পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ৯
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
পুতুলা বেটি
~~~~~~~
কলপাড় থেকে দুটো লেবু ছিঁড়ে আঁচলে ঘাম মুছতে মুছতে রসবালার বাড়ির দিকে পা বাড়ালো বসমতী। গিয়ে দেখে রান্না ঘরের কাঁচা বারান্দায় চটের বস্তা পেতে রসবালা চাল ঝাড়তে বসেছে। মলিন বিবর্ণ একটা শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথা ঢাকা। শাড়িতে, গায়ের রোমে পর্যন্ত ধুলো জমে আছে আর চেহারা যা হয়েছে দেখার মতো! দেখে একটু থমকালো।
“কোনেক নেবু সরবোত খাবার আসিনু তে তুই আরো চাউল ঝাড়িছিত?"
রসবালা মাথা নেড়ে বলে,
“বইসখেনে, দিবে এলায় করি, মাই আইচ্চে কালি, কোনেক আস্তা গেল। অই তো উয়ার বেটি আস্তায় আস্তায় গোয়াল্ডিং ধরি ব্যাড়ের ধইচ্চে এমন অউদখানোত।”
ঘরের ভেতর থেকে খুটখাট আওয়াজ আসছে দেখে বসমতী অবাক হল।
“তে, আন্দনঘরত ফির কায় তে!"
“হ, সাগাই মাইটা! মোরে পুতুলা বেটি, কালি মাইর সাতে আইচ্চে। আন্দনঘরটাত আলান্দুই সার দেখিয়া উয়ায়ে কছে, মাহোই একেলায় পাইসকে না, মুই কোনেক ঝাড়ি দেং।”
রান্নাঘরের বেড়ার গায়ে ঠেকিয়ে রাখা পিঁড়িগুলি থেকে একটা টেনে নিয়ে বসতে বসতে বসমতী ডাক দেয়,
“আয় তো মাই কোনেক দেখং।"
ডাকতেই অবশ্য ছিপছিপে গড়নের শ্যামলা একটি মেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। বসমতী ভালো করে তাকালো। সরল শিশুসুলভ মুখটায় একটা লাজুক হাসি। রসবালা অবশ্য তখনও একনাগাড়ে তার পুতুলা বেটির প্রশংসা করেই চলেছে।
“মাইটা হামার খিবে ভাল দি। মায় মান্ত্রি চলনও যেমন, কাজ কামাইও করে এখেরে পইস পইস করি, কোবারে নানাগে। আর পয় পরিস্কারও আছে।" এত প্রশংসা শুনে মেয়েটি লজ্জা পায়। রসবালার দিকে তাকিয়ে লাজুক কন্ঠে বলে,
“কি যে কছেন বারে!” তারপর বসমতীর দিকে তাকিয়ে বলে,
“তোমরা মাহোইর কাথা না শুনেন তো, উমরা কোনেক বাড়ে কছে, মুই কোটে কাজ করং বেশি, বড় বৌদিয়ে হামার বেশি কাজ করে। তে এইবার থাকে যে দোলাবাড়ির কাজোত বিরাইসে, বাড়ির কাজলা না মোকে করির নাগে বারে।"
এসব কথার মাঝেই সুশীলা মেয়েকে কোলে নিয়ে চলে আসে।। ওর মেয়ে অবশ্য কোলে থাকার পাত্রী নয়। ঠেলেঠুলে মায়ের হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে খচমচ করে কোল থেকে নেমে পড়ে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই উদ্দেশ্য বোঝা গেল। নেমেই সোজা চালের পাহাড়ের কাছে। হাত দিয়ে ইচ্ছেমতো চালগুলো ছড়াতে লাগল। রসবালার সব কথাই একেবারে থেমে গেল। বেচারা তটস্থ হয়ে পড়ল।
“না নাড়িস দিদি। বিছিড়াইন্না অমতোন করি। চাউলের মাতা ভাঙিলে ভোন বুড়া জাঙ্গোই পাবো”
নাতনির অবশ্য জামাই নিয়ে দুশ্চিন্তা বিশেষ নেই বোঝা গেল। মোটেই কথা কানে দিল না। উলটে এক খাবলা তুলে নিয়ে মুখে পুরে চিবোতে লাগল। রসবালা চেঁচিয়ে উঠল,
“না খাইস দিদি, চাউল খাইলে খোলপিত হবে, বুক বলবলাবে, বমি হবে এলায়।"
তারপর সুশীলার দিকে তাকিয়ে ধমক দিল,
“দেকি আছিত, ছাওয়াটা ধর খেনে, চাউল খাছে, খোলপিত হবে!”
সুশীলা মেয়েকে টেনে এনে মুখে আঙুল ঢুকিয়ে কিছু চাল বের করে ফেলে দিল, কিছু খেতে দিল। বড় বড় চোখ করে ধমক দিল,
“মণিকা, মাইর দিম কিন্তুক।"
ব্যাস অমনি ভ্যাঁ! তবে বেশিক্ষণ কান্না করাও ওর পোষায় না। কিছুক্ষণের মধ্যেই কেমন নিজে নিজেই চুপও করল, খেলতেও লেগে গেল।
বসমতী সুশীলার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তোমার গারাগারি শ্যাষ মাই?"
সুশীলা মাথা হেলিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলে। তারপর ধীরে ধীরে যোগ করে,
“ভাদোর মাস আইসেছে, ছোটঝোন যে বাপের বাড়ি যাবে, তে তোমার জাঙ্গোই কছে এই সোমাতে তুই আগোত যায়া আইসেক, পরে আর যাওয়া হবে না।"
রসবালা চাল ঝাড়া থামিয়ে যোগ করে,
“তে দোনোঝোনে কি একেবারে বাড়িটা ছাড়ি যাওয়া যায়?"
কথাটা ঠিক। বসমতী সুশীলার হাতে লেবুদুটো দিয়ে বলে,
“বানাতো মাগো কোনেক সরবোত, তোর মাকো দেক।"
তারপর আবার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, “নাম কি মাই তোর?"
কচি গলায় উত্তর এল “নিমলা”।
“ভালে তো নামখেনা।"
বসমতীর কথায় রসবালা বলে,
“নামখানাও যেমন ভাল, ছাওয়াটাও হামার তেমন ভাল।"
নির্মলা এবার আর কিছু বলল না, অল্প হেসে ওর বৌদির পিছু পিছু চলে গেল। ঘরের ভেতর থেকে নিচু গলায় দুজনের কথা ভেসে আসতে লাগল। রসবালা সেদিকে তাকিয়ে আবার বলে,
“ততকরায় দি, বিয়ানি হামার ছাওয়ালাক কিন্তুক ভালোই শিক্কা কইচ্চে, দ্যাখ তো কেমন ঠান্ডা ছাওয়াটা, আই ঝাই নাই একেবারে। আর ভাত-শাগও আন্দে ভাল। কী এখেরে ঝন ঝন করি কান্তাইত শাক চরায়, চকচক করি আন্দে।"
বসমতী উত্তরে মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করে,
“মাইর আর কয়টা ননোন তে?"
“নাই আর, একিনায় শেষুয়া। বড় দুইটার বিয়াও হইসে, আছে দোনোঝোনে ভালে। আর দ্যাওরটার এই যে আরবার বিয়াও হইল।"
রসবালার চাল ঝাড়া আর হয়ে এসেছে। আস্তে আস্তে সব তুলে ফেলতে থাকে। ছোট নরম ঝাড়ু দিয়ে চারধার ধীরে ধীরে ঝাঁট দিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা চালগুলো জড়ো করে তুলে এনে আবার ঝাড়ে। বসমতী জিজ্ঞ্যেস করে,
“একঠে খায় না ব্যাগল হইসে?"
রসবালা গলায় জোর এনে বলে,
“একঠেখেনায় না খায়! কায় কায় আরো ব্যাগল হবে দি! এলা ছোটঝোনকার বিয়াও হইসে উমুরা যদি হয় তে হবে। তে না হবে বোদায়। বুড়া-বুড়ি বাঁচি থাইকতে না হবে ব্যাগল। মুই তো হামার মাইক কয়া দিসুং খবরদার ব্যাগল হবু না। শাশুড়ি যেঠে মাও সেঠে, দুই একটা হেটা উচাল কতা কইলে সইহ্য করিবু।"
রসবালার বিচার-বুদ্ধি দেখে বসমতী খুশি হয়। রসবালা রান্না ঘরের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তে বুড়িটাও অবশ্য না কয় কোনো। দোষ পাইলে ওই কোনেক ধরে দেয়। তে হোটা না দিবে। শ্বশুরটা তো কোনোই না কয়। মানষিগিলা উমরা সোগায় ভাল।"
রসবালার গল্প থেমে গেল মণিকাকে দেখে। কখন ঘরে ঢুকে ওর মামার এভারেডীর তিন ব্যাটারির টর্চটা হাতে নিয়ে খেলতে শুরু করে দিয়েছে। আপন মনে গান করছে, কথা বলছে আর টর্চটায় একবার আলো জ্বালছে, একবার নিভিয়ে দিচ্ছে। খুব মজা। কিন্তু রসবালার দেখে মাথা খারাপ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সুশীলাকে ডাক দিল।
“নাইটটা আগোত হাত থাকে নিয়া থো, নষ্ট করি ফেলাবে এলায়।"
সুশীলার গলায় কোনো তাপ-উত্তাপ বোঝা গেল না। নির্বিকার গলায় বলল,
“না হয় নষ্ট। কোনেক জ্বোলাইতে কি এখেরে নষ্ট হছে?"
রসবালা রেগে গেল,
“তে বেটারিগিলা নষ্ট হছে না? বাউ এলায় দেকিলে মরিয়া মরিবে। আর হাত থাকি পড়িলে এলায় কাইচখান যাবে না!"
সুশীলা তবু শান্ত।
“না ফেলায় তো। আর সাকালে উটি তোমরা বেটারিগিলা খুলি থন নাই কেনে?"
এত কথা যাকে নিয়ে সে কাপড়ের ফিতে লাগানো টর্চটা গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে ঘুরে ততক্ষণে উঠোনময় নাচতে শুরু করে দিয়েছে আর তার মা রান্না ঘরের দুয়োরটায় হেলান দিয়ে মুগ্ধ চোখে সেই দৃশ্যই আয়েস করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। একসময়ে মেয়েকে ভুলিয়ে ভালিয়ে টর্চটা নিয়ে আবার ফড়িং ধরার পাটকাঠি দিয়ে তৈরি ফাঁদটা হাতে দিয়ে গাড়ির মতো উঠোনেই একটু খেলা দেখিয়ে দেয়। বসমতী জিজ্ঞেস করে,
“তোমার বেটাটা কোটে? আইসে নাই? ডেকা তো দেখং, মোক মনোত খায় না না খায় পুছোং!"
সুশীলা কথা শুনে হাসে। তারপর বলে,
“না আইসে পিসাই। ওই তো উয়ার বাপোক ছাড়ে না। মুই না কং তোমার কাথা। নানাগে বোলে। উয়ার বাড়ির কমর ভাঙা বুড়িটাই ভাল!"
রসবালাও হাসে। বলে,
“চেংরাটা এলা বড় হইসে না, উয়ার মার পাছ ছাইড়চ্চে। দেখিতে পাতা গাবুর নাগে এলাইতে। হের নম্বা, হের মোটা হইসে।"
শুনে বসমতী অবাক হয়।
“ আর বচ্ছরে না বাচ্চা দেকিনুং মাই?"
“হ্যাঁ, এলা দেখিলে কবেন। একখান বছরে কট্টা বড় হইল। মানসি কয় পাতা গাবুর, হিদি বাউর তো হামার বসে হয় নাই। আর আগখান হইসে উয়ার বড় পিসাইর মতোন। নগতে নগতে তাও, নগতে নগতে পাগলাই উটে। বাওফরকির যম।"
সুশীলার কথা শুনে রসবালা বলে,
“না কইস তো মাই, বড় হইলে আপনে ঠিক হবে। উয়ার পিসাইটাক দেখেক তো, খাছে না ঝাক্কুয়া মানসির মইদ্যত সংসার করিয়া! কেমতোন ভাল আছে। বিয়ানির বলে ভয় আছিল, বড় চেংরিটার বিয়াও দিলে ডেলি ডেলি কাথা আসিবে পরার বাড়ি থাকি। এলা কেমন চলচল করি বেরায় সোগারে সাতে মিলামিশা করি। ছোটতে অইলা হয়, জোঙ্গাল ঘাড়োত পইল্লে তোর বেটাও ঠিক হোবে।"
সুশীলা ওর মার কথা শুনে হাসে। তারপর রান্নাঘরের দিকে তাকায়।
“নিমলা, আনখেনে হইসে তে।"
নির্মলা বড় বড় দস্তার গ্লাসে সবার জন্য সরবত নিয়ে আসে। নিজেও একটা গ্লাস নেয়। তারপর বলে,
“তোমার চুয়ার জলগিলা কেমতোন ঠান্ডা মাহোই। খিব ভাল।"
সরবত মুখে দিয়ে বসমতীরও খুব আরাম লাগে। আহ! অন্তরটা সুদ্ধ যেন ঠান্ডা হয়ে গেল।
-------------------------------------------------------
গোয়াল্ডিং - ফড়িং
আলান্দু - মাকড়সার জাল
পুতুলা বেটি - মেয়ের ননদ বা ছেলের শ্যালিকা
মায় মান্ত্রী - শান্ত শিষ্ট
খোলপিত - গ্যাস অ্যাসিডিটি জাতীয় অসুখ
বুক বলবলাবে - বুক জ্বালা করবে
আই ঝাই - ঝুট ঝামেলা
হেটা উচাল - উঁচু-নিচু
পাতা গাবুর - নবীন যুবক
তাও - রাগ
বাওফরকি - অল্পেই অভিমানী
ডেলি ডেলি - ঝুরি ঝুরি
জোঙ্গাল - জোয়াল
চুয়া - কুয়া