সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
11-August,2023 - Friday ✍️ By- শুক্লা রায় 503

হাসোবুড়ি/শুক্লা রায়

হাসোবুড়ি
শুক্লা রায়

পুতলির তখনও খাওয়া হয়নি। ভাতটা মেখেই চলেছে, মেখেই চলেছে। বাবার, ঠাকুর্দার এমনকি দাদারও খাওয়া শেষ। মা খুব বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে। ঠাকুমা স্নান সেরে ঠাকুর প্রণাম করতে করতে গজগজ করছে। পুতলি অবশ্য শুরুটা শুনল "হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ"। তারপরেই গুনগুন করা গানের সুরটা কেমন পাল্টে গেল। আসলে পুতলি খেতে বসেছে দরজাটার ঠিক মুখটায়। ওখান থেকে যেমন বাইরের বিশ্বজগত দেখা যায়, তেমনি পুতলিকেও চোখে পড়ে সহজেই। সে দেখেই বুড়ির মেজাজ সপ্তমে। একটু কান পাতলেই স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, "মেয়ে মানুষের ঢং দেখ। যার খাওয়া ঝট করে হয় না তার কাজও আগায় না। মায়ের মতো কুঁড়ে হবে। আমার গুণ একটাও পাবে না। সেই কখন খেতে বসেছে, এখনও খাচ্ছেই।" পুতলি বোঝে না ওর মাকে কুঁড়ে বলে কেন। মা তো সব কাজ একাই করে, এমনকি মাঠেও বাবার সঙ্গে কাজ করতে চলে যায় রান্না করে রেখে। তাহলে? প্রণাম সেরে গলাটা তুলে ওকেই বললেন, "এই চেংড়ি, এবার ওঠ! কত খাস রাক্ষসের মতো?" পুতলির রাগ হয়ে যায়, কিন্তু ওঠার নাম করে না, মাথা নিচু করে ভাতটা আবার চটকাতে থাকে। ওর মা বুঝতে পেরেছে মেয়ে আর খাবে না।  শাশুড়ি এত কথা শোনাল বলে নিজের আর মেয়েটাকে বকতে ইচ্ছে করল না। কাছে এসে হাতটা থালা থেকে তুলে ধুয়ে দিল। মুখটাও ধুয়ে আঁচলে মুছতে যাবে পেছন থেকে হাসোবুড়ির গলা, "মা, ভাতটা না খেলে আমাকেই দাও, আজকে ভিক্ষা টিক্ষা নাই।" বলে ছেঁড়া ঝোলাটা তুলে দেখাল। সত্যিই সামান্য এক দু' মুঠ চাল হবে হয়ত। পুতলির মা অনিতা তাড়াতাড়ি মেয়ের এঁটো থালাটা সরিয়ে কাঁচা বারান্দায় একটা পিঁড়ি পেতে দেয়। বুড়ি বুঝতে পারে আজকেও এখানে খাওয়া জুটবে। শাশুড়ি পছন্দ না করলেও অনিতা বুড়িটাকে খেদাতে পারে না। পাড়ারই মানুষটা, দেখার কেউ নেই। এখানে ওখানে ভিক্ষে শিক্যে করে পেট চালায়। তাকে দুটো ভাত দিলে কতটুকুই বা হাঁড়ির ভাতে কম পড়বে!
বুড়ি ঝোলাটা একপাশে নামিয়ে কলপাড়ে গিয়ে হাতে পায়ে জল দেয়। ফোলা ফোলা ফাটা ফাটা পা দুটোয় অজস্র দাগ। পুতলি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। বুড়িটা বুঝতে পারে। মাথাটা ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ফোকলা মুখে হাসে। এতক্ষণের অনিশ্চিত বিষন্ন মুখটায় যেন এক ঝলক আলো এসে পড়েছে। তারপর লাঠিটা বারান্দায় হেলিয়ে রেখে পিঁড়িতে বসে। অনিতা যত্ন করে ভাত আর জলের গ্লাস এগিয়ে দেয়। খেতে খেতে পুতলি দেখে বুড়ির চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। বুড়ি গেলে পুতলি ওর মার পিছে পিছে ঘোরে। "মা, ওমা। বুড়ির নাম হাসোবুড়ি কেন?" অনিতা পান চিবোতে চিবোতে অন্যমনস্ক গলায় উত্তর দেয়, "কি জানি। আমরা কী আর অতশত জানি? আমার বিয়ের আগে থেকেই সবাই ওই নামে ডাকে। এসে অবধি শুনছি।" আসলে অনিতা ক'দিনের জন্য বাপের বাড়ি ঘুরে আসতে চাইছে। অনুমতি পাওয়া যাবে কিনা এই ভেবেই দুদিন থেকে চিন্তায় অস্থির। অনেকদিন যাওয়া হয় না। বাপ নাই, মা-টা কেমন আছে কে জানে। পুতলি কিন্তু ছাড়ার পাত্র নয়, "মা, ওওমা। হাসোবুড়ি আবার কেমন নাম!" এবার বাস্তবে ফেরে অনিতা। মেয়ের প্রশ্নটা ভালো করে মন দিয়ে বোঝে, তারপর বলে, "ছোটবেলায় নাকি খুব হাসত, সেজন্য নাম হাসোবুড়ি।" পুতলি হি হি করে খানিকটা হেসে বলে, "তাহলে এখন যে কাঁদে, তাহলে তো নাম কাঁদোবুড়ি হয়!" অনিতা রেগে যায়। মেয়েকে একটা ধমক দেয়। "এঃ, এসব কী কথা মা, এরকম বলতে নেই।" পুতলি থামার পাত্র না। "আমি যে কাঁদতে দেখি। সেদিন বড় বটগাছটার তলায় মাথা নিচু করে কাঁদছিল একা একা।" অনিতার বুকটা মুচড়ে ওঠে। মেয়েকে জিজ্ঞেস করে "কবে?" পুতলি ঠোঁট উল্টিয়ে বলে "কত্ত দেখি আমি। আমি ওখানে খেলি যে।" 
বয়স হয়েছে। খুব দূরে দূরে ভিক্ষা করতে যেতে পারে না। নিজের গ্রামটার বেশিরভাগ লোকই পরের জমিতে খেটে খায়। কত আর ভিক্ষা দেবে তারা। দুপুর বেলা প্রায় বাড়িতেই লোক থাকে না। এই বয়সে না খেয়ে আর থাকতে পারে না বুড়ি। অনিতা ঠিক করল বুড়িটাকে দেখলেই খেতে ডাকবে। তিন কূলে কেউ আছে বলেও তো মনে হয় না। খুব ছোটবেলায় বিয়ে হয়েছিল। বয়সে তিনগুণ বড় একটা বুড়োর সঙ্গে। অবস্থা নাকি ভালোই, বাড়ি-ঘরও সেরকম। সে বুড়ো মরল তো সে বাড়ির সঙ্গে সম্পর্কও চুকে গেল। ফিরে আবার বাপের বাড়ি। বাপ-মাও একদিন মরে জ্বালা জুড়ালো। একটা ভাই, কোথায় শ্বশুরবাড়ি সেখানে থাকে। একটামাত্র ঘর নিয়ে বুড়ি একাই থাকে বহুকাল। মাথাভর্তি ছোট ছোট চুল। বাচ্চারা পেছন থেকে চেঁচালে মাথায় হাত বুলায়। "ও বুড়ি তোর চুল কোথায়?" খরখরে আঙুলগুলো দিয়ে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বুড়ি উত্তর দেয়, "তোরা আর কী বুঝবি। তেল সাবানের খরচ বাঁচে।" তারপর কখনো দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ফেলে আবার হাঁটা দেয় লাঠিতে ভর দিয়ে দিয়ে। ঝুলে পড়া চামড়ার ভেতর থেকে উঁকি মারছে ছোট ছোট দুটি চোখ। তোবড়ানো গালের গোলগাল মুখটায় ক্লান্তি আর ক্ষিধে ক্রমশ প্রকট। এ হেন মুখটা দেখেও কারো মায়া জাগে না, অনিতা অবাক হয়। অবশ্য বেশিরভাগ বাড়িতেই তো নিত্য অভাব এখানে। যাদের একটু জমি-জমা বেশি, সারাবছরের ধানটা পায় তাদের কথা আলাদা, যেমন অনিতারাই।
আশ্বিন মাসের শেষ শেষ এবার দূর্গা পূজা। কারো বাড়িতে আনন্দ তো কারো বাড়িতে ঝুপ ঝুপে অন্ধকার। বাচ্চা বুড়ো সবার মুখ কালো। অবস্থাপন্ন যারা তাদের পুজোর বাজার চলছে। বৌয়ের শাড়ি, ছেলে-মেয়ের জামা-কাপড়। যাদের হাতের উপর ভরসা করে চলতে হয় সারা বছর, তাদের সবকিছুই এখনও অনিশ্চিত। এরমধ্যে হাসোবুড়ির একমাত্র যুদ্ধ শুধু রোজকার খাবারটা জোগাড় করা। ছেঁড়া সাদা থানটা এতটাই মলিন আর জীর্ণ যে চোখে চেয়ে দেখা যায় না। তবু পুজো কাটল এভাবেই। পুজোর দিন ক'টা ভিক্ষা চাইতে গেলে লোকে গালাগালি করে। বাড়িতেই থাকতে হল। তবে এ বাড়ি ও বাড়ি চেয়ে-চিন্তে খেয়ে পাড়াতেই পুজোর দিন ক'টা কেটে গেল। দুই একজন এসে মেলা থেকে কেনা সওদা-পাতিও দিল। বুড়ির মোটের উপর মন্দ কাটল না। 
সবে নতুন শীত পড়েছে। বুড়িকে দেখা গেল শাড়ির উপর বহু পুরনো জরাজীর্ণ একটা ঢলঢলে উলের সোয়েটার গায়ে চাপিয়েছে। অনিতা বুঝতে পারে বুড়ির এখন ঠান্ডা সহ্য হয় না। মনে মনে ভাবল পুতলির বাবার অনুমতি পেলে ওদের পুরনো কম্বলটা বুড়িকে দিয়ে দেবে। কে কবে চাংড়া পেতে দিয়েছে, তার উপরই চটের ভেতর খড় ঢুকিয়ে বিছানা। কম্বলটা পেলে বুড়ির আরাম হবে। দেব দেব করতেই হঠাৎ একদিন শোনে বুড়ি নেই। রাস্তায় মাথা ঘুরে পড়ে ওখানেই শেষ। খেতে না পাওয়া অশক্ত শরীরটা আর নিজেকে বয়ে বেড়াতে পারল না। খবর পেয়ে পাড়ার লোকই ছুটে গিয়ে বুড়িকে নিয়ে এল। এমনিতে ছোটখাট মানুষটা বয়সের ভারে এতটুকু হয়ে গেছে। অনিতা খবর পেয়ে তাড়াতাড়ি বের হতে গিয়ে উচ্চকিত কান্নার আওয়াজ পেয়ে থমকে দাঁড়ায়। কে কাঁদে! কাঁদার কে আছে?  কাঁদছে। বাইরে বের হয়ে এসে দেখে অনেক লোক। বুড়ির নাতি-নাতনি, ভাইঝি, ভাইপো -বৌ গলা তুলে পাড়া সরগরম করে কাঁদছে। বেঁচে থাকতে যার কেউ ছিল না দু-মুঠো খাবারের জোগান দিতে, বুড়ি মরতে তার সদ্ গতি করার লোকের অভাব নেই দেখা গেল। এমনকি কান্নার অভাবটাও থাকল না!

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri