শূন্য আমি পূর্ণ আমি/৯
শূন্য আমি পূর্ণ আমি
পর্ব/৯
অমর চক্রবর্তী
^^^^^^^^^^^^^^^^^^
'কত অজানারে জানাইলে তুমি,
কত ঘরে দিলে ঠাঁই"...
টিউশন বাড়ছে। একটা আয়ের মুখ দেখছি কিন্তু আমার পড়াশোনার কি হবে! আশিস নাহা আমার সিনিয়র, গোসানীমারী হাই স্কুলে ছিলেন, অবসর নেবার পর সাহিত্যে ডুবে ছিলেন, করোনা যাকে আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিল! আশিস তোকে ভুলি সাধ্য কি! আশিসের মা কল্যাণী মাসিমা বলতেন "অমর এম.এ-টা করতে হবে।" প্রতিনিয়ত তাগাদা দিতেন। বলতাম "মাসিমা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার অর্থ আমার নেই।" "তাতে কি? প্রাইভেটে দিবি। বইপত্র কেনার মতো নিশ্চই টিউশন করছিস।" তা করছি। মাস গেলে ২টাকা থেকে শুরু করে পঞ্চাশ টাকায় পৌঁছেছি! আচ্ছা ভাবি। ভাবনা গাঢ় হল এক দেবতাস্বরূপ মানুষকে দেখে, তিনি ড.হরিপদ চক্রবর্তী। পায়ে খড়ম, গায়ে গেরুয়া মিষ্টিভাষী এই মানুষটিকে দেখলাম রণজিৎদা মানে কবি রণজিৎ দেবের বাসায়। তখন সবে ত্রিবৃত্ত দপ্তরে যেতে শুরু করেছি।মাসিমাকে বললাম, "আমি পরীক্ষা দেব।" উনি খুব খুশি হলেন।
আশিস নাহা আমার বেদনার দিনে আনন্দে রাখার চেষ্টা করেছে কিন্তু তাকে অনেক যন্ত্রণা নিয়ে পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে। ওকথা বলতে আমার বুক ভেঙে যায়। যেমন আর এক আশিসের কথায়। সে সদ্য প্রয়াত গল্পকার আশিস ভট্টাচার্য। আমার চেয়ে অনেক বড় কিন্তু আমরা বন্ধু। কাঁধে ঝোলা সাইকেল আরোহী শিক্ষক আশিসকে এই শহরের অনেকেই দেখেছেন। পাগল আশিস এস্টাব্লিশমেন্ট বিরোধী বলে শক্তিশালী গল্পকার হয়েও আলোচনার বাইরে রয়ে গেল। আরো এক কারণ ওরা ঘরের বাইরে যেতে চায়নি ফলে কলকাতা আশিসকে চিনলই না! আমি বলতাম আশিস এই অঞ্চলে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের যথার্থ উত্তরাধিকার। আশিস 'অলক্ষ্যে 'পত্রিকায় আমাকে সহ সম্পাদক করে নিয়েছিল। আর প্রতিদিন বলত "অমর এবার আমরা যৌথ গল্প সংকলন করব।" আমি রাজি, কিন্ত অর্থ! অতএব হল না এবং এই জীবনে আর হলই না!
আশিসের জীবন সে এক মিথ, বিয়ে থেকে দিনযাপন। আশিস আমাকে একটা ভালো টিউশন জোগাড় করে দিয়েছিল। স্বপ্নাদি, দিদিমণি প্রাইভেটে এম.এ। এরপর অনেক মাস্টারমশাইকেও পড়িয়েছি। সে পরের পর্ব।আশিস 'অলক্ষ্যে' বন্ধ করে বের করল 'দশদিগন্ত'। আমার সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বন্ধ হল। শুধু লেখা দেবার জন্য চিঠি পেতাম, আমার দেওয়া হয়নি!
টিউশন বাড়ল। বই কিনতে শুরু করলাম।এম.এ করতেই হবে। সিলেবাস আনলাম।একটু করে পড়া আর টিউশন। ফর্ম ফিলআপের সময় এল, আবার টাকার সমস্যা।বাবাকে বলিনি। মায়ের একটা গলার হার ছিল, নিয়ে গেলাম এক কর্মকারের কাছে।দেড়শো টাকায় বন্ধক এক ভরি হার। সেই হার আজো ফেরত পাইনি তিনগুণ টাকার বিনিময়েও। আমি পাশ করেছি একাধিক চাকরি করেছি কিন্তু মায়ের গয়না ফিরিয়ে দিতে পারিনি এবং খাওয়াতেও পারিনি, তিনি তখন আমাদের থেকে কত দূরে..
একদিকে টিউশন, এম.এ পরীক্ষা, আর এক দিকে নিজেকে প্রকাশের দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা।ঐ যে মেডিকেল স্টোর্সে চাকরি পেয়েছিলাম।ওখানে দুপুরটায় খুব কাজ থাকত না। বসে গল্প লিখতাম। কোথায় ছাপতে দেব? মেলভিন পাওয়ারের একটা বই পড়েছিলাম Self Hypnosis. ওখানে একটা কথা পড়েছিলাম সেইসময়, আজো মাথায় ঢুকে আছে--we must decide what we want and then visualize this. আমি কি হব?সেই যে চাকরির জন্য বয়স বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তার প্যানেল বেরোল। আমি আছি।আর একটা দপ্তরে করণিক পদে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম আমি ফার্স্ট হলাম। আহা একটা চাকরি তো হবেই!
ফরাসি ভাষায় একটি প্রবাদ আছে Nous Avons change tout cela অর্থাৎ আমরা বহু পরিবর্তন করে ফেলেছি আর দরকার নেই। একসময় মনে হয়েছিল জেলা পরিষদে একটা চাকরি বা ইলেকট্রিসিটি বোর্ডে একটা চাকরি হলেই সব হবে, কিন্তু বিধাতা যে অন্য কিছু লিখে রেখেছেন। দুজন বন্ধু পেলাম একজন ইকোনমিক্সের উজ্জ্বল সরকার আর একজন কমার্সের সৌকত আলি। দুই বন্ধু ভরসা দিল "আমাদের রুমমেট হয়ে থাকবি। স্যারদের সঙ্গে দেখা হবে, সাহায্যের ব্যবস্থা হবে।" ওরা কথা রেখেছিল। আমি বেশ কিছুদিন ওদের সঙ্গে আর.কে হস্টেলে কাটিয়েছি। ওদের মাইল্ড ragging-এর মজা নিয়েছি। আর পেয়েছি অচিন্ত্য বিশ্বাসের মতো প্রিয় স্যারকে। লেখার জগতে এসে পেয়েছি মাস্টারমশাই প্রিয় প্রাবন্ধিক অশ্রুকুমার শিকদার-কে । 'আধুনিক কবিতার দিগ্বলয়' আমার পাঠ্য ও প্রিয় গ্রন্থ। মনের মতো না হলেও দ্বিতীয় শ্রেণির মধ্যম রেজাল্ট নিয়ে বেরিয়ে এলাম। অনেকেই বলেন মানে অনেক কবি যারা স্বঘোষিত এস্টাব্লিশমেন্ট বিরোধী প্রচার করাকে শ্লাঘার বিষয় বলে মনে করেন একাডেমিক না হলে তাদের অনেক অজানা থেকে যায় বলে আমার মনে হয়। বোদলেয়ার, রাবোঁ বা গিন্সবার্গ যাদের একমাত্র পাঠ্য বলে মনে হয় তারা মধ্যযুগের এক কবি (পদাবলীর নয়) গোবিন্দ দাস পড়লেন কৈ! তিনি সেই যুগে লিখতে পেরেছিলেন 'আমি তারে ভালোবাসি অস্থি মাংস সহ' কিম্বা মধ্যযুগের মুসলিম কবিদের বৈষ্ণব পদাবলী কিম্বা মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের গদ্য 'যেদিন আমরা পেটপুরে শাকভাত খাই সেদিনই আমাদের জন্মদিন।'
সক্রেটিস আধুনিক কবিদের হোমার আবৃত্তি করতে বললেন এবং জিজ্ঞেস করলেন এর মানে কি? সভা শূন্য করে কবিরা পালিয়ে গেলেন! এখন আমাদের কবিরা হয়তো এই উত্তর দেবেন, আধুনিক কবিতার ব্যঙ্গার্থ সক্রেটিসের মাথায় ঢুকবে না তাই পালিয়ে গেলেন। এভাবেই আধুনিক কবিদের জয় হবে হয়তো! আমার এক অনুজ কবির কবিতা পড়েছিলাম 'সমুদ্র তুমি চানাচুর'। কতকাল ভেবেছি এই চিত্রকল্প-এর মানে কী!সেকি চানাচুরের মতো তরঙ্গের শব্দ ! বুঝিনি।পরে বুঝব। বলতে হবে বন্ধুদের কথা। পাঠক, লিখতে গিয়ে বারবার যে প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছি তা হল অটোটাইপ। লিখি এক চলে যায় আর এক! তেমন লিখলাম মনের মতো না হলেও দ্বিতীয় শ্রেণির উত্তম হয়ে গেল মধ্যম। জীবনটাই তো উত্তম থেকে মধ্যম এবার বুঝি এর থেকেও দূরে চলে যেতে হবে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴