লখীপাড়া চা বাগিচা (প্রথম পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী
লখীপাড়া চা বাগিচা (প্রথম পর্ব)
গৌতম চক্রবর্তী
নির্বাচন শেষ। দুইদিন বাদেই ঘোষিত হবে ফলাফল। সেই সময়তেই ডুয়ার্সের সবুজ গালিচার পাশে বসেই এই লেখা লিখছি। আজ এসেছৎপাদনপাড়া চা বাগিচায়। বিগত সাংসদ জন বারলার খাস তালুক এটা। তাই আজকের বাগিচা সফরের প্রথম পর্বে ভোট পরবর্তী ডুয়ার্সের শ্রমিক মনন বোঝার চেষ্টা করলাম । তাই সঙ্গত কারণেই বাগিচা বৃত্তান্ত, পরিকাঠামো, উৎপাদন, শ্রমিক কল্যাণ সম্পর্কিত তথ্য পরের পর্বের জন্য সঞ্চয় করে রাখলাম। মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবারের মতোই জলপাইগুড়ি জেলার ফল কেন খারাপ তাই নিয়ে কাটাছেড়া চলছে। লখীপাড়া যেতে তাই নাগরাকাটায় রাস্তার পাশে একলব্য স্কুল দেখে হঠাত করেই মনে হল চা বাগিচার ছেলেমেয়েদের ১০০ শতাংশ তো পাশ করে প্রথম বিভাগে এই স্কুল থেকেই। তাহলে জলপাইগুড়ি জেলার বাকি বাগিচা বলয় পিছিয়ে থাকবে কেন। জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ারের বেশিরভাগ এলাকাই চা বাগান অধ্যুষিত। নাগরাকাটার ইংরেজি মাধ্যমের ওই সরকারি স্কুলটিতে মূলত দুই জেলার আদিবাসী সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রীরাই পড়াশোনা করে। লক্ষ্য ও সংকল্প থাকলে যে কোনও কাজে সাফল্য পাওয়া যায় তা আরও একবার প্রমাণ করেছে নাগরাকাটার একলব্য স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। একশো শতাংশ প্রথম বিভাগে পাস। এর আগে বাগিচা সফরে তুলে এনেছিলাম সঞ্জু ওঁরাও এর কথা। নাগরাকাটার একলব্য মডেল আবাসিক স্কুলের পড়ুয়া ছিল সঞ্জু ওরাওঁ। সঞ্জুর বাবা সুভাষ ওরাওঁ ছিল চুয়াপাড়া চা বাগানের শ্রমিক। কোচিং তো দূর অস্ত। স্রেফ পাঠ্যবই খুঁটিয়ে পড়ে লক্ষ্যভেদ করে প্রকৃতই একলব্য হয়ে উঠে ওই পড়ুয়া সর্বভারতীয় নিট-এ উত্তীর্ণ হয়ে ডাক্তারিতে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল। এখন সে উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস কোর্সের ছাত্র। নাগরাকাটা একলব্য স্কুলে সঞ্জু ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে পড়াশোনা করেছিল। মাধ্যমিকে ৮৪ শতাংশ নম্বর পেয়েছিল। ৮৭ শতাংশ নম্বর পেয়ে দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় সে। একলব্য স্কুলটিতে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান বিভাগ চালু হলে প্রথম ব্যাচের ছাত্র সঞ্জুর নিট-এ বসার আগে ভরসা বলতে ছিল স্কুলের শিক্ষক- শিক্ষিকাদের পরামর্শ।
চুয়াপাড়া চা বাগানের চার নম্বর লাইনের শ্রমিক আবাসের সামনে একচিলতে মুদিখানার দোকান চালান সঞ্জুর বাবা। সঞ্জুর মা সনিতা ওঁরাওয়ের চোখে স্বপ্ন। সঞ্জুর কথাতে, ‘চা বাগান এলাকার স্বাস্থ্য পরিষেবা দেখেই মনে মনে ডাক্তার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। স্বপ্ন পূরণ করতে পেরে খুব ভালো লাগছে। হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছি। বাইরে থেকে কোচিং নেওয়া বা টিউশন পড়ার কথা স্বপ্নেও ভাবিনি। এই কৃতিত্ব মা, বাবা ও স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দিতে চাই’। তাই লখীপাড়া যেতে যেতে মনে যে প্রশ্নটা এল তাহলে চ্যাংমারি, লুকশান, লালবাহাদুর শাস্ত্রী বা মেটেলি রাষ্ট্রভাষার মতো স্কুলগুলোতে এত খারাপ ফলাফল কেন? বা সামগ্রীকভাবে ডুয়ার্সের চা বাগিচা সহ জেলা জুড়ে? আসলে ডুয়ার্সের চা বাগানের বহু স্কুলে ব্যাপক সংখ্যায় শিক্ষক নেই। পড়ুয়াদের হইহল্লা সামলাতে সামলাতেই ছুটির ঘণ্টা বেজে ওঠে। এই ফাঁকে মিড-ডে মিলটা ঠিকঠাক হয় বটে। তবে পড়াশোনা কতটা হয় সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। ডুয়ার্সের চা বাগানের বহু জুনিয়ার হাইস্কুলই বর্তমানে মাত্র একজন শিক্ষককে নিয়ে চলছে। আর এতেই সমস্যা জোরালো হচ্ছে। শিক্ষক সংকটের জেরে কোর চা বলয়ের ব্লক বলতে যা বোঝায় সেই বানারহাট, নাগরাকাটা বা মেটেলির জুনিয়ার হাইস্কুলগুলি বর্তমানে জেরবার। কিছু স্কুল স্থানীয় স্তর থেকে স্বেচ্ছাসেবক জোগাড় করলেও সমস্যা মিটছে না। এই স্বেচ্ছাসেবকরা স্কুলের তহবিল থেকে মাসে বড়জোর এক-দেড় হাজার টাকা পান। বানারহাটের কাঁঠালগুড়ি চা বাগানের হিন্দি মাধ্যমের জুনিয়ার হাইস্কুলের টিআইসি প্রেমচাঁদ রবিদাস আমার ভ্রাতৃপ্রতিম। ওর স্কুলে বর্তমানে ৪৪২ জন পড়ুয়া আছে। তাদের পড়ানোর জন্য মাত্র একজন শিক্ষক রয়েছেন। রবিদাসকেই টিচার- ইন-চার্জ (টিআইসি)-এর দায়িত্ব পালন করতে হয়। আগে আরেকজন শিক্ষক থাকলেও তিনি উৎসশ্রীর মাধ্যমে বদলি হয়েছেন। স্থানীয় তিনজন যুবক-যুবতীকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। মিড-ডে মিল চালানো, বিভিন্ন বৈঠকে হাজিরা দেওয়া সহ স্কুলের নানা প্রশাসনিক কাজ সামলে একার পক্ষে সমস্ত শ্রেণিতে পড়ানো খুবই কঠিন। শিক্ষক নিয়োগ হলে তবেই সমস্যা কাটবে।
পাথর ভাঙছে চা বলয়ের পড়ুয়ারা। স্কুলে কমই যাচ্ছে জেলার বন্ধ চা বাগানের শিশুরা। স্কুল খুলে গেলেও সংসারে অনটন রয়েই গিয়েছে। ভুটানে কাজে যাওয়া বন্ধ হয়েছিল করোনার সময়ে। তাই বাবা-মায়েরা অন্যত্র মজুরের কাজে যুক্ত হয়েছেন। কিন্তু অনটনের জেরে সন্তানদের নদীর ধারে পাথর ভাঙা বা দিনমজুরির কাজ থেকে সরিয়ে আনতে পারেননি তাঁরা। জলপাইগুড়ি জেলা শিশু সুরক্ষা ইউনিটের তরফে জেলার বন্ধ ও রুগ্ন চা বাগানে অভিভাবকদের মধ্যে স্কুলে যাওয়া নিয়ে প্রচার অভিযান করা হয়। নবম শ্রেণির ছাত্রীকে কন্যাশ্রীর ফর্ম পূরণ করতে হবে। নতুন স্কুল ড্রেসের জন্য পোশাকের মাপজোখ নেওয়া হচ্ছে। পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ শুরু হয়েছে। স্কুলে অনেক কাজ। তাই অভিভাবকদের কাছে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর আর্জি জানালেন শিশু সুরক্ষা ইউনিটের জেলা আধিকারিক। সেই সচেতনতা শিবিরে অভিভাবকরা এলেও পরদিন সেই পাথর ভাঙার কাজেই যায় বাগানের ছেলেমেয়েরা। রায়পুর চা বাগানের শ্রমিক মিনা বরাইকের কথায় মেয়ে স্কুলে গেলেও ছেলেকে আলু তোলার কাজে তিস্তার চরে অন্যের জমিতে কাজে পাঠাতে হয়েছে। মাঝেমধ্যে স্কুলে যাচ্ছে। রেডব্যাংকের সুমন ওরাওয়ের কথায়, “কবে থেকে চা বাগান বন্ধ। পেট চালাতে আমরা দিনমজুরের কাজে যাচ্ছি। ছেলেমেয়েরা ডায়না নদীতে পাথর ভেঙে দিনে ৮০ টাকা আনছে। সময় পেলে স্কুলে যাবে”। কে বলেছে স্কুলে যাওয়া শিশুর অধিকারের মধ্যে পড়ে? অন্তত ডুয়ার্স সেই কথা বলছে না। ডুয়ার্সের চা বাগানে শিশু সুরক্ষা ইউনিট ছাড়াও ইউনিসেফ, ইন্ডিয়ান প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকেও প্রচার করা হচ্ছে। আইটিপিএ-র মুখ্য উপদেষ্টা অমিতাংশু চক্রবর্তীর কথায়, ‘চা বাগানের সামনে নদীতে পাথর ভেঙে রোজগার করার পেশা চিরাচরিত। করোনার আগে অল্প বয়সি ছেলেরা পাথর ভাঙতে গেলেও স্কুলেও যেত। কিন্তু করোনা সংকট সকলকে আর্থিকভাবে পঙ্গু করে দিয়েছে। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। কিন্তু রোজগারের এই প্রবণতা কিশোর কিশোরীদের গ্রাস করছে’।
শুধু অন্ধকার নয়, আলোও আছে ডুয়ার্সের বাগিচা বলয়ে। বন্ধ, রুগ্ন চা বাগানে বাল্যবিবাহ, কাজের প্রলোভনে নাবালিকাদের ভিনরাজ্যে পাচার করার মতো ঘটনা ঘটছে। অভিভাবকদের পাশাপাশি মেয়েদের সচেতনতা শিবিরে ডেকে বোঝানো হচ্ছে। পঞ্চায়েতস্তরে ভিলেজ লেভেল চাইল্ড প্রোটেকশন কমিটি গড়া হয়েছে। পাশাপাশি ডুয়ার্স এবং অসম জুড়ে টাটা গোষ্ঠীর যে ৩৮ টি বাগান রয়েছে তার মধ্যে ডামডিম ও নেওড়া চা বাগানে পাইলট স্তরে ই-লার্নিংয়ের সুযোগ পাচ্ছে বাগানের পড়ুয়ারা। চতুর্থ শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ডামডিম চা বাগানে ৮৩৪ জন এবং নেওড়া বাগানে ৩৪৩ জন ছেলেমেয়ের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে এই ই-লার্নিংয়ের ব্যবস্থা। বিষয়টি পরিচালনা করছে টাটা গোষ্ঠীর অধীনস্থ শাখা অ্যামালগামেটেড প্ল্যান্টেশন, প্রাইভেট লিমিটেড (অ্যাপেল)। প্রকল্প শুরুর সময় ম্যানেজারের সহযোগিতায় কথা বলেছিলাম অ্যাপেল গোষ্ঠীর ম্যানেজিং ডিরেক্টর তথা চিফ এগজিকিউটিভ অফিসার বিজয় সিং গুলিয়ার সঙ্গে। তিনি জানিয়েছিলেন ই-লার্নিং চালু হওয়ার পর মূলত বিভিন্ন সূচকের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে দেখা হবে ছেলেমেয়েদের মধ্যে কী ধরনের পরিবর্তন আসছে। তারপর তা থেকেই দেখা হবে পরবর্তীতে টাটা গোষ্ঠীর অধীনস্থ সমস্ত চা বাগানে এই ব্যবস্থা চালু করা যায় কি না। আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে টাটা গোষ্ঠীর অধীনস্থ চা বাগানগুলিতে ১০০ শতাংশ সাক্ষরতার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে বাগান কর্তৃপক্ষ। তাতে কাজে আসতে পারে এই ই-লার্নিং। ই-লার্নিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষার ভিত মজবুত করার লক্ষ্যে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে সপ্তাহে একটি করে ক্লাস দেওয়া হবে। ভবিষ্যতে দরকার অনুযায়ী ক্লাসের সংখ্যা বাড়ানো হবে বলে জেনেছিলাম। অ্যাপেল ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি অমিতাভ সেন, ডিবিআইটিএ'র সম্পাদক সঞ্জয় বাগচী সহ টাটা গোষ্ঠীর অধীনস্থ ডুয়ার্সের চা বাগানগুলির কর্তৃপক্ষ, ইউনিয়নের সদস্যদের সহযোগিতায় দুই বাগানের এডুকেশনাল কোঅর্ডিনেটরদের হাতে নিয়োগপত্র তুলে দেওয়া হয়।
নিঃসীম দারিদ্রে বড় হয় ডুয়ার্সের শিশুরা। খালি পায়ে বড় হয় বাগানের শিশু। দিন আনি খাই সংসার। নুন পাতে পড়ার আগেই পান্তা ফুরিয়ে যায়। ভালোমন্দ খাওয়া দূরে থাক, সাধারণ চটিজুতো পায়ে দেওয়াও ওই সংসারে বিলাসিতা। অভাবের সংসারে সচেতনতা বড় বালাই। কথাটা যে কতখানি বাস্তব, প্রত্যন্ত চা বাগান অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে গেলে প্রত্যক্ষ প্রমাণ মিলবে। মাসের পর মাস পেরিয়ে যায়, চোখের সামনে দিয়ে কেটে যায় একে একে উৎসব-পার্বণ। কিন্তু এলাকার ছেলেমেয়েদের পায়ে চটি জোটে না। চটিজুতো পায়ে দিয়ে স্কুলে বা ঘুরতে যাওয়ার আশা কখনও পূরণ হয় না এলাকায়। প্রান্তিক এলাকাগুলির অধিকাংশ চা বাগান জঙ্গল লাগোয়া এলাকাতে। পরিবারে উপার্জনের ভরসা বলতে দিনমজুরি বা জঙ্গল থেকে কেটে আনা কাঠ। সামান্য ওই টাকায় উনুনে একেকদিন হাঁড়ি চড়ে না, ছেলেমেয়ের জন্য চটি আসবে কোথা থেকে। কখনো-সখনো বাপ-মায়ের কাছে বহু আবদার করে যদিও বা চটি মেলে, কমদামি চটির আয়ু বেশিদিন স্থায়ী হয় না। তাই শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা একরকম খালি পায়েই কাটে এলাকার কচিকাঁচাদের। বাজারচলতি একজোড়া চটিজুতোর বাজারমূল্য ৫০-৬০ টাকা। সাধারণ মানের হওয়ায় দুই-তিন মাসের বেশি চটি টেকসই হয় না। তাছাড়া ছেলেমেয়েদের দুরন্তপনায় চটির আয়ু আরও তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়। শেষ কবে জুতো পড়েছিল মনেই পড়ে না লখীপাড়া চা বাগিচার বিশাল বা সোমরুদের মতো খুদেদের। মনোজ জানায়, “বাড়িতে আমাদের বড় অভাব। বাবা সারাদিন কাজ করে। চটি কিনে দিতে পারে না। খালি পায়ে আমাদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে”' মনোজের মা সরিতা মুন্ডা বলে, ‘বাগানে কাজ করে যা উপার্জন হয় তা দিয়ে জামাকাপড় কিনে দিলেও চটি কেনা হয় না। দু'বেলা ভাত জোগাতেই ঘাম ঝরে যায়। বাড়িতে তিনটি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। বছরে একবারের বেশি জুতো কিনে দেওয়ার সামর্থ্য নেই।' তাই কাদায়, ঘাসে অনেক ব্যাকটিরিয়া, ভাইরাস সঙ্গী করে খালি পায়ে হাঁটাচলা করে বিভিন্ন সংক্রামক রোগ সঙ্গী করে বেড়ে উঠছে ডুয়ার্সের শিশুরা।
উত্তরবঙ্গে ৪৫১ টি চা বাগান রয়েছে। চা আবাদ হয় ১.১৪,৪১০ হেক্টর জমিতে। দেশের মোট চায়ের ৩০.৫৬ শতাংশ উৎপাদিত হয় উত্তরবঙ্গে। অতীতে চা শিল্পে মন্দা চলাকালীন সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনে চা মালিকদের একাংশ বারেবারে অক্ষমতা প্রকাশ করেছেন। সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনের প্রসঙ্গ তাঁরা বেমালুম ভুলে থাকতে চান। এই ভুল ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত তা প্রশ্নবোধক চিহ্নের সামনে। চা বাগিচায় শ্রমিকদের ছাতা, চপ্পল এবং শীতকালে কম্বল দেওয়ার দায় বাগান মালিকদের। দেওয়া হয়েও থাকে। এতে বিপুল সংখ্যায় এই সামগ্রীগুলির চাহিদা আছে বলে দীর্ঘদিন ধরে দাবি করা হচ্ছে ছাতা, চপ্পল এবং অ্যাপ্রনের কারখানা উত্তরবঙ্গে স্থাপন করা হোক। এই কারখানা উত্তরবঙ্গে হলে একদিকে যেমন চা বাগানের শ্রমিক পরিবারের বেকার ছেলেমেয়েদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে, তেমনই স্থানীয় এলাকায় লেনদেন বাড়লে সমৃদ্ধ হবে উত্তরবঙ্গের অর্থনীতি। তাছাড়া উত্তরবঙ্গের কারখানা থেকে উৎপাদিত সামগ্রী ক্রয় করলে পরিবহণ খরচে সাশ্রয় হবে। একইরকমভাবে চা বাগানের চাহিদা মেটাতে উত্তরবঙ্গে তৈরি হতে পারে সার, কীটনাশক, সেচের নানা উপকরণ। এইসব কারখানায় কর্মসংস্থানের সুযোগ আরও বেশি। চা শ্রমিক পরিবারের বর্তমান প্রজন্মে অধিকাংশই শিক্ষিত। তাঁরা মূলত আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত। নেপালিভাষীও আছেন। চা বাগান লাগোয়া এলাকায় তপশিলি সম্প্রদায়ভুক্ত লোকসংখ্যাও কম নয়। উত্তরবঙ্গে চা বাগানের অনেক জমি অব্যবহৃত অবস্থা পড়ে আছে। এই জমি কিন্তু চা বাগান মালিকদের নিজস্ব নয়। রাজ্য সরকারের কাছ থেকে লিজে নেওয়া জমি। দীর্ঘমেয়াদি লিজে নেওয়া সমস্ত জমি চা আবাদের জন্য ব্যবহার করা হয় না। চা আবাদ ছাড়া অন্য কিছু কাজ, যেমন হাসপাতাল, স্কুল, শ্রমিক আবাস ইত্যাদির জন্য কিছু জমি ব্যবহার হয়। তারপরও প্রায় সব চা বাগানে কিছু না কিছু জমি পড়ে থাকে। সেই জমির পরিমাণও কিন্তু একেবারে অল্প নয়। সরকারি পরিসংখ্যানেই তরাই-ডুয়ার্স এবং পাহাড়ে প্রায় ২২ হাজার হেক্টর জমি পতিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এই পতিত জমিতে চায়ের সহায়ক শিল্প স্থাপন হতে পারে সহজেই। তাতে কর্মসংস্থানের দুয়ার খুলে যাবে।
সরকারের ঘোষিত লক্ষ্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক উন্নয়ন। অথচ উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় জমি হাতে থাকা সত্ত্বেও তার ব্যবহারের পরিকল্পনা নেই। পরিকল্পনা করলে চা বাগান এলাকার পরবর্তী প্রজন্মের সামনে যে ভয়ংকর বেকার সমস্যা, তার খানিকটা সুরাহা হতে পারে। কিন্তু উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে আন্তরিকতার বড় অভাব। যে কারণে চা শ্রমিক পরিবারের সন্তানদের সামনে অন্য উপায় না থাকায় ভিনরাজ্যে চলে যাওয়া ছাড়া পথ থাকে না। অনাবাদী জমিতে কিছু করার কথা বারবার বলা হলেও এতে আগ্রহ নেই বাগান মালিকদের। বাইরের কেউ উৎসাহ দেখালেও জমি ব্যবহারে অনুমতি দিতে হাজার জটিলতা তৈরি করেন তাঁরা। এই জট কাটাতে তেমন কোনও উদ্যোগ দেখা যায় না সরকারের। অথচ সহায়ক শিল্পের পাশাপাশি পর্যটনে উৎসাহ দিলে উত্তরবঙ্গে লগ্নির সম্ভাবনা আরও বেশি হবে। বহু আলোচিত এবং চর্চিত চা পর্যটন তাই বিশবাঁও জলের তলায়। সরকারের পক্ষ থেকে চা পর্যটনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। জীবিকা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর গুরুত্ব অপরিসীম৷ এতে সাফল্য পাওয়ার সবচেয়ে বড় উদাহরণ জলপাইগুড়ি জেলায় চা বলয়ের রেশন পরিষেবা। খাদ্য দপ্তর জলপাইগুড়ি জেলার চা বলয়ে পরিকাঠামো সৃষ্টি করে ৮০টি রেশন দোকানের দায়িত্ব চা বাগান এলাকায় গঠিত স্বনির্ভর গোষ্ঠীর হাতে তুলে দিয়েছে। এতে রেশন পরিষেবায় যেমন স্বচ্ছতা এসেছে, তেমনই অনেক মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা হয়েছে। এই রেশন ব্যবস্থায় শ্রমিকরাও সন্তুষ্ট। ২২ হাজার পতিত হেক্টর জমিতে কর্মসংস্থানের আরও অনেক প্রকল্প গ্রহণ করা যায়। জমি পেলে হয়তো লগ্নি আসবে। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে চা বাগান মালিকদের মনোভাবে। তাঁরা ওই ধরনের প্রকল্পের জন্য ছাড়পত্র দিচ্ছেন না। অন্যদিকে, চায়ের তেজি বাজার থাকা সত্ত্বেও চা বাগানে সামাজিক দায়িত্ব পালনে মালিকদের অনীহা প্রচণ্ড। শ্রমিক আবাস নির্মাণ এবং সংস্কারে তাঁদের কোনও উদ্যোগই নেই। হালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চা সুন্দরী প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের আবাস তৈরি করার উদ্যোগ অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য।
ভোটপর্ব শেষ। শুরু হবে সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ। আর দেরি নয়। রাজনৈতিক বিরোধ ভুলে গিয়ে রাজ্য কেন্দ্র যৌথ প্রকল্পে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হোক। অনেক রাজনৈতিক আকচাআকচি হল। এবার নবনির্বাচিত সাংসদ এবং বিধায়কেরা উত্তরবঙ্গের তথা চা বলয়ের জন্য কিছু তো করুন।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴