা শিল্পকে টিডিএস (উৎসমূলের কর) থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দাবিতে রিজার্ভ ব্যাংকের দ্বারস্থ হল জয়েন্ট ফোরাম। চা শ্রমিকদের যৌথ মঞ্চের চার সদস্যের প্রতিনিধিদল দেশের শীর্ষ ব্যাংকের কলকাতা শাখার আঞ্চলিক নির্দেশকের সঙ্গে দেখা করে তার কাছে একটি স্মারকলিপি তুলে দেন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। ফোরামের অন্যতম আহ্বায়ক জিয়াউল আলম বলেন, উত্তরবঙ্গের কোনো বাগানেই ব্যাংকের শাখা নেই। এমন অবস্থায় চা শিল্পকে যদি টিডিএস থেকে অব্যাহতি না দেওয়া হয় তবে বাগান মালিকরা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট মারফত ক্যাশলেস মজুরির রাস্তায় হাঁটবেন। সেটা হলে সাড়ে ৪ লক্ষ শ্রমিকের সর্বনাশ। কাজে গরহাজির থেকে শ্রমিকদের পক্ষে দূরদুরান্তের ব্যাংকে মজুরির টাকা তুলতে যাওয়া সম্ভব নয়।
বাগানেই ব্যাংকের পরিকাঠামো তৈরি করে দেওয়া হলে তবেই শ্রমিক-মালিক সব পক্ষের লাভ। যতদিন তা না হচ্ছে ততদিন চা বাগানকে যাতে টিডিএস এর আওতার বাইরে রাখা হয় সেই আর্জি তারাও সরকারের কাছে রাখে। জয়েন্ট ফোরামের তরফে টিডিএস নিয়ে গত ২০১৯ সালের ২১ জুলাই রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর সহ কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছিল। তারা ফের রিজার্ভ ব্যাংকের কলকাতা শাখার কর্তাদের সঙ্গে দেখা করে পরিস্থিতি বিশদে বোঝানোর চেষ্টা করেন। রিজার্ভ ব্যাংকের কলকাতা শাখার পক্ষ থেকে জানানো হয় তাদের পূর্বাঞ্চলীয় আঞ্চলিক কমিটির বৈঠকে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ফোরামের পক্ষ থেকে দাবি জানানো হয় ক্যাশলেস মজুরি ব্যবস্থা চালু করতে হলে বাগানের অফিস থেকেই শ্রমিকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট মারফত টাকা তোলার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। নয়তো এটা মেনে নেওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই। কোন বাগানে ব্যাংকের পরিকাঠামো নেই। এই অবস্থায় অনলাইনে মজুরি শ্রমিকদেরকে বিপাকে ফেলে দিল উত্তরের চা বাগিচাগুলিতে। অ্যাকাউন্ট থেকে বছরে এক কোটি টাকার উপরে তুললে শতকরা ২ শতাংশ হারে উৎসমূল কর অর্থাৎ টিডিএস কেটে দেওয়া প্রত্যাহার না করার ফলে সব চা-বাগানই অনলাইনের রাস্তায় হাঁটতে শুরু করল। চা মহল সূত্রে জানা গেল শতকরা কুড়ি শতাংশ বাগান ইতিমধ্যেই এই পদ্ধতি শুরু করে দিয়েছে। সিসিপিএর আহবায়ক এবং আইটিপিএর উপদেষ্টা অমিতাংশু চক্রবর্তী জানালেন টিডিএস থেকে চা শিল্পকে ছাড় দেওয়ার আর্জি কেন্দ্রীয় সরকারকে জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনোরকম ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। সেই পরিস্থিতিতে নগদ থেকে বের হওয়া ছাড়া উপায় নাই। তাই ধীরে ধীরে অনলাইনে যাওয়া।
ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে তখন টিডিএস দিয়েই শ্রমিকদের মজুরি দিচ্ছিল বানারহাটের মোগলকাটা চা বাগান। বাগানের ম্যানেজার মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য জানিয়েছিলেন ক্ষতি স্বীকার করেও নগদে মজুরি দেওয়া হচ্ছে। তবে বেশিদিন সম্ভবপর নয়। পরিস্থিতি অত্যন্ত সংকটজনক। অনলাইনে যাওয়া ছাড়া কোনো রকম গতি নেই। মেটেলির ইংডং চা বাগানের সুপারিনটেনডেন্ট ম্যানেজার রজত দেব বলেছিলেন স্টাফ এবং সাব স্টাফেদের মাসিক বেতন অনলাইনে দেওয়া হলেও শ্রমিকদের তখনো অফলাইনে দেওয়া হচ্ছে টিডিএস পেমেন্ট করেই। ফলে বাগানের কার্যকরী মূলধন এর ওপর টান পড়তে শুরু করেছে এবং অনলাইনের ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। চা শ্রমিকদের যৌথ সংগঠন জয়েন্ট ফোরামের অন্যতম নেতা জিয়াউল আলম বলেছিলেন যে সমস্ত বাগান অনলাইনে মজুরি দিচ্ছে তাদের আশেপাশে ব্যাংক রয়েছে। তবুও শ্রমিকদের চরম ভোগান্তির মুখে পড়তে হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের দ্রুত মজুরিসহ চা বাগানের সমস্ত সমস্যা নিয়ে সব পক্ষকে ডেকে বৈঠকের আয়োজন করা একান্তই প্রয়োজন। ন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ প্ল্যান্টেশন ওয়ার্কার্সের সাধারণ সম্পাদক মনিকুমার দার্নাল পুনরায় বলেন অনলাইনে মজুরি নিয়ে আপত্তি নেই। তবে তার আগে সব বাগানে ব্যাংকিং পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। ডুয়ার্সের চা বাগানে ব্যাঙ্কিং পরিষেবা নেই বললেই চলে। সেক্ষেত্রে শ্রমিকদের ক্যাশলেস মজুরি প্রদানে চা বাগানের মূল ভরসা হয়ে উঠেছিল ডাক ব্যাংক। মূলত ইন্ডিয়ান টি প্ল্যানটার্স অ্যাসোসিয়েশন এই উদ্যোগ নেয়। নাগরাকাটার প্রত্যন্ত বামনডাঙ্গা চা বাগানের শাখা ডাকঘরে শ্রমিকদের একাউন্ট খোলার কাজ শুরু হয়। জানা যায় সেপ্টেম্বর থেকেই বহু বাগানে ক্যাশলেস মজুরি চালু হয়ে যেতে পারে।
ডাক ব্যাংকের জলপাইগুড়ি শাখার তৎকালীন ম্যানেজার নিমা শেরপা জানিয়েছিলেন চা বাগানের শ্রমিকদের স্যালারি অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া হচ্ছে। তাতে মজুরি ছাড়াও সরকারি নানা প্রকল্পের ভর্তুকির টাকা অ্যাকাউন্টে ঢুকবে। অন্যান্য বাগানেও চাহিদামত অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া হবে। আইটিপি এর উপদেষ্টা অমিতাংশু চক্রবর্তী বলেন, ক্যাশলেস মজুরি প্রদান চা শিল্পে প্রায় বাধ্যতার জায়গায় চলে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কোনরকম ব্যাঙ্কিং পরিষেবাহীন বাগানগুলিতে ডাক ব্যাংক যে ত্রাতার ভূমিকা পালন করতে পারে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। বাগানগুলোর একাংশ ডাক ব্যাংকে শ্রমিকদের একাউন্ট খোলার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। আইটিপিএ সূত্রে জানা যায় ডুয়ার্সের কোন বাগানে ব্যাংকের কোন শাখা নেই। অথচ ডাকঘরের শাখা রয়েছে এমন বাগানের সংখ্যা প্রায় ৯০। সেক্ষেত্রে ডাকঘরের মাধ্যমে ডাক ব্যাংকের ধারণাই এক্ষেত্রে মুশকিল আসান হিসাবে কাজ করবে। সংস্থার উপদেষ্টা অমিতাংশুবাবু জানান ডাকঘর রয়েছে এমন বাগানগুলোর শ্রমিকদের ডাক ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে মজুরি দেওয়া হলে সেক্ষেত্রে তাদের আর কাজে গরহাজির হয়ে দূর-দূরান্তের ব্যাংকে যেতে হবে না। এতে শ্রমিক ও মালিকপক্ষ উপকৃত হবে। ডাক বিভাগের জলপাইগুড়ি ডিভিশন জানিয়েছিল জেলায় তাদের ডাকঘর রয়েছে ৩০২ টি। তার মধ্যে ডাক ব্যাংকের কাজ হয় ২৬৮টি শাখায়। বামনডাঙ্গা চা বাগানের তৎকালীন ম্যানেজার অম্লান কুসুম গরাই এর কাছ থেকে জেনেছিলাম তাদের ১২০০ শ্রমিককে বাগানে অবস্থিত ডাকঘরের ব্যাংকে নিখরচায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া হয়েছিল।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴