দেবপাড়া টি গার্ডেন/গৌতম চক্রবর্তী
দেবপাড়া টি গার্ডেন
গৌতম চক্রবর্তী
বানারহাট থেকে লখিপাড়া টি গার্ডেনের পাশ দিয়ে ৫.৬ কিমি। গাড়িতে সময় লাগে ১০ মিনিট। বানারহাট থেকে ৫০ মিটার উত্তরদিকে গিয়ে বাঁদিকে ঘুরে খেলার মাঠের পাশ দিয়ে একটু এগিয়ে কারবালা রোডে উঠে ডানদিকে প্লেজার পয়েন্ট অতিক্রম করে ৭০০ মিটার এগিয়ে ডুয়ার্স স্পাইসি ফুড মার্টকে বাঁদিকে রেখে আরো সাড়ে চার কিমি এগোলে পরে গয়েরকাটা রোডে টার্ণ নিলেই দেবপাড়া টি গার্ডেন। জলপাইগুড়ি জেলার সদর মহকুমার ধূপগুড়ি ব্লক এর বানারহাট থানার অন্তর্গত দেবপাড়া টি গার্ডেনটির পরিচালক গোষ্ঠী দেবপাড়া টি কোম্পানি। বাগানটি আইটিপিএ এর সদস্য। বর্তমান কোম্পানি ১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বাগানে মোট ম্যানেজারিয়াল স্টাফ ৬ জন। কোম্পানির মালিকের নাম এস মিত্তাল। ঠিকানা উকিলপাড়া, জলপাইগুড়ি এবং কোম্পানির হেড অফিসও উকিলপাড়া, জলপাইগুড়ি। বাগানে স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন ৬ টি। এগুলি হল সিবিএমইউ, ডিসিবিডব্লিউইউ, এনইউপিডব্লিউ, পিটিডব্লিউইউ, টিইএডব্লিউবি, এবং ডিটিডিপিএলইউ। দেবপাড়া চা বাগানের আয়তন এবং চাষযোগ্য আবাদিক্ষেত্র ৮৫১.৮১ হেক্টর, এক্সটেন্ডেড জমির পরিমান ২৫.৪২ হেক্টর। আপরুটেড এবং নতুন বপনযোগ্য আবাদীক্ষেত্র ৬.৮৪ হেক্টর। ড্রেন এবং সেচের সুবিধাযুক্ত অঞ্চল ৫০৫.০৩ হেক্টর। মোট চাষযোগ্য উতপাদনক্ষম আবাদীক্ষেত্র ৫০৫.০৩ হেক্টর। চা বাগানে নিজস্ব চা পাতা উৎপাদনের গড় ২০ লাখ কেজি। ফ্যাক্টরিতে নিজস্ব উৎপাদিত চা ৫-৬ লাখ কেজি। বাইরের বাগান থেকে সংগৃহিত কাঁচা পাতায় তৈরি চা প্রায় ১ লক্ষ কেজি। মোট বাৎসরিক উৎপাদিত চা ৭-৮ লাখ কেজি। বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বাগানে ইনঅরগ্যানিক সিটিসি চা উৎপাদিত হয়। বাগানটি ছোটো হলেও চরিত্রগত দিক দিয়ে মানের বাগান। প্রতি হেক্টর উৎপাদনযোগ্য ড্রেন এবং সেচযুক্ত প্ল্যান্টেশন এরিয়া থেকে ৯৪৭ কেজি করে চা পাতা উৎপাদিত হয়।
দেবপাড়া চা বাগিচার সাব স্টাফ সংখ্যা ৫৪ জন। করণিক ১০ জন এবং ক্ল্যারিক্যাল ও টেকনিক্যাল স্টাফ ১৪ জন। বাগানে শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ৯২৬। মোট জনসংখ্যা ৬১৪২ জন। স্থায়ী শ্রমিক ১১০৭ জন। এরা দৈনিক নির্দিষ্ট পরিমাণ পাতা তোলার বিনিময়ে নির্দিষ্ট মজুরি পায়। অস্থায়ী শ্রমিক বা বিঘা শ্রমিক প্রয়োজন হয় সিজন টাইমে। ফ্যাক্টরিতে নিযুক্ত স্টাফ এবং শ্রমিক সংখ্যা ৯৪ জন। মোট কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ১২৭৯ এবং শ্রমিক নয় এমন সদস্যদের সংখ্যা ৪৮৬৩। প্রতি ২২ দিনের হিসেবে শ্রমিকরা ‘আর্ন লিভ’ পায়। সরকারি ছুটি ছাড়া তারা ‘সিক লিভ’ও পায়। প্রতি বছর যখন বাগানের উৎপাদন বন্ধ থাকে (নভেম্বর এবং ফেব্রুয়ারি) তখন শ্রমিকরা তাদের জন্মভূমিতে যেতে চায়। শ্রমিকরা যাতায়াতের জন্য দ্বিতীয় শ্রেণির ট্রেন ভাড়া অথবা যাতায়াতের মূল খরচ পাবে। তরাই ডুয়ার্স দার্জিলিং, এমনকি আমাদের চা-বাগানের শ্রমিকদের এখন নেটিভ প্লেস বা আদি বাসভূমি বলতে সেই চা-বাগানই। তাই সেখানে এমন ভ্রমণ ভাতা নেই বললেই চলে। ব্যাংকের কাছে বাগানটি আর্থিকভাবে দায়বদ্ধ নয়। বাগান পরিচালনার কার্যকর মূলধন আসে ব্যাংক এবং নিজস্ব অর্থনৈতিক সোর্স থেকে। বাগানটির লিজ হোল্ডার দেবপাড়া টি কোম্পানি লিমিটেড। লিজের ভ্যালিডিটির সময়সীমা লিজের ভ্যালিডিটি ২০১৮ সাল পর্যন্ত ছিল। লিজ রিনিউয়াল হয়েছে। বাগিচায় ব্যক্তিগত ইলেক্ট্রিক মিটার সহ পাকাবাড়ির সংখ্যা ২৮৯ টি। বৈদ্যুতিক সংযোগবিহীন শ্রমিক আবাসের সংখ্যা। আধা পাকাবাড়ির সংখ্যা ১৯৬ টি। মোট শ্রমিক আবাস ৪৮ টি। মোট শ্রমিক ১২৭৯ জন। বাগানে শতকরা ৩৮% শ্রমিক আবাস এবং অন্যান্য বাসগৃহ আছে। জলের উৎস ডিপ টিউবওয়েল এবং কুয়ো। ৪ টে ডিপ টিউবওয়েলে ৮৫০ টিবাড়ি কভার করে। হ্যান্ড টিউবওয়েল আছে ৩ টি। ৭৫ টি বাড়ি কভার করে। মোট ৯৭৫ টি বাড়ি কভার হয়।
অনেক বাগানেই স্থায়ী চিকিৎসাকেন্দ্র নেই। তবে দেখলাম দেবপাড়া চা বাগিচায় ছোট কাজ চালানোর মত হসপিটাল আছে একটি। কোন ডিসপেনসারি নেই। বাগিচার হাসপাতালে মেল এবং ফিমেল ওয়ার্ডের সংখ্যা ছটি করে। আইসোলেশন এবং মেটারনিটি ওয়ার্ড আছে চারটি করে। অপারেশন থিয়েটার আছে, অ্যাম্বুলেন্স এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রও আছে। বহু বাগানে প্রতিদিন থেকে সপ্তাহে দু'দিন বাগানের চিকিৎসক আসে বাইরে থেকে। কিন্তু দেবপাড়া চা বাগিচাতে অল্টারনেটিভ মেডিসিনে আবাসিক এমবিবিএস ডাক্তার রয়েছেন। ট্রেন্ড নার্স নেই। মিড ওয়াইফ, কম্পাউন্ডার, স্বাস্থ্য সহযোগী আছেন একজন করে। রোগীদের অসুখ বিসুখে বাগিচা থেকে পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ করা হয়। স্থায়ী এবং অস্থায়ী শ্রমিকরা সবাই বিনামূল্যে ওষুধ পাওয়ার অধিকারী। ১৮ বছর পর্যন্ত অপ্রাপ্তবয়স্ক পরিবারের সদস্যরা এই চিকিৎসার সুযোগ পেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শ্রমিকদের চিকিৎসার পুরো খরচ পাওয়া যায় না।
অসুস্থতার সময় বাগিচার হাসপাতালে ভর্তি হলে খাবার সরবরাহ করা হয়। দেবপাড়া চা বাগিচাতে স্থায়ী ক্রেশ একটা। অস্থায়ী ক্রেশ নেই। এখানে চা-বাগানগুলির ক্রেশের ব্যবস্থা অন্যান্য চা-বাগানের চেয়ে তুলনামূলকভাবে ভাল। তিন মাস থেকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের রাখার জন্য যেসব ক্রেশ আছে সেগুলি অনেক পরিচ্ছন্ন। তিন বছর পর্যন্ত শিশুদের এখানে নিয়মিত দুধ সরবরাহ করা হয়। তিন বছরের উপরের শিশুদের দেওয়া হয় ভাত-তরকারির মতো শক্ত খাবার। দু'বছর অন্তর শিশুদের জন্য তৈরি পোশাক দেওয়ার ব্যবস্থাও চালু হয়েছে। মায়েরা কাজে যোগ দেওয়ার সময় তাদের শিশুদের ক্রেশে রেখে দেয়। যাবার পথে মায়েরা শিশুদের নিয়ে ফিরে যায়। তাই অন্যান্য চা বাগিচার মহিলা শ্রমিকদের মতো শিশুদের পিঠে বা কোলে নিয়ে কাজ করার দৃশ্য খুব একটা চোখে পড়ে না।
ক্রেশে অ্যাটেনডেন্টের সংখ্যা পাঁচজন। ক্ৰেশে পর্যাপ্ত জলের ব্যাবস্থা, শৌচালয় আছে। দুধ, বিস্কুট বা পুষ্টিকর খাবার ক্রেশের শিশুদের দেওয়া হয়। পর্যাপ্ত পানীয় জল ক্ৰেশে এবং চা বাগানে সরবরাহ করা হয়। বাগিচায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। বাগিচা সংলগ্ন উচ্চ বিদ্যালয় আছে বাংলা মাধ্যমের একটি এবং হিন্দী মাধ্যমের একটি। বাগিচার বাচ্চাদের বাসে করে স্কুলে নিয়ে যাওয়া হয়। বাস একটা। বাগিচাতে খেলার মাঠ এবং ক্লাব আছে। লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার নেই। গার্ডেনে নিয়মিত পি এফ বা গ্র্যাচুইটির টাকা জমা পড়ে। বোনাস চুক্তি অনুযায়ী মিটিয়ে দেওয়া হয়। পি এফ বা গ্র্যাচুইটি মাঝেমাঝে বকেয়া থাকে। তবে মিটিয়ে দেওয়া হয়। শ্রমিকদের মজুরি, রেশন এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা চুক্তি অনুযায়ী দেওয়া হয়। প্রতিটি শ্রমিক বছরে একবার সাধারণ উলের কম্বল পায়। প্রতি দু'বছর অন্তর দেওয়া হয় তুলনামূলকভাবে ভাল উলের কম্বল। যারা কীটনাশক, রাসায়নিক স্প্রে করে, তাদের দেওয়া হয় ওভারকোট। স্থায়ী শ্রমিকরা প্রতি মাসে উৎপাদন খরচের মূল্যে ২৫০ গ্রাম করে গুঁড়ো চা পায়। দেবপাড়া চা-বাগিচা শিক্ষার ব্যবস্থাপনাতেও এগিয়ে আছে। ডুয়ার্সের অধিকাংশ চা-বাগানে সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করে দিয়েছে। ফলে এখানকার শ্রমিকদের সন্তানদের মধ্যে শিক্ষার প্রতি আগ্রহও তূলনামূলকভাবে বেশি। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক ক্ষেত্রেও শিক্ষার প্রসার তুলনামূলকভাবে বেশি। এ ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি স্কুলগুলির উদ্যোগ লক্ষণীয়। এই সমস্ত স্কুলের দূরত্ব বাগান থেকে গড়ে ১ থেকে ৬ কিলোমিটারের মধ্যে। দেবপাড়ার মত উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্সের চা-বাগানের মালিকপক্ষ থেকে শ্রমিকদের সন্তানদের দূরে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যেতে বাগানের গাড়ি দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে।
এবারে বাগিচা সফরে এসে কিছু এক্সক্লুসিভ তথ্য পেলাম। সাম্প্রতিককালে সবজির দর আকাশছোয়া। এর একটা অন্যতম কারণ বন্যা, নির্বাচনী তহবিলে বা পার্টি ফান্ডে মোটা টাকা চাঁদা দেওয়ার পরোক্ষ প্রভাব, মাটির বন্ধ্যাত্ব এবং সর্বোপরি কৃষিজমির পরিমান জনসংখ্যার অনুপাতে কমে যাওয়া। পশ্চিমবঙ্গে উদার অর্থনীতি শুরু হয়েছিল ১৯৮৪ সালে বামফ্রন্টের রাজত্বকালে। পি ভি নরসীমা রাওয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে উদার নীতি সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়েছিল আর বামফ্রন্টের আমলে এই যাত্রা শুরু হয়েছিল অঘোষিতভাবে। সমস্ত ধানি জমিকে চা-চাষে পরিবর্তন না করেই যেভাবে চা-বাগানে রূপান্তরিত করা হয়েছে তার সরকারি অনুমতি না থাকার ফলে এই চা-বাগানের জন্য যেমন সরকারের পক্ষ থেকে ‘এনওসি’ দেওয়া হয়নি, তেমনই সরকারিভাবে এগুলি নথিভুক্তও হয়নি। এই রাজ্যে কত চা-বাগিচা ও কত পরিমাণ জমি এই নতুন চা-বাগিচার জন্য রূপান্তরিত হয়েছে তার সঠিক হিসেব পাওয়া যায়নি। মনমোহন সিং তাঁর উদার নীতির লক্ষ্যে মুনাফাসর্বস্ব ভাবনার যে প্রতিফলনের কথা বলেছেন সেটা বামফ্রন্ট সরকার অনেক আগেই উত্তরবঙ্গের এই নতুন চা-বাগিচা অভিযানের মধ্যে চালু করে দিয়েছিল। কৃষি উৎপাদন থেকে চায়ের মুনাফা শুধু বেশি তা-ই নয়, চা-বাগিচা স্থাপনের অভিযানে তারা নিশ্চুপ থেকে পরোক্ষভাবে সমর্থন জানিয়ে গিয়েছে। এর ফলে এখানকার সামাজিক বিন্যাসে যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হবে বা হচ্ছে তাকে নিয়ে ভাবার প্রয়োজনকে মনে আনেনি। তারা ধরেই নিয়েছিল তাদের যখন সরকারের তরফ থেকে কোনও বিনিয়োগ করতে হচ্ছে না তখন এই বিনিয়োগে যদি মালিকপক্ষ খুশি হয় এবং মুনাফার মুখ দেখে তবে তাদের সমর্থন সরকারের প্রতি থাকবে।
আটের দশকে চায়ের বাজারে আবার তেজি ভাব এলে নতুন চা-বাগিচা স্থাপনের উদ্যোগ নিতে অনেকে এগিয়ে আসতে চাইল। এ সময় আর সেই ঔপনিবেশিক শাসনকালের মতন পতিত জমি বা ওয়েস্ট ল্যান্ড বলে আর কোনও জমি পাওয়া সম্ভব ছিল না। যা পতিত জমি ছিল, ইংরেজ শাসকরা সেগুলিকে চা-বাগিচা স্থাপনের জন্য বিলি করে দিয়েছিল। তাই এবার চোখ পড়েছিল কৃষিজমির উপর। কৃষিজমিকে বাগিচা চাষের জন্য ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দপ্তরের কাছ থেকে অনুমতির অপেক্ষা না করেই বৃহৎ গোষ্ঠীরা তাদের আর্থিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের ক্ষমতার জোরে যেভাবে চা-বাগিচায় রূপান্তরিত করা শুরু করল তা বেআইনি হলেও সরকারের পক্ষে যে উদার অর্থনীতি নেওয়া হয়েছিল তাতে বাধা দেওয়া হল না। এদের দেখাদেখি অনেক মধ্যবিত্ত শ্রেণিও ছোট ছোট কৃষিজমি বিভিন্নভাবে হস্তগত করে সেখানে ছোট ছোট চা-বাগান সৃষ্টি করে চলল। কৃষিজমিকে চা-বাগিচায় রূপান্তরিত করার এই জমির পরিমাণ সরকারি দপ্তর থেকে পাওয়া মুশকিল। এখানকার এইসব জমির অধিকাংশ মালিকই আদিবাসী বা ট্রাইবাল। ট্রাইবালদের জমি কেনা বা হস্তান্তর এত সহজে করা যায় না। এ ক্ষেত্রে বহু জমি বেআইনিভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে আবার ট্রাইবাল মালিকের নামে জমি রেখে তাদের সঙ্গে এক পৃথক চুক্তিপত্রে এই জমিগুলি কার্যত নিজেদের মালিকানায় এনে চা-বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। এ ছাড়া এখানে আছে বর্গা জমি। এইসব বর্গা জমিতে এমনকি তিস্তা ব্যারেজের জন্য অধিগৃহীত জমিতেও সরকারি দপ্তরগুলির নাকের ডগায় চা-বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কৃষিজমির মালিকরা পরিবেশের চাপে তাদের জমিগুলিকে পাশে গড়ে ওঠা চা-বাগানের মালিকের হাতে নামমাত্র মূল্যে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছে।
সামনে বা পিছনে চা-বাগান থাকলে মাঝখানে কৃষিজমিকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়। সাধারণত খণ্ড খণ্ড কৃষিজমি থাকলে এক জমির মালিক অপর জমির আলের উপর দিয়ে যাতায়াত করে। এটাই সর্বজনগ্রাহ্য ব্যবস্থা। কিন্তু সামনে চা-বাগান গড়ে উঠলে তার ভিতর দিয়ে কৃষক তার জমিতে ঢোকার রাস্তা পায় না। এ ছাড়া চা গাছে ও মাটিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্যের প্রভাব অধিকাংশ ধান গাছই সহ্য করতে পারে না। একই সঙ্গে এইসব চা-বাগানের অধিকাংশই সরকারি বাধানিষেধ উপেক্ষা করে গভীর নলকূপের সাহায্যে ভূগর্ভের জল তুলে নিয়ে জলস্তরকে অনেক নিচে নামিয়ে দেয়। চা-বাগিচা সংলগ্ন কৃষিজমির কৃষকরা তাদের জমিতে চাষের জন্য জল পায় না। শেষ পর্যন্ত তাই তারা তাদের কৃষিজমিকে পাশের চা-বাগানের মালিকের হাতে তুলে দিয়ে নিজেরা দিনমজুরে পরিণত হতে বাধ্য হয়। এখানে গড়ে উঠেছে জমি নিয়ে এক বিশাল দালালচক্র। এরা জমির এই ফাটকাবাজিকে পরিণত করেছে এক নতুন লুম্পেনবাদী শিল্পে। এখানে এই জমির দালালচক্র ঘুরে ঘুরে কৃষিজমির মালিকদের কাছে তাদের জমিগুলিকে বিক্রি করতে প্রলুব্ধ করে। অনেকটা সেই এ দেশে চা-বাগিচা প্রতিষ্ঠার যুগের ছবি। তফাত অবশ্য আছে। সে দিন চা-বাগিচার মালিকরা তাদের আড়কাঠি পাঠিয়ে দেশের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় গিয়ে সেখানকার দরিদ্র আদিবাসীদের নানা স্বপ্নিল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়ে চা-বাগানে শ্রমিক রূপে যোগ দিতে প্রলুব্ধ করত। আজকে শ্রমিক সংগ্রহের পরিবর্তে এই নব্য জমির দালালচক্র বাইরের নানা প্রতিষ্ঠানের কাছে টাকা নিয়ে এখানকার কৃষকদের জমি বিক্রি করতে প্রলুব্ধ করে। তাদের বোঝায়, জমিতে চা-বাগিচা গড়ে উঠলে তারা নগদ অর্থ ছাড়াও চা-বাগিচায় ভাল মজুরিতে চাকরি পাবে, চা-বাগানের পাশে দোকান খুলতে পারবে ইত্যাদি। এসব করেও যে সমস্ত জমির মালিক (অধিকাংশই ট্রাইবাল) জমি বিক্রি করতে চাইত না তাদের আশপাশের জমি কিনে সেইসব জমির মালিকদের অসুবিধায় ফেলে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করা হত। এ ক্ষেত্রে তারা যে অনেক কম দামেই তাদের জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয় তা বলাই বাহুল্য।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴