ভাস্কর্যের আঁতুরঘর/৯
ভাস্কর্যের আঁতুড়ঘর (পর্ব-৯)
মৈনাক ভট্টাচার্য
----------------------------------
চিন্তামনি করের ভাস্কর্য 'জাস্টিস'
অলিম্পিকের ভাস্কর্য বিভাগে পদক প্রাপ্ত একমাত্র ভারতীয় ভাস্কর-। কথাটা কাঁঠালের আমসত্ত্বের মত শোনাবে। তবুও ১৯৪৮ এর অলিম্পিক ইতিহাস উজ্জ্বল হয়ে আছে ৩৩ বছর বয়সী এক বাঙালি তরুণ ভাস্করের স্বীকৃতিতে। তিনি চিন্তামণি কর। আধুনিক অলিম্পিক প্রতিযোগিতার জনক ব্যরন পিয়ের দ্য কুবার্তোর স্বপ্ন ছিল ক্রীড়ার সঙ্গে শিল্পচর্চাকে মেলাবেন। সেই সময় অলিম্পিক কমিটি স্থাপত্য, সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা-ভাস্কর্য এই চার বিভাগেও পুরস্কার প্রদান করত । কাগজে কলমে ১৯৪৮সালটা ছিল অলিম্পিকে এইসব ইভেন্টগুলির শেষ অলিম্পিক। সেই বছরই সুইডিস ভাস্কর গাস্টাফ নর্দাল তাঁর ভাস্কর্য ‘হোমেজ টু লিঙ’(Homage to Ling) এর জন্য সোনা, চিন্তামণি কর তাঁর ‘দ্যা স্ট্যাগ’(The Stag) ভাস্কর্যের জন্য রূপা এবং ফরাসি ভাস্কর হার্বাট ইয়েনসেস্ তাঁর ভাস্কর্য নাগিস(Nageuse)এর জন্য পেয়েছিলেন ব্রোঞ্জ পদক।
চিন্তামণি করের এই কীর্তি কোন ভাবেই ভারতীয় ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করা হয়নি কেননা এই সম্মান গ্রহন করেন ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে। বাঙালি হিসেবেও আমরা কখনও বোধহয় গর্বিত হইনা কেননা চিন্তামণি কর ছিলেন অনেকটাই অন্তর্মুখি এক শিল্পী। ওড়িশার প্রথাগত মন্দির ভাস্কর্যের শিল্পী গিরিধারী মহাপাত্র ও ভিক্টর জিওভানেল্লির কাছ থেকে ভাস্কর্যের পাঠ নেন। এর পর উচ্চ শিক্ষার জন্য যান প্যারিসে। সেখান থেকে ফিরে এসে ১৯৪০ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পকলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন । এর পর ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত ছিলেন দিল্লি পলিটেকনিক্যাল শিল্প বিভাগে অধ্যাপনায়। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব নিয়ে লণ্ডনে বসবাস শুরু করেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে সেখানে লণ্ডন রয়াল সোসাইটির সদস্যপদ লাভ করেন। নিজের মাটির টানে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে ফিরে আসেন কলকাতায় এবং গভর্নমেন্ট কলেজ অফ আর্টের অধ্যক্ষ হন। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে লণ্ডনে অবস্থিত ঐতিহাসিক ও শিল্পসংরক্ষণের আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর ফরাসি সরকারের আমন্ত্রণে লুভর মিউজিয়ামের চিত্র-সংগ্রহশালায় বৃত্তিপ্রাপ্ত সংরক্ষণবিদ হিসাবে কাজ করেন ১৯৬০ থেকে ১৯৬১ পর্যন্ত। এর পর কলকাতার নরেন্দ্রপুরে এসে তাঁর কাজ নিয়ে থিতু হয়ে বসেন।
নয়াদিল্লিতে সুপ্রিম কোর্টের লনে ‘জাস্টিস’ নামে মা শিশু এবং বইয়ের সাত ফুট উচ্চতার যে জ্যামিতিক ব্রোঞ্জ বিমূর্ত আইনি প্রতীক হয়ে আছে, সেই কাজ কিন্তু একজন বাঙালি ভাস্করের মস্তিষ্কপ্রসূত। এমন একটা তথ্য বোধয় আমাদের বেশির ভাগ শিল্প সচেতন মানুষেরই অজানা। এই কাজ করার জন্য ব্রোঞ্জের স্কেল মডেল বা ম্যাকুয়েট বা ম্যাকেট জমা করার পর ১৯৬৯ সালে কাজটির বরাত পান ভাস্কর চিন্তামণি কর। তিনি তখন সদ্য ইংল্যান্ড থেকে এই দেশে ফিরে এসেছেন। বরাতের আট বছর পর ১৯৭৭ সালে কালো ব্রোঞ্জের এই ভাস্কর্যটি সম্পুর্ন হয়ে উন্মোচিত হয় সুপ্রিম কোর্ট লনে। নাম দেওয়া হয় ‘জাস্টিস’। জ্যামিতিক ফর্মে বিমূর্ত ভাবে একজন মায়ের নিরাপদ আশ্রয়ে একটি শিশু বইকে অবলম্বন করে আছে। ভারতীয় আইনের স্তম্ভদ্বার সুপ্রিম কোর্টের লনে এর চেয়ে সুন্দর আর কোন আইনের প্রতিমূর্তি বোধহয় শিল্পীর ভাবনায় উঠে আসতে পারে না।
চিন্তামণি কর বরাবরই পরিচ্ছন্ন এবং নির্বিবাদ দর্শনের এক মানুষ। ভাস্কর হিসেবে তিনি সমস্ত জীবন সোজাসাপ্টা চিন্তনে-মননে কাজ করে গেছেন। তথাকথিত শিল্প সমালোচকের কালিমা লেপন থেকে পার পায়নি কালজয়ী সব ভাস্কর্য। মিকেল্যাঞ্জেলোর ডেভিড, রদ্যাঁর ‘ব্রোঞ্জ যুগ’ থেকে ‘বালজ্যাক’। এমন কী কালিমা লেপন হয়েছে রামকিঙ্করের রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কাজ করা ‘কবি’তেও। তাই বোধ হয় বাদ গেল না চিন্তামণির এই ‘জাস্টিস’ও। সুপ্রীম কোর্টের লনে মূর্তি উন্মোচনের কিছু দিনের মধ্যে চৌষট্টি জন আইনজিবীর এক প্যানেল তৎকালীন আইন মন্ত্রীর কাছে এক স্মারকলিপিতে দাবী করেন-“এই মুর্তি ন্যায়বিচারের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান সুপ্রিম কোর্টের প্রতীক এবং অনুপ্রেরণা। কিন্তু শিল্পের পরিমিত জ্ঞানের সূক্ষ্মতা যারা উপলব্ধি করার জন্য প্রশিক্ষিত নন এমন সাধারণের চোখে এই মূর্তি এক বিকৃত প্রতীক। এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে জরুরি অবস্থাকালীন মা এবং সন্তানের এক কলুষিত সম্পর্ক। পরবর্তিতে, আইনজীবীরা নিজেদের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের দ্বিতীয় প্রতিলিপিতে মত কিছুটা পাল্টে বললেন ‘যেহেতু ভাস্কর্যের নকশা জরুরি অবস্থা জারির আগেই চূড়ান্ত করা হয়েছিল, তাই হয়ত ‘ইন্দিরা-সঞ্জয়’ এই ‘মা-ছেলে’র ধারণা এই মূর্তিতে নাও থাকতে পারে, তবে ভাস্কর্যটি প্রতিষ্ঠার কাজ শিল্পীর স্টুডিয়োতে জরুরি অবস্থার সময় সম্পাদিত হয়েছিল। এটি অস্বীকার করাও যায় না মানুষের মনে এই ধারণা আসতেই পারে-তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী তার কোলের নীচে বসে বিচারককে নির্দেশ দিচ্ছেন, কীভাবে বিচার করা যায়। আর তা বাদ দিলেও বইটি যে সংবিধান তাও কিন্তু ভাস্কর্যে বোঝানো নেই। এটা যে গীতা নয় সেটাই বা কে বলতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের মতো প্রবেশদ্বারে ধর্মনিরপেক্ষ একটা দেশের পক্ষ্যে এটা বেমানান’।
এই যুক্তি-প্রতিযুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে শিল্পীকে স্বীকারোক্তিও দিতে হয়েছিল যে-‘আমার ভাবনায় ভারত মাতাকে আমি একজন মহিলার মূর্তিতে চিত্রিত করেছি। তরুণ প্রজাতন্ত্র ভারতের রুপক হিসেবে ব্যাবহার করেছি শিশুটিকে আর সংবিধানকে দেখানো হয়েছে বই হিসেবে। এই শিশু আর বইকে অভিভাবক হিসেবে আগলে রেখেছে এক মা’। প্রশ্নোত্তরে তিনি আরও বলেছিলেন-‘আমি বিশ্বাস করি বইটির নাম গুরুত্বপূর্ণ নয়, কিন্তু কার কোলে তরুণ প্রজাতন্ত্র ভারত সেই বইটি ধরে রাখার জন্য আশ্রয় পেয়েছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। এটি নিছক একটি আশ্রয় নয়, এটি ভারতমাতার তত্ত্বাবধান, যাঁর আদেশে এবং করুণার অধীনে, তরুণ প্রজাতন্ত্র ভারত উন্নতি লাভ করবে। এবং তাই, গ্রন্থের ধরন সংবিধান বা অন্য কিছু যাই হোক না কেন, ভারতমাতা এটাকে প্রতিনিধিত্ব করছে, এটাই গুরুত্বপূর্ণ।’
আমাদের সৌভাগ্য এই বিতর্কের সময়টা ছিল নব্বুইয়ের দশক। মানুষের বিরোধিতাতেও সহনশীলতা আজকের পর্যায়ে এসে পৌঁছায়নি তখনও। আজ হলে বোধ হয় এই অমর সৃষ্টি শিল্পধর্ষকদের হাতে মানুষের জন্য ধরাছোঁয়ার বাইরেই চলে যেত। হয়ত কোন প্রজন্ম মাটি খুড়তে গিয়ে কখনও খুঁজে নিত ব্রোঞ্জের একটা টুকরো। ভারত মাতার মতো সত্যকে আগলে রাখত এই দেশের শিল্পলুটেরাদের চোখকে আড়াল করে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴