লে পাঙ্গা/৯
পহেলবান
জনা দশ বারো ছেলে এসেছে। পরিচিত মুখের মধ্যে তিন চার জন এথলিট, শুভঙ্কর , হরিশংকর, গোবিন্দ - বাকিরা আনকোরা। আশ্চর্যের ব্যাপার একজন ও ফুটবলার আসেনি। সুবীরের চোয়াল শক্ত হল।অথচ তিন দিন ধরে ক্লাসে ক্লাসে নোটিস পাঠানো হয়েছে- কাবাডি র জন্য দল গঠন হবে, আজ নাম দেওয়ার শেষ দিন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল- কাবাডি কে কেউ খেলা হিসেবে তেমন পাত্তাই দেয়নি। সুব্রত নাকি বলেছে - ওটা একটা খেলা? কজন চিনবে কাবাডি খেললে? আশ্চর্যের ব্যাপার - দেবজিতও এলোনা? ওও কি ভাবে কাবাডি একটা ফালতু খেলা?
-"স্যার, কি করব? মাত্র দশ বার জন এসেছে।"
হতাশা লুকিয়ে দিলীপ দা বললেন -" ওতেই হবে। শুরু করার জন্য সংখ্যা টা খারাপ না। আজ কোর্ট টা বানিয়ে ফেল। দেখি না কয়দিন। ছেলেরা আসবে। না আসলে তৈরি করতে হবে।"
সুবীর ছেলেদের নিয়ে কোর্ট তৈরি করতে চলে গেল। মাঠের উত্তর প্রান্তে গোল পোস্টের পিছনে অনেকটা ফাঁকা জায়গা আছে- ওখানেই কোর্ট তৈরি হবে।
দিলীপদা বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন -"একটা মরে যাওয়া খেলাকে বাঁচিয়ে তোলা অত সহজ না।"
দিনদশেক হল কাবাডির প্র্যাকটিস শুরু হয়েছে। উন্নতি আদৌ উৎসাহব্যঞ্জক নয়। অনেক সমস্যা- বেশিরভাগ ছেলেই আনকোরা, অন্য কোন খেলাও খেলেনি। ওদের তৈরি করতে অনেক সময় লাগবে। শুভঙ্কর, গোবিন্দ আর হরিশংকর মোটামুটি খেলাটা ধরেছে। শুভঙ্কর রেইড টা ভালোই করছে। গোবিন্দ র ডিফেন্স খারাপ না। ও একবার ধরে ফেললে বেঁচে আসা মুস্কিল। কিন্তু মুস্কিল হল- কেউই প্রপার টেকনিক জেনে খেলছে না। আর এই ব্যাপারটা ধরিয়ে দেওয়ারও কেউ নেই। সুবীর বা দিলীপদা- কারোরই বিপিএড-এ কাবাডি ছিল না। মোটামুটি টেকনিকগুলো বই পড়ে জানে। কিন্তু নিজে করে দেখান আর মুখে বলার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য - বিশেষতঃ খেলায়।
গোদের উপর বিষফোঁড় - এই কাবাডি খেলোয়াড়দের নিয়ে স্কুলে একটা হাসাহাসি শুরু হয়েছে। একই মাঠে ফুটবলার আর এথলিটরাও প্র্যাকটিস করে। ওরা নাকি মাঝে মধ্যেই এদের টিটকারি দেয়। পহেলবান বলে ডাকে। মূল টার্গেট গোবিন্দ আর শুভঙ্কর। পহেলবান কথাটা গোটা স্কুলে চাউর হয়ে গেছে। এই ব্যাপারগুলোতে ওরা ডিমরালাইজড হচ্ছে। একদিন বাধ্য হয়ে শুভঙ্কর এসে সুবীরকে অভিযোগ জানাল। শুনে সুবীরের খুব খারাপ লাগলো - দেবজিত ও নাকি এই দলে আছে!
এসব ব্যাপার সুবীর একদম বরদাস্ত করতে পারে না। সাথে সাথে সমস্ত ফুটবলার আর এথলিটদের ডাকল -"আজ থেকে তোদের প্র্যাকটিস বন্ধ। যা, ড্রেস চেন্জ করে বাড়ি চলে যা। কাল থেকে কেউ মাঠে আসবি না"
সুব্রত -"কেন স্যার, কি হয়েছে?"
সপাটে চড় পড়ল সুব্রতর গালে -"এদের পহেলবান বলিস কেন? ফাজলামি পেয়েছিস? তোরা স্পোর্টসম্যান? যাদের স্পোর্টসম্যান স্পিরিট নাই, তারা এই মাঠে খেলবে না।"
সবাই নিস্পন্দ হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সুবীরের রাগ সবাই ভয় পায় - এমনকি দিলীপদাও। সুবীর আসলে খুবই ইমপালসিভ। তাই অনেক ক্ষেত্রে কোন সমস্যা সমাধানের জন্য সুবীরের কাছে এলে উল্টে সমস্যা আরো জট পাকিয়ে যায়।
-"তোমরা দেখছ তো স্যার কতটা রেগে গেছেন। অত্যন্ত অন্যায় কাজ করেছ তোমরা। তোমাদের জন্য গোটা স্কুল ওদের নিয়ে হাসাহাসি করে। ওদের জায়গায় তোমরা থাকলে তোমাদের কেমন লাগত? স্কুলে কেউ যাতে ওদের নিয়ে হাসাহাসি না করে - সেটা তোমাদের দেখতে হবে। যেদিন এই ব্যাপারটা পুরোপুরি বন্ধ হবে, সেদিন থেকে তোমরা মাঠে আসতে পারবে।" - দিলীপদা সামাল দেন।
সেদিন প্র্যাকটিস শেষে দিলীপদা , সুবীর বিষণ্ণ মুখে স্টাফরুমে ঢুকল। মিহিররা কয়জন তখনও বাড়ি যায়নি, স্টাফরুমে গ্যাজাচ্ছে।
দিলীপদা একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন -" নাঃ, কাবাডি মনে হয় বাদই দিতে হবে।"
-"কেন, কি হল আবার?"
-"হচ্ছে না। এদের তৈরি করতে অনেক সময় লাগবে। মোটিভেশন নাই, শেখানোর লোক নাই - অনেক সমস্যা। এই চাপটা না নিলেই হত।"
নিতাই হঠাৎ উৎসাহ দেখিয়ে বলল -"এক কাজ করা যায় না? আজকাল তো ইউ টিউব-এ সব কিছুর ভিডিও পাওয়া যায়। কাবাডির ভিডিও যদি ওদের দেখান যায়?"
প্রস্তাবটা দিলীপ দার মনে ধরল -"দেখ তো আছে নাকি।"
নিতাই সাথে সাথে ইউ টিউব খুলে দেখতে শুরু করল। যা পেল, প্রায় সবই PKL-এর ম্যাচ হাইলাইট। দিলীপদাকে দেখাল।
-"হ্যাঁ, ভালোই তো। টেকনিকগুলো শেখানোর ভিডিও থাকলে ভালো হত। ঠিক আছে, এতেও চলবে। এগুলো কি বড় স্ক্রিনে দেখানোর ব্যবস্থা করা যাবে?"
মিহির মাথা নাড়ল।
এবারে শুভাশিসদা মুখ খুললেন -" হ্যাঁ রে, আগে যারা হাডুডু খেলত- তাদের কাউকে যদি শেখানোর জন্য রাজি করানো যায়?"
-" তেমন কাউকে তুমি চেনো নাকি?"
-" এদিকে তো একজন ছিল, কিন্তু ও আবার মারা গেছে নাকি? এক কাজ কর না - হরিহরকেই ধর। সেরা খেলোয়াড় ছিল। যদি রাজি হয়ে যায় - দারুণ হবে।"
-"ওদের বাড়ি তোমার জানা আছে?"
-"ঘাটপাড়ায়। সুবীরদের পাশের গ্রামটা রে। তবে বাড়িটা ঠিক চিনি না। খোঁজ নিতে হবে।"
-"তাহলে আর দেরি কেন, চল কালকেই কথা বলে আসি।" - দিলীপদার হতাশা মুহূর্তেই উৎসাহে বদলে যায়। এই লোকটাও কিছু কম ইমপালসিভ না।