আমি এক যাযাবর-৯/শৌভিক কুন্ডা
আমি এক যাযাবর
৯ম পর্ব
শৌভিক কুন্ডা
যাওয়ার কথা ছিলো বিষ্ণুপুর। কিন্তু এই গরম, প্রায় প্রতিদিনই ঐ অঞ্চল দিয়ে তাপপ্রবাহের আশঙ্কা কাগজে-টিভিতে দেখতে দেখতে, সে ভাবনা থেকে পালাতে হল। হোটেল, ট্রেনের টিকিট সেসব ক্যান্সেল করলাম, কিন্তু মন তো উড়াল দিয়েইছিলো, তাই নাকের বদলে নরুন বা দুধের বদলে ঘোল যাই বলি না কেন, একটা কোথাও যেতেই হবে, সে যদি একদিনের জন্যই হয়, তবুও! আমি যে যে ভ্রমণ গ্রুপে আছি, তারই একটি থেকে খোঁজ পেলাম 'সিকসিন' জায়গাটির। সত্যি বলতে, ঘরের পাশের এই আরশি নগরের নাম আমি অন্তত শুনি নি আগে, এই তিন দশকেরও বেশি ঘুরে বেড়ানোর জীবনে!
অথচ এলাকাটির আশপাশ দিয়ে বহু বার তো গিয়েছি!
আসলে, হোমস্টে ব্যবস্থাপনা এরকম অনেক অনেক নতুন সম্ভাবনার রাস্তা খুলে দিয়েছে।
এই নামটি, অর্থাৎ 'সিকসিন', উচ্চারণবিভ্রাটের ফলে জন্মেছে । আসলে এই সিনকোনা প্ল্যানটেশন-সিঞ্চল অরণ্য এলাকা জুড়ে ব্রিটিশ আমল থেকেই মানুষের বসতি বহু বার স্থান পরিবর্তন করেছে, পরিভাষায় শিফটিং। স্থানীয় মানুষের মুখে মুখে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে এই শিফটিংই স্থাননাম এখন, সিকসিন।
বাঘপুল (যার ভালো নাম করোনেশন ব্রিজ) পেরিয়ে তিস্তাকে হাতের ডানদিকে রেখে একে একে কালিঝোরা, শ্বেতীঝোরা, বান্দরঝোরা ছাড়িয়ে রাম্বিবাজার। বাজারের পরেই বাঁ দিকে রাস্তা উঠে গেছে মংপুর দিকে। মংপু বাজার ছাড়ালে, আরও কিলোমিটার ছয়েক, সিকসিন। তো, মংপুর পথে ভালুখোপ বাইপাস ধরে কিছুটা এগোতে এগোতে দেখি সামনে হলুদরঙা হাজার প্রজাপতির উড়াল। আরও একটু এগোতে বুঝলাম দূর থেকে প্রজাপতি মনে হলেও আসলে পাখির ঝাঁক, উড়ে উড়ে বসছে পথের ওপর। একেবারে কাছে যেতে রহস্য উন্মোচন, না প্রজাপতি না পাখি, আসলে চৈত্রশেষের ঝরা পাতাদের ওড়াউড়ি বাতাসে, রাস্তায় নেমে আসা! মংপু বাজার, তারপর নালিদাঁড়ার ঘিঞ্জি রাস্তা পেরোলে জাদুকাঠির ছোঁয়া। মুহূর্তে ঘুমের দেশে, নৈঃশব্দের দেশে পৌঁছে যাওয়া। এতটাই নির্জন, যে কোথাও রাস্তা ভাগ হয়ে গেলে শুধোনোর মানুষও নেই! আন্দাজে তবু গাড়ি গড়ায়। এবং একটা সময় মনে হয়, যত ধীরেধীরেই উঠি না কেন, ছ' কিলোমিটার পাড়ি দিতে এতটা সময় লাগার কথা নয়। একটু আনডিসাইডেড চলনের পাশ দিয়ে একটা গাড়ি ওভারটেক করছে যখন, দীনেশচন্দ্র হাত দেখিয়ে সাহায্য চায়। সে গাড়ি একটু এগিয়ে ব্রেক কষে। দীনেশ এগিয়ে যায় ঠিকঠাক রাস্তার খোঁজ নিতে। হঠাৎ দেখি ওর জানালায় একটা মুখ। প্রথমে ভেবেছি গাজনের দলের ছোকরা কোনো, শিলিগুড়িতেও টাকা নিয়েছে গাড়ি থামিয়ে। মুহুর্তে সে জানালা গলে পেছনের আসনে বসতে বসতে বুঝে উঠি, ছোকরা নন, পূর্ণবয়স্ক বাঁদর ইনি! মধুপর্ণার ব্যাগ হাতিয়ে, পান-জরদার কৌটো সিটে ফেলে আপেল-বিস্কিট নিয়ে চম্পট! ততক্ষণে তার সঙ্গী আরও দু চারজন উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করেছে, কেউ বনেটে উঠে, কেউ জানালায় ঝুলে!
দীনেশ ফিরে এলে জানলাম, সত্যিই কিলোমিটার দুয়েক আগে সিকসিন ইকো হোমস্টে ছেড়ে এসেছি। অতএব, চল মুসাফির, পিছে মুড়। ততক্ষণে ফোন পেয়ে গৃহকর্ত্রী মেরিনা আর কর্তা প্রশান্ত রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। ফলে এবার আর চিনতে অসুবিধে হয়নি। এক্কেবারে প্রধান সড়কের গা ঘেঁষেই হোমস্টে। রাস্তা থেকে দুই আর দুই চার ধাপ সিঁড়ি বেয়ে। তারপরই সবুজ মখমলি লন, চোখের আরাম। কাছে গিয়ে দেখি কৃত্রিম ঘাসের কারপেট! খিদে পেয়েছিল জব্বর। পৌঁছনোর মিনিট পনেরোর ভেতর গরম গরম খানা হাজির। আমারই ফরমায়েশ মতো কালে দাল, গুন্দ্রুকের আচার, পনীর, আর ফরমায়েশের বাইরেও আলুভাজা, বাঁধাকপির সবজি। একেবারেই ঘরোয়া প্রিপারেশন। মধুপর্ণা বরাবরই নেপালি রান্না মুখে দিয়ে বলে, "এরা না, কি যেন একটা মশলা দেয়, অন্যরকম স্বাদ!" এবারও বলল, এবং যথার্থই বলল। হঠাৎই খেয়াল করলাম বেশ ঠান্ডা লাগতে শুরু করেছে। হ্যাঁ, এই ভরা এপ্রিলেই, চার হাজার ফুট উঁচু সিকসিন গ্রাম শীতলতার স্পর্শ দিয়ে বরণ করে নিচ্ছে আমাদের।
প্রধান সড়কের লাগোয়া হোম স্টে একথা আগে জেনেই এসেছি এখানে। কিন্তু, প্রত্যন্ত এলাকায় যেমন হয়, রাস্তা আছে, ভীড় নেই। অতএব শান্তিযাপনে বিঘ্নও নেই! প্রশান্ত-মেরিনার নিজেদের ঘর কয়েক সিঁড়ি ওপরে। বাড়ির সামনের ঢালে অতিথিদের থাকার জন্য দুটো ঘর। একটা ছোট্ট কুটিরই। পালিশ করা বাঁশের রেলিং দেওয়া বারান্দা থেকে এক পা নামলেই কৃত্রিম ঘাসের এক ফালি লন। আবার দু ধাপ নেমে ফুল ফোটানোর প্রস্তুতি। ঘরে বাহুল্য নেই, প্রয়োজন মেটানোর সরঞ্জাম আছে। আরামসে তিনজন, সুজন হলে চারও, দুটো খাটে। বেডসাইড টেবল। ডাইনিং টেবল ঘিরে চারটি চেয়ার। ওয়াল কাবার্ড। তার ভেতর বাঁশের ক্যান্ডেল স্ট্যান্ড, এ্যাশট্রে। শাওয়ার কিট, টাওয়েল, বাথরুম স্লিপার গুছিয়ে রাখা। ছোট্ট আয়না মাস্টার রুমের দেয়ালে, ওয়াশরুমেও একটা। দেয়ালে আর আছে ফ্রেম বাঁধানো চারটি হাতে আঁকা ছবি। সবুজ লনে সাদা চেয়ার ফুলের মতো ফুটে আছে! ঢাকনা দেওয়া চায়ের কাপ-ডিশ, রঙিন ট্রেতে। ঠান্ডা বাতাসে জিরোতে থাকা শরীর, সামনে বিস্তৃত পাহাড়ি উদারতা, আর সুগন্ধী চায়ে চুমুক! কে জানত সন্ধ্যেয় এই চিত্রপটে অন্য ছবি ফুটে উঠবে!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴