চা বাগিচার ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং - ফিরে দেখা (প্রথম পর্ব) /গৌতম চক্রবর্তী
চা বাগিচার ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং - ফিরে দেখা
(প্রথম পর্ব)
গৌতম চক্রবর্তী
বর্ষার জন্য রণে ভঙ্গ দিতে হয়েছে। তাই বানারহাট সার্কিটের বাকি চা বাগিচাগুলোর ক্ষেত্রসমীক্ষা বাকি রয়েছে বেশ কিছুদিন। তাছাড়া শরীরটাও জুতে নেই। গৃহিণীও এভাবে ঘুরে বেড়ানোতে নারাজ। বয়েস এবার জানান দিচ্ছে। হাঁটু কমজোরি হচ্ছে। কিন্তু ‘সহজ উঠোন’ এর বন্ধুরা আমার লেখা পাবেন না ভাবতেই তো খারাপ লাগে। তাই আজকে ‘পুরণো বোতলে নতুন মদ’ ঢাললাম। আজকের বিষয় ‘চা বাগিচাতে ডিজিটাল ব্যাংকিং’। কেন এই টপিক বাছলাম তার একটা প্রেক্ষাপট আছে। ঠিক বছর আটেক আগে প্রথম দফার প্রধানমন্ত্রীত্বে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী দুটি যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে এসেছিলেন। একটি নোট বাতিল এবং অন্যদিকে ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং। উত্তাল হয়ে উঠেছিল চা বাগিচা। সে এক বিরাট লড়াই। আবারো জনাদেশ নিয়ে তৃতীয়বারের জন্য এনডিএ সরকার গঠন করেছে। ‘স্ব-আরোপিত’ ঈশ্বর নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর ক্যারিশমা অনেকটাই ফিকে। তাই অনেক কিছু সংস্কার নির্ভর করছে আসন্ন বাজেটে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চা বাগিচা। মনোজ টিজ্ঞা জিতলেন আলিপুরদুয়ার থেকে, জলপাইগুড়ি থেকে জিতলেন বিজেপির জয়ন্ত রায়, দার্জিলিং থেকে রাজু বিস্ত। তাই চা বলয় স্বস্তিতে। নিশ্চয় এবার কেন্দ্রীয় সরকার বন্ধ চা বাগিচা নিয়ে, শ্রমিকদের ন্যুনতম মজুরী নিয়ে কিছু করবে। সময়ই বলবে। আপাতত ফিরে যাই আট বছর আগের সেই ভয়ঙ্কর সময়কালে। যখন নোট বাতিলের চক্করে বেসামাল হয়েছিল ডুয়ার্সের চা বাগিচা। বেশ কয়েকটি পর্বে চলবে এই গবেষণামূলক আট বছরের সালতামামি। আসবে ডুয়ার্সের চা অর্থনীতি নিয়ে কিছু দিক নির্দেশ।
চা বাগিচাতে নোট বাতিলের ধাক্কা
যখন চা-বাগিচা, শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক, সমস্যা-সম্ভাবনা-সমাধানের দিশা খোঁজার চেষ্টায় ক্ষেত্রসমীক্ষা করে সমস্যার গভীরে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি, তখন কালবৈশাখী ঝড়ের মতোই দিগ্ভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক'-এর আঘাতে। না, কালবৈশাখী কেন বলব? যখন ২০১৬ সালের নভেম্বরের ৯ তারিখ থেকে ডিসেম্বরের ৯ তারিখ— এক মাসের ক্ষেত্রসমীক্ষার সালতামামি নিয়ে বসেছিলাম, তখন ডিজিটাল ভারত ও স্বচ্ছ ভারতের দিকে অনেকটাই ধাবমান আমরা। ৫০ দিনের কঠোর অধ্যবসায়ের পর ১২০ কোটি আম নাগরিক কি সত্যিই ‘অচ্ছে দিন’-এর সন্ধান পাবে, না হাতে থাকবে পেনসিল, সেগুলি নিয়ে আগাম ভবিষ্যদবাণী জ্যোতিষীরাই করুক। ২০১৭ চা-বাগিচা শ্রমিকদের জন্য কী বার্তা আনে তখনকার প্রেক্ষাপটে সেটাই ছিল বিচার্য বিষয়। ডুয়ার্স এবং তরাইতে দুই শতাধিক চা-বাগান। ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক'-এর নিয়মের বেড়াজালে মজুরি সংকটে জেরবার চা শিল্পমহল দ্রুত কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করে প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়। কারণ স্বাভাবিকভাবেই বড় নোট বাতিলের জেরে উত্তরবঙ্গের চা-বাগানগুলিতে শ্রমিকদের সাপ্তাহিক মজুরি পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে উত্তরের অর্থনীতির জিয়নকাঠি হিসেবে পরিচিত চা শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ১২ লক্ষ শ্রমিক পরিবার। চা-বাগানগুলির ব্যাঙ্ক লেনদেনের শর্ত শিথিল করার দাবি ওঠে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সমস্যার গুরুত্ব উপলব্ধি করে জলপাইগুড়ির জেলাশাসক মুক্তা আর্য জরুরি বৈঠক আহ্বান করেন। মালিকপক্ষের সঙ্গে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষর প্রতিনিধিরাও বৈঠকে উপস্থিত থাকেন নোট বাতিলের ফলে সৃষ্ট হওয়া সংকট সমাধানের আন্তরিক প্রচেষ্টায়।
নোট বাতিলের কুফল
সেই সময়ে কনসালটেটিভ কমিটি অব প্ল্যান্টেশন অ্যাসোসিয়েশন বা সিসিপিএ-র সেক্রেটারি জেনারেল অরিজিৎ রাহাকে দূরভাষে ধরলাম। চা-বাগিচার মালিকপক্ষের শীর্ষ সংগঠনের এই ব্যস্ততম নেতৃত্ব তাৎক্ষণিকভাবে স্বল্প কথায় জানালেন, বাগানগুলির ব্যাঙ্ক লেনদেনে নিয়মকানুন শিথিল করার আর্জি জানিয়ে কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রক, অর্থমন্ত্রক, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, শ্রম দপ্তর, রাজ্য সরকার, রাজ্য শ্রম দপ্তর, টি বোর্ড এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের কাছেও চিঠি পাঠানো হয়েছে। তিনি প্রসঙ্গক্রমে জানালেন, সর্বাগ্রে প্রয়োজন শ্রমিক সহযোগিতা। নইলে চা-বাগানের ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলার সাম্প্রতিক নিয়ম শিথিল না করলে বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। বিপর্যয়টা কী রকম? ৫০০ এবং ১,০০০ টাকার নোট বাতিলের পরদিন আমি বীরপাড়ায়। বীরপাড়া বাগান খোলার সংবাদে হাসি শ্রমিক পরিবারবর্গ সকলেরই। যদিও খোঁজখবর নিয়ে জেনেছিলাম প্রচুর শ্রমিক গত দেড় বছরে পেটের দায়ে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছেন। বীরপাড়া বাগান খোলার সংবাদে আশার সঞ্চার হয়েছিল হান্টাপাড়া, লংকাপাড়া ইত্যাদি বন্ধ বাগানগুলিতে। ৯ নভেম্বর, বুধবার হাট ছিল ডুয়ার্সের লাটাগুড়ি, সুলকাপাড়া এবং ঝালঙে। বীরপাড়া চৌপথিতে পেয়ে গেলাম তিনটি জায়গার মানুষজনকে। ডুয়ার্সের শতাব্দী প্রাচীন বীরপাড়ার হাটে বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজারেরও বেশি দোকানদার আসে। জটেশ্বর থেকে আসা চাল ব্যবসায়ী ঝুনু সাহা দুপুরের মধ্যেই দোকান গুটিয়ে নেন। কেউ দোকান গুটিয়েছেন দুপুরবেলাতেই। কেউ বা সারাদিন শুয়ে কাটিয়েছেন দোকানে বিছিয়ে রাখা মালপত্রের উপর। কোথাও বা খুচরোর অভাবে প্রারম্ভিক বিক্রিটুকুও করতে না পেরে শূন্য হাতেই বাড়ি ফিরেছেন ব্যবসায়ীরা। হাট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জানা গেল, এ দিন তাঁদের ব্যবসা অন্যান্য দিনের তুলনায় ৮০ শতাংশ কম। ৫০০ টাকার নোট নিয়ে এসে চাল কিনতে না পারায় পাঁউরুটি খেয়েই রাত কাটানোর বন্দোবস্ত করেছেন চা-বাগানের বাসিন্দারা।
বজ্র আটুনি ফস্কা গেরো
আসলে নোট বাতিলের ঘায়ে বহু হঠাৎ-বড়লোকের ঘুম যেমন উবে গিয়েছিল, তেমনি সংকটে পড়েছিলেন গরিবগুর্বো অনপড় মানুষ। চা শ্রমিক সুষমা মিঞ্জ সাপ্তাহিক মজুরির টাকা পেয়ে দুটো ৫০০ টাকার নোট নিয়ে মঙ্গলবাড়ির হাটে এসেছিলেন চাল কিনতে। বাড়িতে মা, বাবা, ভাইসহ মোট ন'জন সদস্য। চাল কিনতে হাটের প্রতিটি দোকানে ঢুঁ মারলেও ৫০০-র নোট দেখে কেউই আর তার কাছে চাল বেচেনি। আমি তখন বীরপাড়ার হাটে। যুবতীর কাছ থেকে জানলাম চেনাশোনা একটি দোকান থেকে কয়েকটা পাউরুটি বাকিতে নিয়েছেন। তা খেয়েই তাকে এবং তার পরিবারকে রাত কাটাতে হবে। ঢেকলাপাড়ার ষাটোর্ধ্ব বাসিন্দা কুনা তাঁতির হাতে ছিল কতকগুলো খুচরো টাকা। জেনেছিলাম ৫৩ টাকাই ছিল সেই মুহূর্তের সম্বল। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়েছিল। ছেলে-বউ মজুরি না পেলে হয়ত ৫৩ টাকাই চলে যাবে সংসার খরচে। হাতে থাকবে শূন্য হিসেবের খাতা। ফলে নোট বাতিলে কিছুই গেল এল না কুনা তাঁতিদের। মাত্র ৩৫ বছর বয়সের আগেই বাসন্তীর জীবনে বৈধব্যের অন্ধকার নেমে এলে তিনি জীবিকা নির্বাহ শুরু করেছিলেন হাঁড়িয়া বেচে। সেই বাসন্তীর কেনাবেচাও ছিল বন্ধ। চালই জুটছিল না, হাঁড়িয়া খেয়ে হবেটা কী? জীবনকে প্রত্যক্ষ করেছিলাম বীরপাড়ার হাটে যা আমাকে সারা জীবন নাড়া দেবে। মনে পড়ে যাচ্ছিল সুকান্তের সেই অমোঘ উক্তি, “পিঠেতে টাকার বোঝা তবু সেই টাকাকে যাবে না ছোয়া”। সেই ধরণের বাস্তব পরিণতিই হয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকারের তাৎক্ষণিক নতক্ষণিক। মানুষকে সময় না দিয়ে সামগ্রীক অর্থনৈতিক ব্যাবস্থাকে নিয়ে কার্যত ছেলেখেলা করা হয়েছিল।
বাগিচা প্রশাসনের তৎপরতা
নোট বাতিলের এই চক্কর সরাসরিভাবে আঘাত করেছিল চা-বাগিচা শ্রমিকদের। বাগান শ্রমিক কালী থাপার রাতের ঘুম উবে গিয়েছিল। ভেবেছিলেন পিএফ -এর টাকাটা ব্যাংকে রেখে সুদের টাকায় সংসার চালাবেন। কিন্তু পি.এফ. অফিস জানিয়েছিল আরও কিছুদিন দেরি হবে। পি.এফ এর টাকা না জোটার ফলে অনপড় কালী থাপাকে কে বা কারা বুঝিয়েছিল ওই টাকা তিনি আর পাবেন না। ফলিডল খেয়ে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন কালী থাপা, বরাতজোরে বেঁচে গিয়েছেন। ডুয়ার্স এবং তরাইয়ে মোট প্রায় তিন শতাধিক চা-বাগান রয়েছে। সেই সময়ে দৈনিক ১৩২.৫০ টাকা হারে শ্রমিকরা মজুরি পান বলে মাসিক হিসেব ধরলে তা প্রায় চার হাজার টাকা হয়। বহু শ্রমিক ওভারটাইম করে বাড়তি অর্থ উপার্জন করে। শ্রমিক ছাড়াও বাগানে স্থায়ী-অস্থায়ী কর্মচারী, সহকারী ম্যানেজার, ম্যানেজার, বাবু সহ আরও অন্যান্য লোকজন এবং কর্মচারী বা শ্রমিক আছে। তাই চা শিল্পে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরি প্রদান নিয়ে ব্যাপক সমস্যা সৃষ্টি হবার উপক্রম হয়। কারণ অধিকাংশ চা-বাগানেই মজুরি হিসেবে ৫০০ টাকার নোটই বেশি দেওয়া হত। শ্রমিকরা ২,০০০ টাকার নোটের পরিবর্তে ৫০০ এবং ১০০ টাকার নোট হাতে যাতে বেশি করে পান এবং কোনও অসুবিধায় না পড়েন তার জন্য ব্যাঙ্কগুলিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করে চা মালিকপক্ষের সংগঠন কনসালটেটিভ কমিটি অব প্ল্যান্টেশন অ্যাসোসিয়েশন বা সিসিপিএ৷ তা ছাড়া যে সকল নথি নিয়ে পুরনো নোট ব্যাঙ্কে জমা দিতে বলা হয়েছিল, সেই ব্যবস্থায় চা শ্রমিকদের সুবৃহৎ অংশ সড়গড় ছিল না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বাগানগুলি ৫০০ বা ১,০০০ টাকার নোট ফিরিয়ে নিয়ে ব্যাঙ্কে জমা করে সমপরিমাণ নতুন নোট দেবে।
জেলা প্রশাসনের তৎপরতা
কিন্তু সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের নিয়ম অনুযায়ী চা-বাগিচাগুলি টাকা জমা দিলেও সমপরিমাণ অর্থ না তুলতে পারার ফলে গোলযোগ সৃষ্টি হয়। শ্রমিকদের বোঝাতে সক্রিয় ভূমিকা নেয় স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়নগুলিও। তবে তাদের মধ্যেও বিভ্রান্তি ছিল। তৃণমূল চা মজদুর ওয়ার্কারস ইউনিয়নের সেই সময়কার সভাপতি মোহন শর্মার দায়িত্ব ছিল চা-বলয়ে যাতে নোটের সমস্যা হবার ফলে শ্রমিকদের মধ্যে বিভ্রান্তি না ছড়ায় সেদিকে নজর রাখা। দ্রুত সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে বাগান কর্তৃপক্ষ এবং প্রশাসনের সঙ্গে আলাপচারিতার মাধ্যমে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে তৎপরতার সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে মোহন শর্মাদের ট্রেড ইউনিয়ন-সহ স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়নগুলিও। জলপাইগুড়ির তৎকালীন জেলা শাসক মুক্তা আর্যর আহ্বানে নোট সমস্যা সমাধানে জলপাইগুড়ি সার্কিট হাউসের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক বৈঠকে জেলাশাসক চা বণিকসভার প্রতিনিধিদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বর জানিয়ে দেন মজুরি প্রদান সুনিশ্চিত করার জন্য। প্রশাসনিক বৈঠকে অতিরিক্ত জেলাশাসক ডঃ বিশ্বনাথ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভোলানাথ পান্ডে, টি অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ার ডুয়ার্স শাখার তৎকালীন সচিব রাম অবতার শর্মা, সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের জলপাইগুড়ি জেলার চিফ ম্যানেজার অনাদি বিশ্বাস প্রমুখর উপস্থিতিতে জানানো হয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে নির্দেশনামা এলেই ব্যাঙ্কের মাধ্যমে মজুরি দেওয়ার জন্য টাকা হাতে পেয়ে যাবেন চা-বাগিচা পরিচালন কর্তৃপক্ষগুলির প্রতিনিধিরা। আলিপুরদুয়ারের তৎকালীন জেলাশাসক দেবীপ্রসাদ করণম জানান, চা মালিকদের সংগঠন যে তালিকা প্রদান করেছে তার ভিত্তিতেই শ্রমিকদের মজুরি প্রদানের জন্য যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
কপালে নেই ঘি, ঠক ঠকালে হবে কি
জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ারে জেলাশাসক মুক্তা আর্য এবং দেবীপ্রসাদ করণমের সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত টি অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ার ডুয়ার্স শাখার সচিব রাম অবতার শর্মা জানান আলিপুরদুয়ার জেলার ৬২ টি চা-বাগিচার মধ্যে ৫৫ টি মালিকপক্ষ চালান, যার মধ্যে ৩৫ টি চা-বাগানকে মজুরি দেওয়ার জন্য চিহ্নিত করা হয়েছিল আগেই। পরবর্তীকালে আরও ১৩ টি বাগানের জন্য ছাড়পত্র এসে গিয়েছে। বাকি ৭ টি বাগানও দ্রুত ছাড়পত্র পেয়ে যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। তৎকালীন রাজ্য ক্যাবিনেটের চা ও পাটশিল্প সংশ্লিষ্ট বিশেষ মন্ত্রীগোষ্ঠীর আমন্ত্রিত সদস্য তথা জলপাইগুড়ি কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান সৌরভ চক্রবর্তী সমবায় ব্যাঙ্কগুলিতে টাকা না থাকার কথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে জানান। ইন্ডিয়ান টি প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের মুখ্য উপদেষ্টা অমিতাংশু চক্রবর্তীও শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার জন্য ব্যয় হওয়া প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যাঙ্কগুলি সেই মুহূর্তে দিতে পারবে না জেনে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বাস্তবে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পরবর্তী সাত দিন এবং পর্যায়ক্রমে আরও সাত দিন, অর্থাৎ প্রায় দুই সপ্তাহেও চা শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার জন্য খুচরো টাকার সমস্যার সমাধান হয়নি। এর জেরে সমস্যায় পড়েন জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদয়ার জেলার তিন লক্ষাধিক শ্রমিক। আসামের আদলে চা-বাগিচা পরিচালন কর্তৃপক্ষগুলি মজুরি খাতের অর্থ জেলাশাসকের বিশেষ অ্যাকাউন্টে জমা দেবার জন্য বৈঠকে প্রস্তাব গ্রহণ করে। গৃহীত প্রস্তাব অনুসারে বণিকসভার প্রতিনিধিদের মাধ্যমে চা-বাগানের ম্যানেজাররা ডেপুটি লেবার কমিশনারের দপ্তরে নিজ নিজ চা-বাগানের কর্মরত শ্রমিকদের তালিকা জমা দেন এবং মজুরি খাতে কত অর্থ বরাদ্দ করতে হবে তা-ও জানিয়ে দেন।
চা বাগিচা - জেলা প্রশাসন – ব্যাঙ্কের সমন্বয়
জেলাঅথচ অর্থ দপ্তরের বিশেষ ছাড়পত্র না আসার ফলে বাগিচা পরিচালন কর্তৃপক্ষগুলি মজুরির অর্থ জেলাশাসকের অ্যাকাউন্টে জমা করতে পারেননি। ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ইন কারেন্সি' নিয়ন্ত্রণে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ার জেলা প্রশাসন হাল না ধরলে পরিস্থিতি হয়ত অন্য দিকে মোড় নিত। টি অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ার উত্তরবঙ্গ শাখার সচিব রাম অবতার শর্মা, ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশনের ডুয়ার্স শাখার সচিব সুমন্ত গুহঠাকুরতা, আইটিপিএ-র প্রিন্সিপ্যাল অফিসার অমিতাংশু চক্রবর্তীরা বাগানভিত্তিক মজুরি খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ ডেপুটি লেবার কমিশনারের দপ্তরে জানান। জলপাইগুড়ির জেলাশাসক মুক্তা আর্য বিভাগীয় কমিশনারের মাধ্যমে রাজ্য সরকারকে জানান। অর্থাৎ মজুরি খাতে টাকা না পাওয়ায় চা-বাগিচা শ্রমিকরা যে সমস্যায় পড়েছেন তা মেটানোর জন্য প্রশাসন সর্বতোভাবে চেষ্টা চালিয়ে অর্থ দপ্তরের বিশেষ ছাড়পত্র পাওয়ার প্রচেষ্টা নেয়। মালিকপক্ষও জানান, মজুরি খাতের অর্থ জেলাশাসকের বিশেষ অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়ার জন্য আদেশ এলেই তা জমা দেওয়া হবে। সেই সময়ে কথা হয়েছিল অমিতাংশু চক্রবর্তীর সঙ্গে। তাঁর মতে, তাঁদের অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যভুক্ত বাগানগুলি অনেকটা মজুরি এবং বেতনের টাকা সরিয়ে রেখেছিল। পুরনো নোট বদলে যাতে দ্রুত ৫০০ এবং ১০০ টাকার নোট দেওয়া যায় সেই বিষয়ে তাঁরা সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কের দ্বারস্থ হবার কথাও ভেবেছিলেন। অতিরিক্ত ভিড়ের জন্য এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দেশিকার কারণে ব্যাঙ্কগুলিও কত দূর পর্যন্ত কী করতে পারবে সেই ব্যাপারেও তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন।
অবশেষে সূর্যোদয়
জলপাইগুড়ি সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের চিফ ম্যানেজার অনাদি বিশ্বাসকে যখন টেলিফোনে ধরলাম তখন তিনি চা নিলাম কেন্দ্রের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীকালে জানা গেল, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে টাকা দেওয়ার আদেশনামা সম্পর্কিত পরিবর্তিত নির্দেশাবলি এবং টাকা ব্যাঙ্কের কাছে এলেই তা বাগানগুলির জন্য সংশ্লিষ্ট শাখায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তারপর সেই টাকা হাতে পেয়ে যাবেন বাগানের স্বীকৃত প্রতিনিধিরা। চা-বাগিচা শ্রমিকদের মজুরি খাতের অর্থ যাতে সংশ্লিষ্ট এলাকার জেলা শাসকদের অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়া যায় তার ছাড়পত্র দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে অর্থ দপ্তর। রাজ্যের তৎকালীন অর্থসচিব এইচ কে দ্বিবেদীর স্বাক্ষরিত আদেশনামায় নোট বাতিলের জেরে চা শ্রমিকদের মজুরি দেবার ক্ষেত্রে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে চা-বাগিচা পরিচালন কর্তৃপক্ষকে জেলাশাসকের অ্যাকাউন্টে মজুরি খাতের অর্থ জমা দিতে বলা হয়। অর্থ দপ্তরের প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারির স্বাক্ষরিত আদেশনামা জারি করে তার অনুলিপি পাঠানো হয় উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, কোচবিহার এবং আলিপুরদুয়ার জেলার জেলাশাসকদের কাছে। অর্থাৎ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ার জেলা প্রশাসন হাল না ধরলে পরিস্থিতি হয়ত অন্য দিকে মোড় নিতে পারত। নির্দিষ্ট এলাকার চা-বাগিচার জন্য নির্দিষ্ট ব্যাঙ্কে বিশাল অঙ্কের নগদ অর্থ জমা দেওয়া নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ধৈর্য সহকারে শ্রমিক-মালিক-সরকারি প্রতিনিধি-জেলা প্রশাসন-ব্যাঙ্ক প্রতিনিধি হাসিমুখে কষ্ট স্বীকার করে যেভাবে সরকারি সিদ্ধান্তকে সহযোগিতা করেছেন তা এক কথায় অসাধারণ!
( পরবর্তী পর্ব না পড়লে অতীত থেকে বর্তমানে পৌছতে পারবেন না)
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴