বাগানিয়া জার্নাল
পর্ব।।নয়।।
শিশির রায়নাথ
^^^^^^^^^^^^^
কালো চায়ের গোটা-পাতার (Whole Leaf) গ্রেড FTGFOP দিয়ে শুরু হয়ে শেষ হয়েছিল OP (Orange Pekoe)-তে।
ভাঙা পাতা (Broken Leaf), টুকরো-টাকরা (Fannings) এবং গুঁড়োর (Dust)বেলায়ও এরকম ভাগাভাগির গ্রেড আছে।
#
হাত-মোলাই
(hand rubbing) দিয়ে যে চা বানানোর যাত্রা শুরু হয়েছিল ক্রমশই তা
মেশিন-নির্ভর হয়ে পড়ে। মেশিনপত্রও উন্নত থেকে উন্নততর হয়ে উঠতে থাকে। এদিকে
নতুন নতুন চা বাগান গড়ে ওঠায় কাঁচা চা পাতার উৎপাদন বেড়ে যাচ্ছে ।আয়তনে
আসাম,ডুয়ার্সের এক একটা চা বাগান দার্জিলিং-এর পাঁচ-ছটা চা বাগানের সমান
।সেই পরিমান চা-পাতাকে দ্রুত প্রসেস করার জন্য (কেননা চা পাতা দ্রুত
পচনশীল) প্রয়োজন হয়ে পড়ে মেশিনপত্রের পরিবর্তন।
এরকম সময়ে চা-তৈরির জগতে এসে পোঁছয় সিটিসি (CTC) মেশিন। ১৯৩০ সালে প্রথম আসামের হলমারি চা বাগানে। তবে ব্যাপক প্রচলিত হয় ছয়ের দশকে।
CTC-র
পুরো কথাটা Crush,Tear & Curl...অনেকে Cut,Tear & Curl-ও বলেন।তবে
সত্যিকারের ‘Cut’ বলে এখানে কিছু নেই। প্রথমে শুকিয়ে নেওয়া (withered)
পাতাকে একটা মেশিনের ভিতরে (rotorvane) প্রচন্ড চাপ দিয়ে (Crush) প্রায়
মন্ড-র মতে করে তাদের ফেলে দেওয়া হয় Tear করার জন্য। সেখানে বড় বড় ধারালো
দাঁতওয়ালা স্টিলের দুটো ভরাট-চোঙ (solid cylindrical Roller -আটা-ময়দা
বেলার বেলনের মত) মুখোমুখি, প্রায় ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে, বিপরীত দিকে ঘুরতে
থাকে। একটা বাঁদিক থেকে ডান দিকে – একটু কম গতিতে। অন্যটা ডান দিক থেকে
বাঁদিকে – আগেরটা থেকে আট,নয় বা দশ গুণ বেশী গতিতে। ওই মন্ড করা চাপাতা পড়ে
এই দুটো বেলনের ঠিক মুখে। বেলনের ধারালো দাঁত সেই মন্ডকে টেনে ছিঁড়ে
ফ্যালে(Tear)। বাগানিয়া ভাষায় একে বলে ‘কাট’। সেই পাতাকে যদি আরও দুবার,
তিনবার করে এরকম ছিঁড়ে ফেলা হয় – তাহলে তা হয় থ্রী কাট, ফোর কাট...আসামে এই
সেদিন পর্যন্ত সিংগিল কাট-ই ছিল। ডুয়ার্সে সাধারণত ফোর কাট করা হয়। বট-লিফ
ফ্যাক্টরিগুলোতে (বট-লিফ নিয়ে পরে বলা হবে) ছয়-কাটও পেয়েছি (তাতে চায়ের যে
কী দফারফা হয় – সে কথা পরে)। এরপর এই ‘কাট’ পাতাকে একটা বিশাল ঘুরন্ত
ড্রামের মধ্যে ফেলা হয় – যা ভূমির সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে ঘুরছে। এখানে
কাটা-পাতাগুলো ক্রমাগত ঘুরতে ঘুরতে গোল গোল (Curl) দানা হয়ে যায়। তখন তাকে
ফার্মেন্টেশানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
#
কাঁচা
পাতা থেকে তৈরি-চায়ে আসতে যতগুলো ধাপ(step) আছে তার মধ্যে ‘রোলিং’
অংশটুকুকে শুধু CTC মেশিন প্রতিস্থাপিত (repleace) করল – বাকী সব কটা ধাপ
একই রইল।
‘রোলিং’ করার ধাপটা যেহেতু আদি পদ্ধতি তাই
একে বলা হল ‘অর্থোডক্স (Orthodox) প্রসেস’। তার চা ‘অর্থোডক্স চা’ -এখানে
পাতাকে গোটা অবস্থায় পাওয়া যায়।আর সিটিসিতে পাতাকে ছিঁড়ে-ফেড়ে ফেলা হয় বলে
এখানে কোন গোটা পাতার গল্পই নেই – সবই দানা-চা যাকে সারকাস্টিকালি বলা হয়
‘গুলি চা’। তবে অর্থোডক্স আর সিটিসি দুরকমের চা-ই ‘কালো চা’(Black Tea)।
উত্তরবঙ্গে
সবুজ চা (Green Tea) এবং একমাত্র দার্জিলিং চায়ের ক্ষেত্রেই ‘রোলিং’ এখনও
টিঁকে আছে (তাই চায়ের সত্যিকারের মুগ্ধতা দার্জিলিং চায়েই)...
#
গোটা
পাতার গল্প না থাকায় সিটিসি চায়ের গ্রেড শুরুই হয় ‘ভাঙা’ দিয়ে ( Broken) ।
তবে সত্যি কথা বলতে কি এই গ্রেডিং-এর সঙ্গে অর্থোডক্স চায়ের গ্রেডিং-এর
কোন সম্পর্ক নেই কেননা এখানে কুঁড়ি থেকে আট-নম্বর পাতা অবধি (সে গল্প পরে
বলব) সব মিলেমিশে একাকার। এখানে চালনি দিয়ে ছেঁকে বড় দানা থেকে ধুলো-চা
(Dust Tea) পর্যন্ত আলাদা করা হয়। তারপর দানার সাইজ অনুযায়ী নাম দেওয়া হয়
Broken Orange Pekoe (BOP) > BP> OP (Orange Pekoe)> OF (Orange
Fannings)> PD (Pekoe Dust)… আর সবচেয়ে গুঁড়ো চায়ের নাম চূড়ামনি
Churamani Dust)।
এসব চা
আলাদা আলাদা গ্রেডে, বা একই চায়ের বিভিন্ন গ্রেড মিশিয়ে (blend), কখনও বা
অর্থোডক্সের সঙ্গে সিটিসি মিশিয়ে (ফ্লেভার প্লাস লিকার) দোকানে দোকানে
বিক্রী হয়। আবার ছোট ছোট টিস্যু পেপারের ব্যাগে ভরে তৈরি হয় ‘টি ব্যাগ’ –
গরম জলে চোবাও আর খাও...
[আশাকরি এবার দোকানে গিয়ে আর চা কিনতে অসুবিধা হবে না কারো...হাঃ হাঃ হাঃ ]
#
পান
করবার চা তৈরি করার ক্ষেত্রে দার্জিলিং চা-ওয়ালারা বলেন জলটা যখন সদ্য
ফুটে উঠতে শুরু করেছে তখনই তা নামিয়ে চা দিয়ে তিন থেকে পাঁচ মিনিট চাপা
দিয়ে রাখতে যাতে বাষ্প সমতে সুবাসটা উড়ে না যায়।[জল যদি ডিস্টিল্ড হয় আরো
ভালো। চিনে একসময়ে বরফ-গলানো জল ব্যবহার করা হত।] একে বলে পাতা-ভেজানো
((Brew)। তাই তৈরি হয়েছে নানা রকমের টি-পট।মূলত চিনামাটির। সেই পট আবার
সুন্দর সুন্দর কাপড়ের মোড়ক দিয়ে ঢেকে রাখা হয় অনেক সময়েই। আগেই বলা হয়েছে
শুরুতে চিনদেশে চা-পান খুব রাজকীয় ব্যাপার ছিল।অভিজাতদের একচেটিয়া।
বৃটিশদের ক্ষেত্রেও তাই।বোধহয় সেই ‘রয়্যাল’ মেজাজটা আনার জন্যই এত সুন্দর
সুন্দর টি-পট।
#
তবে পাত্রে
আগে চাপাতা তার ওপরে গরম জল, নাকি আগে গরমজল তার ভিতরে চা দেওয়া হবে এনিয়ে
ইংল্যান্ডে একসময়ে বেশ তর্কবিতর্ক ছিল।খবরের কাগজে, লেখালেখিতে ঝড়। এখনও
শুনি মাঝে মাঝে সে তর্ক।তবে এখানে আমার নিজস্ব একটা অভিমত আছে। চায়ের সব
পাতা একই রকম ভারি হয় না। একচামচ চাপাতায় হালকা আর ভারি পাতা দুটোই মিশে
থাকে। ভারিপাতা জল টেনে দ্রুত নিচে নেমে যায় আর হালকা পাতাগুলো জলের ওপরে
ভাসে – ফলে সঠিক ভিজতে বহু সময় লাগে। তাই পাত্রে আগে চা-পাতা দিয়ে ওপরে জল
দিলে কিছু হালকা-পাতা ভারি-পাতার নিচে চাপা পড়ায় ভেসে ওপরে উঠতে পারবে না
এবং ভালো ভাবে ভিজবে। এছাড়া আগে-পরের কোন পার্থক্য আছে বলে আমার মনে হয় না।
সিটিসি চায়ের ক্ষেত্রে জলের মধ্যে দানা ফেলে যত ফোটানো হবে ততই নাকি ভালো লিকার।
অনেকে
চায়ের সঙ্গে দুধ, চিনি, লবঙ্গ, এলাচ,তেজপাতা আদা ইত্যাদি হরেক রকম জিনিষ
মিশিয়ে, এমনকি দুধের সর মিশিয়ে, ‘মালাই চা’ করেন। পাঞ্জাব-হরিয়ানা অঞ্চলে
এরকম চায়ের খুব কদর। আমাদের এখানেও চায়ের সঙ্গে দুধ ও চিনি স্বাভাবিক। তবে
দার্জিলিং-ওয়ালারা খুব ঠোঁট কাটে – ‘তাহলে দুধ আর চিনি গুলে খেলেই হয় – চা
পাতা দেবার কি দরকার?’।
#
আগে বলা হয়েছে যে এক এক ‘ফ্লাশ’-এর চা এক এক রকম সুবাসিত (aroma ) ও স্বাদীয় (Flavour)।সেসব ঋতু ও প্রাকৃতিক কারণে হয়।
‘ফ্লাশ’
মানে এককথায় গাছে একঝাঁকে পাতা আসা – সাধারণত বছরে চার থেকে পাঁচ বার,
কখনো ছয়বারও এরকম পাতা আসে।প্রতিবার পাতা ছাড়ার পর কুঁড়িগুলো (Tips) ভিতরে
ভিতরে বন্ধ্যা বা বাঁজা হয়ে যায় –আর পাতা ছাড়ে না; তাই একে বলে
বন্ধ্যা-কাল(dormant perod) - বাগানিয়া ভাষায় ‘বাঁঞ্জি সময়’। বাঁঞ্জির পরে
গাছে আবার পাতা আসাটাই ‘ফ্লাশ’(Flush)। শীতকালের ঠান্ডায় গাছের পাতা আসা
পুরোপুরিই বন্ধ থাকে। মার্চ-এপ্রিলে একটু গরম পড়লে(এখন গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর
কারণে দেখছি ফেব্রুয়ারী মাসেই) গাছ বছরের প্রথম পাতা ছাড়তে শুরু করে। একে
বলে ফার্স্ট ফ্লাশ। এরপর বর্ষার আগে, বর্ষায়, এবং হেমন্তে যথাক্রমে সেকেন্ড
ফ্লাশ, রেইনি ফ্লাশ ও অটাম ফ্লাশ। প্রতিটি ফ্লাশেরই এ্যারোমা ও ফ্লেভার
আলাদা আলাদা রকমের সুন্দর।
চা-রসিকদের (connoisseur) কেউ ফার্স্ট ফ্লাশ, কেউ সেকেন্ড ফ্লাশ আর কেউ বা অটাম ফ্লাশ-এর পক্ষে।
ফার্স্ট
ফ্লাশের লিকার সাধারণত একটু বেশী কষা হয়, অটাম ফ্লাশে মিষ্টি এ্যারোমা আর
সেকেন্ড ফ্লাশে থাকে হালকা অদ্ভুত রকমের কস্তুরী মেশানো বনজ মশলার (musky
spiciness / unique muscat-like fruitiness)গন্ধ যাকে ব্যাখ্যা করা মুশকিল ।
শোনা যায় দার্জিলিং-এর ক্যাসেলটন চা বাগানের এক ম্যানেজার সাহেব এটা
প্রথম লক্ষ করেছিলেন। তাই Musk এর সঙ্গে Castleton মিলিয়ে সেকেন্ড ফ্লাশের
এই চায়ের নাম রাখা হয় Muscatel Tea –যা বাজারের ভালো ও দামী চায়ের মধ্যে
পড়ে।
সেকেন্ড ফ্লাশের চায়ে
এই এ্যারোমার উৎপত্তি কিন্তু খুব মজার। জ্যাসিড ( jassid) এবং থ্রিপস্
(thrips) পোকারা কচি চা পাতার রস খেয়ে ফ্যালে বলে গাছ নিজেই সে সময়ে শরীরে
তার্পিন (terpene) তেল উৎপন্ন করতে শুরু করে যা পতঙ্গ-বিতাড়ক (insect
repellent)।সেই গন্ধই চায়ের নিজস্ব এ্যারোমার সঙ্গে মিলেমিশে তৈরি হয়
Muscatel এ্যারোমা।
------------------------------------------------------------
ছবি ঋণঃ ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট থেকে নেওয়া...