রাণীচেরা চা বাগান/গৌতম চক্রবর্তী
রাণীচেরা চা বাগান
গৌতম চক্রবর্তী
~~~~~~~~~~
নতুন রাজনৈতিক ভারসাম্যের খেলা ডুয়ার্সের চা বলয়ে
মোটেও ভাল নেই দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ। দু টাকা কিলো চালে রোজ খাবার জোটে বটে। তবে দারিদ্র্য দূর হয় না। ডুয়ার্সের মালবাজারের চা বাগানের শ্রমিক অমরজিৎ বাসফোরের কথায় 'শুধু সস্তার চাল খেয়ে কি জীবন চলে? চা বাগানের শ্রমিকের সংখ্যা যা ছিল তাই আছে। কিন্তু গত কুড়ি বছরে আমাদের মত শ্রমিক পরিবারের প্রজন্ম তো অনেক বেড়েছে। তাদের কাজ কোথায়'? কেউ জবাব দিতে পারে না। জলপাইগুড়ি থেকে ভোরবেলার ওদলাবাড়ির বাসে এসেছি ওদলাবাড়ি। সেখান থেকে অটোতে ডামডিম মোড়। ডামডিম মোড়ে রসগোল্লা এবং ওদলাবাড়ি মোড়ের রসমালাই অসাধারণ। মোড়ের মাথায় খুব পরিচিত এক মিষ্টির দোকানে রসগোল্লা খাওয়ার বিরতি। ডামডিম মোড় হয়ে রানীচেরা, সাইলি, মীনগ্লাস, রাঙামাটি, ভুট্টাবাড়ি হয়ে গরুবাথান যাবার রাস্তা। মালবাজার থেকে শিলিগুড়ির দিকে সাত কিলোমিটার দূরে ডামডিম মৌজা। অসাধারণ ইকো টুরিজমের উপাদান ছড়িয়ে আছে এই বাগানগুলিকে ঘিরে। ডামডিমে একটা গাড়ি ভাড়া করলাম। শীতের সবুজ ডুয়ার্স দেখব। আর যাব রাণীচেরা, সাইলি, রাঙ্গামাটি চা বাগান ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে। বাগিচা ম্যানেজমেন্ট এর সঙ্গে কথা হয়েছে। সেনা জওয়ানদের প্রশিক্ষণ দেখতে দেখতে রানীচেরা চা বাগানে প্রবেশ করলাম। রাস্তা চলে গেছে মীণগ্লাস চা বাগান, পাপরখেতি হয়ে লাভা লোলেগাঁও এর দিকে। রানীচেরা চা বাগান, ডামডিম সেনা ক্যাম্প, ট্রেনিং সেন্টার। এখানে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ হয়। রানীচেরা চা বাগান ছুঁয়ে পাহাড়। চা বাগানের কোলে ব্রিটিশ আমলের ইউরোপীয়ান ক্লাব। দিগন্ত জুড়ে সবুজ গলফ খেলার মাঠ। জনহীন পথে কয়েকজন আদিবাসী যুবক হাঁড়িয়া খেয়ে টলমল হয়ে হেঁটে যাচ্ছে রানিচেরা থেকে ডামডিম। পাশাপাশি দুই বাগান রাণীচেরা আর সাইলি। ঢুকলাম রাণীচেরা শ্রমিক মহল্লাতে সমস্যা জানতে। শ্রমিক লাইনের বাসিন্দা সীতা রাই এর মতে, 'সমস্যা তো আমাদের ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে। সরকার ওদের বিনে পয়সায় লেখাপড়ার সুযোগ করে দিয়েছে। সাইকেল দিয়েছে। কিন্তু লেখাপড়া শিখে ওরা তো চাকরি পাচ্ছে না। ওরা তো এখন আর পাঁচজনের মতো ভিন রাজ্যে গিয়ে শ্রমিকের কাজও করতে পারবে না'। মালবাজার, কালচিনি, বীরপাড়া, নাগরাকাটা, অথবা কুমারগ্রামের নিউল্যান্ডস চা বাগান হোক না কেন, কাজ চান বাসিন্দারা। তৃণমূল জমানায় চা-বাগানে সিটুর ট্রেড ইউনিয়ন তাই প্রায় বিলুপ্ত। এখন লাল ঝান্ডা হাতে আন্দোলনের বদলে কেউ মাথা ঠোকেন চা বাগানের ভেতরে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা হনুমান মন্দিরে আবার কোনো কোনো পরিবারের লেখাপড়া জানা আদিবাসী তরুণ যাচ্ছেন গীর্জাতে। রাণীচেরাতেও চোখে পড়ল এইরকম ছোট ছোট গীর্জা।
রাণিচেরা টি গার্ডেনের পরিচিতি
মালবাজার মহকুমার ‘রাণীচেরা টি কোম্পাণী’ নামে টাই এর সদস্যভুক্ত রাণীচেরা বাগানটির পরিচালক গোষ্ঠী শ্যামকুমার গোয়েল, প্রদীপকুমার গোয়েল, তনসুখ রাই গোয়েল এবং সূর্যপ্রকাশ মিত্তাল। এই প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পাণীটির বর্তমান পরিচালকমন্ডলী ২০০৬ সাল থেকে বাগানের দায়িত্বে আছে যদিও বাগানটি প্রায় ১১০ বছরের পুরনো বাগান। ১৯০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে বাগানটি আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশ কোম্পাণির হাত ধরে পথ চলতে শুরু করে এবং বহুবার হাতবদল হয়। সাম্প্রতিককালে গোয়েল এবং মিত্তালরাই বাগানটি পরিচালনা করছে। কোম্পাণির হেড অফিস মেটেলিতে। বাগানে মোট ম্যানেজারিয়াল স্টাফ ১৩ জন। বাগানে প্রতিষ্ঠিত ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা ৩ টি। এগুলো হলো সিবিএমইউ, পিটিডব্লিউইউ এবং টিডিপিডব্লিউইউ। যদিও বর্তমানে শাসকদলের ট্রেড ইউনিয়নের প্রাধান্যই বেশি ডুয়ার্সের অন্যান্য বাগানের মতই। রাণীচেরা চা বাগানটির আয়তন এবং চাষযোগ্য আবাদীক্ষেত্র ১২২৬.৭৯ হেক্টর। প্রতি হেক্টর ড্রেন এবং সেচযুক্ত প্ল্যান্টেশন এরিয়া থেকে গড়ে ১২০০ কেজি করে চা উৎপাদিত হয়। রাণীচেরা চা বাগানে নিজস্ব চা পাতা উৎপাদনের গড় বছরে ২৫-২৬ লাখ কেজি। ফ্যাক্টরিতে প্রস্তূত নিজস্ব উতপাদিত বিক্রয়যোগ্য তৈরি চা ৫-৬ লাখ কেজি। বাইরের বাগান থেকে সংগৃহীত কাঁচা পাতায় প্রস্তুত বিক্রয়যোগ্য তৈরি চা এর পরিমান ৬--৭ লাখ কেজি। মোট বাৎসরিক উৎপাদিত তৈরি ইনঅরগ্যানিক চা ১২ লাখ কেজি। বাগানে শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ৮৪৩ । মোট জনসংখ্যা ৫১৪৪ জন। স্থায়ী শ্রমিক ১১৮৯ জন। ফ্যাক্টরিতে নিযুক্ত স্টাফ এবং শ্রমিক সংখ্যা ১০৪ জন। কম্পিউটার অপারেটর ১ জন। মোট কর্মরত শ্রমিক ১৩৭২ জন। অ-শ্রমিক সংখ্যা ৩৭৭২ জন। বাগিচার সাব স্টাফের সংখ্যা ৬৪ জন। করণিক ৮ জন। ক্ল্যারিক্যাল এবং টেকনিক্যাল স্টাফ ২ জন।
বাজারি মিডিয়ার কাছে লোভনীয় খাদ্য চা বাগিচা
শ্রমিকদের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে মিশ্র প্রতিক্রিয়া উঠে এল। ডুয়ার্সে অচল চা-বাগানের পাশাপাশি চালু চা বাগানগুলোর অবস্থাও খুব ভালো তা তো বলা যাবে না, কিন্তু সেখানেও ভোটের বাজারে বিরোধীরা শাসক দলের ভাবমূর্তিতে কাঁটা ছড়াতে পেরেছে এমনটাও বলা যাচ্ছে না। চালু বাগানগুলির শ্রমিক মহল্লায় পানীয় জল থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য পরিষেবার মান অত্যন্ত নিম্নগামী। সেটাও কয়েক বছরের ঘটনা নয়। তা নিয়ে শ্রমিকদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ ছিল বাম জমানার থেকেই। মালিকপক্ষ মুনাফার লোভে শ্রমিক স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে উৎপাদনেই ব্যস্ত থাকত বাম আমলে এবং বর্তমান তৃণমূল সরকারের আমলেও একই চিত্র। আজ যখন বিরোধীরা শ্রমিক স্বার্থ থেকে শুরু করে পানীয় জল, বিদ্যুৎ সরবরাহ, স্বাস্থ্য পরিষেবার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলে তখন কিন্তু চা বাগান শ্রমিক কর্মচারীরাই অতীতের সঙ্গে আজকের অবস্থানের কোন ফারাক খুঁজে পান না। চা বাগানের পানীয় জল, স্বাস্থ্য পরিসেবা ইত্যাদি নিয়ে আসলে সমস্যার শেষ নেই। সময় সময় তার রকমফের হয়েছে। বাগান বন্ধ হয়েছে, শ্রমিক মরেছেও। আজ চা-বাগান বাজারি মিডিয়ার কাছে খুব লোভনীয় খাদ্য। তারা এটাকে ব্যবহার করছে একভাবে, আর অন্যভাবে ভোটের বাজারে ফায়দা তুলতে চাইছে রাজনৈতিক দলগুলো। বাস্তবিক, চা বাগানের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে এখনও পর্যন্ত শাসক দল তাদের দায় ও কর্তব্যের যে খতিয়ান কথায় ও কাজে রাখতে সচেষ্ট হয়েছে তার কোনো বিকল্পই কেউ তুলে ধরতে পারেনি। এটা একদিক দিয়ে বলা যায় শাসকদলের হাতকেই শক্তিশালী করে দেওয়া। তাছাড়া বিরোধী দল নিজেরাও ঠিক কিভাবে শাসকদলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে তার রণকৌশল এখনও পর্যন্ত ঠিক করে উঠতে পারে নি। জয়েন্ট ফোরাম মজুরি বৃদ্ধির দাবি নিয়ে ধারাবাহিক আন্দোলন করে শ্রমিকদের আস্থাভাজন হলেও তার প্রতিফলন বিগত বিধানসভা ভোটে পড়েনি বললেই চলে। এক্ষেত্রে ভোটযুদ্ধে বিরোধীরা শাসকদলের থেকে অনেক কদম পিছনেই ছিল। কারণ তাদের সাংগঠনিক শক্তির ঘাটতি। তারপরেও রণকৌশলের প্রশ্নে ভোটারদের কাছে এখনো পর্যন্ত কোনো উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তৈরি করে উঠতে পারেনি বিরোধীরা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বন্ধ চা বলয়ে তার সরকারের সাফল্যের যে খতিয়ান তুলে ধরেছেন তাতে এখনো পর্যন্ত বিরোধীদের মুখ সেলোটেপ দিয়ে বন্ধ কেন তার কারণ বোঝা দায়।
শ্রমিকেরা চান নিয়মিত মজুরী, সম্মানের সঙ্গে শ্রমদান
রাণীচেরা চা বাগিচার নরেন ভুজেল সেই কারণেই দান, সহযোগিতা, অনুদান, সাহায্য দুহাত ভরে নিলেও খুশী নন এতটুকুও। একথা স্পষ্ট ভাষায় না বললেও আকারে ইঙ্গিতে তা ব্যাক্ত করলেন। তাঁরা চান নিয়মিত মজুরী, সম্মানের সঙ্গে শ্রমদান করে বাঁচতে। অনুদান নিলেও তারা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে এ হল সামান্য কিছু টাকাপয়সা দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করে রাখার প্রচেষ্টা। তারা যে শাসক দলের প্রতি বিক্ষুব্ধ কিংবা অসন্তুষ্ট এমন কথা একজনের মুখেও শোনা গেল না । অসন্তোষ যথেষ্টই আছে সরকারের প্রতি, সরকারের দলের প্রতিও। কিন্তু তার থেকেও বেশি ভালোবাসা এবং ভরসা রয়েছে মুখ্যমন্ত্রী তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরে। এটাই নির্মম এবং বাস্তব সত্য। শাসকদলের পক্ষে ভোটে বন্ধ বা অচল চা-বাগান কাঁটা হয়েই ব্যাথা দেবার কথা। কিন্তু তা হবার জো নেই। কারণ প্রথমত, বিরোধীদের অস্তিত্ব থাকলেও বিরোধীদের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই চা শ্রমিকদের। তাদের স্পষ্ট কথা, চা বাগানের এই অবস্থা তো নয়ের দশকেও ছিলো। তখন তো মমতাও ছিল না, অথবা ফাউলাই মিলত না। বাগানের রেশনটুকু মিলত ঠিকই, তবে মালিক খেয়ালখুশিমতো বাগান চালাত আবার বন্ধ করে দিত। দিনের পর দিন পাওনাগন্ডা বাকি রাখত। পিএফ জমা দিত না। বহু ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন শ্রমিকেরা, কিন্তু মালিকের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে তখন কি কেউ কোন আওয়াজ তুলেছিল? আজও বাগান বন্ধ হচ্ছে। পাওনাগন্ডা থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে। কিন্তু সরকারের সাহায্যও মিলছে। ১০০ দিনের কাজ মিলছে। মেয়েরাও এখন আর হাত-পা গুটিয়ে ঘরে বসে নেই। সরকারি প্রকল্পে তাদের কাজ মিলেছে। তারাও পরিবারের জন্য কিছু টাকা রোজগার করছে। অপুষ্টিতে শ্রমিক কোথাও শুকিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বাগানের চা শ্রমিকরা যে না খেতে পেয়ে মরে যাচ্ছে এই ধরনের প্রচার আর ধোপে টিকছে না। ডানকান চা বাগান ছাড়াও আরো বহু বাগান অচল করে রেখেছে মালিকপক্ষ। সঙ্গে বন্ধ বাগান তো আছেই। ডুয়ার্সের চা বাগান এবং অন্যতম চা শিল্পের এই করুণ চিত্র কি কোনভাবেই বদলাবে না ? সেটাই আমজনতার প্রশ্ন।
বাগিচার স্বাস্থ্য পরিকাঠামো
রানিচেরা চা বাগিচায় হাসপাতাল এবং আউটার ডিসপেনসারি দুইই আছে । বাগিচায় আবাসিক ডাক্তার টি চ্যাটার্জি এমবিবিএস ডাক্তার। প্রশিক্ষিত নার্সের সংখ্যা ১ জন। বাগিচায় নার্সের সহযোগী মিড ওয়াইভস ৩ জন। কম্পাউন্ডার ১ জন। স্বাস্থ্য সহযোগী ২ জন। মেল ওয়ার্ডের সংখ্যা ৬, ফিমেল ওয়ার্ডের সংখ্যা ৯, আইসোলেশন ওয়ার্ড এবং অপারেশন ঠিয়েটার ১ টি করে। অ্যাম্বুলেন্স আছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে। চিকিৎসার জন্য গড়ে বছরে ২০ জন শ্রমিককে রেফার করা হয়। রানীচেরা বাগিচায় লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার ও এন মিশ্র ২০০৭ সাল থেকে বাগিচায় রয়েছেন। কিন্তু শ্রমিকরা স্বাচ্ছন্দ্যে নেই। ক্রেশের সংখ্যা ৪। ক্রেশে পর্যাপ্ত জলের ব্যাবস্থা এবং শৌচালয় নেই। শিশুদের পোশাক সরবরাহ করা হয় না নিয়মিত। পর্যাপ্ত পাণীয় জল ক্রেশে এবং চা বাগানে সরবরাহ করা হয় না বলে অভিযোগ। পাণীয় জল সময়ে সময়ে ব্যবহারযোগ্য নয়। ক্রেশে মোট অ্যাটেন্ডেন্ট ৪ জন। বাগিচায় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। বাগিচা সংলগ্ন উচ্চ বিদ্যালয় নেই। শ্রমিক সন্তানদের বিদ্যালয়ে নেবার জন্য যানবাহনের ব্যাবস্থা হিসাবে একটা বাস আছে। বাগানে বিনোদনমূলক ক্লাব আছে। খেলার মাঠ আছে। রানীচেরা টি গার্ডেনে প্রভিডেন্ড ফান্ড খাতে অর্থ জমা পড়ে। পি এফ বকেয়া নেই। গ্র্যাচুইটি বাবদ বরাদ্দ অর্থের পরিমাণও বকেয়া নেই। বাৎসরিক বোনাসের হার ২০%। রাণীচেরা চা বাগান সংশ্লিষ্ট গ্রাম পঞ্চায়েত ধরে ধরে সংক্রামিত খুজে খুঁজে চিকিৎসা করার জন্য র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট করানো হয়েছিল। স্বাস্থ্য দপ্তর ও জেলা প্রশাসন দেখেছিল জেলার ৮০ টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় অনেক করোনা সংক্রমণের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। চা বাগান এলাকাও সংক্রামিত এলাকার বাইরে নয়। জেলার সমস্ত বিডিও, বিএমওএইচ দের সঙ্গে টানা তিন ঘণ্টা ভার্চুয়াল বৈঠক করেন জেলা শাসক মৌমিতা গোদারা বসু।
লকডাউনে ঋণ মেটাতে বাগানে পাতা তুলেছে পড়ুয়া
মাথা গোঁজার ঠাঁইটা একটু পাকাপোক্ত চেয়েছিলেন বাবা-মা। তাই একটি ব্যাঙ্ক থেকে কিছু ধার হয়েছিল তাঁদের। সেই ঋণ সবটা পরিশোধ হয়নি। বাড়ির চারদিকটা পাকাপোক্ত হয়নি। তার মধ্যেই অনেক আশা নিয়ে বুক বেধেছিলেন দম্পতি। সংসার টানতে ছেলেকে কাজে নামতে হলেও, ইস্কুলে পড়া ছোট ছেলেকে নিয়ে দুই জনেরই ছিল একরাশ স্বপ্ন। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সেই স্বপ্নও চুরমার হয়ে গিয়েছিল। বাড়ির ছোট ছেলে মুকেশ খাড়িয়া ডামডিম হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের ছাত্র। দ্বাদশ শ্রেণীর পড়ুয়া ছিল। লকডাউনে স্কুলে অনলাইনে পড়াশোনা শুরু হয়েছিল। টানাটানির সংসারে ছেলেকে স্মার্ট ফোন কিনে দিতে পারেন নি বাগিচার সামান্য শ্রমিক মুকেশের বাবা। বাবা-মার দেওয়া সেই ফোনটি আজও মুকেশের কাছে থাকে। শিক্ষকদের ‘ডাকে’ মাঝেমধ্যেই বেজে ওঠে সেটি। কিন্তু সেই ফোন ধরার সুযোগ কমে গিয়েছে মুকেশের। অভিমান করে মুকেশ বাড়ির কাছে বাগানে নতুন চা গাছ রোপনে লেগে যায়। মুকেশের কথায়, “বাবা রোজ কাজে বের হন। দাদাও কাজ করতে যায়। তার পরেও করোনা আবহে সবটাই যেন এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। আগের মত আয় নেই। ব্যাঙ্ক ঋণ মেটানোও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আমাকেও চা বাগানে কাজ নিতে হয়েছে।” এর কিছুদিন পরেই হাসি ফোটে রমেশের মুখে। মুখ্যমন্ত্রীর স্মার্ট ফোন দেওয়ার সিদ্ধান্তে হাসি ফোটে রমেশের মত বহু ছাত্রছাত্রীর মুখে। ক্ষেত্রসমীক্ষা যখন করি তখনও মুকেশ পড়াশোনা ছাড়েনি।
মজুরী না বাড়ালে বিপদ আসন্ন ডুয়ার্সের চা বলয়ে
শুধু রাণীচেরা বাগানেই নয়, উত্তরবঙ্গের চা বাগানে ৪৫ শতাংশ শ্রমিক বাগানমুখো হচ্ছে না। যার জেরে ব্যাপকভাবে মার খাচ্ছে উৎপাদন। অন্যদিকে উৎপাদিত চায়ের গুণগত মানও বেশ নিম্নমুখী। ফলে মিলছে না দাম। এই সংকটের জেরে চা শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়েই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, শুধু ছোট বাগানেরই নয়, এমনকি সমৃদ্ধ বাগানেরও দলে দলে শ্রমিক এখন বেশি মজুরির সন্ধানে পাড়ি দিচ্ছেন ভিনরাজ্যে বা ভুটানের মতো ভিনদেশে। সেখানে গিয়ে কেউ রাজমিস্ত্রি আবার কেউ রংমিস্ত্রির কাজ করছেন। এমনকি খামারবাড়িতে কাজ করতেও তাদের কোনো আপত্তি নেই। দৈনিক মজুরি মিলছে চার থেকে পাঁচশো টাকা। কোথাও কোথাও এরও বেশি উপার্জন হচ্ছে। উপার্জিত আয় বাড়িতে পাঠিয়ে নিজের ভাঙাচোরা শ্রমিক অবাসের পাশে তৈরি করে নিয়েছে পাকা ঘর। যে কোনো বাগানে ঢুঁ মারলেই এই দৃশ্য চোখে পড়বে। শ্রমিকদের বাগান ছেড়ে যাওয়ার এই প্রবণতার পিছনে তাদের উপর শোষণকেই দায়ী করেছেন রাণীচেরা চা বাগানের ইউনিয়ন নেতারা। চা বাগান সূত্রে খবর, বাগানগুলিতে কাঁচা পাতা তোলার লোক না পাওয়ায় বেড়ে যাচ্ছে ‘প্লাকিং রাউন্ড'। বাগানের একেকটি সেকশন থেকে যতদিন পরপর কাঁচা পাতা তোলা হয় সেটাকেই বলা হয় ‘প্লাকিং রাউন্ড’। গুণমান বজায় রাখতে গেলে ভরা মরশুমে ওই রাউন্ড ৭ থেকে ৮ দিনের ধার্য করা হয়। লোকের অভাবে তা এখন ১২ থেকে ১৩ দিনে পরিণত হচ্ছে। ফলে ওই বাড়তি সময়ে পাতার আকার বড়ো হয়ে যাচ্ছে। মার খাচ্ছে তৈরি চায়ের ফ্লেভার থেকে শুরু করে স্বাদ। নিলাম কিংবা খোলাবাজারে দাম পাচ্ছে না ওই চা। পাশাপাশি শ্রমিক গরহাজিরায় উৎপাদনের ঘাটতি এখন কয়েক লক্ষ কিলোগ্রামে গিয়ে ঠেকেছে। চা বাগানের আশপাশের এলাকা বা ধারে কাছে বন্ধ বাগান থেকে অস্থায়ী ভিত্তিতে শ্রমিক এনে ঘাটতি পূরণের চেষ্টা চললেও সেটা পর্যাপ্ত নয় বলেই বাগান পরিচালকদের বক্তব্য। ন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ প্ল্যান্টেশন ওয়ার্কার্স-এর সাধারণ সম্পাদক মণিকুমার দার্নালের সাফ কথা চা বাগানের সঙ্গে শ্রমিকদের মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছে। চা বাগান মজদুর ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল আলম বলেন, 'ন্যূনতম মজুরি যতদিন না হবে, শ্রমিকদের বাগান ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রবণতা চলতেই থাকবে। চা বাগান তৃণমূল কংগ্রেস মজদুর ইউনিয়নের অন্যতম শীর্ষ নেতা বাবলু মুখোপাধ্যায় বলেন শ্রমিকদের মধ্যে শিক্ষার হার বেড়েছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে চাহিদা। এটা সত্যি কথা অবসরের পর প্রভিডেন্ট ফান্ড কিংবা গ্র্যাচুইটির টাকা ঠিকভাবে যেখানে মেলে না সেখানে শ্রমিকদের কোনমুখে বাগান ছাড়তে না করবে মালিকপক্ষ? সরকার, মালিক ও ট্রেড ইউনিয়ন সবাই এই সমস্যার মোকাবিলায় সার্বিকভাবে ব্যর্থ
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴