নানারঙের গানগুলি-৯/শৌভিক কুন্ডা
নানারঙের গানগুলি/৯
শৌভিক কুন্ডা
----------------------------
"ক্ষ্যাপা এইসেচে গ, কৌশিক ক্ষ্যাপা।" আমার শৌভিক নামটিকে কোনদিনই সঠিক মর্যাদা দেন না বাসুদা, বার বার শুধরে দিলেও না। আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বের হয়ে আসেন বৌদি, হাত ধরে টান মারেন আমার, "আসবেই ত, আমার ঘরে যে কালার অন্ন বাঁধা রইচে!" গিয়ে বসি আখড়া ঘরে। আগে ছিল মাটির দেওয়াল, পাতার ছাউনি। এখন সেটা গাঁথনি তোলা, মাথায় টালি বসেছে। বাসুদা আয়েস করে বিড়ি ধরান। গল্প এগোয়। বউদির পুনঃ প্রবেশ, হাতের থালায় খোলায় ভাজা চিঁড়ে, সেদ্ধ কলাই আর ঝকঝকে কাঁসার গ্লাসে কাঁচা কাঠের গন্ধ মাখা চা। ঋণীতা আসে, ওঁদের মেয়ে। ছেলে ভোলাও। ভাঙা রান্নাঘরের দরজা থেকে উঁকি দেয় তপু। তপু বাগদি, পালিতা কন্যা। বেলা বাড়ে, ক্লান্তিও ছোঁয়। রাতের বেলা খাব জানিয়ে বিদায় নিতে পারি।
বাসুদার সাথে কিভাবে কোথায় আলাপ হয়েছিল, ভাবতে ভাবতে অনেকক্ষণ কলম থামিয়ে বসে থাকতে হয়েছিল! আসলে, কিছু সম্পর্ক বোধহয় থাকে, যার শুরু-শেষ কোনোটাই নেই। তখন গুগলযুগ নয়। মুঠোফোন নেই। শান্তিনিকেতন ঘুরতে গিয়ে রিক্সোওয়ালা ভাইকে অনুরোধ করেছিলাম কোনো এক বাউলের বাড়িতে যদি নিয়ে যান। তো, সেই প্রথম শ্যামবাটি, গোয়ালপাড়ায়। তারপর বারবার। আমাদের দুটি পরিবার স্থানিকতা, যাপনবিন্যাস সব দূরত্ব ছাড়িয়ে কিভাবে যে কাছাকাছি হয়ে গেল!
ভালো ঘুম হয়নি ট্রেনে। এবার একটু বিশ্রাম সত্যিই প্রয়োজন। চারটি পেটে দিয়েছি বলে, চোখ বুঁজতেই ঘুমের অতল। রুমবয় বাপ্পা এসে ডেকে না তুললে কখন যে চোখ মেলতাম! সঞ্জয় হাজির। তৈরী হয়ে নীচে নামতেই চমক - সঞ্জয়ের অটোরিকশায় আর এক সওয়ার। নানা রঙের তাপ্পি দেওয়া আলখাল্লা ঠিক একইরকম, কাঁধ ছোঁয়া বাবরি আর বুক ছোঁয়া দাড়ির শুভ্রতা তেমনই অমলিন, যেমন তাঁর চিরসঙ্গী ঝকঝকে হাসিটি, "দ্যাখো, পথে সঞ্জয়ের মুখেতে যেই শুনেচ্যি তুমি এস্যে গ্যেচ, অমনি আর ছাড়া নাই, জ্যুট্যে গেলাম।" তারপরেই টোটোর যান্ত্রিকতার ওপর গলা তুলে গেয়ে উঠলেন,
"কালা, এলেই যদি
ক্যান এলে না সকালে
জানালাতে মারছো টোকা
অকালে......." বলেই গান থামিয়ে প্রশ্ন জুড়ে দেন, "আখড়া যাবে তো?" জানালাম, যাবো তবে খানিক ঘুরেফিরে। সত্তর পেরোনো শিশু গোপালদাস বাবাজি, "বেশ তবে, আমি চল্লুম ভুবনডাঙা, রাতেই দেখা হোক" বলে অটো থেকে নেমে হনহনিয়ে হাঁটা লাগালেন। হাঁটতে হাঁটতে মিলিয়ে গেলেন। আর দেখা হয়নি। মাত্র দুবছর আগে পুরুলিয়ার বড়ন্তিতে ভোলার মুখে জানলাম গোপালদা চলেই গিয়েছেন। আর ফিরবেন না। জয় গুরু। বড়ো ভালো গাইতেন গোপালদাস,
"মন চলো যাই ভ্রমণে
কৃষ্ণ অনুরাগীর বাগানে।" আর,
"আট কুঠুরি নয় দরোজা
কোনো খানে নাই তালা..."
চুঁইয়ে আসা জ্যোৎস্না মেখে সোনাঝুরির রহস্যবিস্তৃতি,
বল্লভপুরডাঙায় বুধাই মাঝির চেনা ছপ্পর এসব যে যে মানুষকে বুঁদ করে দেয়, আমি তাদেরই একজন। ফলে, বাসুদার আখড়ায় পৌঁছতে রাত ঘন হল। প্রেমতামাকের অব্যর্থ গন্ধে মিশে সমস্বর অভ্যর্থনা ভেসে এল, "জয় গুরু, জয় গুরু!" তারপর আখড়াঘরের অপরিসর ছাড়িয়ে আসর নেমে এল খোলা আকাশের নীচে। বাসুদার শুরুয়াৎ,
"গুরুর বীজমন্ত্র জপিলে পরে জ্ঞান উৎপন্ন হয়"
"মাটির দেহ মাটি হবে
পুড়ে হবে ছাই",
"আজও সেই বৃন্দাবনে বাঁশি বাজে রে"
একের পর এক। মাঝে শিবু (শিবসুন্দর দাস বাউল), বাসুদার ভাই নেচে উঠল -
"হায় মায়াকাম ছাড়ে না মদনে, আমি
প্রেমরসিকা হ'ব কেমনে..." গৌর ক্ষ্যাপা, প্রশান্ত, ভোলাদাস.... তাদের হাতের খমক, পায়ের ঘুঙুর, তাদের জড়তাহীন আকাশছোঁয়া স্বর, আর কোন প্রাচীন কাল থেকে মুখে মুখে বয়ে আসা রহস্যপদ - ভেসে গেলাম আমি, ডুবে গেলাম!
ফিরে যখন আসছি মাঝরাতে প্রায়, খোলা আকাশে মিশে যাচ্ছে বাসুদার করুণমিনতিমাখা সুর,
"পঞ্চবটীর পাতায় পাতায়
তোমার নামটি লিখা
আবার কবে আসবে ঠাকুর
আবার হবে দেখা....."
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴