তিস্তাবাথান-৯
তিস্তা বাথান
পর্ব : নয়
নীলাঞ্জন মিস্ত্রী
^^^^^^^^^^^^^
তখন তিস্তার চরে বাঘ ছিল, নেকড়ে ছিল, বন্য শূকর ছিল, হাতি-গণ্ডার আর বাইসন ছিল। তবুও চরে চরে শান্তি ছিল। কিন্তু এখন? পুরানো মৈষাল আবদুর রহমান জানালেন- ‘এখন জায়গাটা একেবারে অশান্তি হয়া গেল রে’।
- ‘আচ্ছা আবদুরদা, বাঘের পাল্লায় তোমরা কখনও পড়েছিলে’?
-‘কি যে বলিস? এক দিনে ছয়-সাতটা পর্যন্ত ভইস মারত বাঘ’।
- ‘বলো কি? একদিনে ছয়-সাতটা! মৈষালদের বাঘ মেরেছিল কখনও’?
- ‘না না মৈষালদের বাঘ মারতে পারেনি। তবে চেলুর ব্যাটা আন্ধারুক একবার বাঘ কামরাইসিলো’।
এখন যেটা টাকিমারির চর, বছর পঞ্চাশ আগে তা ছিল নামকরা জঙ্গল। শাল, সেগুন, চিকরাশি, জারুল, কাঞ্চন, শিমূল, কৃষ্ণচূড়ার মতো হাজার হাজার গাছ সূর্যের আলোকে উপরেই আটকে দিত। ঝোঁপঝাড় ও আগাছায় সে ছিল বন্য জীবজন্তুদের আদর্শ পরিবেশ। শুধুমাত্র টাকিমারির চর নয়- বর্তমান রংধামালী, বোদাগঞ্জের জনবহুল এলাকাগুলিও ছিল ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ। সে জঙ্গলে শালগাছের আধিক্যই ছিল সব থেকে বেশি। ‘নাথুয়ার খাল’ নামে একটি জায়গা এখনও রয়েছে তিস্তাচরে। নাথুয়া খালের একটু উজানেই কিন্তু টাকিমারির চর। এই এলাকাতেই ছিল মোহম্মদ ইউনুসের বাথান। সেই বাথানে মৈষালের কাজ করত চেলুর ব্যাটা। অন্যান্য দিনের মতোই ঘন ঝাপসীর জঙ্গলে সে মহিষ শাবকদের জন্য গোছা কাটতে গিয়েছিল। গোছা কাটা কাজটি সমস্ত মৈষাল বন্ধুদেরই নিত্য দিনের কাজ ছিল। গোছা কাটা মানে লম্বা লম্বা ঘাস কেটে ছোট ছোট আঁটি তৈরি করা। যেহেতু পরুরা (মোষ শাবক) বাথানে থাকে তাই তাদের জন্য নল গাছের আগা অথবা ঘাস কেটে পরুর ঘরে ঝুলিয়ে দেওয়া হত। এই গোছা খেয়েই পেট ভরত মহিষ শাবকদের। ঘাস কাটার সময় হঠাৎ পেছন থেকে একটি বাঘ লাফ দিয়ে পরে চেলুর ব্যাটার ঘাড়ের উপর। ধস্তাধস্তি শুরু হয় বাঘে-মানুষে। চিৎকার কানে আসে আন্ধারুদা'র। পাশেই একটি নালায় ঘাস কাটছিলেন তিনি। তাড়াতাড়ি ছুটে এসে সরাসরি লাঠি দিয়ে বাঘটির ‘থোতমা’য় (থুতনি) আঘাত করেন। বাঘ চেলুর ব্যাটাকে ছেড়ে পালায় বটে কিন্তু নখ দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে মৈষালকে। আন্ধারু কোনোক্রমে নিজের গায়ের গেঞ্জী খুলে আক্রান্তের রক্ত থামাবার চেষ্টা করেন। চিৎকার করে ডাকেন অন্যদের। আশেপাশে থাকা দু’-একজন মৈষাল ছুটে আসেন। চেলুর ব্যাটাকে নিয়ে যাওয়া হয় ইউনুসদা’র বাথানে। অবস্থা বেগতিক হলে নদীপথেই নৌকা করে তাকে ‘ফুসীরঘাট পর্যন্ত আনা হয়। সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় জলপাইগুড়ির হাসপাতালে। বরাতজোরে সে যাত্রায় প্রাণে বাঁচে মৈষাল বন্ধু।
একটা প্রশ্ন দিয়ে আরেকটু এগিয়ে চলি। আচ্ছা এমন একটি বন্য জন্তুর নাম করুন যার চলার পথ আপনাকে ছেড়ে দিতেই হবে। উনারা কিন্তু নিজের পথ কোন সময়েই বদলান না। আর এমন একটি বন্যপশুর নাম বলুন- যে আপনার উপস্থিতি টের পেলে নিজেই পথ ছেড়ে দূরে সরে যাবে। ভাবিয়ে তুললাম কি? ঠিক, একদমই ঠিক ধরেছেন। প্রথমটি ‘হাতি আর দ্বিতীয়টি ‘বাঘ’। মৈষালেরা যখন জঙ্গলের মাঝ দিয়ে পথ চলতেন তখন সর্বদাই হাতে আর মুখে আওয়াজ করে চলতেন। কারণ তাঁরা জানতেন আশেপাশেই বাঘ বাবাজীরা লুকিয়ে রয়েছেন। মৈষালের উপস্থিতি টের পেলেই বাঘেরা দূরে সরে যেত। বাঘ ব্যাপারটা শুনলেই আমরা কেমন জানি চমকে উঠি অথচ মৈষাল বন্ধুদের কাছে তা ছিল জলভাত। তবে হাতিকে বেশ সমীহ করত মৈষাল বন্ধুরা। আশপাশের জঙ্গল থেকে মাঝে মাঝেই হাতির দল ঢুকে পড়ত তিস্তার চরে। কোনো কোনো সময় বাথানের দরজার কাছে এসে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত। তারপর আবার চলেও যেত। মৈষাল বন্ধুরাও তাদের বিরক্ত করতেন না মোটেও। নিজেরা দূরে সরে গিয়ে লক্ষ্য রাখত সপরিবারের হস্তিকুলকে। খাবারের লোভে অথবা রাগে বাথানের ঘর কখনও গুড়িয়ে দেয়নি তারা। এমন কোনো দুঃখজনক ঘটনা শোনা যায়নি আজকের মৈষাল বন্ধুদের কাছ থেকে। এ বড় অদ্ভুত জিনিস। অনেকটা সেই কুকুর আর মৈষালদের ভালোবাসার মতো। যে ভালোবাসার পেছনে জড়িয়ে রয়েছে এক গভীর কৃতজ্ঞতাবোধ। এ কৃতজ্ঞতাবোধ মৈষালদের নয়! এ কৃতজ্ঞতাবোধ হস্তিকুলের। হাতির স্মৃতিশক্তি যে ভীষণ প্রখর সে তো আমরা সবাই জানি। হয়তো আওয়াজে-ইশারায় তারা সমস্ত হস্তিকুলকে জানিয়ে দিয়েছে যে, ‘মৈষাল আমাদের বন্ধুরে, মৈষাল আমাদের বন্ধু। ওরা শত্রু নয়। ওরা শত্রু হতে পারে না’। মাঝে মাঝেই যখন হস্তিশাবকেরা তিস্তার চোরাবালিতে আটকে পড়ত অথবা তাদের জলে ভেসে যাবার উপক্রম হতো তখন মধ্যতিস্তার এই হিরোরাই (মৈষাল বন্ধু) তাদের রক্ষায় সর্বপ্রথম এগিয়ে আসতেন। তাই যে বন্ধুরা নিজের সন্তানদের বিপদের হাত থেকে রক্ষা করে, মৃত্যুর কবল থেকে ছিনিয়ে আনে, তাদের ক্ষতি করাটা মনুষ্যকুলের লোভ-স্বার্থমাখা ডায়েরিতে থাকলেও বন্যপশুদের খাতায় একেবারেই নেই।
হাতি বাঁচাবার কত গল্পই না রয়েছে তিস্তার কোণায় কোণায়। সেদিন গভীর রাতে হাতির চিৎকার শুনে মৈষালেরা ধড়ফড়িয়ে বিছানা ছাড়ে। কারণ সেই চিৎকার ছিল আর্তনাদের! উল্লাসের নয়। ঘন কুয়াশায় ঢাকা তিস্তাবক্ষ। পঞ্চাশ মিটার দূরের কিছুই দৃশ্যমান নয়। কিন্তু হাতিরা যে বিপদে। এ বিপদ থেকে তাদের রক্ষা করতেই হবে। দুই বাথানের ছয় মৈষাল দল বাঁধে। দড়ি, বাঁশ, হ্যারিকেন নিয়ে তীব্র শীতকে উপেক্ষা করেই তাঁরা খুঁজে চলে বিপদস্থান। চাঁদের আবছা আলোয় মৈষাল-ব্রিগেডের এই কর্ম তৎপরতা তৃপ্ত করে তিস্তাবুড়িকে। ছয় মৈষাল এবার যেন ছয় খোয়াজপীর। শিমূল গাছের ডিঙিটা টেনে আনে সানিয়াদা। কারণ ওপারের অল্প জলেই হাবুডুবু খাচ্ছে বাচ্চা একটি হাতি। জল কম থাকায় ভেসে যায়নি - এই মঙ্গল। এক ডিঙিতে ছয়জনের ওপারে যাওয়া এই মূহুর্তে সম্ভব নয়। তাই কোনোমতে দুইয়ের জায়গায় তিনজন ঝুঁকি নিয়েই পৌঁছায় বিপদস্থানে। মৈষালদের দেখে প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ হাতি একটু পিছু হটে। তাদের চিৎকার থেমে গিয়ে জলের কুলুকুলু আওয়াজ মুখ্য হয়ে উঠে তিস্তাবক্ষে। অদ্ভুত প্রাকৃতিক নীরবতার মাঝে সানিয়াদা, খোলাভাজা আর বায়া নুড়ল পরম যত্নে স্রোতের অনুকূলে ভাসিয়ে নিয়ে যায় হস্তিশাবককে। ওদিকে একফালি চাঁদের নীচে চল্লিশ-পঞ্চাশজনের একটি দল বুকে উৎকণ্ঠা নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে। পশু হলেও তারা যেন একে অপরের আত্মীয় পরিজন। অবশেষে হস্তিশাবকটিকে ধাধিনায় ঠেকাতে সক্ষম হন তিন মৈষালপীর। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় সদ্য জীবন ফিরে পাওয়া বাচ্চা হাতিটি।
কুয়াশা ভেদ করে আকাশের একফালি চাঁদ থেকে নেমে আসছে সোনালী স্পটলাইট। তার নীচে চারটি চলমান দৃশ্য একসুরে বাঁধা। বালুচরে পায়ের ছাপ ফেলতে ফেলতে দলের দিকে এগিয়ে চলে বাচ্চা হাতি। আবছা আলোয় দূরে দাঁড়িয়ে তার খেলার সাথী আর গুরুজনেরা। সোনালী আলোর জল-নকসার উপর ভেসে যাচ্ছে তিন মৈষালপীর। একটু দূরেই বড় বড় পায়ে হেঁটে আসছে তাদের সাথীরা। বুধারুদা'র কাঁধের লাঠির মাথায় ঝোলানো হ্যারিকেনটা তখনও টিমটিম করে জ্বলছে ।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴