আবারো ইষ্টিকুটুম
অমিত কুমার দে
~~~~~~~~~~
গাড়ি পার্কিং করে দরজা খুলতেই সুব্রত-র হাসি মুখ – “চা, না কফি?”
লকডাউনের
ঝোড়ো ধাক্কা কাটিয়েও ‘ইষ্টিকুটুম’ আগের মতোই সুন্দর। তেমনি চোখ ধাঁধানো
কাঁচা হলুদ রঙ দেওয়ালে দেওয়ালে! প্রথম বার গিয়েছিলাম কোভিড-ঝড়ের আগে। মালিক
সুব্রতও পাল্টাননি একটুও। চেহারায় এবং আন্তরিকতায়। কোনো ট্যুরিস্ট ১৩
নভেম্বর ২০২১-এ নেই। সকাল দশটা নাগাদ ফোন করে বলেছি “আসছি কিন্তু!”
আলিপুরদুয়ার থেকে বাজারপাতি করে আমি পৌঁছবার আগেই তিনি এসে হাজির। শুধু
হাজির নয়, মহা সমারোহে হাজির! পরিকল্পনা করে এসেছেন আমার ওজন এবার নির্ঘাত
কয়েক কিলো বাড়িয়ে দেবেনই!
রাজহাঁসদুটো
লম্বা ঠোঁটে বালতি থেকে জল তুলে তুলে স্নান করছে নরম রোদ্দুরে। ঘাড়
বাঁকিয়ে আমাদের দেখে নিল বার কয়েক। ফুল-জাংলার নীচের ঘাস ভিজে যাচ্ছে সেই
জলে!
রান্নাঘরে ঢুকবার
দরজায় ঝুলছে লতানো জুঁই। সেই বুকছোঁয়া ঘ্রাণ! আগের বারের মতোই আন্তরিক হাসি
ভাইয়ারাম ওঁরাও-এর। তবে বোঝা যাচ্ছে মালিকের তাড়ায় রান্না নিয়ে সে জেরবার।
হাতে খুন্তি নিয়েই বলল – “ভালো আছেন?”
‘ইষ্টিকুটুম’ মেতে আছে কাটা ধানের গন্ধেও। ক্ষেত থেকে ঘরে এসেছে স্বর্ণশস্য। অবশ্য সারা গ্রাম জুড়েই একই ছবি, একই সুবাস।
পাখিদের
নামে ঘরগুলো তেমনি সুন্দর করেই সাজিয়ে রাখা আছে। যদিও পর্যটন বড় যন্ত্রণায়
আছে কোভিড-পরিস্থিতির দুঃসময়ে। পরিকাঠামো ঠিকঠাক রাখা যে কী কঠিন কাজ –
ভুক্তভোগীরাই জানেন। সুব্রত পারছে নিজে শিক্ষকতা করছে বলে, জমিজায়গা আছে
বলে। কিন্তু বাকি অনেকে, যারা পর্যটন থেকে রুজিরোজগার করেন, তাদের অনেককেই
কাঁদতে দেখলাম এবারে বেড়াতে বেরিয়ে। ডিপ্রেশনের ওষুধ খেতে হচ্ছে এমনও
দেখলাম। মন ভার হয়ে গেছে বারবার।
দ্বিপ্রাহরিক
আহারে বসে সুব্রত-র কল্যাণে নিজেকে মহারাজা-মহারাজা মনে হচ্ছিল। মুলো দিয়ে
জম্পেশ মুগডাল, নদীর কালোরঙা কুচো চিংড়ি দিয়ে শীতের সবজি, ফুলকপি
মঞ্চুরিয়ান, আলু-বেগুন দিয়ে নদীয়ালি রূপোলি মাছ, দেশি হাঁসের ডিমের
ডাকবাংলো, জলপাইয়ের চাটনি, পাপড়ভাজা! এবং তারপরেও সুস্বাদু লাড্ডু আর যত
ইচ্ছে নলেন গুড়ের সন্দেশ!
হেমন্তের
বেলা তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়। গাড়ি স্টার্ট দিলাম বৈকালিক বেড়ানোর উদ্দেশ্যে।
সঙ্গে সুব্রতও। পোরো নদীর পাড়ে গিয়ে গাড়ি থামালাম। অদ্ভুত ভালো লাগা চরাচর
জুড়ে। স্বচ্ছ নদীটি সার্থক কবিতার মতো বইছে। অসংখ্য পাখি সবুজ অরণ্য ছুঁয়ে
উড়ছে, কিচিরমিচির করেই চলেছে অনর্গল। মাছের আঁশটে গন্ধ পাচ্ছি। সুব্রত
বললেন – “এ নদীর মাছ খুব টেস্টি!” আর আমি খুঁজে চলেছি নদীয়ালিদের! সুব্রত
জানালেন - জাতীয় সড়কের একদিকে নর্থ পোরো, অন্যদিকে সাউথ পোরো ইকো পার্ক।
চড়ুইভাতির মরশুমে খুব ভিড় জমে। আমার মনে হচ্ছিল, তবে ভালোই করেছি –
নির্জনতা মুঠোয় নিয়ে মুহুর্তকে ধরে রাখলাম চিরকালীন করে।
তারপর
রাজাভাতখাওয়া। জঙ্গুলে গন্ধ হাওয়ায় হাওয়ায়। জঙ্গলে ঘাস লতাপাতা খেয়ে
গরু-মোষ নিজের নিজের ঠিকানায় ফিরছে। ডিমা নদীর সেতুতে পৌঁছতেই সূর্যাস্তের
আভাস। নদীকে বাঁধছেন এক আদিবাসী মানুষ, পাথর দিয়ে। বাঁধের মুখে বসাচ্ছেন
মাছ-শিকারের ফাঁদ। বুঁদ হয়ে দেখছি – সূর্যের রঙ পাল্টানোর জাদু। একটু সময়
আরণয়ক গাছগাছালির মাথায় ঝুলে থেকে সে টুপ করে অদৃশ্য হল! যেন বড্ড তাড়া
আছে। তারপরও আকাশ জুড়ে কত রঙ!
সুব্রত
বললেন – “এবার একটা অফবিট পথে যাব। বাঁদিকে স্টিয়ারিং ঘোরান।” একদিকে
গারোপাড়া চা বাগান, অন্যদিকে আটিয়াবাড়ি চা বাগান। বাগানিয়া সোঁদা ঘ্রাণ
গাড়ির জানালা দিয়ে হুহু করে ঢুকছে। অন্ধকার নেমে আসছে। হঠাৎ সামনে দেখি
রাস্তা আটকে একদন আদিবাসী ছেলেমেয়ে সাদরি গানের সঙ্গে মাদল বাজিয়ে নাচছে।
গাড়ি থামালাম। মোবাইল ফোনের আলোয় ওরা নাচছে। আমায় দেখে আবদার এল – গাড়ির
হেডলাইট জ্বালিয়ে দিলে ওদের খুব সুবিধে হয়। ভিডিও তুলে কোথাও পাঠাতে হবে
ওদের। আলো জ্বেলে দিলাম! সেই ট্রাডিশনাল পায়ের কাজ, কোমড় জড়িয়ে হাত নেড়ে
গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে এক আদিম নৃত্যভঙ্গিমা। এই ছন্দ শরীরের ভেতর ঢুকে যায়।
ফেরার
পথেই অসংখ্য পাখির ডাকে বাধ্য হলাম গাড়ি থামাতে আটিয়াবাড়ি চা বাগানের
মন্দিরে। হাজার হাজার পাখি এখানের গাছগুলোয় দিনশেষে ফিরে এসে ঘুমিয়ে পড়ার
আগে কত কথাবার্তা যে সেরে নিচ্ছে!
ইষ্টিকুটুমে
ফিরেই সুব্রত শুরু করে দিল শিক-কাবাবের প্রস্তুতি। তার আগে চলে এল গরম গরম
কফি আর ভেজ পকোরা। কিছুক্ষণের মধ্যেই শিক-কাবাবও প্রস্তুত, গল্পে গল্পে
সময় গড়ায়। তারপর নিজের বাগানের গোলমরিচ দেওয়া দার্জিলিং চা।
রাতে
সুব্রত নিজে হাতে রেঁধে খাওয়ালেন ‘হান্ডি স্মোকি চিকেন’! মাটির হাঁড়িতে
মাংস। হাঁড়ির ভেতর চারকোল ব্যবহার করে মাটির উনুনে কাঠ দিয়ে রান্না। খাওয়ার
সময় বারবার জানতে চাওয়া – “ধোঁয়ার ওরিজিনাল গন্ধ পাচ্ছেন তো?”
আমি চেটেপুটে খাচ্ছি, আর সুব্রত দিয়েই যাচ্ছে।
ভোরে
উঠে সুব্রত-র চায়ের বাগান স্পর্শ করা মেঠো পথ ধরে চললাম কালজানি নদীটির
দিকে। সারারাত শিশির ঝরেছে, বৃষ্টির টুপটাপের মতো গাছ থেকে বিন্দু বিন্দু
পড়ছে। ভাইয়ারাম ওঁরাও-এর বাসা থেকে মোরগ ডাকছে। গরু-বাছুরদের ঘিরে বসে আছে
অসংখ্য সাদা বক। ছানাপোনা নিয়ে মুরগীরা শীষ-ছোটা ধান খুঁটে খাচ্ছে প্রভাতী
রোদ্দুরে।
ফিরে আসতেই
অভিভাবকের মতো সুব্রত বললেন – “কালো নুনিয়া চালের ভাত হচ্ছে, বাটার দিয়ে
গরম গরম মেখে খাবেন। সঙ্গে ডিমের ওমলেট। কখন কোথায় খাবার জুটবে কে জানে!
তাই একটু খেয়ে বের হন।”
আমায় তখন ডাকছে ভুটানঘাট, সাতরঙা পাহাড়!